You dont have javascript enabled! Please enable it!
বেলাবাের (বড়িবাড়ি) যুদ্ধ
বড়িবাড়ি ছিল ১৯৭১ সালে নরসিংদীর মনােহরদী থানার একটি ইউনিয়ন, যা এখন বেলাবাে থানার অন্তর্গত। বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে এলাকার জনগণ সচেতন ছিলেন। তাঁরা প্রতিটি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করতেন এবং সেখানকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সাধারণ জনগণের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক গণসমাবেশে এলাকার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও দিক নির্দেশনা গ্রহণ করে তারা এই বাণী এলাকার প্রত্যেকটি মানুষের কাছে পৌছে দেন। এলাকাভিত্তিক মানুষ যার যা আছে তা নিয়ে প্রস্তুত হতে থাকেন। এ প্রস্তুতিই পরবর্তী পর্যায়ে তাদেরকে সংঘবদ্ধ হয়ে নিজ এলাকাতে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। এলাকার নেতৃবৃন্দ ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে ঢাকা এবং দেশের অন্যান্য স্থানে গণহত্যার খবর পরদিন জানতে পারেন বিদেশি রেডিও বার্তার মাধ্যমে  দুপুরের পর থেকে ঢাকার আশপাশের এলাকা, যেমন যাত্রাবাড়ি, কাঁচপুর, সায়েদাবাদ থেকে বহু মানুষ ভীত সন্ত্রস্ত্র হয়ে হেঁটে এ এলাকায় চলে আসেন। তারা ঢাকার গণহত্যার ভয়ংকর কিছু তথ্য এলাকার মানুষের কাছে তুলে ধরেন। এলাকার দরিদ্র মানুষেরা এ ক্লান্ত জনগােষ্ঠীকে যতদূর সম্ভব আহার ও আশ্রয়। দিয়ে সাহায্য করেন। অনেকেই তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে এসেছেন, অনেকেই ছিলেন সহায়সম্বলহীন।
সেদিন সন্ধ্যায় ইপিআর-এর ২জন সৈনিক এলাকায় আসেন এবং তারা। জানান যে, আগের দিন রাতে অনেক কষ্টে তারা পিলখানা থেকে পালিয়ে এসেছেন। তারা আরও জানান যে, ২৫ মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২২ বালুচ রেজিমেন্ট অতর্কিতে পিলখানার বাঙালি ইপিআর সদস্যদের উপর আক্রমণ করে এবং প্রায় সমস্ত বাঙালি সৈনিককে হত্যা করে। মাত্র কয়েকজন ইপিআর সদস্য পিলখানা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। এছাড়াও ঢাকার অন্যান্য স্থানে কর্মরত ইপিআর সদস্যদের মধ্যে বেশ কিছু সংখ্যক ইপিআর সদস্য। পালিয়ে আসেন এবং অনেকে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে পালিয়ে অন্যান্য স্থানে চলে যান। এসব ঘটনা শােনার পর এলাকার মানুষ উত্তেজিত হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য দৃঢ় অঙ্গীকার করেন।
এলাকার সামাজিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাধারণ মানুষ নিজেদের উদ্যোগে আরও কঠিন প্রশিক্ষণ শুরু করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি শক্তিশালী দল তখন নরসিংদী শহরে অবস্থান নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় নরসিংদীর অদূরবর্তী মনােহরদী থানা এলাকা অধিকাংশ সময় মুক্তাঞ্চল হিসেবে গণ্য হতাে। প্রথমেই মুক্তিযােদ্ধারা এলাকাটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এদেশীয় সহযােগীদের হাত থেকে মুক্ত করেন এবং মুক্তাঞ্চল হিসেবে গড়ে তােলেন। এ এলাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখনই ঢুকতে চেষ্টা করেছে তখনই তারা কঠিন প্রতিরােধের সম্মুখীন হয়েছে। বড়িবাড়ি বাজার থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দূরে পাটুলি গ্রামের চৌধুরীবাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা ১টি সুদৃঢ় প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করেন। পাটুলি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাদু ভূইয়া তাঁর বিশাল বাড়িটি মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দেন এবং নিজ পরিবারের সদস্যদের পাশের একটি গ্রামে স্থানান্তর করেন। এলাকাটিতে যাতায়াতের জন্য হাটা পথ ছাড়া আর কোনাে রাস্তাঘাট ছিল না। আশপাশে ছিল অনেক গাছগাছালি। দূর থেকে বাড়িগুলাে দেখা যেত না। এখানেই একটি বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অস্ত্রাগার স্থাপন করেছিলেন। বাকি ঘরগুলােতে তারা অবস্থান করতেন এবং আশপাশের জঙ্গলে তারা প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালাতেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যক্রম নির্বিঘ্নে পরিচালনার জন্য এটি ছিল একটি আর্দশ স্থান। প্রায় ৪০০জন মুক্তিযােদ্ধা সেখানে অবস্থান করতেন, প্রশিক্ষণ নিতেন এবং এখান থেকে তারা আশপাশের এলাকায় অপারেশন চালাতেন। জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ১টি এলএমজি পরিষ্কার করার সময় অসাবধানতাবশত ট্রিগারে চাপ লেগে ২জন মুক্তিযােদ্ধা এ স্থানে শহিদ হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে এ এলাকায় বড়িবাড়ির যুদ্ধ একটি উল্লেখযােগ্য প্রতিরােধ যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। নরসিংদী শহর থেকে ২৮ কিলােমিটার উত্তরে বড়িবাড়ি গ্রামটি ছিল আড়িয়াল খাঁ নদী ও ব্রহ্মপুত্র নদের মােহনায়।
চারদিকে ছিল পানি আর পানি। ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে প্রায়ই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লঞ্চ ও গানবােট চলাচল করত। এ সুযােগ কাজে লাগানাের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা আঁটতে থাকেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সুবেদার মাে. আবুল বাশার এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করার কাজে নেতৃত্ব দেন। বড়িবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় অবস্থানরত বিভিন্ন বাহিনী যেমন: সেনাবাহিনী, ইপিআর, আনসার, পুলিশ এবং স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধাগণ সবাই এ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করতে শুরু করেন। মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, ১৩ জুলাই বিকালে টুকের দিক থেকে পাকিস্তানি সৈন্যে বােঝাই বড়াে আকৃতির ৪টি লঞ্চ ডুমরাকান্দা বাজারের নিকটবর্তী হাই স্কুলের কাছে এসে পৌছেছে। মুক্তিযােদ্ধারাও দ্রুত জমায়েত হয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে পাকিস্তানি বাহিনী বেলাবাে বাজারের দিকে অগ্রসর হলে যে-কোনাে উপায়ে তাদের বাধা দিতে হবে। বাজারের কাছে নদীতে থাকা অবস্থায় লঞ্চগুলােতে আক্রমণ করা হবে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের খবর সম্বন্ধে জনগণকে সতর্ক করেন এবং তাদেরকে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে অনুরােধ করেন। কিন্তু অধিকাংশ গ্রামবাসী তাদের বাড়িঘর ছেড়ে যান নি। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক সুবেদার মাে. আবুল বাশার মুক্তিযােদ্ধাদের আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড় সংলগ্ন আনাের আলী গুদারাঘাট, ভাঙারঘাট ও বড়িবাড়ি বাজারের সামনে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন। সংখ্যায় মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন প্রায় ২৫জন। তাদের কাছে ছিল ১টি রকেট লঞ্চার, কিছু গ্রেনেড, ১টি এমজি, ২টি এলএমজি, ১টি ২ ইঞ্চি মর্টার, ৩টি চাইনিজ রাইফেল এবং .৩০৩ রাইফেল। তাদের কাছে অপ্রতুল গােলাবারুদ ছিল। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্ব থেকেই তাদের এদেশীয় সহযােগীদের মাধ্যমে বড়িবাড়ি এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রস্তুতির খবর পেয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুকৌশলে ৫০/৬০জন সৈন্যসহ ২টি দেশীয় মহাজনি বড়াে নৌকা নিয়ে বড়িবাড়ি সংলগ্ন আড়িয়াল খাঁ নদী দিয়ে বড়িবাড়ির পিছনের দিকে অবস্থান নেয়ার জন্য অগ্রসর হয়। তখন বর্ষার পানিতে নদী ছিল।
পরদিন অর্থাৎ ১৪ জুলাই বড়িবাড়ির অদূরে নদীর মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা  তাঁদের প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে নৌকা ২টি দেখতে পান। তখন প্রায় ভােররাত। নৌকাগুলাে চালাচ্ছিল বাঙালি মাঝিরা এবং তারা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযােগী। নৌকা ২টি দেখে মুক্তিযােদ্ধাদের কারাে কারাে মনে সন্দেহের উদ্রেক হলে তারা নদীর পাড় থেকে চিৎকার করে মাঝিদের কাছে। জানতে চান যে নৌকাতে কি আছে। উত্তরে মাঝিরা জানায় যে, নৌকাতে তারা পাট বহন করছে। এই কথা শােনার পর মুক্তিযােদ্ধারা নৌকাগুলােকে যেতে দেয়। নৌকাগুলাে চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে সকাল প্রায় ৬টার দিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্য বহনকারী বড়াে আকারের ২টি স্টিলবডি লঞ্চ নদীবক্ষে দেখা যায়। লঞ্চগুলাে থেকে ক্রমাগত গুলি আসতে থাকে এবং মুক্তিযােদ্ধারাও পালটা আক্রমণ শুরু করেন। লঞ্চগুলাের মধ্যে অগ্রবর্তী লঞ্চে মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমাগত এলএমজি’র গুলির আঘাত করেন। ফলে কিছু সংখ্যক পাকিস্তানি সৈনিক লঞ্চ থেকে পানিতে পড়ে যায়। তাদের সহযােদ্ধারা কয়েকজনকে লঞ্চে তুলে নেয় এবং কয়েকজন পানিতে তলিয়ে যায় লঞ্চের  পাকিস্তানি সৈনিকদের বেশ কয়েকজন হতাহত হয়। কিছুক্ষণ পরে লঞ্চ ২টি নদীর পাড়ে এসে পৌছে এবং পাকিস্তানি সৈন্যরা লঞ্চ থেকে লাফিয়ে নেমে নদীর পাড়ে অবস্থান গ্রহণ করে। সেখান থেকে তারা মেশিনগান ও মর্টার। ফায়ার করতে থাকে অদূরবর্তী মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর  দুই দলই প্রচণ্ড গােলাগুলিতে লিপ্ত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা দেখলেন তাদের অবস্থানের পিছন দিক
থেকে ক্রমাগত গুলি বর্ষণ হচ্ছে।
তখন তারা বুঝতে পারলেন যে, ভােররাতের নৌকাগুলাের সাহায্যেই পাকিস্তানি সৈনিকদের একটি অংশ তাদের পিছনে অবস্থান গ্রহণ করেছে। তখন অধিনায়ক বাশারের নির্দেশে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল নদীর পাড়ে অবস্থানরত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকে এবং আরেকটি দল অবস্থান পরিবর্তন করে পিছন দিক থেকে অগ্রসরমান। পাকিস্তানি সৈনিকদের বাধা প্রদান করতে থাকে। এ যুদ্ধ প্রায় ২ ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী হয়। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধাদের একমাত্র রকেট লঞ্চারটি অকেজো হয়ে পড়ে। দুই দিক থেকে প্রচণ্ড আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হন। প্রচণ্ড যুদ্ধে সম্মুখে অবস্থানরত সুবেদার মাে. আবুল বাশার, সিপাহি আ, বারিক, সিপাহি নুরুল হক, সিপাহি সােহরাব হােসেন, সিপাহি মমতাজ উদ্দিন, সিপাহি আ, হক, সিপাহি আ. সালামসহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন। অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে। পাকিস্তানি সৈনিকেরা দুই দিক থেকে বড়িবাড়ি গ্রামে প্রবেশ করে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের। আক্রমণে আড়িয়াল খাঁ নদীতে অবস্থানকালীন ও পরে নদীর :: : যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেক সৈন্য হতাহত হয়েছিল। যুদ্ধ শেষে প্রতিহিংসাপরায়ণ পাকিস্তানি সৈন্যরা বড়িবাড়ি গ্রামে ঢুকে গ্রামের বহু বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের সাধারণ মানুষের উপর অকথ্য নির্যাতন চালায়। শুরু করে ব্যাপক গণহত্যা। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা অবস্থান ত্যাগ করার সময় তাদের। হাতে ধরা পড়েন। তাদেরকে আশুগঞ্জে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া। হয়। বড়িবাড়ি ও আশপাশের গ্রামের ৭০জনের বেশি গ্রামবাসীকে সেদিন হত্যা করা হয়।
নদীর তীরে ও আশপাশে যে-সকল লাশ পাওয়া গিয়েছিল তাদেরকে গণকবর দেওয়া হয়। এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা সেদিনের কথা স্মরণ করে আজও আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। হাফিজউদ্দিন আহমেদ রচিত ‘বড়িবাড়ির যুদ্ধ ১৯৭১’ নামক প্রবন্ধে ৮জন মুক্তিযােদ্ধার শহিদ হওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে, কিন্তু ৭জনের পরিচয় লিপিবদ্ধ রয়েছে (এ রচনায় আব্দুস সালাম ও আব্দুল হকের নাম তালিকায় নাই, কিন্তু পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, উভয়েই এ যুদ্ধে শহিদ হন)। প্রাপ্ত তথ্য থেকে শহিদ মুক্তিযােদ্ধাগণের নাম নিম্নে উল্লেখ করা হলাে: ১. সুবেদার মাে. আবুল বাশার বীরপ্রতীক। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের রাউজানে। চট্টগ্রামের লােক হয়েও তিনি নরসিংদীবাসীর খুবই কাছের মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ১৪ জুলাই তিনি বড়িবাড়ির যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন এবং যুদ্ধক্ষেত্রেই শাহাদতবরণ করেন। এখানেই তিনি। শেষ শয়ানে শায়িত আছেন । বড়িবাড়ি যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার জন্য তিনি বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত হন।
আব্দুল বারিক (ইপিআর/ফুলদী, রায়পুরা), ৩. হাবিলদার ইদ্রিস (রায়পুরা), ৪. মমতাজ উদ্দিন (দুলালকান্দি, বেলাবাে), ৫. নুরুল হক (টকিপুরা, রায়পুরা), ৬. মাে. চান মিয়া (বটিবন্দ, বেলাবাে), ৭. ফজর আলী (বড়িবাড়ি) (নির্ভরযােগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী | ফজর আলী বড়িবাড়ি যুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন নি। তিনি সিলেটের করিমগঞ্জে সম্মুখযুদ্ধে শাহাদতবরণ করেন।), ৮. আব্দুল হক, ৯. আব্দুস সালাম। নদীর পাড় দখল করার পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ৩টি দলে বিভক্ত হয়ে আশপাশের গ্রামগুলােতে প্রবেশ করে। প্রথম দলটি ভাঙারঘাট থেকে ইদগার দিকে, দ্বিতীয় দলটি আনাের আলী গুদারাঘাট থেকে গ্রামগুলাের দিকে, তৃতীয় দলটি নামাবাজার থেকে বেলাবাে বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। সৈন্যরা বেলাবাে বাজারের ভিতর দিয়ে পশ্চিম রাস্তা বরাবর গ্রামগুলাের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে নারী-পুরুষ-শিশু যাকে পায় তাকেই গুলি করে হত্যা করে। প্রায় ৩০জন গ্রামবাসীকে ধরে এনে চোখ বেঁধে বড়িবাড়ি কুঠির কাছের নদীর পাড়ে গুলি করে হত্যার পর নদীতে ফেলে দেয়। সেদিন দুপুরের পর ভৈরবের দিক থেকে একটি গানবােট আড়িয়াল খাঁ নদী হয়ে বেলাবাে বাজারের কাছে এসে গ্রামগুলােতে কামানের গােলাবর্ষণ করে। প্রায় ২ দিন হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন চালানাের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী বড়িবাড়ি এলাকা ত্যাগ করে। তারপর আবার মুক্তিযােদ্ধারা এ এলাকায় প্রবেশ করে এলাকাটি মুক্তাঞ্চল বলে ঘােষণা করেন। শহিদ সুবেদার বাশারের মরদেহ মুক্তিযােদ্ধা ও স্থানীয় জনগণ নদীর কাছে মাটিয়ালপাড়া গ্রামে সমাধিস্থ করেন। সে গ্রামের মফিজুদ্দিন মুন্সী তার মরদেহ গােসল করান এবং তার ইমামতিতে জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হয় ও দাফন সম্পন্ন হয়। বর্তমানে কবরটি জীর্ণ অবস্থায় আছে। কবরের সুরক্ষা দেয়ালের এক পাশ ভেঙে গেছে। নিহত গ্রামবাসীদের কবর দেওয়া হয় নিজেদের বাড়ির আশপাশে।
বেশ কিছু গ্রামবাসীকে আড়িয়াল খাঁ নদীর পাড়ে ভাঙারঘাট এলাকায় কবর দেওয়া হয়। এখানে একটি কবরে শায়িত আছেন এক পরিবারের ৪জন সদস্য – বাবা আব্দুল হামিদ ব্যাপারী, চাচা আব্দুল কাদের ব্যাপারী, চাচা আব্দুল মজিদ ব্যাপারী, ছেলে। আব্দুস সায়ীদ ব্যাপারী। বাকি কবরগুলাে চিহ্নিত করা সম্ভব হয় নি। | ১৯৭১ সালের আগস্ট থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বড়িবাড়ি মুক্তাঞ্চল হিসেবে গণ্য হয়। এই এলাকার যুদ্ধ ও ব্যাপক গণহত্যার বিষয়ে খুব বেশি লিপিবদ্ধ তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু উল্লেখযােগ্য বিষয় যে, এই এলাকার নতুন। প্রজন্ম, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত তাদের পূর্বসুরীদের বীরত্ব গাথা সম্বন্ধে বিশদভাবে অবগত। এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা তাদের নতুন প্রজন্মকে বড়িবাড়ির যুদ্ধ ও
শিক্ষণীয় বিষয়
এ ক্ষেত্রে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রু সম্পর্কে সঠিক খবর নিতে ব্যর্থ হন। ছইওয়ালা নৌকার ভিতরে আত্মগােপনকারী পাকিস্তানি সেনারা তাই মুক্তিযােদ্ধাদের অপূরণীয় ক্ষতি করতে সক্ষম হয়। ক. পাকিস্তানি বাহিনীর নিরিখে: ১. নৌকা ব্যবহার করে পাকিস্তানি বাহিনী সঠিক লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে মুক্তিবাহিনীকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়। বিভিন্ন পদ্ধতিতে নিজস্ব লক্ষ্যবস্তুকে আড়াল করতে পারলে যুদ্ধক্ষেত্রে সুবিধাজনক। অবস্থানে থাকা যায়। সঠিক কাউন্টার অ্যামবুশ ড্রিলের প্রয়ােগ হতাহতের পরিমাণ সীমিত করতে পারে। ৩. জনবলের দৃষ্টিকোণ থেকে বাড়তি জনশক্তির কারণে পাকিস্তানি বাহিনী অ্যামবুশ মােকাবিলায় সক্ষম হয়।। খ, মুক্তিবাহিনীর নিরিখে: ১. অ্যামবুশ অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর উপস্থিতি প্রকাশ হয়ে যাওয়ার কারণে মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশ ব্যর্থ হয়। অ্যামবুশ সাইটে গােপনীয়তা বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২. মুক্তিবাহিনী সঠিক নৌকা চিহ্নিত করতে ব্যর্থ হয়। যুদ্ধক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু চিহ্নিতকরণ একটি অতীব প্রয়ােজনীয় বিষয়। ৩. আরএল ফায়ারের কোনাে বিকল্প ব্যবস্থার পরিকল্পনা ছিল না, যার কারণে মুক্তিবাহিনী শত্রু ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!