ব্রাহ্মণদী স্কুলে এসএসসি পরীক্ষাকেন্দ্রে রেইড
সাধারণ
১৯৭১ সালে এপ্রিলের পরে অর্থাৎ মে থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতাে নরসিংদী সদর থানাতেও মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষ থেকে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে নি বললেই চলে। তবে পাকিস্তানি সেনারা তথা পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে অবগত করতে চেয়েছিল যে, বাংলাদেশে সব জায়গায় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অন্যদিকে, মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রমাণ করেছিলেন যে, দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল না। তারই একটি অংশ হিসেবে ব্রাহ্মণদী স্কুলের এসএসসি পরীক্ষা ভন্ডুল করা হয়েছিল।
উদ্দেশ্য
এসএসসি পরীক্ষা ভন্ডুল করার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করা যে, অত্র এলাকায় তথা বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে না।
যুদ্ধের স্থান ও সময়
ব্রাহ্মণদী উচ্চমাধ্যমিক স্কুলটি নরসিংদী রেল স্টেশনের ৫০০ গজ উত্তর পাশে অবস্থিত। ঘটনার সঠিক তারিখ খুঁজে পাওয়া যায় নি। তবে সবার সাথে আলাপচারিতায় জানা যায় যে, এপ্রিল মে মাসের যে-কোনাে ১টি দিনে সকাল। ৯টা-১১টার মধ্যে মুক্তিবাহিনী কর্তৃক উল্লিখিত স্কুলে ঝটিকা আক্রমণ করা হয়েছিল।
পরিস্থিতি/পটভূমি
এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে জুলাই মাসের শেষ পর্যন্ত সত্যিকার অর্থে নরসিংদী সদর থানা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কোনােরূপ কার্যক্রম ছিল না বললেই চলে। পাকিস্তানি বাহিনী পুরাে এলাকাটি সুষ্ঠুভাবে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছিল। এমতাবস্থায় ঐ স্কুলটিতে ম্যাট্রিক পরীক্ষার ১টি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কেন্দ্রটিতে এপ্রিল-মে মাসে ম্যাট্রিক পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি চলছিল। এর কয়েক দিন আগে পাকিস্তানিরা একই এলাকায় নিরস্ত্র জনগণের উপর বিভিন্নভাবে নির্যাতনের মাধ্যমে জনজীবন বিপর্যস্ত করে তােলে।
যুদ্ধের বর্ণনা
প্রধানত পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর আপ্রাণ চেষ্টা ছিল বাংলাদেশে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা বিশ্ববাসীর কাছে প্রমাণ করা। তাদের সাথে যােগ দেয় দেশীয় কিছু বাঙালি দোসর। বিভিন্ন দিক চিন্তা করে পাকিস্তানি সেনারা অত্র অঞ্চলে ব্রাহ্মণদী স্কুলটিকেই পরীক্ষাকেন্দ্র হিসেবে নির্বাচন করে। পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার নিমিত্তে পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিশসহ পাকিস্তানি সেনাদের মােতায়েন করা হয় এবং নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা শক্রর এ পরিকল্পনা নস্যাৎ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তাই হাবিলদার মজনু মৃধার নেতৃত্বে ১০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল নরসিংদী শহরের ব্রাহ্মণদী স্কুলে পরীক্ষার নিরাপত্তায় নিয়ােজিত শত্রুর উপর স্কুলের তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। ফলে পরীক্ষার্থীসহ এলাকায় প্রচণ্ড ভীতির সঞ্চার হয়। যে যেভাবে পারে পরীক্ষাকেন্দ্র থেকে দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করে। ফলশ্রুতিতে পরীক্ষা সম্পূর্ণভাবে ভন্ডুল হয়ে যায়।
ফলাফল
এ ঝটিকা আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী পরীক্ষাকেন্দ্রে পরীক্ষা অনুষ্ঠানে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের এরূপ অতর্কিত হামলায় বেশ কিছু পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। তবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কোনােরূপ হতাহত হয় নি।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, পাকিস্তানি বাহিনী: এপ্রিল-মে মাসে মুক্তিবাহিনীর তরফ থেকে উল্লেখযােগ্য কোনােরূপ কর্মকাণ্ড ছিল না বলে পাকিস্তানি সেনারা ঐ সময়টিকে খুব হালকাভাবে নিয়েছিল। প্রতিপক্ষকে তারা কোনােরূপ গুরুত্বই দেয় নি। এত বড়াে একটি গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড পরিচালনায় পাকিস্তানি সেনারা তেমন কোনাে জোরদার নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। মুক্তিবাহিনী: শত্রুর দুর্বল অবস্থান নির্ণয় করতে সক্ষম হওয়ায় মুক্তিবাহিনী শত্রুর ক্ষয়ক্ষতি করতে সফল হয়েছিল। শত্রু সম্পর্কে সঠিক সময়ে নির্ভুল তথ্যসংগ্রহ করা, গােপনীয়তা ও আকস্মিকতা বজায় রাখতে সক্ষম হওয়ার দরুন মুক্তিযােদ্ধারা সহজেই শত্রুর উপর। হামলা পরিচালনা করে সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
বানিয়াদির যুদ্ধ
সাধারণ
স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র সংগ্রামের আহ্বানে নরসিংদী মহকুমার (বর্তমান নরসিংদী জেলা) শিবপুর থানায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চলে প্রশিক্ষণ। উদ্দেশ্য একটাইপাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে দিতে হবে শােষণের দাঁতভাঙা জবাব। মুক্তিবাহিনীর প্রাক প্রশিক্ষণের সংবাদ পেয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী শিবপুর থানায় টহল বৃদ্ধি করে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের টহল রাস্তা হিসেবে মাছিমপুর ইউনিয়নের ভিতর দিয়ে নরসিংদী থেকে শিবপুর থানায় টহল দিত। শিবপুব-নরসিংদী সড়কের উভয় পাশে, দক্ষিণ মাছিমপুর ইউনিয়নে বানিয়াদি গ্রাম অবস্থিত।
উদ্দেশ্য
বানিয়াদি অ্যামবুশের উদ্দেশ্য ছিল ২টি।
ক. শিবপুর থানায় প্রশিক্ষণরত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করা।
খ, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মনােবলের উপর আঘাত হানা।
স্থান ও সময়
সময়টা ছিল ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ এবং স্থান বানিয়াদি গ্রাম। শিবপুর-নরসিংদী একটি আধা পাকা সড়ক, যা শিবপুর থানার সাথে নরসিংদী সদরের যােগাযােগ রক্ষা করে। শিবপুর থানা থেকে ১ কিলােমিটার দক্ষিণে মাছিমপুর ইউনিয়ন। এ মাছিমপুর ইউনিয়নের শিবপুর-নরসিংদী সড়কের উভয় পার্শ্বে বানিয়াদি গ্রাম অবস্থিত। পটভূমি/পরিস্থিতি স্বাধীনতা যুদ্ধের সশস্ত্র প্রতিরােধের শুরুতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের টহল রাস্তায় সন্দেহের উদ্রেক করে, এমন সব জায়গায় অবস্থিত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিত। তিন রাস্তার মিলন স্থল ছিল এ বানিয়াদি গ্রামে। পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ইচ্ছামতাে যে-কোনাে স্থানে গাড়ি থামিয়ে জনগণকে গুলি করে হত্যা করতাে এবং বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দিত। নির্বিচারে গ্রামবাসীর উপর চালাত অমানবিক নির্যাতন। শুরু হয় সুযােগের অপেক্ষা। যেভাবেই হােক ধ্বংস করতে হবে শত্রু বাহিনীকে, এ মানসিকতা ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে অধিনায়ক হাবিলদার। মজনু মৃধা এগিয়ে আসেন এবং সম্পন্ন করেন প্রয়ােজনীয় প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা।
যুদ্ধের বর্ণনা
সময়টা ছিল মে মাসের প্রথম সপ্তাহ। অধিনায়ক মজনু মৃধা বৃদ্ধি করেন। গােয়েন্দা তৎপরতা। চলে শত্রুর সম্ভাব্য আগমন ও গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর। পরদিন প্রতীক্ষার অবসান ঘটে। পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি গাড়ি বহর নরসিংদী-শিবপুর আধা পাকা সড়ক দিয়ে আসতে থাকে। বানিয়াদি গ্রামের তিন রাস্তার মাথায় শিবপুরের দামাল ছেলেরা ওত পেতে অ্যামবুশ অবস্থানে বসে থাকেন। অধিনায়ক মজনু মৃধা, হারুন ও ওসমানসহ এ দলের লােকসংখ্যা ছিল। ২৫জন। পূর্ব ও দক্ষিণ পাশে অবস্থান ছিল অধিনায়ক মজনু মৃধার । হারুন ও ওসমানসহ ১টি দল মজনু মৃধার দল থেকে ৩০০ মিটার দূরে অবস্থান গ্রহণ। করে। একসময় অপেক্ষার অবসান ঘটে। শত্রু অ্যামবুশ অবস্থানে প্রবেশের সাথে সাথে চলে প্রচণ্ড আক্রমণ। শত্রু আকস্মিক আক্রমণে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে এবং এলােপাতাড়ি গুলি বর্ষণ করতে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে উভয় পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলতে থাকে। শিবপুর থানার গার্লস স্কুলে ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প, যা ছিল অ্যামবুশ স্থল থেকে ১ কিলােমিটার দূরে। কিছুক্ষণের মধ্যে সেখান থেকে শত্রু বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধি করার জন্য পাকিস্তানি সেনারা উপস্থিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী উভয় পাশ থেকে আক্রমণ করে। পরিস্থিতি মূল্যায়নপূর্বক মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক হাবিলদার মজনু মৃধা। পশ্চাদপসরণের আদেশ দেন। স্বল্প সময়ের এ অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনী, পাকিস্ত নি হানাদার বাহিনীর গাড়ি বহর ও সৈন্যদের ক্ষতিসাধন করে এবং পূর্বপরিকল্পিত নিরাপদ স্থানে চলে যায়। এ অ্যামবুশে বেশ কয়েকজন শত্রু। হতাহত হয় এবং গাড়ি বহরের ব্যাপক ক্ষতিসাধন হয়। বীর মুক্তিযােদ্ধা মমতাজ উদ্দিন খন্দকার এ অ্যামবুশে শহিদ হন।
ফলাফল
এ অ্যামবুশের ফলাফল মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষেই যায়, কারণ তারা আকস্মিকতা। অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিল এবং শত্রুর গাড়ি বহরের ক্ষতিসাধন ও শত্রুবাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য হতাহত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিক্ষণীয় বিষয় ক. দুর্বল পরিকল্পনা: সঠিক পরিকল্পনা করে যে-কোনাে অভিযান পরিচালনা করলে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছানাে সম্ভব। পূর্বপরিকল্পিতভাবে পশ্চাদপসরণ করলে অহেতুক প্রাণহানির আশঙ্কা এড়ানাে যেত। খ, সঠিক স্থান নির্বাচন; এ অ্যামবুশের স্থান নির্বাচন সঠিক ছিল না। অ্যামবুশ স্থল থেকে মাত্র ১ কিলােমিটার দূরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। যার ফলে, আকস্মিকতা অর্জিত হলেও মুক্তিযােদ্ধারা উল্লেখযােগ্য সফলতা অর্জনে সক্ষম হন নি। কারণ, পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাপ থেকে অন্য সৈন্যদের সাহায্য ঘটনাস্থলে দ্রুত চলে এসেছিল।
পুটিয়া ব্রিজ এলাকার যুদ্ধ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দিকে নরসিংদী, শিবপুর ইত্যাদি এলাকায় অনেক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। সেখানকার কৃষক ও ছাত্র সংগঠনগুলাে ছিল বেশ শক্তিশালী। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর অনুসারীরা এখানে শক্ত অবস্থানে ছিলেন। শহিদ আসাদ ছিলেন এ এলাকার ছেলে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই এলাকার জনগণ, পুলিশ, আনসার, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যরা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি শক্তিশালী দল ছিল নরসিংদী শহরে। নরসিংদী থেকে শিবপুরের দূরত্ব মাত্র ৮ কিলােমিটার। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নরসিংদী থেকে শিবপুর যাওয়া-আসা করত। মধ্যবর্তী স্থানে ছিল পুটিয়া বাজার। সেখানকার একটি ব্রিজ পার হয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মনােহরদী, বেলাবাে ইত্যাদি এলাকায়ও যাওয়া-আসা করত। তখন সেখানে ছিল একটি মাত্র রাস্তা। এ রাস্তায় পুটিয়া বাজারের মধ্যে ছিল একটি ব্রিজ। এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিলেন যে, যদি এ ব্রিজটি ধ্বংস করা যায় তাহলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী শিবপুরে সহজে আসতে পারবে । ফলে শিবপুরের মুক্তিযােদ্ধাদের আরও সংগঠিত করা যাবে এবং এলাকাটি মুক্তাঞ্চল হিসেবে গঠন করা যাবে।
ইতােমধ্যে এলাকার রাজনৈতিক নেতা হায়দার আনােয়ার খান জুনাের নেতৃত্বে এলাকার প্রায় ১০০জন তরুণ আগরতলায় গিয়ে নির্ভয়পুর সাবসেক্টরের অধিনায়ক ক্যাপটেন মাহবুবুর রহমানের কাছ থেকে ২৮ দিনের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে শিবপুর এলাকায় ফেরত আসেন। আসার পূর্বে ক্যাপটেন মাহবুব তাদেরকে রাইফেল, গুলি, স্টেনগান, গ্রেনেড, এক্সপ্লোসিভ ও ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনে সজ্জিত করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। পাঠান। দলটি শিবপুরে এসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মজনু মৃধার সঙ্গে যােগাযােগ করেন। মজনু মৃধা পাকিস্তানের শিয়ালকোট থেকে ছুটিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। তিনি ৫ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মজনু মৃধা শিবপুর এলাকায় কিশাের-তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। কিছু হাতিয়ার জোগাড় করে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। সাহসী ও উদ্যোগী মজনু মৃধা অল্প সময়ে কিংবদন্তি হিসেবে পরিচিত হন। | ১২ আগস্ট পুটিয়া বাজারের ব্রিজ থেকে কয়েক’শ গজ দূরে অবস্থান নেন। মজনু মৃধা, হায়দার আনােয়ার খান জুনাে, তাজুল ইসলাম খান ঝিনুক, শামসুজ্জামান মিলন, আমজাদ, ফজলু, বেণু, আফতাব, ইয়াসিনসহ ১৮জন। মুক্তিযােদ্ধা। গ্রামের পাশে একটি গােয়াল ঘরের আড়ালে থেকে তারা ব্রিজটি পর্যবেক্ষণ করেন। উদ্দেশ্য কীভাবে ব্রিজটি ধ্বংস করা যায়। ব্রিজটি প্রায় ৩০ গজ লম্বা এবং নিচে একটি ছােটো নদী। রেকি সম্পন্ন হলাে। এখন পরিকল্পনার পালা। | মজনু মৃধা, হায়দার আনােয়ার খান জুনাে, তােফাজ্জল ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা মান্নান ভূঁইয়া আলাপ করেন যে, এলাকার সবচেয়ে সাহসী ও অভিজ্ঞ মুক্তিযােদ্ধাদের এ গুরুত্বপূর্ণ অপারেশনে নেয়া হবে। এ খবর পেয়ে এলাকার বিভিন্ন ক্যাম্পের মুক্তিযােদ্ধারা প্রচণ্ড আগ্রহ দেখান এবং অধিনায়কদের অনুরােধ করতে থাকেন।
কাকে ছেড়ে কাকে নেবেন এ নিয়ে অধিনায়করা সমস্যায় পড়েন। এলাকার কিশাের মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক সবার কাছে বিনীত নিবেদন করতে থাকেন যেন তাকে এ যুদ্ধে নেয়া হয়। যেহেতু ফজলুল হকের বয়স খুব কম তাই তার নাম তালিকায় ওঠে নি। কিন্তু নাছােড়বান্দা ফজলু। তিনি হাবিলদার মজনু মৃধার কাছে এসে অনুরােধ করেন – “মামু, যুদ্ধে যাইতাম, পাঞ্জাবি মারতাম।” মজনু মৃধা বললেন যে, তাের কোনাে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নাই, তাের বয়স কম, তুই তাে ভালােমতাে রাইফেল চালাতে পারবি । ফজলু আবার অনুরােধ করলেন এ বলে যে, তিনি রাইফেল চালানাে শিখে ফেলেছেন এবং যুদ্ধে গেলে সে পাঞ্জাবি মেরে দেখাবেন সবাইকে। মজনু তার। কথায় কান দিলেন না। তখন ফজলু অন্যান্য বয়স্ক মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে গিয়ে আবার একই অনুরােধ করতে থাকলেন। তার অনুরােধে ফল হলাে। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা মজনু মৃধাকে অনুরােধ করলেন যে, ফজলু বেশ সাহসী ও বুদ্ধিমান। আর তার যুদ্ধে যাওয়ার যখন এত ইচ্ছা তখন তাকে এ যুদ্ধে নিয়ে একটা সুযােগ দেওয়া যেতে পারে। অধিনায়ক হাবিলদার মজনু মৃধা বিরক্ত হয়ে কাছে। দাঁড়ানাে ফজলুকে বললেন, “চল যুদ্ধে, মরার যখন এত শখ তখন মরতেই চল।” ফজলু খুশিতে টগবগ। ৩০জন মুক্তিযােদ্ধাদের দলে তাকে অপারেশনের। জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। | সিদ্ধান্ত হলাে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে ব্রিজটি ধ্বংস করা হবে। ব্রিজ ধ্বংসের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অগ্রসরমান সৈন্যদেরকে আক্রমণ। করা হবে। অপারেশনের জন্য ১টি এলএমজি, ২টি এসএমজি, ১৮টি ৩০৩ রাইফেল নেয়া হয়। তা ছাড়াও ২টি ট্যাংকবিধ্বংসী মাইন ও প্রত্যেকের কাছে ২টি করে গ্রেনেড দেওয়া হয়। বেস ক্যাম্প থেকে ৫ কিলােমিটার দূরে ছিল ব্রিজটি।
ভােররাতের পূর্বে মুক্তিবাহিনীর দলটি ব্রিজের কাছে পৌছে। সাথে সাথেই ১টি রেকি প্যাট্রল ব্রিজের কাছে পাঠানাে হয় এবং রিপোের্ট পাওয়া যায় যে, ব্রিজের কাছে শক্রর কোনাে অবস্থান নাই। তখন মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজের পাশে অবস্থান গ্রহণ করেন। যেহেতু তাদের কাছে কোনাে এক্সপ্লোসিভ ছিল না সুতরাং পদার্থবিদ্যার মেধাবী ছাত্র হায়দার আনােয়ার খান জুনাে এবং নির্ভয়পুরের এক্সপ্লোসিভ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা ঝিনুক ট্যাংকবিধ্বংসী মাইনের প্রেসার মেকানিসম খুলে ১ ফুট লম্বা পি কে ফিউজ লাগিয়ে অনেকগুলাে গ্রেনেড তার সঙ্গে একত্রে স্থাপন করে ব্রিজের পিলারের নিচে লাগিয়ে দেয়। যার যা কাজ তাঁকে তা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ব্রিজ উড়ানাের দায়িত্ব ছিল জুনাে আর ঝিনুকের। সবার মধ্যেই। উত্তেজনা বিরাজমান। অনেক তরুণ যােদ্ধার জন্য এটাই প্রথম যুদ্ধের স্বাদ। সিদ্ধান্ত হয় সকাল ৫টায় ব্রিজটি ধ্বংস করা হবে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫টার একটু আগে ফিউজে আগুন লাগান জুনাে। আগুন লাগানাের পরে তিনি দৌড়ে কিছু দূরে অবস্থান গ্রহণ করেন। এ কাজে ফজলু অতি উৎসাহে সবার সঙ্গে যােগ দেন।
মজনু মৃধা চিৎকার করে সবাইকে বলেন, “মুখ হা করাে, দুই কানে হাত দাও।” মুহুর্তের মধ্যে বিস্ফোরণের শব্দ শােনা যায়, ব্রিজের একাংশ ধ্বংস হয়েছে, কিন্তু আশানুরূপ কাজ হয় নি। ব্রিজের যতটুকু ধ্বংস হয়েছে তা হয়ত পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতি অল্প সময়েই মেরামত করবে। চিন্তিত মজনু মৃধা। কিন্তু একটু পরেই দেখা গেল শত শত মানুষ আশপাশের গ্রাম থেকে হাতুড়ি, শাবল, গাঁইতি ইত্যাদি নিয়ে ব্রিজের কাছে দৌড়ে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্রিজের মধ্যের অংশটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য। একটু পরেই মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামবাসীদের এলাকা ত্যাগ করতে অনুরােধ করলেন। কারণ, ব্রিজ ধ্বংস হওয়ার খবরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চলে আসবে এবং গ্রামবাসীদের উপর নির্যাতন চালাবে। কিন্তু গ্রামবাসীরা এলাকা ত্যাগ করতে রাজি না। অনেক অনুরােধের পর তারা এলাকা ত্যাগ করলেন কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য রুটি ও ডিম ভাজি নিয়ে আসলেন। কৃতজ্ঞচিত্তে ক্ষুধার্ত মুক্তিযােদ্ধারা খাবার খেয়ে নিলেন পেট ভরে। এখন পরবর্তী যুদ্ধের পালা। অধিনায়ক মজনু মৃধা মুক্তিযােদ্ধাদের বােঝালেন। যে, পাকিস্তানি সৈন্যরা নিশ্চয়ই ব্রিজ ভাঙার খবর পেয়ে গেছে এবং সম্ভবত কিছুক্ষণ পরেই এ এলাকায় এসে পৌছাবে আর তখনই তাদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করতে হবে। তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের ব্রিজের অপর দিকের অবস্থান দেখিয়ে সেখানে অবস্থান গ্রহণ করতে নির্দেশ দিলেন এবং অতি দ্রুত কিছু পরিখা খননের নির্দেশ দিলেন। ভাঙা ব্রিজের এক পাড়ে এলএমজি নিয়ে মজনু মৃধা কিছু দূরে আর ঢিবির ডান দিকে ফজলু অবস্থান নিলেন। মজনুর নির্দেশ ছিল যেহেতু গুলি সীমিত সুতরাং অযথা গুলি নষ্ট করা যাবে না। প্রথম গুলি করবে মজনু মৃধা এবং তারপর প্রত্যেকে টার্গেট দেখে দেখে গুলি করবেন। ফজলুর অবস্থান ছিল প্রতিরক্ষার প্রায় মাঝখানে।
প্রায় ২ ঘন্টা প্রতীক্ষার পর ৬ ট্রাক বােঝাই পাকিস্তানি সৈন্য ব্রিজ থেকে প্রায় ২০০ গজ দূরে অবস্থান গ্রহণ করে। ব্রিজের কাছে যখন তারা পৌছে তখন মজনু মৃধার এলএমজি থেকে গুলি শুরু হয়, অব্যর্থ লক্ষ্য। লুটিয়ে পড়ল অগ্রসরমান। বেশ কিছু শত্রু সৈনিক। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান উঁচুতে, সুবিধাজনক স্থানে। গর্জে উঠল মুক্তিযােদ্ধাদের এসএমজি ও রাইফেল। আরও কিছু পাকিস্তানি সেনা মাটিতে পড়ে গেল। তাদের মধ্যে অগ্রসর হওয়ার প্রবণতা ব্যাহত হয়েছে বলে মনে হলাে এবং তাদের বেশ ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বােঝা গেল। তবুও পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তাদের অবস্থান থেকে ক্রমাগত গুলি চালাতে থাকে। কিছুক্ষণ পর পাকিস্তান। সেনাবাহিনীর অবস্থান থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে যায়। অভিজ্ঞ মজনু মৃধা বুঝতে পারেন যে, হয়ত পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের অবস্থান কিছুটা রদবদল করে আবার গুলি চালনা শুরু করবে। মুক্তিযােদ্ধা জুনাে ক্রলিং করে মজনু মৃধার অবস্থানে গিয়ে দেখেন, তিনি তার এলএমজিটা চেক করছেন। মজনু তাকে বললেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু তারা শীঘ্রই আক্রমণের চেষ্টা করবে। মুক্তিযােদ্ধারা কীভাবে আছে দেখে আসা প্রয়ােজন এবং তাদেরকে গুলি সরবরাহ করার এটাই উপযুক্ত সময়। আমার পিছনে ক্রলিং করতে করতে আসুন। তাঁরা ২জন মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে গিয়ে তাদেরকে গুলি সরবরাহ করে প্রয়ােজনীয় উপদেশও প্রদান করেন। ফজলুর অবস্থানের কাছে আসতেই মজনুকে দেখে হঠাৎ করে উত্তেজিত ফজলু দাড়িয়ে উঠে চিল্কার করে বললেন, “মামু আমি তিনটা পাঞ্জাবিকে শ্যাষ করছি, কইছিলাম না পাঞ্জাবি খতম করুম।” মজনু চেষ্টা করলেন ফজলুকে দাঁড়াতে বারণ করতে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেল। মুহূর্তেই একটি গুলি এসে ফজলুর দেহ ভেদ করল।
কি জানি বলতে চাইলেন ফজলু। একটু আওয়াজ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। আবার চলল দুই পক্ষের গােলাগুলি। মজনু দ্রুত ফজলুকে ধরাধরি করে পিছনের নিচু জমিতে নিয়ে গেলেন। ২জন মুক্তিযােদ্ধা তাকে সহযােগিতা করলেন। তারা পাশের স্কুলঘর থেকে একটি তক্তা নিয়ে আসলেন এবং ফজলুকে বেঞ্চে শশায়ানাে হলাে। রক্তে রক্তাক্ত বেঞ্চটি। ১জন মুক্তিযােদ্ধা চিল্কার করে বললেন, “ডাক্তার আনা যায় না?” ইতােমধ্যে গােলাগুলির এক পর্যায়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান ত্যাগ করতে শুরু করল এবং তাদের তরফ থেকে গুলি আসাও বন্ধ হয়ে গেল। ফজলুকে ধরে রেখে মজনু মৃধা সবাইকে ধীরে ধীরে নিচের দিকে সরে যেতে নির্দেশ দিলেন। ফজলুর বুকে-পিঠে কাপড় প্যাচানাে হলাে যা সঙ্গে সঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে গেল। একটি তক্তার উপরে শুইয়ে তাকে নিয়ে সহযােদ্ধারা ক্যাম্পের দিকে রওয়ানা দিল। সে সময় ফজলু আবার ক্ষীণ কণ্ঠে মজনুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “মজনু মামু, পাঞ্জাবি মারলাম এবং নিজেও মরলাম।” ডুকরে কেঁদে উঠলেন মজনু মৃধা। তিনিইতাে বলেছিলেন, “চল যুদ্ধে, মরার যখন এত শখ তখন মরতেই চল।” তার কথাই কি সত্যি হলাে। একটু পরেই ফজলু শাহাদতবরণ করলেন। মুক্তিযােদ্ধারা ফজলুর মরদেহ নিয়ে তাদের শিবিরে রওনা দিলেন। ইতােমধ্যে মজনু মৃধা ও মুক্তিযােদ্ধা আমজাদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত অবস্থানের দিকে এগিয়ে গেলেন। শত শত গ্রামবাসী ধেয়ে আসছে। প্রথমে পাওয়া গেল ১জন ক্যাপটেনের মৃতদেহ। তার নেমপ্লেটে দেখা গেল নাম – সেলিম। মুক্তিযােদ্ধারা তার টুপি, ব্যাজ ও পিস্তলটি সংগ্রহ করলেন। আরও পাওয়া গেল ২টি চাইনিজ রাইফেল, ৭ বাক্স গুলি। পুটিয়ার যুদ্ধের অপমানজনক পরাজয়ের ৩ দিন পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
পুটিয়া বাজারে আগুন লাগিয়ে দেয়। নিরীহ জনগণের উপর চালায় নির্যাতন। কিশাের মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক তার জীবনের প্রথম যুদ্ধে তাঁর সহযােদ্ধাদের বিজয় এনে দিলেন। এ যুদ্ধে তিনি অনেক চেষ্টা করে সামিল হয়েছিলেন এবং দেশমাতৃকার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ ত্যাগ করে গেলেন। কিশাের ফজলুল হক অত্যাচারিত জাতির প্রতি অঙ্গীকার ও দায়বদ্ধতা পালন করতে গিয়ে তার জীবনটাকেই জাতিকে উপহার দিলেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড