ভাটেরচর ব্রিজ ধ্বংস
১৯৭১ সালে ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কে ঢাকা থেকে কুমিল্লা যেতে ৩টি ফেরি পার হতে হতাে। প্রথমটি তারাবাে, দ্বিতীয়টি মেঘনায় এবং তৃতীয়টি দাউদকান্দিতে। দাউদকান্দি থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত আর কোনাে ফেরি ছিল না। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে রেললাইন উপড়ে ফেলে, ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে দেওয়া হয়। নৌপথ ছিল সময় সাপেক্ষ ও ঘুরপথ। বিমানের অভাবে বিমানপথ ছিল অনির্ভরশীল। তা ছাড়া নিয়মিত মালামাল, অস্ত্র ও গােলাবারুদ এবং সৈন্য কুমিল্লা বা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে পরিবহণ বিমানে পৌঁছানাে সম্ভব ছিল না। ফলে ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর একমাত্র চলাচলের পথ (MSR – Main Supply Route) | ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ এ সড়ক পথের ফেরি ও ব্রিজ ধ্বংস এবং রাস্তা কেটে দেওয়ার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। বিশেষ এ অপারেশনের জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ধরনের এক্সপ্লোসিভ যেমন: প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, জিলেটিন এবং নানা ধরনের চার্জ। (কাটিং চার্জ, প্রেশার চার্জ, প্লেটার চার্জ, বি-হাইভ চার্জ ইত্যাদি) তৈরির উপর। আলাদা প্রশিক্ষণ প্রদান করতেন ক্যাপটেন এ টি এম হায়দার। এ প্রশিক্ষণে আরও অন্তর্ভুক্ত ছিল ফেরি চালানাে এবং শক্রর ফেরি ধ্বংস করা।
ঢাকার পূর্বে ডেমরা থানা এলাকার ভিতর দিয়ে এ মহাসড়ক মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থানা এলাকা অতিক্রম করে দাউদকান্দির পশ্চিমে মেঘনা নদীর পাড়ে পৌছে। এখানে ফেরি পার হয়ে দাউদকান্দি পৌছতে হয়। এ রাস্তায় পূর্ব দিক যাওয়ার এটাই শেষ ফেরি। মেঘনা ফেরি এবং দাউদকান্দি ফেরির মধ্যকার অংশটি গজারিয়া থানা এলাকায়। মহাসড়কটির এ অংশে ২টি গুরুত্বপূর্ণ ব্রিজ ছিল। মেঘনা ফেরি থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার দাউদকান্দির দিকে ভাটেরচর ব্রিজ। ব্রিজটি ফুলদি নদীর উপর অবস্থিত। দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০০ ফুট। ফুলদি নদী খরস্রোতা ও গভীর। এ ব্রিজ ধ্বংস করা গেলে শক্রকে যথেষ্ট নাজেহাল করা যাবে। মেজর খালেদ মােশাররফ এ ব্রিজ ধ্বংসের পরিকল্পনা নেন জুন মাসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ছেলে মুক্তিযােদ্ধা ভাষণকে এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ এবং প্রয়ােজনীয় ব্রিফিং দেন ক্যাপটেন হায়দার। জুন মাসের শেষ সপ্তাহ। ভাষণ তার সহযােদ্ধাদের নিয়ে ভাটেরচর আসেন। তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা ভাটেরচর ব্রিজে পাহারা বসায় নি। গাড়ি দিয়ে টহল দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা ব্রিজ ধ্বংস করার জন্য ব্রিজের পিলারে এক্সপ্লোসিভ লাগান। সব আয়ােজন সম্পন্ন করে এবার সেফটি ফিউজে আগুন দেওয়া হবে। কিন্তু দেখা গেল, আগুন ধরানাের দিয়াশলাই ম্যাচটি পানিতে ভিজে আছে। আগুন ধরানাে সম্ভব না হওয়ায় সব চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। ঠিক এমন সময় পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি আসতে দেখে মুক্তিযােদ্ধারা আত্মগােপন করেন। শত্রুরা ব্রিজে এসে এক্সপ্লোসিভ দেখতে পায়। পরে ওরা বিশেষজ্ঞ এনে এক্সপ্লোসিভ খুলে নিয়ে চলে যায়। ব্রিজ ধ্বংস করার প্রচেষ্টা দিয়াশলাই ভিজা থাকার কারণে বিফল হলাে।
২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তর মেলাঘর থেকে আসতে বিভিন্ন ধরনের জলপথ অতিক্রম করতে হয়। তা ছাড়া বৃষ্টিবাদলা মাথায় নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের চলাচল করতে হতাে। এমন অবস্থায় কখন দিয়াশলাই ভিজে গেছে কেউ লক্ষ্য করেনি। অথচ বিষয়টি ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সামান্য ১টি ভেজা দিয়াশলাইয়ের জন্য এ ধরনের ব্যর্থতার ঘটনা এটাই প্রথম। পরবর্তী সময় ওয়াটার টাইট বা জলনিরােধক প্যাকেট বানিয়ে তার ভিতর দিয়াশলাই নেয়া হতাে। এ ধরনের ঘটনা অবশ্য এটাই শেষ। এ ঘটনার পর পরই পাকিস্তানি সৈন্যরা এ ব্রিজে সশস্ত্র পাহারা বসায়। ব্রিজের পূর্ব প্রান্তে (দাউদকান্দি প্রান্তে) রাস্তার উত্তর পার্শ্বে সুরক্ষিত এবং শক্ত বাংকার বানিয়ে তারা সেখানে থাকার ব্যবস্থা করে। জুলাই মাসের মাঝামাঝি মুক্তিবাহিনী দ্বিতীয়বার ভাটেরচর ব্রিজটি ধ্বংস করার উদ্যোগ নেয়। এবার তারা প্রথমে প্রহরাধীন শত্রু সৈনিকদের হত্যা করে ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ লাগানাের পরিকল্পনা করেন। দিনের বেলায় রেকিতে দেখা যায় ইপিসিএএফ, পুলিশ এবং রাজাকার মিলিয়ে তাদের সংখ্যা মােট ২২জন। তাদের সংখ্যা ৩২জন। মুক্তিযােদ্ধা রাস্তার দক্ষিণ দিক থেকে অগ্রসর হন। তারা শত্রুর উপর গুলি বর্ষণ। শুরু করেন। শত্রুও তাদের নিরাপদ ট্রেঞ্চ ও বাংকার থেকে পালটা গুলি বর্ষণ। করে। ঘুটঘুটে আঁধারে দুই পক্ষেরই গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। শত্রু নিধন করা সম্ভব হয় নি। তাই ব্রিজ ধ্বংসের দ্বিতীয় প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হয়। ব্রিজ ধ্বংস করার পূর্বের ব্যর্থ প্রচেষ্টার ২টি অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তৃতীয় পরিকল্পনা করা হয়। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানি সৈন্যদের স্বাধীনতা দিবস। কোনাে গুলি না করে শত্রুকে জানান না দিয়ে নিঃশব্দে ব্রিজের পিলারে এক্সপ্লোসিভ স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়।
প্রহরারত শত্রু হত্যার কোনাে পরিকল্পনা এবার করা হয় নি। নৌকা দিয়ে রাতের অন্ধকারে ব্রিজের নিচ দিয়ে গিয়ে এক্সপ্লোসিভ লাগানাে হবে। পাছে শত্রু তাদের দেখে ফেলে, সে জন্য শত্রুর উপর কভারিং ফায়ার দেওয়ার জন্য ৪জনের ২টি দলকে আলাদা অবস্থানে রাখা হয়। এক্সপ্লোসিভ লাগাতে ৪জনের আরেকটি দল নৌকা দিয়ে যাবে। ৩ উপদলে মােট ১২জন মুক্তিযােদ্ধা। নৌকার দলে ২জনের দায়িত্ব মাঝির। রফিক ও তােফাজ্জল নৌকা থেকে নেমে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ (পিইকে) লাগাবে।
মেলাঘরে ক্যাপটেন হায়দার তাঁদের এক্সপ্লোসিভের পরিমাণ, কী ধরনের চার্জ এবং কীভাবে লাগাতে হবে সব শিখিয়ে দিয়েছেন। কোনাে তাড়াহুড়া ছাড়া ধীরেসুস্থে তারা ব্রিজের পিলারে এক্সপ্লোসিভ লাগান, এবার সেফটি ফিউজ সংযুক্ত করে ডিটোনেটর এক্সপ্লোসিভের সাথে লাগান। মাত্র ১ ফুট সেফটি ফিউজ লাগানাে হয়। নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার জন্য ১ ফুট সেফটি ফিউজ যথেষ্ট নয়। কেননা ব্রিজের টুকরাে ইট, লােহা ছুটে এসে প্রচণ্ড গতিতে যে কাউকে আঘাত করতে পারে, তা ছাড়া ব্রিজ ধ্বংস হওয়ার প্রচণ্ড শব্দ তাঁদের কানের পর্দা বিদীর্ণ করতে পারে। অনভিজ্ঞ যােদ্ধারা সেদিকে খেয়াল করেন নি। তাদের অপেক্ষা কখন ব্রিজ উড়ে যাবে। তারা নৌকা নিয়ে পাশের পাটক্ষেতের ভিতর আশ্রয় নেন। পাটক্ষেতে ঢোকার প্রায় সাথে সাথেই প্রচণ্ড শব্দে রাতের নিস্তব্ধতা চূর্ণ করে ব্রিজ ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। শেষ অবধি মুক্তিযােদ্ধাদের বহুদিনের প্রচেষ্টা সফল হয়।
তালতলার যুদ্ধ
সিরাজদিখান থানার ২-৩ কিলােমিটার পূর্বে তালতলা বাজার। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ইছামতি নদীর শাখা। আগস্ট মাসে স্থানীয় তরুণরা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামগুলােয় ঢুকতে থাকেন। এরূপ ১টি মুক্তিযােদ্ধার দল বেশ কিছু অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে অস্থায়ীভাবে লুকিয়ে থাকার আস্তানা খুঁজতে ব্যস্ত ছিল। তারা বাজার থেকে চিড়া-গুড় ক্রয় করে শ্রীনগরের দিকে যাত্রা করেন। রাত তখন গভীর। শত্রুর অবস্থান এবং বিরাজমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের ধারণা নেই। যুদ্ধ সম্বন্ধে অজ্ঞতার কারণে রেকি করার প্রয়ােজনীয়তাও তারা অনুভব করেন নি। তারা নৌকায় করে নিশ্চিন্তভাবে শ্রীনগরে পৌছান। তালতলা ডাকবাংলােয় ছিল শত্রুর অবস্থান। ডাকবাংলাের কাঠের পুল অতিক্রম করার পরই তারা পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুখােমুখি হয়ে পড়েন এবং শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হন। মুক্তিযােদ্ধারা নৌকা থেকে ডাকবাংলাে ও পুলের দিকে অপরিকল্পিত, বিক্ষিপ্ত ও লক্ষ্যহীনভাবে গুলি ছুড়তে শুরু করেন। দীর্ঘক্ষণ গুলি ছুড়তে ছুড়তে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অবস্থান দৃঢ় করেন এবং পুলের উপর অবস্থিত পাকিস্তানি সৈন্যদের গুলি করে পানিতে ফেলে দেন। এ যুদ্ধে ১জন মুক্তিযােদ্ধার গায়ে গুলি লেগে গুরুতর আহত হন। মুক্তিযােদ্ধারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে স্থান ত্যাগ করেন এবং ধলেশ্বরীর কূল বেয়ে বয়রাকান্দি গ্রামে আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিক্রমপুর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি সৈন্যদের এটাই প্রথম সম্মুখযুদ্ধ বলে জানা যায়। শত্রুরা অপ্রস্তুত থাকায় মুক্তিযােদ্ধারা নিশ্চিত বিপদ থেকে রক্ষা পান।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড