You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভবেরচর ব্রিজ ধ্বংস
ভাটেরচর ফেরিঘাট থেকে দাউদকান্দির দিকে ১৫-১৬ কিলােমিটার পর দাউদকান্দি ফেরিঘাট। মেঘনা নদীর এ ফেরিঘাটের পশ্চিম প্রান্তের ঘাটের নাম বাউসিয়া ফেরিঘাট। পূর্ব প্রান্তের ঘাটের নাম দাউদকান্দি ফেরিঘাট। ভাটেরচর থেকে ৭-৮ কিলােমিটার দাউদকান্দির দিকে ভবেরচর ব্রিজ। এ ব্রিজের ৪০০৫০০ গজ পূর্বে পুরােনাে বাউসিয়া কালভার্ট। মুক্তিবাহিনীর উপর্যুপরি এবং অতর্কিত আক্রমণের ফলে শত্রু তাদের পূর্বেকার অবাধ কার্যক্রম, বিচরণ এবং স্থায়ী পাহারা সংকুচিত করে আনে। ব্রিজ, কালভার্ট, ফেরিঘাট নিরাপত্তার জন্য শক্র কখনাে গাড়িতে, কখনাে হেঁটে প্যাট্রলিং করত। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিযােদ্ধারা এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ভবেরচর ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। এর ২-১ দিন পর মধ্যবাউসিয়া ব্রিজ ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ লাগানাের সময় শত্রু যেন গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে ব্রিজ এলাকায় না আসতে পারে, সে জন্য তারা প্রায় ৪০০ গজ পূর্ব দিকে (দাউদকান্দির দিকে) ৪টি এম-১৬ অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন দিয়ে বুবি ট্র্যাপ লাগান। এ বিশেষ ধরনের অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইনগুলাে কেবল পজে আসা মানুষের বিরুদ্ধেই কার্যকরী নয়, প্রায় সমানভাবে যানবাহনের বিরুদ্ধেও কার্যকরী। মুক্তিযােদ্ধা রফিক ও তার সহযােদ্ধারা মাইনগুলাে রাস্তার উত্তর পাশে বসিয়ে রাস্তার উপর দিয়ে এনে অপর পাশে খুঁটি পুঁতে তার সাথে বাধেন। রাতে যথাসময়ে ব্রিজটি ধ্বংস করা হয়।
যেহেতু রাতে দাউদকান্দির দিক থেকে শত্রু গাড়িতে বা হেঁটে আসে নি তাই এম-১৬ অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন দিয়ে লাগানাে বুবি ট্র্যাপ অব্যবহৃত থেকে যায়। পরদিন সকালে মুক্তিযােদ্ধারা এ বুঝি ট্র্যাপগুলাে খুলতে এবং মাইন তুলতে যান। অন্যথায় নিরীহ জনগণ এ বুবি ট্র্যাপের শিকার হবে। মাইন ৪টি তােলা যখন শেষ, তখন সকাল আটটা। এমন সময় দেখা যায়, দাউদকান্দির প্রান্ত থেকে ২২জন শত্রু সৈন্য হেঁটে বাউসিয়া ব্রিজের দিকে আসছে। মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ২৫জন। শক্রর সম্পূর্ণ অগােচরে মুক্তিযােদ্ধারা দ্রুত অ্যামবুশ অবস্থান গ্রহণ করেন। শক্র প্রায় ১০০ গজ দূরত্বের মধ্যে চলে আসে। শুরু হয় অ্যামবুশ অবস্থান থেকে গুলি। এরা ছিল ইপিসিএএফ (EPCAF)। এদের হতাহত হয় প্রচুর আর অল্প। কয়েকজন পালিয়ে যেতে সমর্থ হয় এবং ৬জন মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ধরা পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা বন্দিদের ও হতাহতদের কাছ থেকে মােট ১১টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
গােয়ালিমান্দার যুদ্ধ
লৌহজং থানা থেকে ৪ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে গােয়ালিমান্দার হাট। শত্রু লৌহজং থেকে শ্রীনগর পর্যন্ত খাল দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌযান (Speed Boat) দিয়ে টহল দিত। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্প ছিল হলদিয়া, কাজির পাগলা ও শ্রীনগরে (দয়হাট-মজিদপুর)। এ এলাকা থেকে সুযােগ বুঝে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণ করতেন। ২৬ অক্টোবর, আনুমানিক ৭টা। লঞ্চে পাকিস্তানি সৈন্যদের আসার খবর তারা জানতে পারেন। মুক্তিযােদ্ধারা গােয়ালিমান্দার হাটে অবস্থান নেন। আগেই জানা যায়, লৌহজং থেকে শত্রু লঞ্চযােগে শ্রীনগর যাবে। তথ্য অনুযায়ী দেখা যায় যে, পাকিস্তানি সৈন্যদের ২টি লঞ্চ গােয়ালিমান্দার হাটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সৈন্যবাহী লঞ্চ ২টির মধ্যবর্তী দূরত্ব প্রায় ১০০ গজ। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ দায়িত্ব বণ্টন করে অপেক্ষায় থাকেন। ২টি লঞ্চই অস্ত্রের রেঞ্জের আওতায় আসার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার ওপেন করেন। শত্রুর ১জন সুবেদার পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং পানিতে দাঁড়িয়ে গুলি বর্ষণ শুরু করে। লঞ্চ ২টি ঘাটের কাছে চলে আসলে মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা নেয় যাতে ১জন শত্রুও ঘাটে নামতে না পারে। তারা লঞ্চের দিকে অবিরত গুলি ছুড়েন।
অধিনায়ক আতিকুল্লাহ খান মাসুদ ক্রলিং করে লঞ্চের ছাদের উপর। পর পর কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে ছাদ ধ্বংস করে দেন। কৌশলগত কারণে মুক্তিযােদ্ধারা কিছুটা পিছিয়ে আসায় পাকিস্তানি সেনারা ১টি লঞ্চকে খালের দক্ষিণ পাড়ে নিতে সক্ষম হয়। শত্রুর ১৪-১৫জন সদস্য পাকা সেচ ড্রেনে। অবস্থান নিয়ে ফায়ার করতে থাকে। অপর দিকে হলদিয়া থেকে আরও মুক্তিযােদ্ধা এসে যােগ দেওয়ায় তাদের সাহস ও মনােবল বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধি পায় যুদ্ধের তীব্রতাও। সারারাত উভয় পক্ষে তুমুল গােলাগুলি হয়। ৮জন শত্রু সৈন্য আত্মসমর্পণ করে। বাকি সবাই মারা যায়। লঞ্চ থেকে উদ্ধার করা হয় ২০টি রাইফেল ও প্রচুর গােলাবারুদ। সার্বিক অর্থে গােয়ালিমান্দার যুদ্ধ মুক্তিযােদ্ধাদের একটি সফল যুদ্ধ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!