You dont have javascript enabled! Please enable it!

এবার উ থান্টের মধ্যস্থতা

ঢাকায় গৃহবন্দী রয়েছেন ভারতীয় ডেপুটি হাই-কমিশনার এবং তাঁর সহকর্মীরা। এতদিন কলকাতায় বহাল তবিয়তে ছিলেন পাক ডেপুটি হাই-কমিশনার মেহদী মাসুদ এবং তার তিরিশজন অবাঙ্গালী কূটনৈতিক কর্মী। সুইজারল্যান্ড করতে চেয়েছিল মধ্যস্থতা। বাগড়া দিলেন ইসলামাবাদ। সব ভেস্তে গেল। ইয়াহিয়ার দাবী, প্রাক্তন পাক ডেপুটি হাই-কমিশনের বাঙালী কর্মীদের সঙ্গে দেখা করবেন মাসুদ। তার ব্যবস্থা করতে হবে ভারতকে। নয়াদিল্লীর বক্তব্য পরিষ্কার। কলকাতার প্রাক্তন পাক-মিশন রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশ মিশনে। এই মিশনের প্রধান এম হুসেন আলি এবং তার বাঙালী সহকর্মীরা অস্বীকার করেছেন পাকিস্তানের আনুগত্য। তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক। পাক-ডেপুটি হাই-কমিশনার মাসুদ অনায়াসেই দেখা করতে পারেন তাদের সঙ্গে। কিন্তু ভারত নেবে না এই সাক্ষাৎকার ঘটাবার দায়িত্ব। সুইস প্রতিনিধি যদি প্রস্তাবিত দেখা-সাক্ষাতের সময় উপস্থিত থাকতে চান, তাতে আপত্তি নেই নয়াদিল্লীর। এ-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলেন ইসলামাবাদ। গৃহবন্দী হলেন ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা। এই ঘটনার অনেকে পরে নড়ল নয়াদিল্লীর টনক। তারাও খানিকটা বাধানিষেধ আরােপ করলেন মাসুদের উপর। চলল অচল অবস্থা। সুইস প্রতিনিধিও হয়ে পড়লেন নিষ্ক্রিয়।
এদিকে প্রতিদিন হাজার হাজার শরণার্থী আসছেন ভারতে। তাদের ক্রমবর্ধমান চাপে সবাই ভুলতে বসেছিলেন ঢাকার বন্দী ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীদের। নয়াদিল্লী রাষ্ট্রসঙ্ঘের সেক্রেটারী জেনারেল উ থান্টের কাছে অভিযােগ আনলেন জেনিভা কনভেনশন ভেঙেছেন ইসলামাবাদ। একটা বিহিত দরকার। মধ্যস্থতার অনুরােধ জানালেন উ থান্টকে। সাড়া দিয়েছেন সেক্রেটারী জেনারেল। তিনি হয়েছেন সক্রিয়। রাষ্ট্রসঙ্ঘের পাক-দূত আগা শাহী তাকে লিখেছেন চিঠি। পাকিস্তান সব কিছুতেই রাজী। ফ্যাসাদ বাধাচ্ছে। ভারত। কলকাতার প্রাক্তন পাক ডেপুটি হাই-কমিশনের বাঙালী কর্মীরা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারছেন তাদের মতামত। ওদের মুখে কুলুপ এঁটে দিয়েছেন নয়াদিল্লী। এই কুলুপটা খুলে নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কুলুপ ভােলার ব্যবস্থা নাকি ঠিক হয়ে গেছে। সুইস প্রতিনিধিরা বাংলাদেশ মিশনের কর্মীদের প্রত্যককে করবেন একই ধরনের প্রশ্ন। সামনে থাকবেন মাসুদ এবং ভারতীয় প্রতিনিধি। যারা পাকিস্তানে যেতে চান তারা যাবেন পাকিস্তানে। যারা থাকতে চান তারা থাকবেন এখানে। কোন জেরজবরদস্তি চলবে। এই জিজ্ঞাসাবাদরে পালা চুকে গেলেই পাক-ভারতের মধ্যে হবে কূটনৈতিক কর্মী বিনিময়।
সমস্যাটির আন্তর্জাতিক গুরুত্ব সাংঘাতিক। সমাধানের পথটি হাস্যকর। যে প্রস্তাবে পাকিস্তান এখন রাজী, সে প্রস্ত বি তাে আনেক আগেই এসেছিল। তা বাতিল করেছিলেন ইসলামাবাদ। তাদের গো-বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে প্রাক্তন পাক-মিশনের সব কর্মীকেই পাঠাতে হবে পাকিস্তানে। এ-দায়িত্ব নেবে ভারত। তা না হলে ছাড়া পাবেন না ঢাকার ভারতীয় কূটনৈতিক কর্মীরা। বাংলাদেশ মিশনের প্রধান হুসেন আলি এবং তার বাঙালী সহকর্মীরা দিনের পর দিন করছেন ইয়াহিয়ার মুন্ডপাত। সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় তারা উৎসর্গীত প্রাণ। ইসলামাবাদের একথা অজানা নেই। তবু জল ঘােলা করেছেন পাক-স্বৈরাচারীরা। সুইস প্রতিনিধিরা হুসেন আলির সহকর্মীদের একএকজনকে ডেকে জিজ্ঞাসা করবেন কবুল? ওরা যদি বলেল—কবুল’ তবে ওদের পাঠানাে হবে পাকিস্তানের ঘর করতে। আর যদি বলেন—‘না’ তবে নিরাশ হয়ে ফিরবেন মাসুদ। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধারা বুলেট দিয়ে দিচ্ছেন পাক-ধৃষ্টতার জবাব। কলকাতায় এধরনের জবাব দেবার সুযােগ নেই। বাংলাদেশের মুক্তিকামী কর্মীদের চোখে আগুনের ফুলকি। ইয়াহিয়ার ঘাতকেরা তাদের স্বজনদেরই করেছে পাইকারী হবে হত্যা। ওদের মা-বােনেরা হয়েছেন ধর্ষিতা। তারপরও ইসলামাবাদ আশা করছেন তাদের আনুগত্য। এমন নির্বোধের দল যে-দেশের শাসক, সে-দেশের বিড়ম্বনা অনিবার্য। রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাহায্যের দরকার পাকিস্তানের। তাই হয়ত সে চটাতে চায়নি উ থান্টকে। কিন্তু ইসলামাবাদকে বিশ্বাস নেই। নতুন নতুন ফ্যাকরা তুলতে তাদের জুড়ি নেই। বাংলাদেশ মিশনের কর্মীরা সবার সামনে যখন মাসুদের মুখে চপেটাঘাত করবেন, তখন হয়ত বের হয়ে আসবে আর একটা শয়তানি মতলব। উ থান্টের প্রচেষ্টার সাফল্য কামনা করবেন সবাই। কিন্তু ঢাকার ভারতীয় মিশনের কর্মীরা কলকাতায় না আসা পর্যন্ত স্বস্তি পাবেন না কেউ। কারণ, ইয়াহিয়া শয়তান, ইয়াহিয়া বিশ্বাসঘাতক, ইয়াহিয়া নরঘাতী এবং ইয়াহিয়া সভ্য দুনিয়ার লজ্জা। কথার খেলাপ তার বজ্জাতির স্বাভাবিক রূপ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৯ জুন ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!