You dont have javascript enabled! Please enable it!
রাজাপুরের যুদ্ধ
নারায়ণগঞ্জ সদর থেকে উত্তরে রূপগঞ্জ থানায় গাজীপুর জেলার সীমান্তে রাজাপুর গ্রামের অবস্থান। ২৯ নভেম্বর ভাের ৪টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাপুর আক্রমণ করে। এ দুর্গম অঞ্চলে শক্রর আগমনের উদ্দেশ্য বােঝা না গেলেও অনুমান করা হয় যে, তারা মুক্তিবাহিনীর খোঁজে এসেছিল। বাস্তবেও গ্রামে মুক্তিবাহিনী ছিল তবে সংখ্যায় কম ও অপ্রস্তুত। মুক্তিযােদ্ধারা সাধ্যমতাে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। আশপাশের ১২-১৪টি গ্রামে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে এবং বিকাল ৪টা পর্যন্ত খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সিরাজুল ইসলাম, আমিনুল, গােপীনাথ, মাহফুজুর রহমান প্রমুখ ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর কাছে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় এবং লােকবল স্বল্পতার জন্য একপর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা রাজাপুর, লক্ষ্মীনগর, রামনগর, গঙ্গানগর, কানাইনগর, রাধানগর, মধ্যনগর, গোপালনগর, আলীরটেক, মুক্তারকান্দি প্রভৃতি গ্রামগুলাে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। শত্রুর হাতে প্রায় ১৩৯জন নিরীহ গ্রামবাসী শহিদ হন। শহিদেরা লক্ষ্মীনগর ও মুক্তারকান্দি কবরস্থানে শায়িত আছেন। পূর্বে ৪ নভেম্বর বক্তাবলী ইউনিয়ন দক্ষিণ সীমানা তালতলা বাজার, ডাকবাংলাে অধিনায়ক মফিজুল হকের নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রু ক্যাম্পটি দখল করে নেন। এবং বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন। এ যুদ্ধে ১জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক মফিজুল হক গুরুতর আহত হন।
বক্তাবলী এলাকার যুদ্ধ
নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ঢাকা জেলার সীমান্তে বক্তাবলী অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সময়ে নারায়ণগঞ্জ শহরের দক্ষিণাংশে গােগনগর ইউনিয়নের বুড়িগঙ্গা নদীর পূর্বাঞ্চলে অর্থাৎ গােগনগর (মসিনাবন্দ) ও সৈয়দপুরে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। সেপটেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা শহরের বিভিন্ন স্থানে অপারেশন পরিচালনা করেন। গােগনগর ও সৈয়দপুরের মাঝামাঝি লুহিয়ারকুম (জলাধার), সৈয়দপুরস্থ জিএমসি মাঠের অপারেশনে পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হওয়ার পর শক্র নির্বিচারে গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে থাকে এবং মুক্তিবাহিনীর সন্ধানে নিরীহ জনসাধারণের উপর অত্যাচার বাড়িয়ে দেয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা বুড়িগঙ্গার পশ্চিম পাড় অর্থাৎ কুরেরপাড়, আলীরটেক, মুক্তারকান্দি, লক্ষ্মীনগর, বক্তাবলীতে ক্যাম্প স্থাপন করেন এবং যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এসব ক্যাম্প থেকেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। ঐ সমস্ত ক্যাম্প যুদ্ধকালীন নারায়ণগঞ্জ থানা অধিনায়ক গিয়াসউদ্দিনের দলের কতিপয় সদস্য সালাউদ্দিন, তপু, এমদাদুল হক বাচ্চু, নাজির উদ্দিন, আবু বক্কর সিদ্দিক, গফুর, আউয়াল চৌধুরী, আফাজ, রিয়াজুল করিম, বাসার, এস এম গিয়াসউদ্দিন, এস এম মােসলেহ উদ্দিন, শরীফ, ছিদ্দিক, মতিউর রহমান, আমিনুর দলের আমিনুর, এমরান, আফজাল, রাশেদ, আলী আজগর, কমর উদ্দিন দলের কমর উদ্দিন, আ, কাদির, মাইন উদ্দিন দলের মাইন উদ্দিন, মালেক ও গােপীনাথ সাহা দলের গােপীনাথ, পরিমল, জাহাঙ্গীর, শরিয়তুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম দলের সিরাজুল ইসলাম, আজাহার, তমিজ উদ্দিন রিজভী, ফয়েজ আহম্মেদ, দেওয়ান আবদুল করিম ও মাহফুজুর রহমান, জানে আলম। ছাত্তার (মরণ), রব, সফি উদ্দিন, ইসমাইল, কমল গ্রুপের ফয়েজ আহম্মেদ মাসুম, মজিবুর ও হায়দার আলী সবাই স্থানীয়ভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা।
২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ ও পরে। মেজর হায়দারের নির্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী স্থানীয়ভাবে স্থাপিত পরগনাসহ অন্য ক্যাম্পগুলাের সমন্বয়সাধন করতেন মাহফুজুর রহমান। মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জের উত্তরাংশে ও বন্দর এলাকায় অবস্থানরত তকালীন থানা অধিনায়ক গিয়াসউদ্দিন যৌথভাবে সেক্টর অধিনায়কের নির্দেশিত পরিকল্পনা বাস্ত বায়নে কর্মসূচি প্রণয়ন করতেন। কৌশলগত দিক থেকে আলীরটেক ও বক্তাবলী পরগনা বুড়িগঙ্গা নদীর কারণে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিচ্ছিন্ন একটি এলাকা। পাকিস্তানি বাহিনী সরাসরি ঐ এলাকায় যাতায়াত করতে পারত না। মুক্তিযােদ্ধারা এটিকে মুক্ত এলাকার মতাে বিবেচনা করে নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এবং সেখান থেকেই। নারায়ণগঞ্জ শহরে অপারেশন পরিচালনা করতেন। শত্ৰু আতঙ্কে থাকলেও প্রকৃতপক্ষে ঐ এলাকায় শুধু মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারাই অবস্থান করতেন। সেখানে কোনাে নিয়মিত বাহিনী ছিল না। ২৯ নভেম্বরের সুবেহ সাদিক। শীতের ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন সকাল। অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে ঐ এলাকার বিভিন্ন পয়েন্টে কয়েকটি গানবােট থেকে প্রায় ৫০০জনের উপর পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার অবতরণ করে। প্রথমে তারা সমস্ত পরগনা ঘিরে ফেলে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় অতর্কিতে মুক্তিযােদ্ধা অবস্থানগুলােয় আক্রমণ চালায়। এ সময় তাদের কাছে ভারী মর্টারও ছিল। হঠাৎ আক্রমণ শুরু হওয়ায় বিভিন্ন ক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধাদের গ্রুপগুলাে একত্র হওয়ার সুযােগ না পেয়ে যার যার ক্যাম্প থেকে শত্রুর অগ্রযাত্রায় বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। সর্বপ্রথম শক্ত প্রতিরােধের সম্মুখীন হয় কুরের পাড়ে ও আলীরটেকের মাঝ চরে। পূর্ব দিক থেকে প্রতিরােধ গড়ে তােলে গিয়াসউদ্দিনের একাংশ এবং পশ্চিম দিক থেকে মাইন উদ্দিনের দল। আবার মুক্তারকান্দি, কানাইনগরে একদিকে মাহফুজুর রহমান, জানে আলম, রব ও অন্যরা এবং অন্যদিকে আমিনুর, এমরান গ্রুপসহ অন্যরা প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। এ প্রতিরােধে আলীরটেকে ১জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত এবং কয়েকজন আহত হয়। আলীরটেক অঞ্চল থেকে এক কৃষক শক্রর ১টি বিধ্বস্ত ওয়্যারলেস সেট ও কিছু রক্তমাখা জামাকাপড় মুক্তিবাহিনীর কাছে হস্তান্তর করেন। ভােরের আলাে ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় মুক্তিবাহিনী পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়। কারণ, তারা পাকিস্তানি সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়ায় সম্মুখযুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়।
শত্রুর সাথে দিনের বেলায় যুদ্ধ করার মতাে নূ্যনতম ভারী অস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ছিল না। যদিও তাদের মনােবলের অভাব ছিল না। এলাকার ছাত্র-জনতাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের সাথে সহযােগী হিসেবে সর্বাত্মক সহযােগিতা করেন। মুক্তিবাহিনীর প্রতিরােধ ও খণ্ডকালীন যুদ্ধের সময় শক্র তাদের অগ্রযাত্রা কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখে। ঠিক সে সময়ই মুক্তিবাহিনী পিছু হটার কৌশল অবলম্বন করে এবং এলাকার পুরুষ ও যুবক নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে সক্ষম হয়। দিনের আলাে বাড়ার সাথে সাথে শত্রুর কয়েকটি হেলিকপটার থেকে। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান ও গতিবিধি নির্ণয়ের চেষ্টা করে এবং অবস্থান বুঝে গুলি। বর্ষণ করে। শত্রুরা মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে এলাকার প্রায় ১৩৯জন নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে ও জীবন্ত অগ্নিদগ্ধ করে হত্যা করে। এলাকার সমস্ত বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। পিছু হটে। মুক্তিযােদ্ধারা মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার তালতলায় জড়াে হতে থাকেন। দিনের মাঝ পর্যায়ে সিরাজদিখান থানার মুক্তিযােদ্ধা জামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযােদ্ধা তাদের সাথে মিলিত হয় এবং পালটা আক্রমণের চিন্তা করে। কিন্তু কোনাে মুক্তিযােদ্ধা গ্রুপের কাছে ভারী অস্ত্র ও যথেষ্ট গােলাবারুদ না। থাকায় পালটা আক্রমণ সম্ভব হয় নি।
আনন্দবাজার ঘাটে অ্যামবুশ
নারায়ণগঞ্জ জেলার সােনারগাঁও থানায় আনন্দবাজার অবস্থিত। মেঘনা নদীর পাড়ে আনন্দবাজারের অবস্থানের কারণে আনন্দবাজার ঘাট দিয়ে নৌযানে। সহজে পারাপার হয়ে মুক্তিযােদ্ধারা যাওয়া-আসা করতেন। ২৬ মার্চের পর। থেকে বিভিন্ন এলাকার শরণার্থী ও মুক্তিযােদ্ধারা আনন্দবাজার ঘাট থেকে নদীপথে ভারতে আসা-যাওয়া করতেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকার মুক্তিযােদ্ধারা ভারত থেকে আসার সময় আনন্দবাজারে অবস্থান করতেন। পর্যায়ক্রমে আনন্দবাজারটি ১টি ট্রানজিট ক্যাম্পে পরিণত হয়। পাকিস্তানি দোসর এ এস এম সােলায়মান ও তার সহযােগীরা তা সহ্য করতে পারে নি বলে শত্রুকে উল্লিখিত বিষয়ে অবহিত করে। যার ফলে শত্রুরা গানবােট নিয়ে ১ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক ৮টায় আক্রমণ চালানাের উদ্দেশ্যে আনন্দবাজার আসার চেষ্টা করে। এ এলাকার কাছাকাছি অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা তাৎক্ষণিকভাবে পালটা আক্রমণের পরিকল্পনা করে বারদী থেকে বৈদ্যের বাজার ঘাট পর্যন্ত মেঘনা নদীর তীরে অ্যামবুশ করে বসে থাকেন। আনােয়ার হােসেন কাওসারের দল বারদী ঘাটে, রুহুল আমিন বাদশার দল আনন্দবাজার ঘাটে এবং রামদীর খালে। অধিনায়ক মােহাম্মদ আলীর দল, মােবারকপুর গ্রামে হাবিবুল্লা, আবদুল খালেক।
সােহেল ও ইব্রাহীম অবস্থান নেন। শক্রর গানবােট রেঞ্জের কাছাকাছি আসার সাথে সাথেই মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ আরম্ভ হয়। শুরু হয় পালটা আক্রমণ। ঘণ্টা খানেক যুদ্ধের পর শক্রর দল গানবােট নিয়ে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে প্রায় ৫০-৬০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে কয়েকজনের নাম নিমে উল্লেখ করা হলাে: ১. সুলতান আহম্মদ মােল্লা। ২. অধিনায়ক মােহাম্মদ আলী ৩. অধিনায়ক রুহুল আমিন ৪. সিরাজুল ইসলাম ৫. আব্দুল মতিন। ৬. সুরু মিয়া ৭. লাল মিয়া ৮, রেহাজ আলী ৯, মােসলেহ উদ্দিন ১০. নুরুল ইসলাম ১১. আব্দুল গফুর ১২. গােফরান ১৩. ইলিয়াস ১৪. আক্কাস আলী ১৫. আলমাস। ১৬. আবদুর রশিদ ১৭, নজরুল খন্দকার ১৮, শাহজাহান খন্দকার। ১৯. আলমগীর সরকার ২০. আবু ওহাব সামসুর রকি ২১. দেলােয়ার হােসেন। ২২. মােশারফ। ২৩. ইব্রাহিম খলিল ২৪. আব্দুল আউয়াল ২৫. খসরু।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!