You dont have javascript enabled! Please enable it! কাইকারটেকের অ্যামবুশ - বৈদ্যের বাজার (সােনারগাঁও) থানা আক্রমণ - ইসদাইর রেলসেতু অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
কাইকারটেকের অ্যামবুশ
২৬ অক্টোবর গানবােট অপারেশনের পর মুক্তিযােদ্ধারা বন্দর থানার কাইকারটেক নামক স্থানে আশ্রয় নেন। বেলা দ্বিপ্রহর। তারা খবর পেলেন, শক্রর ১টি জিপ অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কাইকারটেক ‘হাটের দিকে এগিয়ে আসছে। ১২জনের মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল নিয়ে অধিনায়ক সাহাবুদ্দিন খান। (সবুজ) অ্যামবুশ করার জন্য কাইকারটেকের হাটে অবস্থান নেন। জিপ যখন মুক্তিযােদ্ধাদের আয়ত্তে আসে, তখন তার উপর ফায়ার করেন। ফলে শত্রু বাহিনীর ৪জন নিহত হয়। এখানে ২টি অটোম্যাটিক অস্ত্রসহ ২টি রাইফেল ও গােলাবারুদ মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে এ যুদ্ধের ঘটনা প্রচারিত হয়। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা হলেন: ১. অধিনায়ক সাহাবুদ্দিন খান সবুজ ২. জি কে বাবুল। ৩. নুরুজ্জামান ৪. দুলাল ৫. আজগর ৬. আবদুল আজিজ ৭. সামছুদ্দিন। ৮. কুতুবউদ্দিন ৯. ইসহাক ১০. টুকু ১১. হাতেম ১২. জালাল উদ্দিন ১৩. রুমি।
বৈদ্যের বাজার (সােনারগাঁও) থানা আক্রমণ
ঢাকা-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বৈদ্যের বাজার (সােনারগাঁও) থানা এলাকার ভিতর দিয়ে অতিক্রম করে। থানাটি সদর মহাসড়কের উত্তর পার্শ্বে অবস্থিত। থানা সদর থেকে একটি পাকা সড়ক ঢাকা-কুমিল্লা মহাসড়ক অতিক্রম করে নারায়ণগঞ্জের বন্দর থানাকে সংযুক্ত করে। এ কারণেই এ এলাকা এবং বিশেষ করে চৌরাস্তার গুরুত্ব বৃদ্ধি পায়। সাবেক বৈদ্যের বাজার থানায় পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প ছিল। থানার মুক্তিযােদ্ধাদের গ্রুপ অধিনায়কগণ সমন্বয় সাধন ও আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে। পরিকল্পনা করে ২৭ অক্টোবর তিন দিক থেকে থানায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালান। শত্রুও পালটা আক্রমণ করে। মুক্তিযােদ্ধাদের শক্ত প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তানি সৈন্যরা নাজেহাল হয়ে পড়ে এবং ১৪জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ হতাহত হয় নি। মুক্তিযােদ্ধারা ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিতে দিতে ঐ স্থান ত্যাগ করেন। এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা সমগ্র থানার বিভিন্ন গ্রুপ থেকে একত্রিত হয়ে যুদ্ধ করেন।
ইছাপুরার অপারেশন
রাজধানী শহর ঢাকার উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় উপকণ্ঠে ইছাপুরা, বর্তমানে পূর্বাচল। উপশহর নামে খ্যাত। পার্শ্ববর্তী গ্রাম পর্শি, ধামছি, কাদিরার টেক, পিংলাল এলাকার বিশাল স্থানজুড়ে মুক্তিবাহিনীর প্রায় ৩০টি গ্রুপের অবস্থান। ২৮ অক্টোবর সকাল আনুমানিক ১০টায় ঢাকা সেনানিবাস থেকে হেঁটে প্রায় ১০০জন। পাকিস্তানি সেনা বালু নদীর অপর পাড় থেকে প্রায় ২৫টি নৌকাযােগে অনায়াসে নদী পাড়ি দিয়ে ইছাপুরাস্থ পর্শি বাজারে উপস্থিত হয়। অপর পাড়ের ডুমনী পাতিরা গ্রাম হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্নভাবে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে করতে এগিয়ে যেতে থাকে। পর্শি বাজারস্থিত স্থানীয় চেয়ারম্যান সামসুদ্দিনের একটি দ্বিতল কাঠের ঘরে ডিউটিরত ৩জন মুক্তিযােদ্ধা বীরদর্পে পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমনের দৃশ্য অবলােকন করেন। পাকিস্তানি কমান্ডাে বাহিনীর আগমনের সংবাদ দিতে মুক্তিযােদ্ধারা দৌড়ে বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে ছুটে যান।
এ সময় পর্শি বাজারটি প্রায় অরক্ষিত অবস্থায় থাকায় কমান্ডাে বাহিনী নির্বিবাদে শিলাবৃষ্টির মতাে গুলি ছুড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে বিশালাকার পর্শি বাজারটিতে অগ্নিসংযােগ করে। এখানে বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দা হতাহত হন। ইতােমধ্যে মুক্তিযােদ্ধা সেন্ট্রিদের সংকেত পেয়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন গ্রুপের অধিনায়কগণ পাকিস্তানি বাহিনীর মােকাবিলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকেন। অবস্থানরত অধিনায়কদের মধ্যে এখানে ছিলেন এম এ আজিজ, মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া, এম এ রশীদ, আ, জব্বার খান পিনু, আব্বাস আলী ও আরও অনেকে। স্বল্প সময় ও প্রতিকূল অবস্থায়ও মুক্তিযােদ্ধারা সংগঠিত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। শত্রু তাদের ফায়ারের আয়ত্তে আসার সাথে সাথে শুরু হয় মুক্তিযােদ্ধাদের তুমুল গুলি বর্ষণ। শত্রু সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় আক্রান্ত হয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে। শত্রুর প্রচুর সৈন্য হতাহত হয় বলে ধারণা করা হয়। তারা তাদের যাত্রা স্থগিত করে ঢাকা ফিরে যায়।
ইসদাইর রেলসেতু অপারেশন
ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের সুষ্ঠু যােগাযােগ ব্যবস্থা ছিল সড়ক, রেল ও নৌপথে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের উপর্যুপরি অ্যামবুশ ও আক্রমণের ফলে এ ৩টি পথই। অনির্ভরশীল হয়ে পড়ে। পাকিস্তানি সৈন্যরা সশস্ত্র প্রহরার মাধ্যমে এ ৩টি পথই সচল রাখতে সচেষ্ট থাকে। নারায়ণগঞ্জের সাথে যােগাযােগ অব্যাহত রাখার কোনাে বিকল্প পথ তাদের কাছে ছিল না। মুক্তিযােদ্ধারা একের পর এক হামলা। করে শত্রুদের আক্রমণ ও নাজেহাল করতেন। নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিম প্রান্তে নারায়ণগঞ্জ-ঢাকা রেললাইনের উপর। অবস্থিত ইসদাইর রেলসেতু। পাকিস্তানি সেনা ও রসদবাহী ট্রেন এ পথে নিয়মিত যাতায়াত করে। সাধারণত রাজাকাররা এ সেতুগুলােয় প্রহরায় থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকারদের হত্যা করে ব্রিজটি ধ্বংসের পরিকল্পনা করেন। অক্টোবর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের। মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল ব্রিজ ধ্বংসের জন্য প্রয়ােজনীয় প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ, সেফটি ফিউজ, প্রাইমার কর্ড, ডিটোনেটর নিয়ে রাতে ইসদাইর ব্রিজ আক্রমণ করে। তারা সহজেই ব্রিজ প্রহরারত ৭জন রাজাকারকে হত্যা করে ব্রিজের কর্তৃত্ব গ্রহণ করেন। তারা রাজাকারদের ৭টি .৩০৩ রাইফেল ও গুলি উদ্ধার করেন। তারপর এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ব্রিজটি ধ্বংস করে দেন। এ কে এম ফজলুল হকের নেতৃত্বে এ অপারেশনে যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন: ১. মাে. শহিদুল্লা ২. মুজিবর রহমান ৩. নবী হােসেন প্রমুখ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড