You dont have javascript enabled! Please enable it!
লৌহজং থানা আক্রমণ
লৌহজং মুন্সিগঞ্জের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত একটি প্রত্যন্ত থানা। দক্ষিণে বিশাল পদ্মা নদী। থানায় ডিউটিতে নিয়ােজিত ছিল বাঙালি পুলিশ ও রাজাকার। পাকিস্তানি সৈন্যরা এখানে থাকে না। মাঝে মাঝে নৌপথে এখানে আসে, আবার চলে যায়। থানাটি দখল করা গেলে পুলিশ ও রাজাকারদের অত্যাচার বন্ধ হবে আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এখানে আসার আগ্রহ ও প্রয়ােজন ফুরিয়ে যাবে। তা ছাড়া থানায় রক্ষিত অস্ত্র ও গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে আসবে। তাই মুক্তিযােদ্ধারা থানাটি দখল করার পরিকল্পনা করেন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। মশদগাঁওয়ের গিয়াসউদ্দিনের বাড়িতে লৌহজং তথা বিক্রমপুরের মুক্তিযােদ্ধারা লৌহজং থানা আক্রমণের লক্ষ্যে সমবেত হন। মুন্সিগঞ্জ থেকে শহীদুল আলম সাঈদ, আনিস, থােকা, হেলাল, হুমায়ুন, নজরুল, মিলনসহ ১৫জন মুক্তিযােদ্ধা এবং কোলাপাড়া থেকে মালেক, আউয়ালসহ ১০জন এবং স্থানীয় (লৌহজং) যােদ্ধাদের মধ্যে ছিল। সেন্টু, ইকবাল, গনি, আখতার, গিয়াসসহ ২০জন মুক্তিযােদ্ধা, মােট প্রায় ৪৫জন মুক্তিযােদ্ধা এ আক্রমণে অংশ নেন। গােটা দলকে ২টি উপদলে ভাগ করা হয়। রাত ১২টার সময় ৬টি কেরাই নৌকা করে তারা ঘােড়দৌড় পুলের পূর্ব পাশে দপ্তরি বাড়ির কোণে একত্রিত হন। বিলম্বে হলেও এখানেই আক্রমণের বিস্তারিত পদ্ধতি নিয়ে আলােচনা করা হয়। আখতার ও গনি ছিল পাকিস্তান বিমানবাহিনীর সাবেক সদস্য। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। ঠিক হলাে প্রথম দল ঘােড়দৌড় পুলের পাশে নৌকা রেখে অস্ত্রসহ হেঁটে খাল পাড়ি দিয়ে থানার উত্তর পাশে অবস্থান নেবে। দ্বিতীয় দল নৌকা করে ঘােড়দৌড় পুলের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে থানার সামনে দিয়ে লৌহজং মেডিক্যালের পাশে থাকবে। ওখান থেকে তারা খালের পাড় ঘেঁষে ক্রলিং করে থানা সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে অর্থাৎ পশু হাসপাতালের সাথে থাকবে। দ্বিতীয় দলে অস্ত্র ছিল ১টি এলএমজি, ৮টি এসএলআর, ৪টি এসএমজি, ৯টি ৩০৩ রাইফেল এবং কিছু গ্রেনেড ।
প্রথম দল পরিকল্পনা অনুযায়ী অবস্থান নেয়। দ্বিতীয় দলের অবস্থান গ্রহণকালীন শক্রর দৃষ্টিগােচর হলে প্রথম দল কভারিং ফায়ার দেবে। পরিকল্পনা মতাে ও নির্বিঘ্নে ২টি দলই অবস্থানে চলে যায়। পূর্বের আদেশ অনুযায়ী দ্বিতীয় দল গ্রেনেড ছুড়ে মারার মাধ্যমে আক্রমণের সূচনা করে। শুরু হয় আক্রমণ। থানা থেকে কোনাে গুলি আসে নি। পুলিশ, রাজাকাররা চিৎকার করতে থাকে, ‘মুক্তিযােদ্ধা ভায়েরা আমরা ছেরেন্ডার, আমরা ছেরেন্ডার’ । বিনা যুদ্ধে লৌহজং থানা দখল হয়ে যায়। থানা থেকে ৬৫টি .৩০৩ রাইফেল, ২টি রিভলভার, ৬টি বন্দুক এবং ১২ বাক্স গুলি উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
ভাটেরচর ব্রিজ অ্যামবুশ
১৪ আগস্ট রাতে ভাটেরচর ব্রিজ ধ্বংস করার পর পাকিস্তানি বাহিনী মহাসড়ক ব্যবহারের উপযােগী রাখার জন্য ৪টি ফেরি দিয়ে পারাপার শুরু করে এবং ফেরির নিরাপত্তার জন্য ভাটেরচর ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বে বাংকার ও প্রহরার ব্যবস্থা করে। মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল, এ মহাসড়কের উপর যাতায়াতকারী শত্রুকে অ্যামবুশের মাধ্যমে এবং শক্রর বাংকার ও অবস্থান রেইড করার মাধ্যমে তাদের নাজেহাল, হয়রানি ও হত্যা করা। ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর থেকে গজারিয়া এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের নির্দেশ দেওয়া হয় যেন শত্রু এ মহাসড়ক নিরাপদে ব্যবহার করতে না পারে। নির্দেশানুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা সুযােগমতাে রেইড ও অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। সেপটেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা ভাটেরচর ফেরিঘাটে প্রহরারত শত্রুর উপর অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। ১৬জন মুক্তিযোেদ্ধা সড়কের দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হয়ে ২টি উপদলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। ঘাটের দুই পার্শ্বের সেন্ট্রিদের গুলি করার জন্য দুই গ্রুপ নিয়ােজিত হয়। সিদ্ধান্ত নেন, পূর্ব পার্শ্বের গ্রুপ সেন্ট্রি হত্যা করার পর বাংকারেও গুলি বর্ষণ করবেন। নির্দিষ্ট সময়ের পর তারা পশ্চাদপসরণ করবে। মাঝ রাত। প্রথম গুলি বর্ষণেই ঘাটের উভয় পার্শ্বের প্রহরারত সেন্ট্রিরা মারা যায়। প্রায় সাথে সাথেই বাংকার থেকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট গুলি আসে। কয়েক মিনিট পর শত্রুর গুলি থেমে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে। পরদিন পার্শ্ববর্তী গ্রাম রায়পুর থেকে ১জন পলাতক বাঙালি পুলিশকে। গ্রেপ্তার করা হয়। তার জবানবন্দি থেকে জানা যায় যে, তারা ৯জন এ ব্রিজে প্রহরারত ছিল। আক্রমণের পর জীবিতরা যে-যার মতাে পালিয়ে যায়।
ভাটেরচর ফেরি অপারেশন
মুক্তিযােদ্ধারা ভাটেরচর ব্রিজ ধ্বংস করার পর (১৪ আগস্ট) সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ফেরিঘাটে প্রহরারত শত্রুর উপর অ্যামবুশ পরিচালনা করেন। আতঙ্কিত শত্রু রাতের বেলায় মুক্তিবাহিনীর ভয়ে বাংকারে আশ্রয় নেয় অথবা সবাই একসাথে কোথাও জড়াে হয়ে থাকে। এ অবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা ৪টি ফেরির চালকদের সাথে যােগাযােগ করে। ফেরি চালক সবাই ছিলেন বাঙালি। তারা পরিকল্পনা করেন যে, সব ফেরি এখান থেকে সরিয়ে নেবেন, যাতে শত্রু তাদের গাড়ি পারাপার করতে না পারে। মুক্তিযােদ্ধা সফিক যুদ্ধের আগে সড়ক ও জনপথ বিভাগের কর্মচারী হিসেবে ফেরি চালকের কাজ করতেন। তাকেই দায়িত্ব দেওয়া হয় ফেরির বাঙালি চালকের সাথে যােগাযােগের মাধ্যমে ঘাট থেকে ফেরি সরানাের । সফিকের মাধ্যমে সবরকমের সহযােগিতার আশ্বাস দেন। ফেরি চালকেরা। সেপটেম্বরের শেষ সপ্তাহের এক রাতে একে একে ৪টি ফেরি চালিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থান দাউদকান্দি থানার আওরখােলা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সেখানে অপেক্ষারত ও প্রস্তুত ছিলেন। ফেরি পৌছার সাথে সাথে সব ফেরির ইঞ্জিনে এক্সপ্লোসিভ লাগানাে হয়। অতঃপর ফেরির সব ইঞ্জিন ধ্বংস করা হয়।
আলীপুরের অ্যামবুশ
মেঘনা ফেরিঘাট থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার পূর্ব দিকে (দাউদকান্দির দিকে) আলীপুর গ্রাম। মুক্তিযােদ্ধারা সময় ও সুযােগ বুঝে শক্রর উপর অ্যামবুশ করে। শক্রর যাতায়াতের কোনাে নির্ধারিত সময় না থাকলেও তারা সব সময় এ মহাসড়ক ব্যবহার করত। মুক্তিযােদ্ধারা তাই রাস্তার উপর গ্রামের লোকজনকে দাঁড় করিয়ে রাখতাে শক্রর আগমনবার্তা তাদের দেয়ার জন্য। মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান করতেন রাস্তার আশপাশের গ্রামে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে একদিন সকাল আনুমানিক ৯টায় গ্রামের লােকজন খবর দেয় যে, মেঘনার দিক থেকে অনেক পাকিস্তানি সৈন্য পূর্ব দিকে। (আলীপুরের দিকে) হেঁটে আসছে। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ৯জন। তাদের সাথে ১টি এলএমজি, ১টি এসএমজি এবং বাকি এসএলআর ও .৩০৩ রাইফেল। শত্রুর সংখ্যা ৩৫-৪০জন হবে বলে অনুমান করেন তারা। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ৯জন হলেও তারা শত্রুকে অ্যামবুশ করার সিদ্ধান্ত নেন। রণকৌশল সম্বন্ধে। তাদের কোনাে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। যুদ্ধ করতে করতে এঁরা যুদ্ধ শিখেছেন। এ ক্ষেত্রে তারা একটি অদ্ভুত অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করেন। রাস্তার দুই পার্শ্বে অর্থাৎ উত্তর ও দক্ষিণ উভয় পার্শ্বে তাঁরা পশ্চিম দিকে (শত্রুর দিকে) মুখ করে অবস্থান নেন। অস্ত্রের রেঞ্জের মধ্যে আসা মাত্র তারা শত্রুকে আক্রমণ করেন। ভুল অবস্থান গ্রহণের কারণে পিছনের শত্রু সৈন্যদের গুলি করা সম্ভব। হয় নি।  প্রারম্ভিক গুলিতেই শত্রুর ১১জন সদস্য নিহত এবং ৩জন আহত হয়। অবশিষ্টরা হতাহতদের ফেলেই মেঘনা ফেরিঘাটের দিকে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা এদের অস্ত্র দখল করেন। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা অক্ষত থাকেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!