কামারখােলা-পাইকশার যুদ্ধ
মুন্সিগঞ্জ জেলার সর্ব পশ্চিমের থানা শ্রীনগর। এর দক্ষিণে লৌহজং। দুই থানার মাঝখানে শ্রীনগর খাল। খালের পাশেই গােয়ালিমান্দার হাট। উভয় থানাতেই পাকিস্তানি সৈন্যদের শক্ত ঘাঁটি ছিল। রাজাকারদের সহায়তায় তারা আশপাশের গ্রামগুলােতে প্রবেশ করে লুটতরাজ ও নারীনির্যাতন চালাত। গােয়ালিমান্দার হাট থেকে প্রায় ২ কিলােমিটার উত্তরে খালের পশ্চিমে কামারখােলা গ্রাম। কামারখােলা গ্রামের পূর্বে শ্রীনগর খালের ওপারে উত্তর ও দক্ষিণ পাইকশা গ্রাম। ২৯ নভেম্বর দ্বিপ্রহরে লােকমুখে সংবাদ পাওয়া যায়, এ গ্রামের দিকে শত্রু আসছে। ১৬জন পাকিস্তানি সৈন্য, ১০জন ইপিসিএএফ এবং বাকি সবাই রাজাকার। ২টি ছােটো আকারের লঞ্চে তারা আসতে থাকে। আতিকুল্লা খান মাসুদ তার মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে প্রস্তুতি নেন। কাজীর পাগলায় অবস্থানরত সুবেদার মেজর সােলেমানের কাছেও খবর পাঠানাে হয়। ভাগ্যকুলের সেকশনকেও জানানাে হয়। ধীরগতির লঞ্চে এগােতে এগােতে মুক্তিযােদ্ধাদের ৩টি দল একত্রিত হয়ে সুবিধাজনক অবস্থান গ্রহণ করে। ৩টি দলই গােয়ালিমান্দার হাটে মিলিত হয় এবং কিছুটা অগ্রসর হয়ে কামারখােলা গ্রামে অ্যামবুশ পেতে শত্রুর অপেক্ষায় থাকে। শত্রুর লঞ্চ ২টি এগােতে থাকে। এক পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধাদের রেঞ্জের মধ্যে আসার সাথে সাথে শুরু হয় ফায়ার। প্রায় ২ ঘণ্টা অবিরাম গুলি বিনিময় চলে। ১৫জন শত্রু সৈন্য ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পালানাের পথ না থাকায় তারা। মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা আবার যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে গেলে আতিকুল্লা খান মাসুদ ক্রলিং করে শক্রর নিকটবর্তী স্থানে চলে যান। তিনি পর পর কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারলে আত্মগােপনকারী আরও ৪জন শত্রু মারা পড়ে। ১জন রাজাকারসহ ৭জন পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে। যুদ্ধ শেষে ২টি এলএমজি, ৩৪টি .৩০৩ রাইফেল এবং প্রায় ২০০০টি .৩০৩ রাইফেলের গুলি উদ্ধার করা হয়। গােয়ালিমান্দার যুদ্ধের আদলের এ যুদ্ধও। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
ভবেরচর এলাকার শেষ যুদ্ধ
ডিসেম্বরের শুরুতেই পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সম্ভাব্য পরিণতি উপলব্ধি করতে শুরু করে। কুমিল্লা সেনানিবাসের ইউনিট দাউদকান্দি এলাকায় মােতায়েন ছিল। ঢাকার ইউনিট মােতায়েন ছিল মেঘনা নদীর পশ্চিম এলাকায় অর্থাৎ বাউসিয়া থেকে মহাসড়ক বরাবর ঢাকা পর্যন্ত। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই ভারতীয় বাহিনী কুমিল্লা সেনানিবাস অবরােধ করে ফেলে। ফলে এ সেনানিবাস থেকে বিভিন্ন স্থানে মােতায়েন শত্রুর ক্যাম্পগুলােয় খাবার, গোলাবারুদসহ সব । সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে, বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পগুলাে থেকে আহত-নিহত সৈন্যদেরকে মূল ক্যাম্পে পাঠানাে অসম্ভব হয়ে পড়ে। বাস্তবিক অর্থেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্পে অবরুদ্ধ হয়ে যায়। তাদের ক্যাম্প ছাড়া বাকি এলাকা চলে আসে মুক্তিবাহিনীর দখলে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের ভয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের খাবার সংগ্রহের জন্য আশপাশের বাজার বা এলাকায়। বের হতে পারত না। এ অবস্থায় তারা ছােটো ছােটো অবস্থান ত্যাগ করে আশপাশের ক্যাম্পে গিয়ে নিজেদের শক্তিবৃদ্ধি করার চেষ্টা করে। গজারিয়াদাউদকান্দি এলাকা নদীবহুল হওয়ায় ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক ছাড়া তাদের। চলাচলেরও কোনাে উপায় ছিল না। ৫ ডিসেম্বর ভবেরচর কাঠের ব্রিজে আগুন দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য, পাকিস্তানি । সৈন্যরা যেন ঢাকার দিকে যেতে না পারে। ব্রিজটি ভস্মীভূত না হয়ে ব্যবহারযােগ্য থেকে যায়। ৬ ডিসেম্বর শত্রুরা ভবেরচর ব্রিজের আনুমানিক ১ কিলােমিটার দূরে ঢাকার দিকে অবস্থিত আলীপুর গ্রামে আগুন দেয় এবং ১৩জন লােককে হত্যা করে। আগের দিনও তাদের ৭জনের ১টি দল ১টি মাইক্রোবাসে ভবেরচর কাঠের ব্রিজ এলাকায় এসে শিশু-কিশােরসহ বহু লােককে গুলি করে হত্যা করে। কয়েকজন কিশাের ভয়ে পাশের কবরস্থানে কবরের ভিতর আশ্রয়। নেয়। নরপশুরা কবরের ভিতর বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে তাদের হত্যা করে। এবং একই মাইক্রোবাসে করে চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা সংবাদ পেয়ে ছুটে আসেন। কিছুক্ষণ পর ২ ট্রাক বােঝাই পাকিস্তানি সৈন্য আসে ঢাকার দিক থেকে। এরা কাঠের ব্রিজের কাছে এসে হেঁটে অগ্রসর হতে থাকে মুক্তিবাহিনী। এদের উপর গুলি ছুড়েন। পাকিস্তানি সৈন্যরাও পালটা জবাব দেয়। কিন্তু অবস্থা। বেগতিক তারা তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে ঢাকার দিকে ফেরত যায় । ব্রিজের বাংকারে অবস্থানরত শত্রু সৈন্যরা সেগুলাে ছেড়ে বাউসিয়ার দিকে চলে যায়।
এবং থেকে থেকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে গুলি করতে থাকে। এভাবে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পর্যায়ক্রমে অবশিষ্ট পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌযানের অভাবে মেঘনা নদী পার হতে না পেরে বাউসিয়ার চর এলাকায় আশ্রয় নেয়। ৯ ডিসেম্বর ভােরে মুক্তিযােদ্ধা নজরুল ইসলাম তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে চর এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণ করাতে যান। তারা তখন ফরাজিকান্দির চরে অবস্থান। করছিল। মুক্তিবাহিনীর আগমনে তারা তাদের অস্ত্র এক স্থানে পাকারে রেখে একটু দূরে মাথার উপর হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাড়িয়ে থাকে। এটা লক্ষ্য করা যায় নি যে, শক্রর এক সৈনিক খড়ের নিচে গ্রেনেডের পিন খুলে লিভার পা দিয়ে চাপা দিয়ে রেখেছে। নজরুল ও তার সহযােদ্ধারা এগিয়ে কাছে গেলে সৈন্যটি গ্রেনেডের উপর থেকে তার পা সরিয়ে নেয় এবং তারা সবাই তৎক্ষণাৎ নদীর দিকে লাফিয়ে পড়ে। প্রচণ্ড শব্দে গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হয়। অধিনায়ক নজরুল সবাইকে সতর্ক করে পজিশনে যেতে বলেন। কিন্তু ততক্ষণে গ্রেনেডের স্প্রিন্টারের আঘাতে তার দেহ ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অন্য ৬জনও আহত হন। পরবর্তী সময় সকল (মােট ১১জন) সৈন্যকে হত্যা করে তাদের সব অস্ত্র দখল করা হয়।বেদেরবাড়ি (মুন্সিরহাট) যুদ্ধ মুন্সিগঞ্জ জেলার সদর থানার প্রায় ২ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে একটি গ্রামের নাম মুন্সিরহাট। মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের চাপে পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করতে থাকে। তারা কেন্দ্রমুখী হতে গিয়ে চর কেরওয়ার গ্রামের দিকে রওনা দেয়। কিন্তু যাওয়ার পথে নদী পার হতে বেশ বিপত্তির মধ্যে পড়ে তারা পারাপারে ব্যস্ত পাকিস্তানি সেনাদের উপর মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করেন। শেষ পর্যন্ত শত্ৰু ব্যর্থ হয়ে মুন্সিগঞ্জে ফিরে যায়।
১৯৭১ সালের ৭ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর ১টি জঙ্গিবিমান ঢাকা শহরে বােমা বর্ষণ করতে এসে বিধ্বস্ত হয়। বিমানের পাইলট স্কোয়াড্রন লিডার কে ডি মেহতা হরিরামপুর থানার অদূরে প্যারাসুট দিয়ে আহত অবস্থায় অবতরণ করেন। ৮ ডিসেম্বর কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা তাকে প্রয়ােজনীয় চিকিৎসা প্রদানের জন্য নৌকাযােগে আগরতলায় পৌছানাের উদ্দেশ্যে গজারিয়া অভিমুখে রওনা হন। তারা গজারিয়া থানা থেকে গানবােট যােগে আগত পাকিস্তানি সেনাদের দেখতে পান। শক্রর গানবােট মেঘনা নদীর কালীপুরা লঞ্চঘাটের কাছে আসতেই মিত্র বাহিনীর জঙ্গিবিমানের কোপানলে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় বােমা বর্ষণ। শত্রুও গানবােট থেকে পালটা গুলি বর্ষণ শুরু করে। চলৎশক্তি হারিয়ে গানবােটটি চরে গিয়ে ভিড়ে। এতে পাকিস্তানি সেনাদের বেশ ক্ষতি হয়। গানবােটে আগুন ধরে যায়। তারা নদীর মাঝখানে চরে আশ্রয় নেয়। বেঁচে থাকা শত্রু চরে লুকিয়ে থাকে। ৯ ডিসেম্বর কুমিল্লা সেনানিবাসের পতন ঘটে। ফলে গােটা এলাকায় বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের মনােবল ভেঙে পড়ে। সত্যিকার অর্থে তারা প্রাণে বাচার পথ খুঁজতে থাকে। শেষ অবধি এদের কয়েকজন ছাড়া সে। পথ তারা খুজে পায় নি।
মােজারপুর ফেরি/লঞ্চঘাটের যুদ্ধ
বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত অভিযান তখন শেষ পর্যায়ে। দেশের সর্বত্র মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত গতিতে এগিয়ে চলেছে। শত্রু সৈন্যরা প্রচণ্ড চাপের মুখে তাদের ছােটোখাটো বিচ্ছিন্ন ঘাঁটিগুলাে ছেড়ে দিয়ে কেন্দ্রীভূত হতে বাধ্য হচ্ছে। ঢাকার আশপাশের শত্রু অবস্থান থেকে তারা ঢাকার দিকে পালাতে ব্যস্ত। এ সময় বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের অসংখ্য খণ্ডযুদ্ধ হয়। শত্রুর মনােবল তখন সর্বনিমে। মুক্তিযােদ্ধারা পলায়নমান শত্রুর উপর আক্রমণের সম্পূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় পাকিস্তানি সৈন্যরা হরগঙ্গা কলেজের স্থাপনা ছেড়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে ধলেশ্বরী নদী পার হয়ে মুক্তারপুর চরে আশ্রয় নেয়। উদ্দেশ্য, নিকটবর্তী শক্ত ঘাঁটি ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ পৌছানাে। মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকা বা নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার এটিই একমাত্র ফেরি ও লঞ্চঘাট। ১২ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা ধলেশ্বরী নদীর দক্ষিণ পাড়ে চরমুক্তারপুরে অবস্থানরত পলায়নমান পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হন। এতে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রভূত ক্ষতি হয়। মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট থেকে কাটপট্টি গুদারাঘাট পর্যন্ত পথিমধ্যে বেশ কয়েকটি স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে শত্রুর খণ্ডযুদ্ধ হয়। সর্বশেষ ১৫ ডিসেম্বর বিকালে পাকিস্তানি সেনারা চরমুক্তারপুর ছেড়ে নারায়ণগঞ্জ বন্দরের দিকে চলে যায়। চলে যাওয়ার পথেও মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর উপর আক্রমণ করেন। এ যুদ্ধে কমপক্ষে ৩জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। তাদের ফেলে যাওয়া ১টি জি-৩ রাইফেলসহ বহু অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড