You dont have javascript enabled! Please enable it! লাঙলবন্দ ব্রিজ অপারেশন - কালীগঞ্জ মসলিন কটন মিল অপারেশন - ভােলাবাের যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
লাঙলবন্দ ব্রিজ অপারেশন
বন্দর থানার লাঙলবন্দ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের একটি তীর্থস্থান। এখানে প্রতি বছর হাজার হাজার হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ পাপ মুক্তির জন্য স্নান করে থাকে। বহু প্রতীক্ষার পর ২জন ইপিআর সৈন্যের সহযােগিতায় লাঙলবন্দ ব্রিজের অপারেশন পরিচালনা করা হয়। ব্রিজ রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ৪জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করা হয়। এ অপারেশনে সর্বমােট ২২জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। অপারেশনের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১ নভেম্বর গভীর রাতে অপারেশনের সময় নির্ধারিত করা হয়। রাত ৩টা থেকে শত্রুর পরবর্তী ডিউটি থাকায় তারা সন্ধ্যা রাতে ঘুমিয়ে পড়েন। এ সুযােগে পরিকল্পনা মাফিক ইপিআর সদস্যরা গ্রিন সিগন্যাল দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। বাকি ২জন ইপিআর সৈনিক মুক্তিযােদ্ধাদের নেয়ার জন্য ব্রিজ থেকে লাঙলবন্দ বাজারে চলে আসেন। পূর্বেপ্রস্তুত থাকা মুক্তিযােদ্ধারা ইপিআর সদস্যদের সাথে নিয়ে ঘুমন্ত পাকিস্তানি। সৈন্যদের উপর আক্রমণ করেন।
দ্রুত প্রস্তুত হয়ে তারা মুক্তিবাহিনীকে প্রতিরােধ করার চেষ্টা করে। তা সত্ত্বেও পাকিস্তানি সৈন্যদের ৪জন নিহত হয়। এ যুদ্ধে এলএমজিসহ বহু অস্ত্র ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। ফেরার পথে তারা অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন দিয়ে ব্রিজের ক্ষতিসাধন করে। পরবর্তী। সময়ে বিবিসি, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ও ভয়েস অব আমেরিকা থেকে এ অপারেশনের খবর প্রচার করা হয়। এ যুদ্ধে অধিনায়ক গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. সাহাবুদ্দিন খান সবুজ ২. জি কে বাবুল। ৩. নুরুজ্জমান। ৪. দুলাল। ৫. জালকুড়ীর শফি ৬. নুরুল ইসলাম। ৭. অধিনায়ক ইসমাইল ৮, আ, আউয়াল ৯. জাফর উল্লা সাউদ ১০. লাঙলবন্দের গিয়াসউদ্দিন ১১. জসিম উদ্দিন ১২. আলী আজগর ১৩. আবদুল কাশেম ১৪. মােরশেদ ১৫. জসিম উদ্দিনসহ আরও অনেকে।
কালীগঞ্জ মসলিন কটন মিল অপারেশন
২৩ নভেম্বর কালীগঞ্জ মসলিন কটন মিলে স্থাপিত পাকিস্তানি সেনা ঘাঁটিতে মুক্তিযােদ্ধাদের পরিকল্পিত হামলায় অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা আনুমানিক সাড়ে ৪০০। এ যুদ্ধে কালীগঞ্জ থানা ও রূপগঞ্জ থানা এলাকায় অবস্থানকারী মুক্তিযােদ্ধাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল সর্বাধিক। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে মসলিন কটন মিলে অবস্থানরত সৈন্য বিপর্যস্ত হয়ে ওয়্যারলেস যােগে ঢাকায় খবর পাঠায় তাদের সাহায্য করার জন্য। ঢাকা থেকে ট্রেনযােগে অধিক সংখ্যক সেনা সদস্য, ৩টি জঙ্গিবিমান, ১টি হেলিকপটার, ২টি ট্যাংক এসে অবতীর্ণ হয়। এ সময়ে তারা হেলিকপটার ও জঙ্গিবিমান থেকে বােমা বর্ষণ করতে থাকে। অন্যদিকে, মুক্তিযােদ্ধারা বেপরােয়াভাবে শক্রর উপর গুলি বর্ষণ করতে থাকেন। এ যুদ্ধে বহু শত্রু হতাহত হয়। মাত্রাতিরিক্ত বােমা বর্ষণে আহত হন কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা মারাত্মক আহত যোদ্ধারা হলেন: ১. আর, ম আফজাল হােসেন (পিতা: মৃত আ. গনি, গ্রাম: মৈকুলী, ইউনিয়ন: তারাব) ২. মাে. আমান উল্লাহ মিয়া (পিতা: মৃত নেওয়াজ আলী, গ্রাম: গন্ধর্বপুর, ইউনিয়ন: তারাব)। বিল্লাল হােসেন (পিতা: মৃত অজ্ঞাত, গ্রাম: জাঙ্গির, ইউনিয়ন: রূপগঞ্জ) ৪. আবু সাঈদ (পিতা: মৃত ইদ্রিস আলী, গ্রাম: গন্ধর্বপুর, ইউনিয়ন: তারাব) আবু সিদ্দিক (পিতা: মৃত রােস্তম আলী, গ্রাম: দক্ষিণ নগ্রাম, ইউনিয়ন ও থানা: রূপগঞ্জ)। রণকৌশলের নিয়ম ভঙ্গ করে এত অধিক সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার অংশগ্রহণ ছিল অনাবশ্যক। যােদ্ধাদের সংখ্যাধিক্যের কারণে সংগঠন ও পরিকল্পনা ছিল দুর্বল। সমন্বয়হীন এ যুদ্ধ ছিল লােকবল ও গুলির অপচয়।
ভােলাবাের যুদ্ধ
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ মহাসড়কের পশ্চিম পাশে ভােলাবাে অবস্থিত এবং মহাসড়ক থেকে ভােলাবাে পর্যন্ত পাকা সড়ক বিদ্যমান। ২৭ নভেম্বর। ভােলাবাে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প। এ ক্যাম্পটিতে ৪৫জন মুক্তিযােদ্ধার অবস্থান। ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের শেষ প্রহর। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রায় সবাই ঘুমিয়ে। গুটিকয়েক মুক্তিযােদ্ধা রাতের আঁধারে ক্যাম্পের ১০০ গজের দূরত্বে থেকে সেন্ট্রি হিসেবে কর্তব্যরত। ক্যাম্পের পূর্ব পার্শ্বে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এ সময়ে সেন্ট্রি হিসেবে দায়িত্ব পালনরত মুক্তিযােদ্ধা গােলাম রশিদ বকুল। এক পর্যায়ে বকুলের টর্চলাইট হঠাৎ আঙুলের চাপে জ্বলে ওঠে। বকুল জানতেন না যে, শক্রর ১টি শক্তিশালী দল ইতঃপূর্বেই তার খুব সন্নিকটে ধানক্ষেতে অবস্থান নিয়েছে। লাইটের আলাে প্রত্যক্ষ করে প্রথমেই লাইট জ্বালার নির্দিষ্ট স্থানে শত্ৰু গুলি ছােড়ে। শক্রর গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়ার সাথে। সাথেই বকুল শুয়ে পড়েন এবং তার হাতের স্টেনগানের ফায়ার করে শত্রুর উপর।
এমতাবস্থায় পাকিস্তানি সেনারা শিলাবৃষ্টির মতাে গুলি করতে থাকে বকুলের উপর। শত্রু ক্রলিং করতে করতে বকুলের অবস্থানে এসে বকুলের অসাড় দেহটি পড়ে থাকতে দেখে। ততক্ষণে গােলাগুলির শব্দ শুনে ক্যাম্পের ঘুমন্ত মুক্তিযােদ্ধার একাংশ আত্মরক্ষার্থে শীতলক্ষ্যা নদী সাতরিয়ে পিতলগঞ্জ গ্রামে আশ্রয় নেন। বাকিরা সব চারিতলুক ও ভােলাবােয় আশ্রয় গ্রহণ করেন। বকুল শহিদ হলেও ৪৪জন মুক্তিযােদ্ধা প্রাণে রক্ষা পান সেদিন। পরদিন শহিদ আবদুর রশিদ বকুলের লাশ মুক্তিযােদ্ধা আবুল কাশেম, আবু জাহানসহ আরও কতিপয় মুক্তিযােদ্ধা অত্যন্ত সন্তর্পণে বকুলের নিজ গ্রাম রূপসীতে নিয়ে আসেন এবং রূপসী কবরস্থানে দাফন করেন। জয়-পরাজয় যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি। কিন্তু অসতর্কতা ও অসাবধানতা যুদ্ধে অপরাধসম। ভােলাবােয় মুক্তিযােদ্ধাদের উপর শত্রুর আচমকা আক্রমণ তারই একটি প্রমাণ। মুক্তিযােদ্ধা বকুল নিজের প্রাণের বিনিময়ে রক্ষা করলেন প্রিয় সহযােদ্ধাদের প্রাণ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড