You dont have javascript enabled! Please enable it!
মাসদাইর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ
নারায়ণগঞ্জ শহরের সন্নিকটেই উত্তর দিকে ফতুল্লা থানা অবস্থিত। এ থানার অন্তর্গত মাসদাইর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থায়ীভাবে ক্যাপ স্থাপন করে স্থানীয় জনসাধারণের উপর নানাবিধ অত্যাচার চালাতে থাকে। বেশির ভাগ নির্যাতন ও লুটতরাজ শত্রুর দোসর রাজাকাররা করত। ফতুল্লায় অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা ডিসেম্বরের ১ম সপ্তাহে শত্রু ক্যাম্পে আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। পরিকল্পনা মােতাবেক এক দল মুক্তিযােদ্ধা মাসদাইর সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ে আক্রমণ করেন। সারা দেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের তখন পরাজয় ও পিছু হটার পালা। তাদের মনােবল তখন সর্বনিমে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে টিকতে না পেরে শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। পলায়নের সময় তারা বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে যায় এবং ২জন শত্রু নিহত হয়। ঐ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা শহিদুল্লাহ, মুজিবর রহমান, নবী হােসেন গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ পরিচালনা করেন।
কল্যাণদীর অপারেশন
বন্দর থানার একটি গ্রাম কল্যাণদী। নারায়ণগঞ্জ শহরের মুসলিম লীগ নেতা ও বন্দর থানার শান্তি কমিটির আহ্বায়ক মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে ৫ ডিসেম্বর ১ প্ল্যাটুন পাকিস্তানি সৈন্য কল্যাণদী গ্রামে হামলা করে এবং আগুন দিয়ে সারা গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামবাসী একত্র হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় শত্রুর। মােকাবিলা করে। গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করেন। শত্রুর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় ৭ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১৭জন। গ্রামবাসী মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করতে গিয়ে প্রাণ হারায়। উল্লেখ করা যায় যে, প্রায় ১৫০জন মুক্তিযােদ্ধা সম্মিলিতভাবে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যদের ভারী অস্ত্রের মুখে প্রাণপণ যুদ্ধ করেও শেষ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। এ যুদ্ধে গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. সাহাবুদ্দিন খান সবুজ ২. জি কে বাবুল ৩. দুলাল ৪. কাজী ইসহাক ৫. মােজাম্মেল ৬. সামছুদ্দিন। ৭. মিয়া সাহাবুদ্দিন ৮, হাতেম ৯. খসরু ১০. কুতুবউদ্দিন ১১, আলী হােসেন ১২. আমান ১৪. মাে. সেলিম ১৫, মােশারফ খান ১৬. আজাদ ১৭. নুরুল হক ১৮. গফুর খান। ১৯, সফিউদ্দিন ২০. দিল মােহাম্মদ ২১. দীন ইসলাম ২২. এইচ এ ছিদ্দিকী ২৩. বরকত উল্লা। ২৪. হাবিবুর রহমান। ২৫. মােতাব্বের হােসেন ২৬. মনির। ২৭. মফিজ ২৮. নাছির ২৯. নাছিউল্লা ৩০. ওয়াদুদ ৩১. জব্বার। ৩২. আজিজুর রহমান বাবু ৩৩. সানী ৩৪. জালাল উদ্দিন রুমী। ৩৫. আলী আজগর ৩৬. শওকত ৩৭. ছিদ্দিক ৩৮, আবুল হাসেম ৩৯. কাশেম। ৪০. গিয়াসউদ্দিন গেসু ৪১. নুরুজ্জামান ৪২. আ, আজিজ ৪৩. লিয়াকত হােসেন ৪৪. আক্তার হােসেন। ৪৫, আতাউর। ৪৬. মতিন। ৪৭. বাতেন প্রমুখ।
হরিপুর অপারেশন
বন্দর থানায় হরিপুর গ্রামের অবস্থান। ৬ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় হরিপুর ও বঙ্গশাসন গ্রামে এসে পাকিস্তানি সৈন্যরা চারদিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলে। শক্রর কাছে মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা এ গ্রামে আছে বলে তথ্য থাকায় তারা গ্রাম ঘেরাও করে। পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামবাসীর উপর গােলাগুলি শুরু করে দেয়। এ পর্যায়ে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুকে প্রতিরােধ করতে থাকেন। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধা আওলাদ হােসেন ও অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা করতে গিয়ে ১৩জন মুক্তিপিপাসু গ্রামবাসী শহিদ হন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. আলী আক্কাস ২. হাবিব ৩. লতিফ ৪, সালাম ৫. ইদ্রিস ৬. নজরুল ৭. আ. গনি। ৮, আ. রশিদ ৯. আ. হাশেম ১০. মুজাফফর ১১. বাদশা। ১২. আওলাদ হােসেন ১৩. হাবিবুল্লা মাস্টার ১৪. আলাউদ্দিন ১৫. আমির হােসেন, ১৬. বারেক খন্দকার ১৭. আবুল কাশেম ১৮. আ. রাজ্জাক ১৯, সফি খন্দকারসহ আরও অনেকে।
বড়ালু অপারেশন
রূপগঞ্জ থানার মুড়াপাড়ায় গাউসিয়া জুট মিলে পাকিস্তানি সৈন্যদের ক্যাম্প ছিল। ডিসেম্বর মাসে যৌথ বাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে প্রায় জায়গা থেকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের ক্যাম্প গুটাতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বিকাল ৩টায় মুড়াপাড়া গাউসিয়া জুট মিলের ক্যাম্প গুটিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা জলযান যােগে ডেমরা অভিমুখে রওনা হয়। শীতলক্ষা নদীর পশ্চিম তীরের কায়েতপাড়া। ইউনিয়নের বড়ালু বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে এবং নদীর উভয় তীর থেকে। অ্যামিবুশরত মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধাদের গােলাবারুদ সীমিত থাকায় ঘন্টা খানেক সময়েই আক্রমণের ইতি টেনে বাংকার ছেড়ে সরে পড়েন। তারপর শুরু হয় চোরাগােপ্তা হামলা। গঙ্গানগর চরে বিক্ষিপ্তভাবে ৮জন শক্রকে মুক্তিযােদ্ধা ও এলাকাবাসী পিটিয়ে হত্যা করে নদীতে ভাসিয়ে দেন। এমতাবস্থায় শক্র দ্রুতগতিতে নৌযান যােগে নারায়ণগঞ্জ চলে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে এখানে কেউ হতাহত হন নি। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. মাে. আ. কুদুস ভূইয়া ২. মাে, কেরামত আলী। ৩. আবু জাহান ভূইয়া ৪, বশীর আহাম্মদ চানু। ৫. ফশিরউদ্দিন আহম্মদ ৬. মনিরুজ্জামান খান।
মদনগঞ্জের যুদ্ধ
বন্দর থানায় মদনগঞ্জ একটি শিল্প সমৃদ্ধ এলাকা। এ এলাকায় প্রচুর ধান উৎপন্ন হয় বিধায় এখানে কয়েকটি রাইস মিল স্থাপিত হয়েছে। ১০ ডিসেম্বর মদনগঞ্জ গাল্লা বরাবর খালের এপার-ওপার পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের। সম্মুখযুদ্ধ হয় এবং যুদ্ধে মদনগঞ্জ গাল্লার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। মদনগঞ্জ ক্যাপিটাল রাইস মিল সংলগ্ন বিলের মাঝে বাংকারে শক্রর অবস্থান। শীতলক্ষ্যা নদীতে অবস্থিত শত্রুর গানবােট থেকেও প্রচুর গুলি বর্ষণ করা হয়। সে যুদ্ধে ৩জন পাকিস্তানি সেনা মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে বাংকারে নিহত হয় এবং ২জন রাজাকারকে আহত অবস্থায় ধরা হয়। পরবর্তী সময় তাদের হত্যা করা হয়। মদনগঞ্জ যুদ্ধে অনেক মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। যুদ্ধের নেতৃত্ব দেন। অধিনায়ক এস এইচ ছিদ্দিক (তপন)। অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১, মফিজুল ইসলাম ২. মনির হােসেন (শাহেনশাহ)। ৩. মাে. আলী মােল্লা। ৪. মনির হােসেন ৫. তাওলাদ হােসেন ৬. আলী হক ৭. আ. সাত্তার (মরণ) ৮. গুল মােহাম্মদ ৯, মােদাব্বের হােসেন ১০. নাসির উদ্দিন। ১১. বরকত উল্লা ১২. আজাহার উদ্দিন ১৩. ফয়েজ আহম্মেদ। ১৪. রফিকুল ইসলামসহ আরও অনেকে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!