You dont have javascript enabled! Please enable it!
রতনপুরের অ্যামবুশ
মুন্সিগঞ্জ সদর থানার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে রতনপুর গ্রাম। এ গ্রামসহ আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, লােকজনকে হত্যা ও নারী নির্যাতন করতে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। এমতাবস্থায় মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেয়ার সুযােগ খুঁজতে থাকেন। ৮ নভেম্বর। শত্রু সৈন্যরা রতনপুর গ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা যথাসময়ে খবর পেয়ে যান। মুক্তিযোেদ্ধারা ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেন, শত্রুকে নিরাপদে ফিরতে দেবেন না। তারা শত্রুর চলা মেঠো পথের দক্ষিণের গ্রামে অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান শক্রর থেকে প্রায় ৩০০ গজের বেশি দূরত্বে ছিল। অতএব তাদের গুলি যথেষ্ট কার্যকর হয় নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা নিরাপদ স্থানের খোঁজে উত্তর দিকে বণিক পাড়ার দিকে যেতে চেষ্টা করে। সেখানে অপেক্ষা করছিল আরেকটি মুক্তিযােদ্ধা দল। তারাও শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ শুরু করেন। বাধা পেয়ে শত্রু পুনরায় রতনপুরে প্রবেশ করে। এ পর্যায়ে তারা মূল অ্যামবুশের কার্যকরী দূরত্বের মধ্যে এসে যায়। উপর্যুপরি গুলি বর্ষণে তাদের অন্ততপক্ষে ২জন নিহত এবং বহু আহত হয়। হতাহতদের নিয়ে তারা হরগঙ্গা কলেজের দিকে পলায়ন করে। মুক্তিযােদ্ধাদের ১জন গুরুতর আহত হন।
টঙ্গীবাড়ি থানা আক্রমণ
মুন্সিগঞ্জ জেলা সদর থেকে সড়ক পথে প্রায় ২০-২২ কিলােমিটার দক্ষিণপশ্চিমে টঙ্গীবাড়ি থানার অবস্থান। ১৯৭১ সালে টঙ্গীবাড়ি থানার অবস্থান ছিল বর্তমান উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত সরু খালের পশ্চিম পাড়ে। বর্তমানে থানার অবস্থান খালের পূর্ব পাড়ে।  টঙ্গীবাড়ির প্রায় ৩ কিলােমিটার উত্তরে বেতকায় অবস্থিত ছিল মুক্তিযােদ্ধা রতনের দল। তারা ১৪ নভেম্বর রাত সাড়ে ১১টায় খালের পূর্ব পাড়ে অবস্থান নেয়। অব্যবহিতপরেই গুলি বর্ষণ শুরু হয়। থানা থেকে পালটা গুলি বর্ষণ করা হয়। গুলির শব্দে বেতকার পূর্বে আবদুল্লাপুরে অবস্থিত আবদুর রবের দল এবং টঙ্গীবাড়ি থানার কাছে পশ্চিমে আবদুস সালামের দল থানা ঘেরাও করে ফেলে। রব ও সালামের দলের মধ্যে পূর্বে কোনাে যােগাযােগ হয় নি। এমনকি তারা একে অপরের আগমন ও অবস্থান সম্বন্ধেও জানতেন না। এমতবস্থায় ভুল বােঝাবুঝির সমূহ আশঙ্কা ছিল। সৌভাগ্যবশত তেমন অঘটন ঘটে নি। স্লোগান দিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ শুরু করেন। থানায় অবস্থান করতাে বাঙালি পুলিশ, রাজাকার ও ইপিআর সদস্য। বাঙালি পুলিশ ও রাজাকার মিলিয়ে ছিল ৩০-৩২জন। তারা আধা ঘণ্টার মধ্যে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। কোনাে পক্ষের হতাহত হয় নি। মুক্তিযােদ্ধারা থানা থেকে ৩০-৩২টি .৩০৩ রাইফেল এবং বেশ কিছু গুলি উদ্ধার করেন।
মুন্সিগঞ্জ থানা আক্রমণ
মুন্সিগঞ্জ সদরের ঘনবসতি এলাকার ভিতর মুন্সিগঞ্জ থানার অবস্থান (১৯৭১ সালে থানার অবস্থান ছিল বর্তমান থানার দক্ষিণস্থ রাস্তার অন্য পাশে। টিনের ছাদের জীর্ণ দেয়ালের গঠন)। ১৪ নভেম্বর। শহরের হরগঙ্গা কলেজে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল ঘাঁটি। ৫০-৬০জনের সেনা সদস্যের দলের নেতৃত্বে আছে ১জন মেজর। শত্রু তাদের সংখ্যার ঘাটতি পূরণ করেছে পাকিস্তান থেকে আনা পুলিশ দিয়ে। কিছু বাঙালি পুলিশ ও রাজাকাররা এদের সেবক হিসেবে কাজ করে। পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরােচিত কর্মকাণ্ডের সহযােগী কিছু ইতর শ্রেণির দেশীয় দোসর। তথাকথিত শান্তি কমিটির মাধ্যমে এরা সাধারণ মানুষের শান্তি হারাম করেছে। কয়েক বার এদের উপর আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের কয়েকজনকে হত্যা ও জখম করেছেন। তারপরও ক্ষমতার মােহ এদের আবার সক্রিয় করে তােলে। নভেম্বরের শুরু থেকে গােটা দেশে পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয়ের ঘণ্টা। বাজতে শুরু করে। ওয়্যারলেসের কথােপকথনের মাধ্যমে সব পাকিস্তানি সেনাই। তাদের ভবিতব্য পরাজয় সম্বন্ধে জেনে যায়। ইতােমধ্যেই সদর থানা ছাড়া মুন্সিগঞ্জের বাকি ৫টি থানার পতন ঘটেছে। মুক্তিযােদ্ধারা তারপর পরিকল্পনা। করেন সদর থানা আক্রমণ করার। ঘনবসতি ও লােক চলাচলের সুযােগ নিয়ে। খুব কাছে থেকে গুলি ও গ্রেনেডের আক্রমণ করা হয় থানায়। ভিতরের হতাহতের সংখ্যা নিরূপণ করা যায় নি। সংক্ষিপ্ত এ আক্রমণ শেষে মুক্তিযােদ্ধারা। আবার জনগণের সাথে মিশে যান। থানা দখলে রাখা মুক্তিযােদ্ধাদের উদ্দেশ্য ছিল না এবং এটি সম্ভবও, ছিল না। সদর থানা আক্রমণ মুন্সিগঞ্জে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের আস্থা ও। শক্তির ভিত নাড়িয়ে দেয়। জনগণও উপলব্ধি করে তাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা অতি নিকটে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!