You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুন্সিগঞ্জ জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আয়তন: মুন্সিগঞ্জ জেলার আয়তন ৯৫৪.৯৬ বর্গকিলােমিটার। উত্তরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, পূর্বে কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা, দক্ষিণে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা, পশ্চিমে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা। মুন্সিগঞ্জ নদীবিধৌত ও কৃষিভিত্তিক এলাকা। এখানে পলল সমভূমি ও মেীসুমি জলবায়ু বিদ্যমান। এ জেলার চারপাশে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি ও শীতলক্ষ্যা নদী বহমান। জেলার দক্ষিণ এলাকা প্রায়ই প্রমত্তা পদ্মার এবং পূর্বাংশ মেঘনার ভাঙনের শিকার হয়। উল্লেখযােগ্য নিমভূমি আড়িয়াল বিল (৪,৩৩০ হেক্টর)। প্রশাসন: ঢাকা জেলার অন্তর্গত মুন্সিগঞ্জ মহকুমাকে ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত করা হয়। ৬টি উপজেলা তথা: গজারিয়া, টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, লৌহজং, শ্রীনগর ও মুন্সিগঞ্জ সদর, ইউনিয়ন ৬৭টি, মৌজা ৬৬২টি, গ্রাম। ৯০৬টি, পৌরসভা ২টি, ওয়ার্ড ১৮টি, মহল্লা ৭৩টি। | প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্তিক সম্পদ: মুন্সিগঞ্জ শহরে ইদ্রাকপুর দুর্গ। (১৬৬০), বজ্রযােগিনীতে পণ্ডিতের ভিটা (অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থান), রামপালে বাবা আদমের মসজিদ, হরিশ্চন্দ্র বাজার দিঘি, রাজা বল্লাল সেনের বাড়ি, রাজা শ্রীনাথের বাড়ি, রামপাল দীঘি, কোদাল ধােয়ার দীঘি, শ্রীনগরের শ্যামসিদ্ধির মঠ, হাসারার দরগা, ষােলঘর মঠ, ভাগ্যকুল রাজবাড়ি, রাঢ়িখালে জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি, সােনারঙের জোড়া মঠ, টঙ্গীবাড়ির কালীবাড়ি, কুসুমপুরে তালুকদার বাড়ি মসজিদ, তাজপুর মসজিদ, পাথরঘাটা মসজিদ, কাজিশাল মসজিদ, পােলঘাটার ব্রিজ, পাঁচ পিরের দরগা।
হরগঙ্গা কলেজ গ্রন্থাগারে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আশুতােষ গাঙ্গুলীর আবক্ষ মার্বেল মূর্তি। ঐতিহাসিক ঘটনাবলি: মেঘনা ও ধলেশ্বরীর পশ্চিমে মুন্সিগঞ্জ জেলার অন্তর্ভুক্ত সমগ্র ভূভাগ প্রাচীন কালে বিক্রমপুর রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেন রাজাদের শাসনামলে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়ার পাশাপাশি সেনদের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল পূর্ববঙ্গের বিক্রমপুরে। বখতিয়ার খিলজী কর্তৃক নদীয়া অধিকারের (১২০৪) পর সেন বংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেন বিক্রমপুরে পালিয়ে আসেন এবং স্বাধীনভাবে পূর্ববঙ্গ শাসন করতে থাকেন। লক্ষ্মণ সেনের মৃত্যুর (১২০৬) পর ১২২৩ সাল পর্যন্ত তাঁর উত্তরাধিকারী বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন বিক্রমপুরে রাজত্ব করেন। লক্ষ্মণ সেনের পুত্ররা ১২৪৩-৪৫ সাল পর্যন্ত। বিক্রমপুরে রাজত্ব করেন বলেও কোনাে কোনাে ঐতিহাসিক মনে করেন। ত্রয়ােদশ শতকের তৃতীয় পদে চন্দ্রদ্বীপের দেব বংশীয় রাজা দশরথদেব দনুজমাধব (দনুজ রায়) সেনদের বিতাড়িত করে বিক্রমপুর রাজ্য অধিকার। করেন এবং ত্রয়ােদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করেন। মােগল শাসনামলে বর্তমান মুন্সিগঞ্জ শহর ও শহরতলি এলাকার নাম ছিল। ইদ্রাকপুর। তল্কালীন মােগল ফৌজদার ইদ্রাকের নামানুসারে এর নামকরণ হয় ইদ্রাকপুর। মুন্সিগঞ্জ শহরের উপকণ্ঠে এখনাে একটি গ্রাম ইদ্রাকপুর নামে পরিচিত। ব্রিটিশ শাসনামলে রামপালের কাজি কসবা গ্রামের জমিদার মুন্সি এনায়েত আলীর নামানুসারে তার জমিদারির অন্তর্গত ইদ্রাকপুরের নতুন নাম হয় মুন্সিগঞ্জ ।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৯ মে পাকিস্তানি বাহিনী মুন্সিগঞ্জ এবং ১৪ মে কেওয়ারে হামলা করে কিছু সংখ্যক যুবককে হত্যা করে। তারা ৫ মে গজারিয়ায় অভিযান চালিয়ে ৪ শতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে গুলি করে হত্যা করে। এর আগে ৩১ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী নারায়ণগঞ্জে আক্রমণ চালালে মুন্সিগঞ্জের তরুণরা নারায়ণগঞ্জবাসীদের সঙ্গে মিলিতভাবে আক্রমণ প্রতিহত করে। জুলাই মাসে ধলাগাঁও এলাকায় শত শত যুবককে রিক্রুট করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং তারা বিভিন্ন অপারেশনে অংশ নেন। মুক্তিযােদ্ধারা ১১ আগস্ট শ্রীনগর থানা, এর কিছুদিন পর লৌহজং থানা, সেপটেম্বরের শেষের দিকে টঙ্গীবাড়ি থানা আক্রমণ করে প্রচুর অস্ত্র ও গােলাবারুদ সংগ্রহ করেন এবং লৌহজং থানা জ্বালিয়ে দেন। ২৪ সেপটেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা গালিমপুর ও গােয়ালিমান্দ্রায় পাকিস্তানি সেনাদের লঞ্চে আক্রমণ চালিয়ে শতাধিক পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন। ২৭ রমজান শবেকদর রাতে ১১৫জন মুক্তিযােদ্ধা পাকিস্তানি সেনাদের উপর সম্মিলিত আক্রমণ চালিয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর দখল করে নেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব: বৌদ্ধ পণ্ডিত অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান (বজ্রযােগিনী, মুন্সিগঞ্জ), বিজ্ঞানী স্যার জগদীশচন্দ্র বসু (রাঢ়িখাল, শ্রীনগর), রাজনীতিক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস (তেলিরবাগ, লৌহজং), রাজনীতিক সরােজিনী নাইডু। (ব্রাহ্মণগাঁও, লৌহজং), সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু (মালখানগর, সিরাজদিখান), প্রফেসর এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরী (বিশিষ্ট চিকিৎসক ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট, শ্রীনগর), প্রফেসর ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক প্রেসিডেন্ট, মুন্সিগঞ্জ সদর), ইংলিশ চ্যানেল বিজয়ী সাঁতারু ব্ৰজেন দাস (কুচিয়ামােড়া, সিরাজদিখান), সাহিত্যিক মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় (শ্রীনগর), শহিদ বুদ্ধিজীবী নিজামউদ্দিন (লৌহজং)।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন: বধ্যভূমি ৩টি, স্মৃতিস্তম্ভ আছে ৩টি এবং ১টি গণকবর আছে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান: ১,৪৭৮টি মসজিদ, ১০৮টি মন্দির, ৭৭টি মাজার এবং ৯টি গির্জা রয়েছে মুন্সিগঞ্জে। শিক্ষার হার: মুন্সিগঞ্জে গড় শিক্ষার হার ৩৫.৮%, তারমধ্যে পুরুষ ৪০.৩%, নারী ৩১.১%। | শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সরকারি কলেজ ২টি, বেসরকারি কলেজ ১৪টি, সরকারি হাই স্কুল ৩টি, বেসরকারি হাই স্কুল ৭৯টি, জুনিয়র হাই স্কুল ১১টি, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ১টি, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ৩টি, মাদ্রাসা ৮৭টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৪২৩টি, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৮টি, কিন্ডারগার্টেন ৫টি, গণশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৬৮৮টি। পত্রপত্রিকা ও সাময়িকী: দৈনিক মুন্সিগঞ্জের কাগজ, সাপ্তাহিক মুন্সিগঞ্জ, সাপ্তাহিক মুন্সিগঞ্জ সংবাদ, মাসিক বিক্রমপুর; অবলুপ্ত পত্রিকা: মাসিক পল্লীবিজ্ঞান, Hindu Intelligencer, মুক্তি, বিক্রমপুর পত্রিকা (১৯২০), গ্রামের কথা (সাপ্তাহিক, ১৯৬২), অনুসন্ধান, চেতনা, কালের ভেলা, সংশপ্তক, সরব, কবিতাপত্র, বিক্রমপুর মুখশ্রী, সাপ্তাহিক বিক্রমপুর বার্তা, বিক্রমপুর। জনগােষ্ঠীর প্রধান পেশা: কৃষি ২৭.৪৩%, মৎস্য ২.২৫%, ব্যবসা ১৯.৪৬%, চাকরি ৯.২৮%, পরিবহণ ১.৬৭%, কৃষি শ্রমিক ২১.৯৬%, অকৃষি শ্রমিক ২.৮৭%, হকার ১.০২%, নির্মাণ শ্রমিক ১.৫৭%, অন্যান্য ১২.৪৯%। | প্রধান কৃষি ফসল: আলু, পাট, কলা, ধান, পান, গম, সরিষা, তিল, ছােলা, মসুর, মটর, মরিচ, ধনে, চিনাবাদাম, ভুট্টা, পটল, করলা, টমেটো, মিষ্টি কুমড়া, শাকসবজি। যােগাযােগ: বিশেষায়িত পাকা রাস্তা ২৪২.২৭ কিলােমিটার, আধা পাকা রাস্তা ১২৭ কিলােমিটার, কাচা রাস্তা ১৩৩৯ কিলােমিটার; লঞ্চঘাট ২৯টি, খেয়াঘাট ১৬টি, বােট মহাল ৫টি। প্রধান রপ্তানি দ্রব্য: আলু, কলা, ধান, পটল, পাট, পান, মিষ্টি কুমড়া, শাকসবজি, দুগ্ধজাত খাদ্য, চট, সুতা, তামা-কাঁসার তৈজসপত্র, বাঁশ ও বেতের সরঞ্জাম।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!