You dont have javascript enabled! Please enable it!
মনােহরদী ডাকবাংলাে রেইড
যুদ্ধের স্থান নরসিংদী জেলার মনােহরদী থানার চন্দনবাড়ি ইউনিয়নে অবস্থিত মনােহরদী উচ্চবিদ্যালয়। এ বিদ্যালয়ের কাছেই মনােহরদী ডাকবাংলােতে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলার অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা দুঃসাহসিক রেইড সম্পন্ন করেছিলেন। যুদ্ধের সময় ১৯৭১ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর। যুদ্ধের বর্ণনা মনােহরদী ডাকবাংলাে ও মনােহরদী উচ্চবিদ্যালয় এলাকায় সেপ্টেম্বর মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করে। এ ক্যাম্পে তাদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৫-৪০জন। এ ক্যাম্পে অবস্থান করেই তারা রাজাকারদের সহায়তায়। আশপাশের এলাকাগুলােয় বর্বর অপারেশন পরিচালনা করত। অপারেশনে কোনাে পাকিস্তানি সেনা আহত হলে কিংবা অন্য কোনাে অসুস্থতায় তারা চিকিৎসার জন্য মনােহরদী বাজারের ডা. সামসুল ইসলামকে ক্যামেপ খবর। দিয়ে চিকিৎসা করাত। এ সুবাদে ডা. সামসুল ইসলামকে প্রায়ই শক্রর ক্যাম্পে যেতে হতাে। ডা, সামসুল ইসলাম ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও তাদের চিকিৎসা করতেন। তবে তার মধ্যে ছিল অগাধ দেশপ্রেম। তাই বিভিন্ন সময় ক্যাম্পে। আসা-যাওয়ার সময় ক্যাম্পের ভিতরে পাকিস্তানি সেনারা কখন কী করে, তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদের অবস্থান, পরিমাণ ইত্যাদি বিষয় সুকৌশলে লক্ষ্য। করতেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের এসব তথ্য সরবরাহ করতেন। এভাবে কয়েকদিন ডা. সামসুল ইসলামের কাছ থেকে পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর। সাহসী যােদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প রেইড করার পরিকল্পনা করেন। | পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিবাহিনী ১৯ সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় ডাকবাংলােতে রেইড পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেয়। এ রেইডে ২৫-৩০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশ নেন। যাদের মধ্যে হারুন অর রশীদ ও মাে. ওসমান ছিলেন স্থানীয় নেতৃত্ব। পক্ষান্তরে স্থানীয় সূত্র মতে, পাকিস্তানি সেনাদের সংখ্যা ছিল ৩৫-৪০জন, যাদের অধিনায়ক ছিলেন জুলফিকার আলী শাহ । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাত ১০টার পূবেই মুক্তিযােদ্ধারা যার যার অবস্থান গ্রহণ করেন। নির্দিষ্ট সময়ে একত্রে গর্জে ওঠে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্রগুলাে। চারদিক থেকে সংঘবদ্ধ ও অতর্কিত আক্রমণে ক্যাম্পে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে এবং এলােপাতাড়ি গুলি বর্ষণ শুরু করে। এভাবে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড গােলাগুলির পর শত্রুর ক্যাম্প সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়।
ফলাফল
মনােহরদী ডাকবাংলাের এ রেইডে কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায় এবং বাকিরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। মৃত পাকিস্তানি সেনাদের মনােহরদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দক্ষিণ পাশে এবং ডিসি রােডের দক্ষিণ পাশে কবর দেওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয় নি। শুধু কয়েকজন আঘাত পেয়েছিলেন। এবং চিকিৎসার পর তারা সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
একটি সফল রেইড অভিযান সম্পন্ন করতে শত্রু অবস্থান ক্যাম্পের ভিতরের বিস্তারিত তথ্য, অস্ত্র ও গােলাবারুদের অবস্থান, প্রহরীদের অবস্থান এবং ক্যাম্পে সৈনিকদের দৈনন্দিন অভ্যাস সম্পর্কে জানা অত্যন্ত প্রয়ােজনীয়। ডা. সামসুল ইসলামের সহায়তার কারণেই মুক্তিযােদ্ধারা এ সফল অভিযানটি পরিচালনা করতে পেরেছিলেন। পাকিস্তানি সেনাদের চিকিৎসা করার জন্য বাধ্য করা হলেও তিনি সেখানকার সব খবরাখবর মুক্তিযােদ্ধাদের সরবরাহ করে দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখেছেন।
ভরতেরকান্দি অপারেশন
সাধারণ
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। স্বাধীনতা সংগ্রামের সক্রিয় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। দখলদার হানাদার বাহিনী তখন সর্বত্র প্রতিরােধের সম্মুখীন। পলায়ন রাস্তা নিরাপদ রাখতে ব্রিজ, সেতু, ও কালভাট পাহারায় ব্যস্ত। এমনই ১টি সেতু নরসিংদী মহকুমার (বর্তমান নরসিংদী জেলা) পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের উপর। নাম ভরতেরকান্দি সেতু। চলাচলের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে। সেতুটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাই ভরতেরকান্দি সেতুর উভয় পাশে ছিল শক্রর প্রতিরক্ষা অবস্থান। মজবুত বাংকারে অবস্থান গ্রহণ করে পাকিস্তানি। সেনারা সেতুটি রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিল।
উদ্দেশ্য
নরসিংদী সদরের সাথে শিবপুর থানার যােগাযােগ রক্ষাকারী ভরতেরকান্দি সেতু ধ্বংস করা এবং সেতু পাহারারত শত্রু বাহিনীর অস্ত্র ও গােলাবারুদ হস্তগত করা। স্থান ও সময় সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের সেপটেম্বর মাস। শিবপুর থানার সর্ব-দক্ষিণে ভরতেরকান্দি গ্রাম অবস্থিত। এ গ্রামের পাশ দিয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রবাহিত। নদের ওপারে নরসিংদী সদর। এ নদের উপরই ভরতেরকান্দি সেতু।
পটভূমি/পরিস্থিতি
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। অত্র এলাকায় ৩ নম্বর সেক্টরের তত্ত্বাবধানে যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। সশস্ত্র প্রতিরােধ সর্বত্র ব্যাপক আকারে বিস্তৃতি লাভ করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী পলায়ন রাস্তা রক্ষার্থে সর্বদা তটস্থ। নরসিংদী সদর থেকে শিবপুর থানায় অবস্থিত হানাদার বাহিনীর রসদ ও অন্যান্য সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় নরসিংদী-শিবপুর রাস্তার মাধ্যমে। হানাদার বাহিনী এ রাস্তা ব্যবহার করে টহল দিয়ে এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। সশস্ত্র প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী তখন দিশেহারা। তাই অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্রিজ/সেতু ও কালভার্ট রক্ষার্থে তারা ব্যস্ত। সংগত কারণেই ভরতেরকান্দি সেতু রক্ষার্থে উভয় পাশে পাকিস্তানি বাহিনী নির্মাণ করে বাংকার । সারাক্ষণ চলে সেতু রক্ষার জন্য পাহারা। এ বুঝি মুক্তিযােদ্ধারা এসে সেতু। এলাকা আক্রমণ করল, এ বুঝি ধ্বংস করে দিল সেতু এবং ছিনিয়ে নিল অস্ত্র ও গােলাবারুদ। তাই সেতু রক্ষার্থে চলে দল বেঁধে পাহারা দেওয়ার কাজ ।।
যুদ্ধের বর্ণনা
দুঃসাহসিক নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে এগিয়ে এলেন হাবিলদার মজনু মৃধা। শুরু হলাে শত্রুর গতিবিধির উপর লক্ষ রাখা। সংগ্রহ করা হলাে ডিউটি পরিবর্তনের সময়। পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ ও পরিকল্পনার পর সবাই প্রস্তুত অপারেশনের জন্য। রাতের অন্ধকারে ভরতেরকান্দি সেতু অভিমুখে অগ্রযাত্রা শুরু হলাে। ১২জনের দলটির অধিনায়ক ছিলেন হাবিলদার মজনু মৃধা। অস্ত্র ছিল ২টি এলএমজি, ২টি স্টেনগান, ১টি এসএমজি এবং ৭টি রাইফেল। আরও ছিল কয়েকটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও কিছু বিস্ফোরক ।
সেতু রক্ষায় সশস্ত্র প্রহরায় ছিল শক্র। উভয় পাশে বাংকারে ছিল তাদের শক্ত অবস্থান। মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন যে, সেতুর দুই পাশ থেকে আক্রমণ পরিচালনা করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী দুই গ্রুপে ৬জন করে ২টি দলে ভাগ হয়ে যান। মুক্তিযােদ্ধারা রাতের অন্ধকারেই নিজস্ব অবস্থানে দখল সম্পন্ন করেন। নিঃশব্দে অবস্থান দখলের ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে শত্রু বাহিনী একটুও বুঝতে সক্ষম হয় নি। এবার শুরু হয় অপেক্ষার পালা। ক্রমান্বয়ে কেটে যায় রাতের অন্ধকার। ভােরের আকাশে তখন পর্যন্ত সূর্য ওঠে নি। এসে যায় প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। হাবিলদার মজনু মৃধার সামনে অবস্থিত বাংকার থেকে শক্র প্রহরী বের হয়ে আসে। কিন্তু সেতুর অপর পাশের বাংকার থেকে তখন পর্যন্ত কেউ বের হয় নি। হঠাৎ ভােরের নিঃশব্দ ও নির্জনতা ভঙ্গ করে হাবিলদার মজনু মৃধার এসএমজি গর্জে ওঠে। সাথে সাথে ৪জন পাকিস্তানি সেনা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। সেতুর অপর পাড়েও শুরু হয় শত্রুর উপর প্রচণ্ড গুলি। প্রায় ২০-২৫ মিনিট ধরে চলে তুমুল গােলাগুলি। গুলি বিনিময়ের এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা বাংকারের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। মুক্তিযােদ্ধারা এরই মধ্যে বাংকার ও ব্রিজ লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুড়ে মারেন। ব্রিজে অবস্থিত প্রহরীরা পলায়ন করে। পাকিস্তানি বাহিনী পলায়নের পর মুক্তিযােদ্ধারা সেতুতে বিস্ফোরক লাগানাের কাজ শুরু করে। তারপর বিস্ফোরক ফাটিয়ে সম্পূর্ণ সেতুটি ধ্বংস করে দেয়।
ফলাফল
এ অভিযানে মুক্তিযােদ্ধারা কার্যকরীভাবে ভরতেরকান্দি সেতু ধ্বংস করে। এখানে ৬জন পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায়। বাংকার থেকে মুক্তিযােদ্ধারা সংগ্রহ করেন ৩টি চাইনিজ রাইফেল ও ৪ বাক্স গুলি। আহত অবস্থায় ১জন পাকিস্তানি সৈন্য ধরা পড়ে। কিন্তু পরবর্তী সময় সে মারা যায়। এটা একটা কার্যকরী, সার্থক ও সফল অভিযান ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. নিখুঁত পরিকল্পনা: সঠিক ও সুচারুভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে যে-কোনাে অভিযানে সার্থকতা ও বিজয় সুনিশ্চিত করা যায়। যথাযথ প্রশিক্ষণ: ছদ্মবেশ ও গােপনীয়তা বজায় রেখে নিজস্ব অবস্থান দখলের মাধ্যমে শক্রর অতি কাছে পৌছানাে সম্ভব হলে জয় সুনিশ্চিত। প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনের মাধ্যমেই শুধু এর।
স্বার্থক রূপায়ণ সম্ভব। গ, আকস্মিকতা: যে-কোনাে রেইড ও অ্যামবুশ অপারেশনের সফলতার জন্য আকস্মিকতা অর্জন একটি প্রধান শর্ত।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!