ইউনাইটেড মেঘনা চাঁদপুর (ইউএমসি) পাটকলে পণ্যবাহী জাহাজ ধ্বংস
সাধারণ
বাংলাদেশে আদমজী জুট মিলের পরে ইউএমসি পাটকলটি অন্যতম। এ পাটকলটির উৎপাদন অব্যাহত রেখে পাকিস্তানি সরকার অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছিল। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ যাতে লাভবান হতে না পারে, সে জন্য মুক্তিযােদ্ধারা এ পাটকলটির উৎপাদন ব্যাহত করার জন্য বিভিন্ন উপায় খুঁজতে থাকেন। তা ছাড়া ঐ পাটকলে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি ক্যাপও ছিল।
উদ্দেশ্য
ইউএমসি পাটকলের অভ্যন্তরে যে-কোনাে ধরনের ধ্বংসাত্মক কার্যসম্পাদন করে মিলের উৎপাদন ব্যাহত করা। যুদ্ধের স্থান ও সময়। ইউএমসি পাটকলের ঘাট বা জেটিতে অবস্থানরত (পাটজাত দ্রব্য বােঝাই জাহাজবাজ) জাহাজ বা বার্জে ১৫ আগস্ট রাত আনুমানিক ১টার সময় মুক্তিযােদ্ধারা মাইন স্থাপন করে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঐ পাটকলটি মেঘনা নদীর পাড়ে এবং ঢাকা-নরসিংদী রােডস্থ সাটির পাড়া হাই স্কুল থেকে ৮০০ গজ দক্ষিণে অবস্থিত।
পটভূমি/পরিস্থিতি
দেশের সর্বত্রই পাকিস্তানি সেনাদের হেনস্তা করা এবং পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিলুপ্ত করাই ছিল মূলত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্য। এ অবস্থায় নরসিংদী সদর থানাস্থ ইউএমসি পাটকলটি এমনি ১টি প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া মিলের নিরাপত্তার স্বার্থে পাকিস্তানি সেনাদের ১টি ক্যাম্পও ছিল সেখানে।
যুদ্ধের বর্ণনা
মেঘনা নদীর পাড়ে অবস্থিত ইউএমসি পাটকলটি নরসিংদীর তথা সমগ্র দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। ঐ মিলের যে-কোনাে ধরনের ক্ষতিসাধনই হবে। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি বিরাট সাফল্য। মিলের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও অনেক শ্রমিক ছিল পাকিস্তানি। এ সময় সঠিক পর্যবেক্ষণের উদ্দেশ্যে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শ্রমিক বেশে মিল এলাকায় প্রবেশ করে দেখতে পান যে, এ মিলের উৎপাদিত পাটজাত পণ্য পরিবহণের জন্য ১টি জাহাজ বা বাজ এসে মিলের পূর্ব দিকে জেটিতে (ঘাটে) অবস্থান করছে। মুক্তিযােদ্ধারা জাহাজটি ধ্বংস করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মেজবাহউদ্দিন ইরানের উপর এ দায়িত্ব পড়ে, যিনি মেরিন অপারেশনে ১জন অভিজ্ঞ মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর সাথে আরও ৬জন (মাে. কফিল উদ্দিন, লােহানী, সাদী, খসরু, ফরিদ ও হারুনুর রশিদ) মুক্তিযােদ্ধা ঐ অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ে চর কালাই গােবিন্দপুরে সবাই সমবেত হন। পরবর্তী সময় সবাই মিলে ১টি নৌকাতে করে চর এলাকায়। এক ধানক্ষেতে এসে নামেন এবং সেখান থেকে শুধু লােহানী ও সাদীকে জাহাজ/বার্জের কাছে পাঠানাে হয়। দুজন মুক্তিযােদ্ধা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে চোরাগােপ্তাভাবে সাঁতার কেটে ঐ জাহাজ বার্জের কাছে আসেন এবং মাইন/বিস্ফোরকটি জাহাজ/বার্জের গায়ে স্থাপন করে মাইন বিস্ফোরক থেকে সংযােগকারী তার নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যান। এখানে উল্লেখ্য যে, পাটজাত দ্রব্য বােঝাই করা জাহাজ/বার্জটি পরদিন সকালে যাত্রা করার কথা ছিল। পরবর্তী। সময় নিরাপদ দূরত্ব থেকে মাইন/বিস্ফোরকটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মেজবাহউদ্দিন ইরানের দলটি নিরাপদে ঐ স্থান ত্যাগ করে।
ফলাফল
পণ্য বােঝাইকৃত জাহাজ/বার্জটি সম্পূর্ণভাবে পানিতে ডুবে যায়। এ ঘটনার পর মিলে উৎপাদিত পণ্য পরিবহণের জন্য পরবর্তী সময় কোনাে জাহাজ আর মিল ঘাটে/জেটিতে আসতে সাহস পায় নি। পাকিস্তানি সেনাদের মাঝে প্রবল ভীতির সঞ্চার হয়। সাময়িকভাবে মিলের উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার এ পাটকল থেকে অর্থনৈতিকভাবে যে লাভবান হচ্ছিল, তার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। রেইডে কোনাে পক্ষের কেউ হতাহত হয় নি।
শিক্ষণীয় বিষয়
পাকিস্তানি সেনারা মিলের নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। মুক্তিযােদ্ধা দ্বারা আক্রমণের বিষয়টি অনুমান করে সে অনুযায়ী পরিকল্পনা করতে তারা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল। সঠিক প্রশিক্ষণ এবং সুচারু পরিকল্পনার ফলে মুক্তিযােদ্ধারা এত বড়াে একটি কাজ অল্পসংখ্যক যােদ্ধা দিয়ে সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাদের উচ্চ মনােবল এবং দেশের প্রতি অগাধ ভালােবাসা ছিল বলেই একটি আদর্শকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য তারা এ দুঃসাধ্য অভিযানটি সার্থকভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।
দশদোনা অ্যামবুশ
যুদ্ধের স্থান
নরসিংদী জেলার মনােহরদী থানার শুকন্দী ইউনিয়নের একটি গ্রাম দশদোনা। এ গ্রামেই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযােদ্ধারা একটি সফল অ্যামবুশ পরিচালনা করেন।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। দশদোনা গ্রামটি হাতিরদিয়া থেকে আনুমানিক ২ কিলােমিটার উত্তরে এবং মনােহরদী থেকে ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। শিবপুর-মনােহরদী আধপাকা সড়কটি হাতিরদিয়া বাজার হয়ে এ গ্রামের মধ্য দিয়ে মনােহরদী পৌছেছে। এ গ্রামের পশ্চিম দিকে লাক্ষ্যা নদী উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত। হাতিরদিয়া বাস স্ট্যান্ড থেকে হাতিরদিয়া বাজারের মধ্য দিয়ে একটি রাস্তা উত্তর দিকে নারান্দি বাস স্ট্যান্ডে গিয়েছে। এ রাস্তায় পাকিস্তানি সৈন্যদের রসদ বহরের উপর অ্যামবুশ করা হয়।
যুদ্ধের বর্ণনা
হাতিরদিয়া থেকে মনােহরদীর মধ্যকার এ রাস্তা দিয়েই পাকিস্তানি সৈন্যরা শিবপুর থেকে মনােহরদীতে তাদের অস্ত্রশস্ত্র, রসদ ও লােকজন পরিবহণ করত। রাস্তা নিরাপদ রাখার জন্য তারা প্রায়ই ফাইটিং প্যাট্রল বের করত। একই সাথে তারা রাস্তার দুই পাশের এলাকায় অত্যাচার-নির্যাতনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের মনে ভীতির সৃষ্টি করত যাতে সাধারণ মানুষ মুক্তিযােদ্ধাদের কোনােরকম সহায়তা করতে সাহস না পায়। এলাকার যুবক ছেলেদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে শারীরিক নির্যাতন শেষে অনেক ক্ষেত্রেই মেরে ফেলা হতাে। একদা ফাইটিং প্যাট্রলের সময় শক্রর ১টি দল দশদোনা গ্রামের নাজিমউদ্দিন সরকার নামে ১জন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ককে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনা সাধারণ গ্রামবাসী ও স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাদের মনে পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর প্রতিশােধ স্পৃহাকে আরও বাড়িয়ে তােলে। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে তখন কর্মরত ছিলেন ইপিআর-এর নায়েক আকমল হােসেন (কুমিল্লা) ! মনােহরদী থানার মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক তার লােকজন নিয়ে পরিকল্পিতভাবে শত্রুর কাছে থেকে নাজিমউদ্দিন সরকারকে উদ্ধার করার পরিকল্পনা গ্রহণ। করেন। পরিকল্পনা অনুসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় যে, পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনাে টহল দল অথবা যানবাহন যখনই ক্যাম্প থেকে বের হবে, তখনই তাদের উপর অ্যামবুশ করা হবে। এ সিদ্ধান্তের পর মুক্তিযােদ্ধারা সুযােগের অপেক্ষায় থাকেন।
১০ সেপটেম্বর সকালবেলা হাতিরদিয়া বাজারের ফাইজউদ্দিন ব্যাপারী মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ দেন যে, শত্রুর রেশন বহনকারী গাড়ি বহর মনােহরদী। যাবে। ঐ সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আকমল হােসেন শত্রুর গাড়ি বহরে অ্যামবুশ করবেন বলে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুসারে ২৫-৩০জন মুক্তিযােদ্ধা দশদোনা গ্রামে রাস্তার উভয় পাশে ফাদ পেতে অবস্থান গ্রহণ করে গাড়ি বহর আগমনের অপেক্ষায় থাকেন। আনুমানিক দুপুর সাড়ে ১২টায় পাকিস্তানি সেনাদের গাড়ি বহর তাদের অ্যামবুশ এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথে পরিকল্পিতভাবে রাস্তার উভয় পার্শ্ব থেকে শত্রুর উপর আক্রমণ করা হয়। এরূপ আচমকা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা হতচকিত হয়ে পড়ে। উপায়ান্তর না দেখে তারাও পালটা ফায়ার করতে শুরু করে। এভাবে প্রায় ৮১০ মিনিট উভয় পক্ষের গােলাগুলি চলে।
ফলাফল
এ যুদ্ধে কোনােরূপ ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিযােদ্ধারা জয়লাভ করেন। পক্ষান্তরে, শত্রুপক্ষের ২জন সেনা নিহত এবং ৫জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকিস্তানি সেনারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
সময়মতাে সঠিক সংবাদ সংগ্রহ করা যুদ্ধে জয়লাভের অন্যতম পূর্বশর্ত। উক্ত অপারেশনে ফাইজউদ্দিন ব্যাপারী কর্তৃক পাকিস্তানি সেনাদের আগমনের সংবাদ সঠিক সময়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে পৌছাতে না পারলে এ অপারেশন পরিচালনা দুষ্কর হয়ে পড়ত। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেয়া যে-কোনাে সামরিক অপারেশন পরিচালনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক কর্তৃক তৎক্ষণাৎ অ্যামবুশের সিদ্ধান্ত না নিলে হয়ত অপারেশনটি সফল হতাে না।
হাঁটুভাঙার যুদ্ধ
সাধারণ স্বাধীনতা যুদ্ধের দিনগুলােয় ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে পাকিস্তান। সেনাবাহিনী জেনারেল নিয়াজীর নেতৃত্বে দেশের সর্বত্র তাদের রণকৌশলগত পুনর্বিন্যাস করছিল। এরই অংশ হিসেবে নরসিংদী জেলায় মূলত ভৈরব-ঢাকা রেললাইন নিরাপদে রাখার জন্য তারা নরসিংদী, রায়পুরা প্রভৃতি স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে। ভৈরব থেকে নরসিংদী চলাচলের জন্য তারা প্রায়ই এ রেললাইন ব্যবহার করত। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এমনই ১টি প্যাট্রল দলকে রায়পুরা থানার অন্তর্গত হাঁটুভাঙা নামক স্থানে ফাঁদ পেতে হত্যা করা হয়। হাঁটুভাঙার এ অপারেশনটি নরসিংদী জেলায় মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অন্যতম সাফল্যজনক ও বিখ্যাত অপারেশন বলে পরিচিত।
উদ্দেশ্য
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি টহল দল যখন ভৈরব-নরসিংদী রেললাইন ধরে হেঁটে রায়পুরা সদর থেকে নরসিংদী সদরে যাবে, তখন তাদেরকে হাঁটুভাঙা নামক স্থানে ফাদ পেতে হত্যা করা এবং তাদের অস্ত্র ও সরঞ্জাম ছিনিয়ে নেয়া।
স্থান ও সময়
হাটুভাঙা গ্রিডসূত্র ৯১৮৫৪৩, বাংলাদেশ ম্যাপ শিট নম্বর ৭৯ আই/১৩, যা রায়পুরা থানার অন্তর্গত। এ যুদ্ধটি ১৯৭১ সালের ৫ অক্টোবর সংঘটিত হয়। হাঁটুভাঙা স্থানটি রায়পুরা থানা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত।
পটভূমি/পরিস্থিতি
অপারেশনের পূর্ব দিন রায়পুরা সদর থেকে কলােনি মসজিদের ইমাম কর্তৃক মুক্তিযােদ্ধারা এ তথ্য পান যে, পাকিস্তানি বাহিনীর বেশ কিছু সৈন্য (আনুমানিক ১ কোম্পানি) পরদিন রায়পুরা থেকে নরসিংদী হেঁটে যাবে। তখন ঐ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত ৩ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর প্লাটুন অধিনায়ক হাবিলদার গফুর হাটুভাঙায় শত্রুকে ফাদ পেতে হত্যা করার জন্য পরিকল্পনা করেন। তিনি ৪টি দলে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভক্ত করেন এবং এসব দলের নেতৃত্বে ছিলেন সার্জেন্ট শাহজাহান, নায়েব জালাল, নায়েব জয়দর আলী ও নায়েব লতিফ।
যুদ্ধের বর্ণনা
অপারেশনের দিন আনুমানিক সকাল ৬টায় সার্জেন্ট শাহজাহানের গ্রুপ হাঁটুভাঙা এলাকায় খানাবাড়ি রেল স্টেশনে অবস্থান নেয়। অ্যামবুশ এলাকায় রেললাইনের উভয় পাশে হাঁটুভাঙা গ্রাম ও পশ্চিম দিকে খানাবাড়ি রেল স্টেশন অবস্থিত। সম্পূর্ণ এলাকাটি ১.৫ কিলােমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ছিল (বিস্তারিত নকশায় দেখানাে আছে)। রেললাইনের উভয় পাশে নিচু ভূমি ও খালবিলে ঐ সময় কিছু কিছু স্থানে পানি ছিল। ফাদ এলাকার পূর্ব পাশে ১টি রেলসেতু ছিল। | পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক নিয়মিত বাহিনী সমৃদ্ধ কর্পোরাল শাহজাহানের দলটি খানাবাড়ি রেল স্টেশনে আনুমানিক সকাল ৬টার মধ্যে অবস্থান নেয়। পরিকল্পনা মােতাবেক নায়েব জয়দর আলীর গ্রুপটির ইসলামপুর উচ্চবিদ্যালয় ও মেন্দেরকান্দি গ্রামের মাঝে অবস্থান নেয়ার কথা ছিল কিন্তু তারা অ্যামবুশ স্থানে দেরিতে পৌছে। তাই পূর্বেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দলটি ফাদ অবস্থানে ঢুকে ইসলামপুর বিদ্যালয়ে অবস্থান করছিল। নায়েব জয়দর আলী তাঁর গ্রুপ নিয়ে ইসলামপুর উচ্চবিদ্যালয়ের পূর্বে রেলসেতুর উভয় পাশে আনুমানিক সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে অবস্থান নেয়। অতঃপর পাকিস্তানি সৈন্যরা হেঁটে খানাবাড়ি রেল স্টেশনের দিকে যেতে থাকলে কর্পোরাল শাহজাহানের (নিয়মিত বাহিনী) দলটি খানাবাড়ি রেল স্টেশন ও বাঙালি নগর বটগাছ থেকে তাদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হতচকিত হয়ে যায় এবং রেললাইন ধরে আবার পূর্ব দিকে এলােপাতাড়ি দৌড়াতে শুরু করে। অতঃপর তারা যখন রেলসেতু এলাকায় আসে তখন জয়দর আলীর দলটি তাদেরকে রাস্তার উভয় পাশ থেকে বাক্স অ্যামবুশ করে।
রাস্তার উভয় পাশ থেকে মুক্তিযােদ্ধা কর্তৃক ফায়ারের সময় কিছুটা ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি হয় এবং ফায়ারের কিছুটা সমন্বয়হীনতা পরিলক্ষিত হয়। এর ফলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকিস্তানি সেনারা রেললাইনের উভয় পাশে জলাশয়ে পড়ে যায় এবং তাতে আটকে পড়ে। এ ফাঁদে প্রচুর পাকিস্তানি সেনা গুলিবিদ্ধ ও হতাহত হয়। এহেন পরিস্থিতিতে পার্শ্ববর্তী এলাকার আরও মুক্তিযােদ্ধা এসে ঘটনাস্থলে যােগ দেন। পার্শ্ববর্তী এলাকার জনসাধারণও তখন ফাদের অবস্থানে যােগ দেয়। মুক্তিযােদ্ধা ও জনসাধারণের পারস্পরিক সহযােগিতায় সম্পূর্ণ পাকিস্তানি দলটি নির্মূল হয় এবং তাদের থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়।
এ অপারেশনটি বেলা ২টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। ঐ টহল দলের উপর অ্যামবুশ হয়েছে, এ খবর পেয়ে রায়পুরা থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল তাদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসে। কিন্তু রায়পুরা থেকে হাঁটুভাঙা দূরে হওয়ায় (আনুমানিক ৬ কিলােমিটার) ঘটনাস্থলে পৌছার পূর্বেই মুক্তিযােদ্ধারা সেখান থেকে সরে পড়েন।
ফলাফল
এ যুদ্ধের ফলে রায়পুরা থানার অন্তর্গত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনােবল ভেঙে পড়ে। ভৈরব-নরসিংদী রেললাইন ধরে চলাচলের বিষয়ে তারা সন্দিহান হয়ে পড়ে এবং নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে থাকে। এ সামরিক অপারেশনে স্থানীয় জনসাধারণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতামূলক অবদান বেশ উল্লেখযােগ্য। এ যুদ্ধে আনুমানিক ২৬-২৮জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং ১টি এমজি, ১০৫ মিলিমিটার আরআর, ৩টি জি-৩ রাইফেল, ৪টি রাইফেল ও ৮টি .৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করা হয়। এ অপারেশনের ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল অনেকাংশে বেড়ে যায় এবং ভৈরব-নরসিংদী রেলপথে পাকিস্তানি সৈন্যদের চলাচল অনেকাংশে হ্রাস পায়।
শিক্ষণীয় বিষয়
এ যুদ্ধে নিম্নলিখিত বিষয়গুলাে শিক্ষণীয় ছিল: ক. পাকিস্তানি বাহিনীর নিরিখে: ১. জনসমর্থনের অভাব থাকলে জনযুদ্ধ মােকাবিলায় সামরিক দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব থাকলেও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শক্তির কাছে বিশেষ মুহূর্তে নাজেহাল হতে হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাতায়াতের জন্য অধিকাংশ সময় ভৈরবনরসিংদী রেললাইন ব্যবহার করত। কাজেই মুক্তিবাহিনী সহজেই বিস্তারিতভাবে এ ফাদ পরিকল্পনা করতে সমর্থ হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর প্যাট্রল পরিকল্পনার গােপনীয়তা নষ্ট হওয়ায় তারা মুক্তিবাহিনী কর্তৃক অ্যামবুশে পতিত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে গােপনীয়তা রক্ষা করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাকিস্তানি সেনারা সঠিকভাবে কাউন্টার অ্যামবুশ করতে ব্যর্থ হয়। এর ফলে অ্যামবুশ কার্যকরী হওয়ার পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। বাড়তি সৈন্য সাহায্য (রি-ইনফোর্সমেন্ট) পরিকল্পনা মাফিক সঠিক সময়ে পৌছাতে না পারলে বিপদগ্রস্ত দল/উপদলের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাে দুষ্কর হয়ে পড়ে।
খ. মুক্তিবাহিনীর নিরিখে: ১. শত্রু সম্পর্কে সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে সংগ্রহ করতে পারার কারণে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর অ্যামবুশ করতে সমর্থ হয়। ২. যুদ্ধের সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি যুদ্ধের সামগ্রিক পরিস্থিতিকে পালটে দিতে পারে। ৩. বাক্স অ্যামবুশে ফায়ারের বিস্তারিত সমন্বয়সাধন আবশ্যক। ৪. মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন দলের মধ্যে সমন্বয় ও সহযােগিতা লক্ষণীয় ছিল, যা শত্রুকে সমূলে ঘায়েল করতে সহায়তা করেছে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড