গণ আন্দোলন ও অসহযােগ আন্দোলনে নরসিংদী
ঢাকার অদূরে উত্তর-পূর্বে নরসিংদী। ১৯৭১ সালে নরসিংদী ছিল নারায়ণগঞ্জ মহকুমার একটি থানা। দক্ষিণে নারায়ণগঞ্জ হয়ে উত্তরে নরসিংদীর পশ্চিম দিকে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে প্রবাহিত হয়েছে মেঘনা নদী। মেঘনা নদী আশুগঞ্জ ভৈরব স্পর্শ করে উত্তর ও উত্তর-পূর্বে সিলেটকে সংযুক্ত করেছে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ দক্ষিণ দিক থেকে প্রবাহিত হয়ে। এঁকেবেঁকে এবং ঘুরপথে উত্তরে এসে অন্যান্য নদীর সাথে মিশেছে। তা ছাড়া মেঘনা নদীর শাখা হিসাবে আড়িয়াল খাঁ, কলাগাছিয়া, বগা নদী নরসিংদীর মধ্যে ও উত্তর-পূর্ব অঞ্চলকে বিধৃত করেছে। ঢাকা থেকে রেলপথ টঙ্গী, ঘােড়াশাল, নরসিংদী, ভৈরব বাজার, আশুগঞ্জ হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া পৌঁছেছে। চট্টগ্রাম ও সিলেট যাওয়ার এটিই একমাত্র রেলপথ। ২৫ মার্চের অব্যবহিতপরবর্তী থেকে এ রেলপথের রেললাইন তুলে, স্লিপার সরিয়ে এবং পথের কালভার্ট ও ব্রিজ ধ্বংস করে ট্রেন চলাচলের অযােগ্য করে ফেলা হয়। পাকিস্তানি বাহিনী যেন রেলপথে সৈন্য ও যুদ্ধের রসদ পরিবহন না করতে পারে, সে উদ্দেশ্যে এ ব্যবস্থা নেয়া হয়। জলযানে পরিবহণ ছিল ধীরগতি সম্পন্ন ও সময় সাপেক্ষ। এর ফলে এগুলাে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সহজ লক্ষ্যবস্তু ছিল। ঢাকা থেকে ডেমরা হয়ে একটি রাস্তা নরসিংদীকে সংযােগ করেছে। নরসিংদী থেকে ভৈরব বাজার যাওয়ার কোনাে রাস্তা ছিল না। তবে রেললাইনের উপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া। সম্ভব ছিল। এ রাস্তা যান্ত্রিক বাহন চলার অনুপযােগী। টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জ বা ঘােড়াশাল হয়ে নরসিংদী পৌছার কোনাে পথ না থাকলেও পায়ে হেঁটে আসা সেনাবাহিনীর জন্য সম্ভব ছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল ঢাকার প্রায় ২৫ মাইল উত্তরে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে। এ ব্যাটালিয়নটি ছিল ঢাকা। সেনানিবাসস্থ ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধীন, ব্রিগেড অধিনায়ক ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব। অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের নামে ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কোম্পানিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ময়মনসিংহে এবং ‘এ’ কোম্পানিকে টাঙ্গাইলে। ‘বি’ কোম্পানি এবং ‘ডি’ কোম্পানি থেকে যায়। ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের সাথে জয়দেবপুরে। ‘বি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন ছিল। গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি প্রহরায়। সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের আরেকটি কোম্পানিও মােতায়েন ছিল।
২৫ মার্চ দিবাগত রাত ৩টায় লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের টেলিফোন নির্দেশে ‘বি’ কোম্পানির বাদবাকি সৈন্যদের গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ‘ডি’ কোম্পানির ১টি প্লাটুন ছিল রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপাে প্রহরায়। এখানে ২ প্লাটুন পাকিস্তানি সৈন্যও প্রহরায় ছিল। ২৬ মার্চ সকালে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিল ‘ডি’ কোম্পানি (১টি প্ল্যাটুন ব্যতীত) ও সদর দপ্তর কোম্পানির অংশ (ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তর)। ২৬ মার্চ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে। ২৮ মার্চ ব্যাটালিয়নের মেজর কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লাহ জয়দেবপুর থেকে সকল সৈনিকসহ প্রথমে টাঙ্গাইলে পৌঁছেন। সেখানকার কোম্পানিসহ ২৯ মার্চ তিনি ময়মনসিংহ পেীছেন। বিকালের মধ্যে তিনি বিদ্রোহী ইপিআর, পুলিশ ও ছাত্র-জনতা সংগঠিত করেন। সংঘবদ্ধ সেনা দলের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৩ হাজার। এ পর্যায়ে তিনি ঢাকা সেনানিবাস আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। ঢাকার উত্তর ও পশ্চিম দিক থেকে অবরুদ্ধ রেখে পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে অপ্রত্যাশিত পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এ আক্রমণ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে মেজর সফিউল্লাহ ক্যাপটেন মতিউর রহমানকে ১ কোম্পানি ইপিআর দিয়ে নরসিংদী এলাকায় পাঠান।
৩১ মার্চ ক্যাপটেন মতিউর রহমান তাঁর সেনা দল নিয়ে নরসিংদী পৌছেন। এ ইপিআর কোম্পানি (১৪ উইং) ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানায় বাঙালি সৈনিকদের উপর পাকিস্তানি ২২ বালুচ রেজিমেন্ট কর্তৃক অতর্কিত আক্রমণ করার ঘটনার কয়েক দিন পর এসে যােগদান করে। সে রাতে ঘুমন্ত, বিশ্রামরত ও অপ্রস্তুত বাঙালি ইপিআর সৈনিকরা ছিলেন নিরস্ত্র । যারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে সক্ষম হন তাঁরা সাহসের সাথে রুখে দাঁড়ান। কিন্তু অপরিকল্পিত এ প্রতিরােধ কার্যকরী হলেও দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থায়ী ফলাফল লাভের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে যায়। বহু সৈনিক ঘুমন্ত এবং নিরস্ত্র অবস্থায় শহিদ হন। বাকিরা বিচ্ছিন্নভাবে পিলখানা ত্যাগ করেন। এদের বেশির ভাগই দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী পার হয়ে আপাতত আপদ মুক্ত হন। পিলখানা ত্যাগ করা বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের ১টি দল নিয়ে নায়েব সুবেদার সুলতান আহমদ ১ এপ্রিল পাঁচদোনায় ক্যাপটেন মতিউর রহমানের। সাথে যােগ দেন। কেউ মানিকগঞ্জে ক্যাপটেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরীর সাথে, কেউ টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর সাথে এবং অন্যরা যে-যার মতাে তাদের গন্তব্যে চলে যান। এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সামরিকবাহিনীর সৈনিক এবং ছুটিতে থাকা বহু সৈনিকও এ পর্যায়ে নিজেদের ক্যাপটেন মতিউর রহমানের দলের সাথে অন্তর্ভুক্ত হন। আরও যােগ দেন বাঁধনহারা এক ঝাঁক ছাত্র-জনতা, যুদ্ধের আদ্যক্ষরটির সাথেও যাদের পরিচয় নেই একেবারে। মাতৃভূমি রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব পালনে এ স্বেচ্ছা সৈনিকেরা মরণপণ লড়াইয়ের বাজি নিয়ে। এগিয়ে আসেন।
এ ছাত্র-জনতা ও সৈনিকেরা সম্মিলিতভাবে নরসিংদীর ক্রমাবনতিশীল আইনশৃঙ্খলার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সে সময় খাদ্যশস্যবাহী ১টি মালগাড়ি নরসিংদী স্টেশনে অবস্থান করছিল। উদ্ধৃঙ্খল কিছু লােক এ ট্রেনের খাদ্যশস্য লুট করতে উদ্যত হয়। নরসিংদী বাজারের ব্যক্তিমালিকানাধীন খাদ্যশস্যের গুদামগুলােও কিছু লােক লুট করতে যায়। এ সৈনিকেরা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনেন। আগত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের ও ইপিআর সৈনিক তথা মুক্তিযােদ্ধাদের তারা এ খাদ্যশস্য দ্বারা খাবারের ব্যবস্থা করেন। তা ছাড়া তারা ঢাকা ও অন্যান্য অঞ্চল থেকে আসা হাজার হাজার পথচারী এবং ঘরে ফেরা নারী-পুরুষ-শিশুদেরও খাবারের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তী সময় যখন মুক্তিযােদ্ধারা ১৩ অথবা ১৪ এপ্রিল নরসিংদী ত্যাগ করে আশুগঞ্জ-ভৈরব চলে যান, তখন উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য লঞ্চে করে তাদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। | আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও প্রশাসনিক এসব কাজ করা ছাড়াও এ স্বেচ্ছা। সৈনিকেরা মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে মিলে কেবল তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করেন নি, শত্রুকে প্রতিরােধ ও প্রতিহত করতে প্রাণ তুচ্ছ করে প্রভূত অবদান। রেখেছিলেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলেন: ১. নরসিংদী কলেজের অধ্যাপক আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া ২. আব্দুস সাত্তার ভূইয়া। ৩, নজরুল ইসলাম ভূইয়া। ৪. আলীজান জুট মিলের ম্যানেজার অকৃতদার মিজানুর রহমান ৫. আপেল মাহমুদ। ৬. আলী আকবর ৭. শামসুল হুদা বাচ্চু ৮. হারাধন সাহা ৯. সুভাষচন্দ্র সাহা। ১০, মতিন ভূইয়া ১১. খন্দকার গােলজার হােসেন ১২. মানিক লাল সাহা। ১৩, মনিরুজ্জামান। ১৪. ছােটো মানিক। ১৫. মেজবা উদ্দিন ইরান।
এর পূর্বে ক্যাপটেন ইকরাম মজিদ সেহগাল ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১টি সেনা দল নিয়ে আশুগঞ্জ-ভৈরব যাওয়ার পথে ২৮ মার্চ ট্রেনযােগে নরসিংদী আসেন। তিনি ২ দিন থাকেন সেখানে। ক্যাপটেন সেহগালের পিতা | লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল মজিদ সেহগাল ১৯৫৫ সালের ২৯ জুলাই থেকে ১৯৫৭ সালের ২ জুন পর্যন্ত ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সেহগাল ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি। তিনি বিয়ে করেন। বগুড়ার সারিয়াকান্দি থানার এক বাঙালি মহিলাকে। ক্যাপটেন সেহগাল এ দম্পতির সন্তান। মাতৃভূমির প্রতি ভালােবাসা এবং ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক তাকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে আসে। ঢাকা সেনানিবাস থেকে তিনি পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। নরসিংদীতে তিনি আধাে বাংলায় আধাে ইংরেজিতে জনতাকে বলেন যে, পাকিস্তান বাহিনীর এ অন্যায় যুদ্ধে অবশ্যই বাঙালিরা জয়ী হবে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবে ইনশাআল্লাহ্। | ক্যাপটেন মতিউরের নির্দেশনায় মুক্তিযােদ্ধারা পাঁচদোনার মাইল চারেক পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে ডাঙা এলাকায় একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। নেয়, একটি অগ্রবর্তী অবস্থান নেয় নরসিংদী-ঢাকা রাস্তায় মাধবদী বাজার এলাকায়, মূল প্রতিরক্ষা অবস্থান থাকে পাঁচদোনায়। ৩১ মার্চ অসামরিক ও সামরিক যানবাহনে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি সেনা দল ঢাকা থেকে নরসিংদীর | দিকে যাত্রা করে। পাকিস্তানি সেনারা নরসিংদী রওনা হয়ে মুক্তিবাহিনী দ্বারা পথিমধ্যে বাঘবাড়ি নামক স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়। পরবর্তী সময় আবারও নরসিংদী। ও পাঁচদোনার মাঝামাঝি পালবাড়ি নামক স্থানে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক পাকিস্তানি সেনারা অতর্কিতে আক্রান্ত হয়ে বহু প্রাণ দিতে হয়েছিল তাদের। এমতাবস্থায় শক্রর নিরাপদ পশ্চাদপসরণ বিপৎসংকুল হয়ে ওঠে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্যাপকভাবে আর্টিলারি ফায়ার দিতে শুরু করে আক্রান্ত সেনা দলকে নিরাপদে পিছিয়ে আনতে। আর্টিলারির গােলায় মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
আর্টিলারি গােলা বর্ষণ পরদিন ২ এপ্রিল অব্যাহত থাকে। প্রথমবারের মতাে স্যার (এফ-৮৬) বিমান উপর্যুপরি আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী অবস্থানের উপর বিমান আক্রমণে জনগণ ভীত সন্ত্রস্ত ও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। বিমানের গােলা বর্ষণে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ৭ এপ্রিল আবারও ২টি স্যাবর নরসিংদী আক্রমণ করে। নাপাম বােমা ফেলে এলাকা। জ্বালিয়ে দেয় এবং বহু মানুষ পুড়ে মারা যায়। মেশিনগানের গুলিতে অসামরিক এলাকার সমূহ ক্ষতি হয়। | এদিকে ১ এপ্রিল থেকে আশুগঞ্জ-ভৈরব-লালপুর এলাকায় ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও তেলিয়াপাড়ায় অবস্থিত মেজর খালেদ মােশাররফের ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান। নিরাপদ রাখা যাতে এ ২টি ব্যাটালিয়ন ঐ এলাকায় একত্র হয়ে সম্মিলিত যুদ্ধ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকায় ২ ও | ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একত্র হওয়ার পরিকল্পনা সম্বন্ধে অবগত হয় এবং অনুধাবন করে, এ ২টি ব্যাটালিয়নের যৌথ শক্তি মােকাবিলা করা হবে দুরূহ কাজ। কাজেই ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট একত্র হওয়ার পূর্বেই তাদের বিচ্ছিন্ন ও ধ্বংস করা ছিল পাকিস্তান বাহিনীর সর্বাত্মক প্রয়াস। শত্রুদের ভৈরব দখলের আক্রমণ পরিকল্পনা ছিল যে, তাদের ১টি আক্রমণকারী দল ব্যবহার করবে ঢাকা-নরসিংদী সড়ক, মেঘনা নদী হয়ে ১টি পাকিস্তানি সেনা দল আসবে দক্ষিণ দিক থেকে নৌযানে এবং এদের সুযােগমতাে নির্বাচিত স্থানে নামানাে হবে। তা ছাড়াও আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝামাঝি সােহাগপুরে হেলিকপটার যােগে (এমআই-৮) নামানাে হবে শত্রুর ১ কোম্পানি। নরসিংদী এলাকার রণকৌশলগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পায় এ কারণেই। ১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা ডেমরায় শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে ঢাকা| নরসিংদী রাস্তা ধরে পাঁচদোনার সন্নিকটে পালবাড়ি আক্রমণ করে বিমানবাহিনীর সহায়তায়। গত ১০ দিনে ক্ষয়ে এসেছে প্রতিরােধের শক্তি। গুলি আর খাদ্যের অভাব তীব্র। বিশেষ করে গুলি ও খাদ্যের বিতরণ ব্যবস্থায় মারাত্মক ত্রুটি দেখা দেয়। কোনাে কোনাে অবস্থানে প্রচুর গুলি থাকলেও বিতরণের ত্রুটির কারণে গুলিশূন্য হয়ে পড়ে কয়েকটি প্রতিরক্ষা অবস্থান। অন্যদিকে, রণকৌশলগত গুরুত্বে ঐ অবস্থান গুলির উপরেই শত্রুর আক্রমণ চাপ বাড়তে থাকে। লাভক্ষতির বিবেচনায় ১১ এপ্রিল বিকালে ক্যাপটেন মতিউর প্রতিরক্ষা অবস্থান। থেকে পশ্চাদপসরণের সিদ্ধান্ত নেন। হারানাের ব্যথা সব সময়ই পীড়াদায়ক, আর তা যদি হয় দেশের মাটি।
পাঁচদোনা অবস্থান বর্ণনার শেষ অঙ্কে ক্যাপটেন মতিউর রহমান বলেন, “বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে আমি মনস্থির করেছি, এ স্থান আমাদের ছাড়তে হবে। খালি হাতে জোশ দেখিয়ে বসে বসে মৃত্যুকে বরণ করার কোনাে অর্থ নেই। নায়েব সুবেদার সুলতান আর নায়েব সুবেদার মালেক আমার প্ল্যাটুন অধিনায়ক ছিলেন। আমি ব্ৰহ্মপুত্র নদের রামনগর ব্রিজের পার্শ্বে যেখানে আমার অবস্থান ছিল, সেখানে তাদের আসতে বললাম। প্ল্যাটুন অধিনায়করা আসার পর জিজ্ঞেস করলাম, কী অবস্থা? তারা বললেন, স্যার, আমি তাে ঘুরে দেখে | এলাম। জওয়ানরা প্রায় শূন্য হাতে বসা। আমি বললাম, সুলতান সাহেব, মালেক সাহেব, আমাদের এ এলাকা ছাড়তে হবে। খালি হাতে এখানে বসে মরার কোনাে অর্থ নেই। আমি কথাটা বলার সাথে সাথে ২জনই হাউমাউ করে শিশুর মতাে চিল্কার করে কেঁদে উঠলেন। বললেন, স্যার, কাপুরুষের মতাে পালিয়ে কোথায় যাব, দেশ কি স্বাধীন হবে না? তাঁদের কান্নায় আমারও দুই চোখে অশ্রু নেমে এলাে। আবেগে প্রায় ১৫-২০ সেকেন্ডের মতাে মনে হলাে, আমি চিন্তাশক্তি হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের জীবনে অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত থাকে। এ মুহূর্ত আমার জীবনে কীভাবে মূল্যায়ন করব জানি না। অনেক সময় মৃত্যু বাঞ্ছনীয় হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু তখন জীবন মনে হয় ইলাস্টিকের মতােই দীর্ঘ।” ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ২৭ মার্চ বিদ্রোহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া তাদের দখলে রাখে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তাদের অবস্থান নিরাপদ রাখার জন্য তারা আশুগঞ্জে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। পরবর্তী সময় কিশােরগঞ্জ থেকে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ও তেলিয়াপাড়ায় যােগ দিলে আশুগঞ্জ-ভৈরবের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দায়িত্ব নেয় ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। কুমিল্লা সেনানিবাস (ময়নামতি) থেকে ময়নামতি-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়ক পথে এবং কুমিল্লা-গঙ্গাসাগরআখাউড়া রেলপথে হেঁটে পাকিস্তানি সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া দখলের উদ্যোগ নেয় কয়েক বার। উভয় অক্ষে ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শক্ত প্রতিরােধের কারণে তা ব্যর্থ হয়। এখানে বহু হতাহত হয় তাদের। ঢাকা-নরসিংদী অক্ষে এবং পাচদোনায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ থেকে প্রচণ্ড বাধার কারণে তাদের অগ্রাভিযান ব্যাহত হয়। এখানেও তাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়।
৬ এপ্রিলের মধ্যে পাকিস্তান থেকে অতিরিক্ত ২টি ডিভিশন (৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং ১৬ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন) বাংলাদেশে পৌছায়। ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ২টি ব্রিগেড ৩০৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এবং ১১৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড দায়িত্ব পায় মেঘনার পূর্ব পাড়ের এলাকার। এ ২টি ডিভিশন পূর্বেকার ১৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনে যােগ দেওয়ার ফলে সামরিক ভারসাম্য বৃদ্ধি পায় পাকিস্তানি বাহিনীর। | পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ১ ব্রিগেড পরিমাণ সৈন্য নিয়ে আশুগঞ্জ-ভৈরব দখলের পরিকল্পনা করে। ১৪ এপ্রিল সকালে শুরু হওয়া এ আক্রমণে তারা জল, স্থল এবং আকাশপথে ৩টি পৃথক সেনা দল নিয়ােগ করে। পদাতিক সেনা দল ঢাকা-নরসিংদী-ভৈরব অক্ষ ব্যবহার করে। ২টি এলসিটি (LCT), ২টি গানবােট এবং ৪টি অসামরিক লঞ্চে শত্রু আশুগঞ্জের দক্ষিণে লালপুরে অবতরণের জন্য মেঘনা নদী দিয়ে অগ্রসর হয়। আশুগঞ্জ ও আজবপুরের মাঝে সােহাগপুরে কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের পাকিস্তানি সেনারা অবতরণ করে। ৬টি এফ-৮৬ স্যাবর জেট ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ভৈরব, আশুগঞ্জ, লালপুর ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর উপর্যুপরি আক্রমণ করতে থাকে। বিমান আক্রমণ ১৫ এপ্রিল ভাের সাড়ে ৫টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৪ এপ্রিল আক্রমণের শুরু থেকেই নরসিংদী হয়ে আনা আটিলারি গানগুলাে বিরামহীনভাবে গােলা বর্ষণ করতে থাকে। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে এ আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে অস্ত্র, সৈন্য, বেতারযন্ত্র, বিমানবিধ্বংসী কামানের অভাব ও সীমাবদ্ধতা নিয়েও। ২ দিন যুদ্ধ করার পর তাদের যুদ্ধ ক্ষমতা হ্রাস পায় এবং হতাহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ১৫ এপ্রিল রাতের অন্ধকারে তারা পশ্চাদপসরণ শুরু করে।
১৬ এপ্রিল সকালের মধ্যে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়া-হবিগঞ্জ সড়কে শাহবাজপুরে তিতাস নদীর পূর্ব তীরে একটি অগ্রবর্তী অবস্থান রেখে মাধবপুরে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করে। মধ্য এপ্রিলে আশুগঞ্জ-ভৈরবের এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকা-ডেমরা-নরসিংদী-ভৈরব বাজার সড়ক তাদের প্রধান যােগাযােগ পথ (Line of Communication) হিসেবে ব্যবহার করে। নরসিংদীর রণকৌশলগত গুরুত্ব এখানেই। ১৩-১৪ এপ্রিল বিকালে ক্যাপটেন মতিউর রহমান তাঁর সৈনিকদের নিয়ে নরসিংদী ত্যাগ করেন। তিনি ঘুরপথ হয়ে আশুগঞ্জ-ভৈরবের ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের নেয়া প্রতিরক্ষা অবস্থানে যােগ দেন। অধিনায়ক মেজর সফিউল্লাহর নির্দেশে তিনি তার কোম্পানি নিয়ে ভৈরব বাজার রেল স্টেশনের পশ্চিমে রামনগর রেলসেতুর উভয় পার্শ্বে নরসিংদীর দিকে মুখ করে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। ক্যাপটেন মতিউর রহমানের নরসিংদী ত্যাগের পর নরসিংদীতে আর প্রচলিত সৈন্যের উপস্থিতি রইল না। কিন্তু তাতে নরসিংদীতে যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে নি। ছাত্র-জনতা যারা ক্যাপটেন মতিউর রহমানের সাথে ১ এপ্রিল থেকে ১৩-১৪ এপ্রিল পর্যন্ত যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা ১০ দিনের প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা লাভ করে। যুদ্ধ ভীতি কেটে যায় তাদের। আম জনতাও বিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে ওঠে যে, তারাও পারে এবং ভালােভাবেই পারে। এদের অনেকে ১৩-১৪ এপ্রিল ক্যাপটেন মতিউর রহমানের সাথে আশুগঞ্জভৈরব চলে যায় । কিন্তু স্বেচ্ছা সৈনিকদের অধিকাংশই থেকে যান নরসিংদীতে ।
১১ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যরা নরসিংদী প্রবেশ করে এবং গণহত্যা, অগ্নিসংযােগ ও অবাধ নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। এলাকায় থেকে যাওয়া মুক্তিযােদ্ধারাও তাদের অবস্থা উপলব্ধি করেন এবং অবস্থানও পরিবর্তন করেন। এঁরা যথাযথভাবে উপলব্ধি করেন যে, সম্মুখসমরে পাকিস্তানি শক্রদের পরাভূত করা সম্ভব নয়। মােকাবিলা করতে হবে তাদের অপ্রস্তুত অবস্থায়, যেখানে তারা মুক্তিবাহিনীকে কল্পনা করবে না। এবং যেখানে তারা দুর্বল এবং আক্রমণ করে স্থান দখলে না রেখে দ্রুত স্থান ত্যাগ করা। একই সাথে তারা শত্রুর পব্রজে চলাচলকারী দল ও গাড়িতে যাতায়াতকারী দলের উপরও আক্রমণ করতে থাকেন। এ আক্রমণ পরিচালিত হতে থাকে সমন্বয়হীন ও অগভীর পরিকল্পনার মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন মুক্তিযােদ্ধার এ দলগুলাে পরবর্তী পর্যায়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে প্রয়াস পায়। তারা তাদের অপারেশন এলাকাও ভাগ করে নেয়। এ পর্যায়ে তাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাব দেখা দেয়। মে মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে অর্থাৎ ক্যাপটেন মতিউর রহমানের নরসিংদী ত্যাগের পর থেকে ছাত্র-যুবকেরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাওয়া শুরু করেন। ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ১ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ত্যাগ করে হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়া চা-বাগানে আশ্রয় গ্রহণ করে। ২ এপ্রিল ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তেলিয়াপাড়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে একত্র হয়। তারা। তেলিয়াপাড়ায় ১টি প্রশিক্ষণ ক্যাল্প প্রতিষ্ঠা করে। ছাত্র-যুবকদের প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপ্ত হয় তেলিয়াপাড়া ক্যাম্পে এবং প্রশিক্ষিত এ তরুণদের অধিকাংশই ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে যােগ দেয়। ভারতে গমনকারী। তরুণদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষ করতে কয়েক মাস সময় লেগে যায়। মূলত ২ ধরনের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপিত হয় ভারতে (ত্রিপুরা রাজ্যে)। প্রথমটি ২ ও ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তত্ত্বাবধানে যথাক্রমে হজামারা ও মতিনগরে।
দ্বিতীয়টি ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে লােহারবন, ইন্দ্রনগর, ওপিনগর এবং অন্যান্য স্থানে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও দেশে ফেরত আসার মধ্যে প্রায় ২ মাসের এ সময়সীমা মুক্তিযুদ্ধের ক্ষীণ কাল। অস্ত্র ও গােলাবারুদের অভাবে এ সময় যুদ্ধের মান, সংখ্যা ও তীব্রতা হ্রাস লক্ষ্য করা যায়। স্বাভাবিক কারণেই এ সময়টা সশস্ত্র যুদ্ধের একটি ক্রান্তি কাল। স্বল্প যুদ্ধ মাত্রায় (Low Intensity Operation) এ সময়টির বড়াে চ্যালেঞ্জ ছিল জনগণের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কার্যকর করে কীভাবে জিইয়ে রাখা যায়। জুন মাসের শুরু থেকেই ২ নম্বর ও ৩ নম্বর সেক্টর থেকে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা নরসিংদী প্রবেশ করতে থাকেন। তাদের প্রবেশের সাথে সাথে অস্ত্র ও গােলাবারুদের চাহিদা আপাতত ও বহুলাংশে পূরণ হয়। সবচেয়ে বড় কথা, জনগণ পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে। ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা ভাগ অনুযায়ী নরসিংদী ৩ নম্বর সেক্টরের আওতাভুক্ত। কিন্তু বাস্তবে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা এখানে যুদ্ধ করেন। রেইড, অ্যামবুশ ছাড়াও মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন ধরনের অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস, গ্যাস সরবরাহ লাইন ধ্বংস, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কেন্দ্র ধ্বংস করার জন্য ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ বিশেষ মুক্তিযােদ্ধা দল তৈরি করে এক্সপ্লেসিভ ও ডেমােলিশনের উপর তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি তাদের দায়িত্ব দেন ঘােড়াশাল ও নরসিংদীর শিল্পাঞ্চল অচল করে দেয়ার।
মেজর খালেদ মােশাররফ বলেন, “আমার হেডকোয়ার্টারসে অন্ততপক্ষে চার হাজার গেরিলা সে সময় প্রশিক্ষণরত ছিল। এদের আমি বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বিশেষ বিশেষ ধরনের গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতি শিক্ষা দিচ্ছিলাম। ১টি দলকে শিক্ষা দিচ্ছিলাম ডেমােলিশন (বিস্ফোরক) ব্যবহার – যাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে যত রাস্তা ও রেলসেতু আছে, সেগুলাে ধ্বংস করে দেওয়া – যাতে শত্রুরা অনায়াসে যাতায়াত করতে না পারে এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি সেনা দল তাদের রেশন ঠিকমতাে পৌছাতে না পারে। তা ছাড়া এ দলটির আরও কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে – কিছু মনােনীত শিল্পকে সাময়িকভাবে অকেজো করে দেওয়া। বিশেষ করে ঐসব শিল্প, যাদের তৈরি মাল পাকিস্তান বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এসব শিল্প অকেজো করার সময় আমাকে অনেক সতর্কতার সাথে পরিকল্পনা করতে হয়েছে, যেহেতু সব শিল্পই আমাদের দেশের সম্পদ এবং ঐগুলাে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলে পরবর্তী সময় স্বাধীনতার পর আমাদের নিজেদেরই আবার সংকটের সম্মুখীন হতে হবে, সে কারণে প্রতিটি টার্গেট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার পর পরিকল্পনাগুলােকে যথেষ্ট বিবেচনার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হতাে এবং তার পরই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতাম। শিল্পগুলােকে ধ্বংস না করে এগুলােকে সাময়িক অকেজো করার এক অভিনব পদ্ধতি আমি খুঁজে পাই। আমার সেক্টরের বেশির ভাগ শিল্প ঢাকার চারপাশে ঘােড়াশাল ও নরসিংদীতে অবস্থিত ছিল।
আমি জানতে পেরেছি যে, এসব শিল্পের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি সাধারণত সাজিবাজার পাওয়ার হাউজ ও কাপ্তাই থেকে পাওয়ার লাইনের মাধ্যমে আসে। আমি আমার গেরিলাদের প্রথম টার্গেট দিই ঐসব পাওয়ার লাইন উড়িয়ে দেয়ার জন্য। প্রতি সপ্তাহে ২০টি টিম বিভিন্ন এলাকায় পাওয়ার লাইনের পাইলন ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প এলাকাগুলােতে বন্ধ হয়ে যায়।” গণযােদ্ধাদের পরিচালিত বিভিন্ন অপ্রচলিত যুদ্ধ ১৯৭১ সালের প্রেক্ষাপটে বিচার্য। অভিজ্ঞতা, রণকৌশলগত জ্ঞান ও যথাযথ প্রশিক্ষণের অভাবে যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি ও মাত্রা আজকের বিশ্লেষণে ত্রুটিপূর্ণ, অসংলগ্ন ও ভ্রান্ত মনে হতে পারে। বাস্তবেও ছিল তাই। ত্রুটিপূর্ণ রেকি ও পরিকল্পনা এবং কখনাে কম কখনাে প্রয়ােজনাতিরিক্ত শক্তি ব্যবহারের দৃষ্টান্তও প্রচুর। এ বৈশিষ্ট্য যুদ্ধের প্রাথমিক সময়ের। মেজর খালেদ মােশাররফ মুক্তিযােদ্ধাদের বলতেন যে, যুদ্ধের মাঠই তােমাদের প্রশিক্ষণ একাডেমি। বাস্তবে মুক্তিযােদ্ধারা যুদ্ধ করেই যুদ্ধ শিখেছেন। কয়েক দিনের বা কয়েক সপ্তাহের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নয়। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের পর থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পরিচালিত যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন লক্ষণীয়। পূর্বের ন্যায় তাঁরা অস্ত্রের কার্যকরী দূরত্বের বাইরে থেকে গুলি করেন নি, অপ্রয়ােজনীয় স্থানে এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করেন নি, প্রয়ােজনাতিরিক্ত লােকবল ব্যবহার থেকে বিরত থেকেছেন। যদিও এর ব্যতিক্রমও ছিল। দেশপ্রেমের প্রণােদনা কখনাে তাদের মাত্রাতিরিক্ত সাহসী করে তুলেছে। প্রচলিত যুদ্ধের পুথিগত বিদ্যার বাইরে এঁরা নব উদ্ভাবিত রণকৌশল ব্যবহার করেছে। নিজেদের সীমিত জ্ঞান দিয়ে, কখনাে হেরেছে, কখনাে জিতেছে। এঁদের যুদ্ধ জয়-পরাজয়ের ফলাফল দিয়েই শুধু নয়; মুক্তিযােদ্ধাদের আঙ্গিকে যুদ্ধ বিচার করতে হবে। একটি জাতির স্বাধীনতা অর্জনে জনযুদ্ধের বিচারে যেখানে দেশপ্রেম, বুকভরা সাহস আর সুতীব্র আবেগই মুখ্য।
বাঘবাড়ি যুদ্ধ
সাধারণ
২৫ মার্চ রাতে ঢাকার পিলখানাস্থ ইপিআর সদর দপ্তর থেকে প্রাণে বেঁচে আসা এক দল ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) সদস্য এবং ক্যাপটেন মতিউরের নেতৃত্বাধীন ১টি কোম্পানি নরসিংদী সদর থানাস্থ ময়েজ উদ্দিন ফকিরের আশ্রমে অবস্থান নেয়। প্রাথমিক অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর কোনােরূপ সাংগঠনিক কাঠামাে তৈরি হয় নি। প্রথম দিকে যারা ছড়ানাে-ছিটানােভাবে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশের সদস্য ও অন্যান্য নিয়মিত বাঙালি সেনা সদস্যকে বিভিন্নভাবে সাহায্য করতেন, তারাই পরবর্তী সময় প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান। ঐ সময়ে নেহাব গ্রামের পাকিস্তান নৌবাহিনীর সদস্য সিরাজউদ্দিন আহমেদ ছুটিতে আসেন (তিনিই পরবর্তী সময় নেভাল সিরাজ হিসেবে খ্যাতিমান হন) এবং পরবর্তী সময় ছুটি থেকে ফেরত না গিয়ে নিজ মাতৃভূমির মায়াজালে আবিষ্ট হয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। মূলত নরসিংদী সদর থানায় সকল প্রকারের বড়াে/খণ্ডযুদ্ধ তাঁর প্রত্যক্ষ/পরােক্ষ নেতৃত্বে সমাধা হয়। ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যদের সাথে নেভাল সিরাজ ৩-৪ এপ্রিল গােপন বৈঠকে মিলিত হয়ে সিদ্ধান্ত নেন যে, ঢাকা। থেকে নরসিংদীর দিকে অগ্রসরমান পাকিস্তানি বাহিনীকে যে-কোনাে উপায়ে বাধা দিতে হবে।
উদ্দেশ্য
শত্রুর অগ্রাভিযান প্রতিহত করা।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, ৯ এপ্রিল আনুমানিক বেলা ৩-৪টার মধ্যবর্তী সময়ে বাঘবাড়ি (তারা পুকুর পাড়) নামক স্থানে, যা পাঁচদোনা ব্রিজ থেকে ৮ কিলােমিটার পশ্চিমে (ঢাকার দিকে), শত্রুপক্ষের উপর ঝটিকা আক্রমণ করবেন।
পরিস্থিতি/পটভূমি
নরসিংদী দখলের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা থেকে নরসিংদী সদর অভিমুখে বিপুল পরিমাণে অস্ত্র, গােলাবারুদ ও অন্যান্য সরঞ্জামসহ প্রধান সড়ক ধরে যাত্রা শুরু করেছে। উল্লিখিত সংবাদ পাওয়া মাত্র শত্রুর ঐ অগ্রাভিযান। নস্যাৎ করে দেওয়ার জন্য ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা ইপিআর সদস্যরা এবং নেভাল সিরাজের নেতৃত্বে কয়েকজন গ্রামবাসী বাঘবাড়িতে অবস্থান নেন।
যুদ্ধের বর্ণনা
৯ এপ্রিল দুপুর ৩টার পূর্বেই ইপিআর ও নেভাল সিরাজের দল বাঘবাড়িস্থ তারা পুকুরপাড়ে অবস্থান নেয় এবং অধীর আগ্রহে বসে থাকে পাকিস্তানি বাহিনীর অগ্রবর্তী দলটির জন্য। ঐ যুদ্ধে এক পক্ষে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ব্যাটালিয়ন এবং অপর পক্ষে ইপিআর এবং আশপাশের গ্রামের কিছু গণযােদ্ধা মিলে প্রথমে ১০জনের ১টি দল পরবর্তী সময় ২০-২৫জনের ১টি দল তাদের সাথে অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেকের চোখেমুখে ছিল ক্রোধ ও ভীতির ছায়া। কারণ, তাদের কাছে তেমন কোনাে ভারী অস্ত্র অথবা অত্যাধুনিক অস্ত্র ছিল না বললেই চলে। এমতাবস্থায় বিকাল আনুমানিক ৪টার সময় পাকিস্তানি বাহিনীর প্রথম। দলটি কিছু যান্ত্রিক গাড়িসহ মুক্তিযােদ্ধাদের নাগালের মধ্যে চলে আসে এবং সাথে সাথে পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযােদ্ধারা প্রবলভাবে গুলি ছুড়তে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী প্রাথমিকভাবে এত শীঘ্রই মুক্তিবাহিনীর কাছ থেকে এত ত্বরিতগতিতে এরূপ বাধা পাবে, তা কোনােভাবেই আন্দাজ করতে পারে নি। ফলে তারা উপায়ান্তর না দেখে ডানে-বামে ছােটাছুটি করতে থাকে। পরবর্তী। সময় অবশ্য তারা একত্র হয়ে পালটা গুলি বর্ষণ শুরু করে। রাত ৪টা পর্যন্ত এ যুদ্ধ চলতে থাকে। এমতাবস্থায় শত্রুরা শক্তিবৃদ্ধি করে তিন দিক থেকে। মুক্তিবাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থান ত্যাগ করে পিছু হটে যান। ঐ যুদ্ধে সিরাজ ছাড়াও অংশগ্রহণকারী অন্য মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. ইমামুদ্দিন ২. অহিবুর রহমান ৩. ওসমান গনি। ৪. আবদুল হাকিম ৫. ড. আবদুল খালেক ৬. ড. রফিক এবং নাম-না-জানা আরও অনেকে।
ফলাফল
বাঘবাড়ি সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের পরিমাণ অনেক বেশি ছিল এবং তাদের ৩টি ট্রাক এ অপারেশনে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়েছিল। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর হতাহতের পরিমাণ ছিল নিতান্তই কম, ২-১জন শুধু গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কিন্তু শক্রর অত্যাধুনিক যুদ্ধসামগ্রী এবং প্রচণ্ড চাপের মুখে শেষ পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কোনাে আদর্শের ভিত্তিতে যুদ্ধ করে নি। ফলে তাদের মনােবল খুবই কম ছিল। পরে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী হতচকিত হয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর নরসিংদী আসার ব্যাপারে কোনােরূপ তথ্যের নিরাপত্তা অথবা আকস্মিকতা ছিল না বললেই চলে। যার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজেদের সুবিধা | মােতাবেক পরিকল্পনা করা সম্ভবপর হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী: মুক্তিবাহিনীর সঠিক উদ্দেশ্য সামনে ছিল বলেই বিভিন্ন প্রতিকূলতার মাঝেও মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল ছিল আকাশচুম্বী। দৃঢ় মনােবলের কারণেই সুসজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে অল্পসংখ্যক মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা করেছিল। তাদের মধ্যে সর্বদাই একটা আক্রমণাত্মক মনােভাব বিরাজ করছিল, যার ফলে তারা জনগণের সহায়তায় তা বাস্তবে রূপদান করেছিল। তথ্যের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছিল বলেই পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান। সম্পর্কে মােটেই ওয়াকিবহাল ছিল না।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড