সম্মানদী গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন ও যুদ্ধ
সােনারগাঁও থানার সম্মানদী গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থানীয়ভাবে ১টি শিবির গড়ে ওঠে। যে-সকল যুবককে ভারতে পাঠানাে সম্ভব হতাে না তাদের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের দ্বারা প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে। তা ছাড়া ঢাকা জেলার মুক্তিযােদ্ধাদের ভারতে যাতায়াতের রাস্তা ও বিশ্রামের স্থান হিসেবে এ গ্রামটি নিরাপদ ও অভয় স্থান হিসেবে গড়ে ওঠে। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রী এ এস এম সােলায়মান এ সংবাদ জানতে পেরে মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ শিবিরে আক্রমণের জন্য পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্দেশ দেন। ২৯ সেপ্টেম্বর খুব ভােরে মেঘনা নদীর পশ্চিম তীরে আনন্দ বাজার ঘাটে লঞ্চ ও গানবােট রেখে ১৫-২০টি বড়াে নৌকা, ৩০-৪০টি মাঝারি নৌকা ও ৩টি স্পিডবােট নিয়ে সম্মানদী গ্রামের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশ থেকে সম্মানদী গ্রামস্থ মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটিতে শত্রুরা অতর্কিত আক্রমণ করে। দামােদরদী গ্রামের রাজাকার ইউনুস মেম্বার ও সম্মানদী গ্রামের রাজাকার এমদাদ হােসেন পাকিস্তানি সৈন্যদের পথপ্রদর্শক হিসেবে সহযােগিতা করে। মুক্তিযােদ্ধারাও চতুর্দিক থেকে পালটা আক্রমণ। চালান। প্রায় ৪ ঘন্টা অবিরাম যুদ্ধ চলে। এ যুদ্ধে শক্রর ৪টি নৌকা বিধ্বস্ত হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা ৭জন গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। অগ্নিসংযােগ। করে প্রায় ৪০টি ঘর পুড়িয়ে দেয়। শত্রুর গানবােট থেকে মর্টার শেল নিক্ষেপ শুরু হলে মুক্তিযােদ্ধারাও অধিক শক্তিপ্রয়ােগের জন্য অলিপুর বাজারে অবস্থানরত ঢাকার খসরু গ্রুপের শরণাপন্ন হন। পর্যাপ্ত গােলাবারুদসহ খসরুর। দল ঘটনাস্থলে পৌছার পূর্বেই পাকিস্তানি সৈন্যরা স্থান ত্যাগ করে চলে যায়।
সিদ্ধিরগঞ্জ ইএসএসও (ESSO) কোম্পানি আক্রমণ
ইএসএসও (ESSO) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১টি বিখ্যাত তেল কোম্পানি হিসেবে পরিচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জের (ফতুল্লা থানাধীন) গােদনাইলে দেশের বৃহত্তম তেলের ডিপাে ছিল। সিদ্ধিরগঞ্জে ছিল ইএসএসও (ESSO)-এর বৃহত্তম অফিস। এসব তেল কোম্পানির অফিস ও ডিপাে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করে সেখানে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তার দায়িত্বে পাকিস্তানি সৈন্য ও পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করে। সেপটেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে সন্ধ্যার পর মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধিরগঞ্জ ইএসএসও কোম্পানিতে আক্রমণ করে ২জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করেন এবং ১০জন পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। ঐ অপারেশনে ২টি চাইনিজ রাইফেল, ১০টি .৩০৩ রাইফেল ও কিছু গােলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সবাই অক্ষত ছিলেন।
লক্ষ্মীনারায়ণ পােস্ট অফিসে আগুন
৪ অক্টোবর দুপুর সাড়ে ১২টায় বন্দর থানায় অবস্থিত লক্ষ্মীনারায়ণ পােস্ট অফিসে আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেওয়া হয়। মুক্তিযােদ্ধারা জালকুড়ি থেকে সাড়ে ১১টায় গােদনাইলে পৌছে। সাদাসিধা বেশে মুক্তিযােদ্ধারা লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলে আসেন। পরিচিত ২-১জনে জানতে চায় তাদের কোনাে অসুবিধা হচ্ছে কি না? বিনিময়ে মুক্তিযােদ্ধারা লােকজনকে অন্যত্র সরে যেতে বলেন। এরই মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা খুব তাড়াতাড়ি পােস্ট অফিসে ঢুকে পড়েন। পােস্টমাস্টার ও পিয়নকে অফিস থেকে বের করে দিয়ে লােকজনকে চলে যেতে বলার সাথে সাথে অফিস ফাকা হয়ে যায়। মুক্তিযোেদ্ধারা আলমারি, চেয়ার, টেবিল ও ফাইলপত্র যা আছে, তাতে কেরােসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিয়ে নিরাপদে ট্রানজিট পয়েন্টে ফিরে আসেন। মুক্তিযােদ্ধা আলী হােসেনের গ্রুপ এ অপারেশন পরিচালনা করে। সেক্টর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খালেদ মােশাররফের নির্দেশ মতাে পােস্ট অফিসের টাইপরাইটার মেশিন ও টেলিফোন সেট সেক্টর সদর দপ্তরে জমা দেওয়া হয়।
কাখন বাজার অপারেশন রূপগঞ্জ থানার কাঞ্চন বাজার নারায়ণগঞ্জ মহকুমার ১টি শিল্পাঞ্চল হিসেবে। পরিচিত। কাঞ্চন বাজারের সন্নিকটে নবারুণ জুট মিলে ছিল পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্প। ক্যাম্পের সেনা সদস্যদের বাজার করার জন্য প্রতিদিন ২জন সেনা সদস্য বাজারে কেনাকাটা করতে আসত। তারা বীরদর্পে চলাচল করত।
দেখে মনে হতো, এরা যেন কাঞ্চন এলাকার জমিদার এবং সবাই ওদের চোখে ঘৃণ্য জীৰ। ব্যাপারটি সবার কাছে ছিল দারুণ পীড়াদায়ক। তারা এ দেশের মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতাে না। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক মির্জা মাে. আরমানের কাছে এটা সাংঘাতিক অপমানজনক মনে হতাে। শত্রু সেনাদ্বয় বাজার করতে এসে অধিকাংশ সময়ই জিনিসপত্র নিয়ে টাকাপয়সা দিত না। এ অভিযােগ ছিল প্রায় প্রতিদিনের। ঘটনাগুলাে মির্জা মাে. আরমানের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। এ অবস্থার মূলােৎপাটনের লক্ষ্যে অধিনায়ক মির্জা মাে. আরমান তার সহযােদ্ধাদের সাথে গােপন পরামর্শ করে ঠিক করলেন যে, পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যা করতে হবে। ১০ অক্টোবর ওদের উপর আক্রমণ চালাবেন বলে নির্ধারণ করলেন। স্থান ঠিক করলেন, কাঞ্চন বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বের মােড়ে বর্তমানে যেখানে চাঁদমহল সিনেমা হল। হলের পূর্ব পার্শ্বে একটি গলি। নবারুণ মিলে যাতায়াত করতে হলে চাঁদমহল সিনেমা হলের সম্মুখ দিয়েই আসা-যাওয়া করতে হয়। ১০ অক্টোবর সকাল থেকেই অধিনায়ক আরমান অপর ২জন সহযােদ্ধাকে সাথে নিয়ে অ্যামবুশের জন্য গলির ভিতরে ওত পেতে বসে থাকেন শত্রু সৈন্য দ্বয়ের আগমনের অপেক্ষায়। সাড়ে ১০টার সময় শিকার স্টেনগানের আওতার মধ্যে উপস্থিত হওয়ার সাথে সাথেই অধিনায়ক আরমান ও অপর দুই সহযােদ্ধার স্টেনগানের গুলি বর্ষণ শুরু করেন। লুটিয়ে পড়ে ২জন শত্রু সেনা। আক্রমণের পর দ্রুত সটকে পড়েন মুক্তিযােদ্ধারা। গুলির শব্দে বাজার ফাকা।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড