You dont have javascript enabled! Please enable it!
শিলমান্দি গ্রামে রেলগাড়িতে অ্যামবুশ
সাধারণ
ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে জিনারদি রেল স্টেশনের ৫০০ মিটার পূর্বে শিলমান্দি গ্রামে দড়িপাড়ায় একটি রেলসেতু অবস্থিত। ব্রিজটি মুক্তিযােদ্ধারা একবার ধ্বংস করার পর পাকিস্তানিরা পুনরায় মেরামত করে উভয় পাশে বাংকার তৈরি করে পাহারা দিত। রেলসেতুর পাশে বিস্তৃত এলাকা রেললাইন থেকে অনেকটা নিচু। তবে এ এলাকাটি শস্যের চাষাবাদযােগ্য হওয়ায় জমির মধ্যে উচু আইল ছিল, যা ক্ষুদ্রান্ত্রের ফায়ার ও পর্যবেক্ষণ থেকে কভার দিত। এ স্থানে রেললাইনটি পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। ঢাকা থেকে দেশের পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে ভৈরব-আশুগঞ্জ এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের গমনাগমন এবং সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ সরবরাহের জন্য তারা এ রেললাইনটি ব্যবহার করত। এ সরবরাহের মধ্যে মাঝে মাঝে তেলের ট্যাংকার পরিবহণ করা হতাে। তাই এলাকাটি রণকৌশলগত দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পরিকল্পনা
স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা শামসুল হক জনসাধারণের কাছ থেকে তথ্যসংগ্রহ করে ঐ স্থানে একটি অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করেন। তিনি অ্যামবুশস্থল পর্যবেক্ষণ করে রেললাইনের দক্ষিণ পাশে ধানক্ষেতের আইলের আড়ালে তার অ্যামবুশ দলের সকল সদস্যকে মােতায়েন করে লক্ষ্যবস্তু আসার পর এক দিক থেকে আঘাত করার পরিকল্পনা করেন।
যুদ্ধের ঘটনা
মুক্তিযােদ্ধা শামসুল হক পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রায় ২০জন সহযােদ্ধা নিয়ে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর সকাল ১০টায় অ্যামবুশ স্থলে অবস্থান গ্রহণ করেন। ট্রেনটি পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে অ্যামবুশ স্থলে পৌছা মাত্রই মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ডভাবে গুলি বর্ষণ করেন। নিকটেই দড়িপাড়া ব্রিজে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনটি উদ্ধার করতে আসে। ট্রেনে আগত এবং উদ্ধারকারী পাকিস্তানি সেনারা সম্মিলিতভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষের মধ্যে প্রচুর গুলি বিনিময় হয়। যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর এক পর্যায়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ট্রেনটি নিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
ফলাফল
এ অ্যামবুশের মূল লক্ষ্য ছিল তেলের ট্যাংকারটি ক্ষতিগ্রস্ত করা। এতে ৩-৪জন পাকিস্তানি সেনা মারাত্মক আহত হয়। অন্যদিকে, মােহাম্মদ আলী নামে ১জন। মুক্তিযােদ্ধা শহিদ এবং অপর ১জন আহত হন। আপাতদৃষ্টিতে এ অ্যামবুশে মুক্তিযােদ্ধাদের সাফল্য সামান্য হলেও এর সুদূরপ্রসারী ফলাফল ছিল অনেক বড়াে। এখানে উল্লেখ্য যে, শিলমান্দি গ্রামের দড়িপাড়া রেলসেতুতে প্রহরারত পাকিস্তানি সেনাদের অতি নিকটে তাদের ১টি ট্রেনে অ্যামবুশ করাটা ছিল পাকিস্তানি সেনাদের নিরাপত্তার প্রতি বিরাট হুমকি। ফলে শত্রুর মনােবল ভেঙে যায়। এককভাবে অপারেশনের ফলাফল সামান্য হলেও পাশাপাশি নরসিংদীর অন্যান্য এলাকায় পরিচালিত অপারেশনগুলাের সমন্বয়ে সার্বিক ফলাফল ছিল, অনেক বেশি। এ অপারেশনের বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় ছিল এ যে, অ্যামবুশ অবস্থানের সংলগ্ন ব্রিজে নিয়ােজিত প্রহরী এবং ৫০০ মিটার পশ্চিমে জিনারদি রেল স্টেশনে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প থাকলেও এর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের চলাচল নিরাপদ ছিল না। ফলে পাকিস্তানি সেনারা সব সময়। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। ফলে চূড়ান্ত আক্রমণে এ এলাকায় নিয়ােজিত পাকিস্তানি সেনারা তেমন কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারে নি।
ঘাসিরদিয়ার মাইন বিস্ফোরণ
সাধারণ
১৯৭১ সালে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতির প্রাথমিক পর্যায়ে নরসিংদী সদরে এবং আশপাশের থানাগুলােয় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়। এসব এলাকায় প্রাথমিক প্রস্তুতি এবং প্রশিক্ষণ চলতে থাকে। পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য নরসিংদী সদরে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। নরসিংদী-শিবপুর থানায় যেহেতু সশস্ত্র কার্যক্রম সবচেয়ে বেশি পরিলক্ষিত হয়, সে জন্য পাকিস্তানি সেনারা শিবপুর এলাকায় নিয়মিত টহলে যেত। নরসিংদী থেকে। শিবপুর যাতায়াতের রাস্তাটা ছিল আধাপাকা। এ রাস্তাটি আইয়ুবপুর ইউনিয়নের ঘাসিরদিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। রাস্তাটা পারিপার্শ্বিক অবস্থান থেকে ৪-৫ ফুট উচু। শুকনাে মৌসুম ছাড়া অধিকাংশ সময় রাস্তার উভয় পাশের। চাষাবাদযােগ্য জমি জলমগ্ন থাকে। চলাচল সব সময় রাস্তার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে।
উদ্দেশ্য
ঘাসিরদিয়া মাইন বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য ছিল শত্রুর মনােবলের উপর আঘাত হানা এবং নিয়মিত টহলের রাস্তা হিসেবে নরসিংদী-ঘাসিরদিয়া-শিবপুর রাস্তা ব্যবহারে শত্রুকে বিরত করা।
স্থান ও সময়
ঘাসিরদিয়া গ্রাম শিবপুর থানা সদর থেকে মেঠো পথে ৪ কিলােমিটার এবং রাস্তা দিয়ে আগমন করলে ৮ কিলােমিটার দূরে অবস্থিত। শিবপুর থানা সদর থেকে দক্ষিণে আইয়ুবপুর ইউনিয়ন। এ ইউনিয়নেরই একটি গ্রাম ঘাসিরদিয়া । ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পূর্বনির্ধারিত স্থানে পরিকল্পনা অনুসারে মাইন স্থাপন করা হয়।
পটভূমি/পরিস্থিতি
১৯৭১ সালের সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি লগ্নে নরসিংদী সদরের শিবপুর থানার মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠন ও প্রশিক্ষণের কাজ চলছিল। শুরুতেই শিবপুর থানা সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রকারের দুঃসাহসিক অপারেশনাল তৎপরতায়, যা পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনীকে হতবিহ্বল করে দেয়। এসব তৎপরতা রােধ কল্পে নরসিংদীতে মােতায়েন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যরা নিয়মিত টহলে আসত শিবপুরে। সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসে নিজ নিজ এলাকায় আসেন। শুরু হয় সক্রিয় প্রতিরােধ। পরিচালিত হয় অভিযান। এ সময় শিবপুর থানায় সংগঠিত এসব কার্যক্রমের বিরুদ্ধে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পাকিস্তানি সেনা টহলে নিয়মিত আসত। তা ছাড়া নরসিংদী থেকে। শিবপুর হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী মনােহরদী যেত। যােগাযােগের একমাত্র রাস্তা ছিল আধপাকা। ঘাসিরদিয়া গ্রামে মাইন বিস্ফোরণের উদ্দেশ্য ছিল, যাতে শত্রু উল্লিখিত রাস্তা ব্যবহার না করে এবং গ্রামের এ রাস্তা ব্যবহার করা থেকে যেন বিরত থাকে।
যুদ্ধের বর্ণনা
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্ধারিত স্থানে মাইন স্থাপন করা হয় ঘাসিরদিয়া গ্রামের ঠিক মাঝখান বরাবর যেখানে। অনেকখানি জায়গা ফাঁকা। উভয় পাশে চাষাবাদ যােগ্য জমি। মাইনটা যেখানে স্থাপন করা হয়েছে তার থেকে একটু দূরে ১টি কালভাট। কোনােক্রমে ঐ। এলাকা অতিক্রম ছাড়া পার্শ্ব রাস্তা ব্যবহার করে শত্রু বাহিনী যাতে যেতে না পারে। যেহেতু রাস্তাটা গ্রাম থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তাই মুক্তিযােদ্ধারা দূরে গ্রামের মধ্যে অবস্থান করেন। পরিস্থিতি কী হয়, তা পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন। আনুমানিক দুপুর ১২টার দিকে শক্রর ১টি গাড়ি বহর এ রাস্তা দিয়ে নরসিংদী থেকে শিবপুর যাচ্ছিল। গাড়ি বহরটির প্রথম গাড়ি মাইন এলাকায় এসে পৌছালে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটে এবং গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। এ ঘটনায় বহু ‘ পাকিস্তানি সৈন্য হতাহত হয়। এ অপারেশনের সময় মুক্তিযোেদ্ধদের সাথে। পাকিস্তানি বাহিনীর কোনােপ্রকার গুলি বিনিময় হয় নি। এ ঘটনার পর পরই পাকিস্তানি বাহিনী ঘাসিরদিয়া গ্রামে অসংখ্য ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। এবং অনেক নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
ফলাফল
ঘাসিরদিয়া মাইন বিস্ফোরণ অপারেশন একটা সুন্দর ও সুপরিকল্পিত অপারেশন ছিল। মুক্তিযােদ্ধারা সম্পূর্ণ অপারেশনটা সার্থকভাবে সম্পন্ন করেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য: বিস্ফোরক/বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র দলের মাধ্যমেও যে-কোনােরকম বিপর্যয় ঘটিয়ে শত্রুর সমূহ ক্ষতিসাধন করা সম্ভব। যথাযথ প্রশিক্ষণ ও পরিকল্পনা: বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র দলের সমন্বয়ে পূর্বপরিকল্পিত যে-কোনাে স্থানে এভাবে মাইন পুঁতে শত্রুর উপর আক্রমণ পরিচালনা করে প্রাথমিক ক্ষতিসাধনের পর বিশৃঙ্খল সেনাদের উপর অ্যামবুশ করা হলে আরও অনেক সফলতা অর্জন করা। সম্ভব হতাে, যা এ ক্ষুদ্র অপারেশনে পরিকল্পনা করা হয় নি।
খাটেহারা ব্রিজে প্রথম ও দ্বিতীয় রেইড
সাধারণ
পাকিস্তানি বাহিনী নরসিংদী সদরে প্রবেশের পর রণকৌশলগত এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলােয় ক্যাম্প স্থাপন অথবা বাংকার করে ডিউটিতে থাকত। এর মধ্যে খাটেহারা ব্রিজটি ছিল অন্যতম। কারণ, শহর থেকে বের হয়ে ঢাকা যাওয়ার। জন্য সর্বপ্রথম এটা একটা বড়াে ধরনের ব্রিজ। এ ব্রিজটি পাকিস্তানি বাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার অথবা ধ্বংস করার জন্য মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন সময়ে মােট ২ বার রেইড পরিচালনা করেছিল।
উদ্দেশ্য
প্রতিবারই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল যে, ঢাকা অথবা নরসিংদীর অন্যান্য এলাকার সাথে নরসিংদী সদরের সরাসরি যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে। দেওয়া।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
সত্যিকার অর্থে প্রথম যুদ্ধটির কোনাে সঠিক তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে প্রথম রেইডটি ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল সংঘটিত হয় বলে ধারণা করা যায় এবং পরবর্তী দ্বিতীয় রেইডটি নভেম্বর মাসে রােজার ঈদের দিন অর্থাৎ ২০ নভেম্বর রাত আনুমানিক সাড়ে ১০টায় সংঘটিত হয়। খাটেহারা ব্রিজটি সদর থানার ‘সাহে প্রতাপ মােড় থেকে ৬০০ গজ পূর্ব দিকে এবং চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র থেকে ৭০০ গজ পশ্চিমে অবস্থিত।
পরিস্থিতি
খাটেহারা ব্রিজে প্রথম রেইডের আগেই পাকিস্তানি সেনারা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলােয় ক্যাম্প স্থাপন করেছিল। তাই প্রাথমিক প্রতিরােধের অংশ হিসেবে তদানীন্তন ইপিআর ও এলাকার উৎসুক জনগণের ১টি দল এলাকার বিভিন্ন স্থাপনাগুলােয় এবং রণকৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলােয় হানা বা রেইড করতে থাকে। দ্বিতীয় রেইডের সময় অর্থাৎ নভেম্বর মাসের অনেক আগেই সদর থানা। এলাকা থেকে ক্যাপটেন মতিউরের নেতৃত্বাধীন ইপিআর-এর দলটি ভৈরব চলে। যায়। মূলত এ সময় অর্থাৎ জুলাই মাসের পর ভারত থেকে এবং দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা এলাকায় ফেরত আসতে শুরু করেন এবং নেভাল সিরাজের প্রত্যক্ষ/পরােক্ষ নেতৃত্বে বিভিন্ন এলাকাতে অপারেশনাল কর্মকাণ্ড শুরু হতে থাকে।
যুদ্ধের বর্ণনা
খাটেহারা ব্রিজটি খাটেহারা খালের উপর নির্মিত, যা কিনা উত্তর দিক থেকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ব্রিজটি সমতল ভূমি থেকে ১০-১২ ফুট উঁচুতে নির্মিত এবং ব্রিজ থেকে ৩০০ গজ পূর্ব দিকে একটি রেললাইন উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে গেছে। ব্রিজ থেকে আশপাশের ৫০০-৬০০ গজ এলাকা সহজেই দৃষ্টিগােচর হয়। ব্রিজটির নিরাপত্তার নিমিত্তে। প্রথম থেকেই ব্রিজের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে রাস্তার দুই পাশে ২টি করে ৪টি এবং ব্রিজের দুই পাশে মােট ৮টি বাংকার ছিল। ব্রিজের উপর দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন ও মানুষকে পাকিস্তানি বাহিনী অহরহ তল্লাশি করতাে। ব্রিজটির নিরাপত্তা নিশ্চিতের নিমিত্তে প্রথম থেকেই বাংকারের মধ্যে ২৫৩০জন পাকিস্তানি সেনা এবং রাজাকার ডিউটিরত থাকত। এমতাবস্থায় তদানীন্তন ইপিআরের সদস্য এবং এলাকার লােকজনসহ মােট ৪০-৫০জনের ১টি দল ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল ভােররাতের দিকে ব্রিজটির উপর রেইড অভিযান পরিচালনা করে। পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান অপেক্ষাকৃত উঁচু জায়গায় এবং বর্ধিত সেনা সাহায্যের (রি-ইনফোর্সমেন্ট) দ্রুত ব্যবস্থা ছিল বিধায় মুক্তিবাহিনী তেমন একটা সুবিধা করে উঠতে পারে নি। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের প্রচণ্ড চাপে তাদেরকে পিছু হটে এলাকা ছাড়তে হয়েছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, এ রেইডের পরই তদানীন্তন ইপিআর দলটি ক্যাপটেন মতিউরের নেতৃত্বে আলীজান জুট মিল থেকে লঞ্চে করে ভৈরবে চলে যায়। ঐ যুদ্ধে ইপিআর সদস্য ব্যতিরেকে মনিরুজ্জামান, মােবারক হােসেন, আপেল মাহমুদ, সামছুল হুদা বাচ্চু, আলী আকবর ও মিজানুর রহমান (তদানীন্তন আলীজান জুট মিলের সহকারী প্রকৌশলী) অংশগ্রহণ করেন যারা পরবর্তী সময় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে পরিচিত হন।
তা ছাড়া আরও অনেকেই ছিলেন, যাদের নাম জানা যায় নি। দ্বিতীয় রেইডের সময় মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে আনুমানিক ১০জনের ১টি দল ঐ ব্রিজ রেইড করার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা নভেম্বর মাসে রােজার ইদের দিনটিকে বেছে নেয়। কারণ, তাদের ধারণা ছিল যে, ইদের দিনে হয়ত পাকিস্তানি সেনাদের কর্তব্যরত ডিউটির সংখ্যা কম থাকবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ব্রিজের নিরাপত্তার দায়িত্বে কর্তব্যরত পাকিস্তানি সেনাদের বেইস ক্যাম্প ছিল চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে, যা ব্রিজ থেকে ৭০০ গজ পশ্চিমে অবস্থিত। ব্রিজ থেকে দেড় কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বিদ্যমান শান্তিবাওলা গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন বৈঠকের পর মাে, আরমান ব্রিজ এলাকাটি খুব কাছ থেকে কয়েকবার পর্যবেক্ষণ করেন। পর্যবেক্ষণ মােতাবেক মাে. মনিরুজ্জামানের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা ২টি ছােটো দলে বিভক্ত হয়ে প্রথমে রেললাইনের পূর্ব । প্রান্তে অবস্থান নেন। ব্রিজটি ধ্বংস করার নিমিত্তে বিস্ফোরক দ্রব্যের উপর বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মনিরুজ্জামান সঙ্গে বেশ কিছু পরিমাণ বিস্ফোরক দ্রব্য বহন করেন। এমতাবস্থায় রেললাইনের পূর্ব প্রান্ত হতেই আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টায় মুক্তিবাহিনী প্রথম গুলি বর্ষণ শুরু করে। ৬-৭ মিনিট গুলি বর্ষণের সাথে সাথেই পূর্ব প্রান্ত থেকে অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর পিছন দিক থেকে (পাকিস্তানি সেনাদের বেইস ক্যাম্প হতে) ৩-৪টি গাড়ি দ্রুততার সঙ্গে তাদের দিকে আসতে থাকে। ফলে মুক্তিবাহিনী নিজ অবস্থান ছেড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। দ্বিতীয় রেইডটিতে মাে. মনিরুজ্জামান (ছােটো), মাে. আলী আকবর, শুকুর আলী, আশরাফ উদ্দিন মুকুল, জহিরুল হক, ওয়েজ উদ্দিন, মাে, আরমান, তাজুল ইসলাম, নুরুল ইসলাম এবং রিয়াজুল ইসলাম (রাজু) এ ১০জন অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে জানা যায়।
ফলাফল
প্রথম ও দ্বিতীয় রেইডে কোনাে পক্ষেরই কোনােরূপ হতাহতের খবর পাওয়া যায় নি। তবে ২টি ঘটনার সময়ই পাকিস্তানি সেনাদের মজবুত ও উঁচু অবস্থানের জন্য তারা মুক্তিবাহিনীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়। ফলে প্রতিবারই মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: প্রতিবারই পাকিস্তানি বাহিনীর উঁচু, মজবুত ও শক্ত অবস্থানের জন্য তারা মুক্তিবাহিনীর উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছিল। বর্ধিত সেনা সাহায্য প্রদানের (রি-ইনফোর্সমেন্টের) ত্বরিত ও সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকার ফলে প্রতিটি আক্রমণ শত্রু সৈন্যরা প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী: প্রতিবারই দ্রুততা ও সঠিক পরিকল্পনার অভাবে মুক্তিবাহিনীকে পিছু হটতে হয়েছিল। প্রথম রেইডটিতে বিভিন্ন দলের সাথে অভ্যন্তরীণ সমন্বয় ছিল না বললেই চলে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!