পালবাড়ির যুদ্ধ
সাধারণ
বাঘবাড়ি যুদ্ধের পর ইপিআর (বর্তমানে বিজিবি) ও নেভাল সিরাজের দলটি পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরবর্তী সময় ক্যাপটেন মতিউর ও নেভাল সিরাজের গােপন বৈঠকের সিদ্ধান্ত মােতাবেক পরিকল্পনা হয় যে, আনুমানিক ১১ এপ্রিল পালবাড়িতে (বাঘহাটা) আবারও পাকিস্তানি সেনাদের অগ্রযাত্রাকে প্রতিহত করতে হবে।
উদ্দেশ্য
শত্রুর অগ্রাভিযানকে প্রতিহত অথবা বাধাগ্রস্ত করা।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
আনুমানিক ১১ এপ্রিল (সঠিক তারিখ পাওয়া যায় নি) সকাল ১০টার সময় পালবাড়ি নামক স্থানে (পাঁচদোনা ব্রিজ থেকে ১ কিলােমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত) মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি/পটভূমি ৯ এপ্রিলে বাঘবাড়ি যুদ্ধে প্রচুর হতাহতের পর পাকিস্তানি সেনারা পরবর্তী যেকোনাে পরিস্থিতির জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত ছিল। এমতাবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা নিজেদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ সমন্বয়সাধন জোরদার করে এবং পূর্ববর্তী যুদ্ধ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে পালবাড়ি এলাকায় শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
যুদ্ধের বর্ণনা
পাঁচদোনা সেতুর ১ কিলােমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত পালবাড়ি এলাকাটি গাছগাছালিতে সম্পূর্ণভাবে পরিপূর্ণ। তদানীন্তন ঢাকা-নরসিংদী মহাসড়কটি পালবাড়ি গ্রামের মধ্য দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে বিস্তৃত এবং পাশের ভূমি থেকে ৮-১০ ফুট উঁচু। এ যুদ্ধে ক্যাপটেন মতিউরসহ নেভাল সিরাজ এবং ইপিআর ও উৎসুক জনগণের ৪০-৫০জনের ১টি দল ছিল এবং অপরপক্ষে। পাকিস্তানি সেনাদের ১টি ব্যাটালিয়ন ভারী অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নরসিংদী সদর অভিমুখে যাত্রা করছিল। পথিমধ্যে উল্লিখিত তারিখে বাঘহাটা নামক স্থানে। পাকিস্তানি সেনাদের প্রথম দলটি উপস্থিত হলে আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে মুক্তিবাহিনী প্রথমে গুলি ছুড়ে। সত্যিকার অর্থে মুক্তিযােদ্ধারা দুই দলে ভাগ হয়ে রাস্তার দুই পাশ থেকেই সড়ক পথে আগত শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ করছিলেন।
ফলে প্রাথমিকভাবে একটু সমস্যা হলেও পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনারা নিজেদের গুছিয়ে পালটা গুলি বর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এভাবে সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত এ খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে এবং একপর্যায়ে পাকিস্তানি সেনাদের বর্ধিত সেনা সাহায্য (Re-inforcement), এমনকি বিমান হামলাও শুরু হয়। অবশেষে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় এবং পাকিস্তানি সেনাদের অত্যধিক চাপের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন।
ফলাফল
পালবাড়ি যুদ্ধে দুই পক্ষেরই তেমন কোনাে হতাহতের তথ্য পাওয়া যায় নি। তবে পাকিস্তানি সেনাদের চাপের মুখে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও টিকতে না পেরে মুক্তিযােদ্ধারা পালবাড়ি এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হন। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনারা নরসিংদী শহরে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করতে সক্ষম হয় এবং টাউন হল, টিঅ্যান্ডটি ভবন, ইউএমসি পাটকল ও চৌয়ালা বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। ঢাকার সাথে যােগাযােগ করার জন্য পাকিস্তানি সেনারা খাটেহারা ব্রিজ ও পাঁচদোনা ব্রিজের নিরপত্তা জোরদার করেছিল। শিক্ষণীয় বিষয়। ক. পাকিস্তানি বাহিনী: তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিবাহিনীকে তেমনভাবে সঠিক মূল্যায়ন করতে পারে নি। ফলে বরাবরই তাদের আকস্মিকতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। মুক্তিবাহিনী: অপেক্ষাকৃত কম প্রশিক্ষিত এবং যৎসামান্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিযােদ্ধারা সঠিক দিক নির্দেশনা এবং পর্যাপ্ত গুলির অভাবে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল।
রায়পুরা মেথিকান্দা রেল স্টেশনে হানা
সাধারণ
১৯৭১ সালের এপ্রিল। ঢাকা-নরসিংদী সড়ক পাকিস্তানি সেনা মুক্ত রাখার জন্য যখন ৩ নম্বর সেক্টরের ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর ও অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা চেষ্টা চালাচ্ছিলেন তখন পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ নরসিংদী এলাকায় সেনা প্রেরণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের মুখে মুক্তিযােদ্ধারা। (ক্যাপটেন মতিউরের নেতৃত্বে ১ কোম্পানি ইপিআর সদস্য ও অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধা) যদিও পিছু হটে যান তবু বিচ্ছিন্নভাবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা। পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভিন্ন সময়ে তারা। পাকিস্তানি সামরিকবাহিনী তথা সরকারকে কাবু এবং নিজেদের শক্তিশালী করার জন্য বিভিন্ন রেইড, অ্যামবুশ ও নাশকতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। এরই অংশ হিসেবে রায়পুরা মেথিকান্দা রেল স্টেশনে হানা দিয়ে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি সেনা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা করেন। উদ্দেশ্য রায়পুরা মেথিকান্দা রেল স্টেশনে রায়পুরা থানার পুলিশ সদস্যদের উপর। অতর্কিতে হানা দিয়ে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়া।
স্থান ও সময়
মেথিকান্দা রেল স্টেশন গ্রিডসূত্র ৯৭০৫৭৫, বাংলাদেশ ম্যাপ শিট নম্বর ৭৯। আই/১৮। রায়পুরা মেথিকান্দা রেল স্টেশনটি রায়পুরা থানা সদর থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনের উপর অবস্থিত। রায়পুরা থানা সদরটি নরসিংদী থেকে রেলপথ বরাবর ১৫ কিলােমিটার পূর্বে এবং বর্তমানে ঢাকাসিলেট মহাসড়কের বারৈচা নামক স্থানের ৫ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এ আক্রমণটি ১৯৭১ সালের ১৫ এপ্রিল সংঘটিত হয়।
পরিস্থিতি/পটভূমি
মুক্তিযােদ্ধা দারুল ইসলাম এপ্রিল মাসের দিকে ৫-৬জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে। রায়পুরা থানা সদরের আশপাশে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। ঐ দলের অধিকাংশ সদস্য ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ছিলেন। ঐ সময় ১৪ এপ্রিল জনৈক রিকশাওয়ালা জুমা মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক দারুল ইসলামের কাছে সংবাদ দেন যে, রায়পুরা পুলিশ থানা সদর থেকে সমস্ত অস্ত্র ও গােলাবারুদ এসআই মান্নানের নেতৃত্বে ১৫ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ মহকুমা সদরের উদ্দেশ্যে যাওয়ার জন্য সকালে মেথিকান্দা রেল স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠবে। ঐ সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা আরও সাের্সের মাধ্যমে ঐ তথ্যের সত্যতা যাচাই করেন। মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন যে, মেথিকান্দা রেল স্টেশনে যখন অস্ত্রগুলাে নেয়ার জন্য জমা করা হবে, তখন অতর্কিতে তাদের উপর হামলা চালিয়ে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ছিনিয়ে নেয়া হবে।
যুদ্ধের বর্ণনা
মুক্তিযােদ্ধা দারুল ইসলাম তার নেতৃত্বে আরও ৬জন মুক্তিযােদ্ধা এবং ১০জন অসামরিক জনগণ নিয়ে ১টি দল গঠন করেন। গতি, গােপনীয়তা ও ক্ষিপ্রতাই এ অপারেশনের মূল উপাদান বলে বিবেচিত হয়। ১৫ এপ্রিল সকাল ১০টায় পুলিশ ও ৭-৮জন শত্রু সেনা (অনুমান অনুযায়ী তদানীন্তন ইপিআর অথবা পুলিশের সদস্য) মেথিকান্দা স্টেশনে জমায়েত হয় এবং ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। শক্রর উপর আক্রমণের জন্য মুক্তিযােদ্ধারা আগে থেকেই প্রস্তুত ছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর অসতর্কতার সুযােগ নিয়ে রেললাইনের পশ্চিম দিক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতে তাদের উপর হামলা করেন। এতে এসআই মান্নান ও বাকিরা অস্ত্র ও গােলাবারুদ রেখে পালিয়ে যায়। এ আক্রমণে অত্যন্ত কম সময়ের জন্য গুলি বিনিময় হয় (মতান্তরে কোনাে গােলাগুলির প্রয়ােজনই হয় নি বা ফাকা গুলি করা হয়)। স্বল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা। সেখান থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে পালিয়ে যান। কেননা, অদূরেই পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরােধ গড়ে তােলে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস, ক্ষিপ্রতা ও উদ্যমের ফলে তারা এ অপারেশনে সাফল্য লাভ করেন।
ফলাফল
এ অপারেশনে ২৪টি .৩০৩ রাইফেল, ১টি রিভলভার ও ১ বাক্স গ্রেনেড উদ্ধার করা হয়। এ অপারেশনে মেথিকান্দা রেল স্টেশনে ৭-৮ বছরের এক ছেলে মারা যায়। এ অপারেশনটি ছিল মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকের অপারেশন। কাজেই এর সাফল্যের ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়ে যায় এবং উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গােলাবারুদ পরবর্তী সময় আরও মুক্তিযােদ্ধা সংগঠনে এবং অভিযান পরিচালনার কাজে ব্যবহৃত হয়। উল্লেখ্য, এ অস্ত্র ও গোলাবারুদগুলাে ২ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক গফুরের কাছে দেওয়া হয়, যা তিনি পরবর্তী সময় অন্য মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে বন্টন করেন।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক. সময়ােপযােগী তথ্য ১টি ক্ষুদ্র দলকেও শত্রুর বিরুদ্ধে বিরাট সাফল্য এনে দিতে পারে। খ, অভিযানে ক্ষিপ্রতা ও সাহসের সাথে আচমকা শত্রুর উপর ঝাপিয়ে পড়লে কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন সম্ভব। গ. পাকিস্তানি বাহিনীর নিরিখে এটা স্পষ্ট যে, যুদ্ধকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ। অস্ত্র ও গােলাবারুদ বহনের সময় সেটি যে-প্রকারই হােক না কেন, উচু মানের সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড