You dont have javascript enabled! Please enable it!
উলন বিদ্যুৎ লাইন অপারেশন
শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপগঞ্জ থানায় উলন অবস্থিত। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন থেকে ঢাকাস্থ উলন বিদ্যুৎ সঞ্চালনের বৃহদাকার খুঁটির মাধ্যমে ঢাকাডেমরা সড়কের উপর দিয়ে ধার্মিক পাড়ার উত্তর পাশ দিয়ে বিদ্যুৎ সঞ্চালন হতাে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে মেজর এ টি এম হায়দারের পরিকল্পনা অনুযায়ী ওয়াপদার (WAPDA – Water and Power Developement Authority) নির্বাহী প্রকৌশলী মমিনুল হক ভূঁইয়ার তৈরি নকশানুযায়ী অপারেশন করার প্রয়ােজনে রেকি করতে যান মাে. এনায়েত আলী, আবদুল খালেক, আর, ম আফজাল হােসেন, বারেক ও আলী আকবর । মুক্তিযােদ্ধারা রেকি করতে গিয়ে দেখতে পান, বিদ্যুৎ টাওয়ারের ও স্টিলের পিলারের চারদিকে অসংখ্য ছােটো-বড়াে মাইন পুঁতে রাখা হয়েছে। পানির নিচে বড়াে আকারের ৪টি করে মাইন পিলারের চার কোণে এবং ছােটো মাইনগুলাে। তারের সঙ্গে সংযােগ করে বুবি ট্র্যাপ (Booby Trap) তৈরি করে রেখেছে। যাতে কোনাে কিছুতে চাপ পড়ার সাথে সাথে বা টান লাগার সাথে সাথে বিস্ফোরণ ঘটে। এমনি এক অবস্থায় মাে. এনায়েত আলী ও তার সহযােদ্ধা। আলী আকবর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে সংযােজিত তার ও মাইনগুলাের সংযােগ বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন এবং রাত ১১টায় ডিঙি নৌকাযােগে চিহ্নিত খুঁটিগুলাের কাছে গিয়ে নিজস্ব আঙ্গিকে প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ৩টি টাওয়ার ও ৪টি স্টিলের পিলার ধ্বংসের ব্যবস্থা করেন। রাত ১২টা ২০ মিনিটের সময় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পিলার ও খুঁটি ধ্বংস করা হয়। এ অপারেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।
নবীগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন অপারেশন
শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে বন্দর থানা এলাকায় নবীগঞ্জ অবস্থিত। নবীগঞ্জ বাজারে টি, হােসেন রােডে অবস্থিত বন্দর থানার বিদ্যুৎ সরবরাহের একমাত্র পাওয়ার স্টেশন ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যার সময় এক্সপ্লোসিভ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। উত্তরে কঁচপুর, মদনপুর এবং দক্ষিণে কলাগাছিয়া ও শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ঐ পাওয়ার স্টেশন থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহসহ আবাসিক এলাকাতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতাে। এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাছেই ছিল লােহিয়া ও ফেব্রিক্স পাট কোম্পানি। এ কোম্পানিগুলােয় পাকিস্তানি সৈন্যদের স্থায়ী ক্যাম্প ছিল। ফলে প্রথম বার ধ্বংস করার পর তারা জরুরি ভিত্তিতে নতুনভাবে ২০ দিনের মধ্যে ট্রান্সফর্মার বসিয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে থাকে এবং সেখানে ২০জন সশস্ত্র দল পাহারায় নিযুক্ত করে। তারপরও মুক্তিযােদ্ধারা। নতুন করে পরিকল্পনা নিয়ে দেড় মাসের মাথায় ২০জন মিলিশিয়া ও পুলিশকে। আত্মসমর্পণে বাধ্য করে ২০টি ৩০৩ রাইফেল উদ্ধার করেন। আবারও টিএনটি এক্সপ্লেসিভ (TNT Explosive) দিয়ে ঐ ট্রান্সফর্মার দ্বিতীয় বারের মতাে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে চূড়ান্ত বিজয় পর্যন্ত বন্দরে কোনাে বিদ্যুৎ সরবরাহ ছিল না। এ অপারেশ পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন সাহাবুদ্দিন খান সবুজ এবং সর্বমােট ১০জন মুক্তিযােদ্ধা অংশগ্রহণ করেন। তাঁরা হলেন: ১. জি কে বাবুল ২. আলী আজগর ৩, আ, আজিজ। ৪. সহিদ ড্রাইভার ৫. সামছু ড্রাইভার ৬. দুলাল ৭. গিয়াসউদ্দিন গেসু ৮. হাতেম ৯, লিয়াকত হােসেন ১০. জসিম উদ্দিন কবির।
ইস্ট পাকিস্তান জুট কো-অপারেটিভ অফিসে আগুন
বন্দর থানার আজিম মার্কেটের অদূরে ইস্ট পাকিস্তান জুট কো-অপারেটিভ অফিসে আলী হােসেন গ্রুপের মুক্তিযােদ্ধারা ২২ সেপটেম্বর রাত ৮টা ২০ মিনিটে আগুন দিয়ে সম্পূর্ণ পাট পুড়িয়ে দেন। কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়, তা। নিরূপণ করা যায় নি। তবে গােডাউন বােঝাই পাট ছিল। দিন ছােটো হওয়ায় সন্ধ্যা ৭টায় রাত হয়ে যায়। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের ১৫জনের গ্রুপ রওনা হয় কো-অপারেটিভের উদ্দেশ্যে। পথে কোনােপ্রকার অসুবিধা হয় নি। পথেঘাটে কোনাে লােকজনের আনাগােনা নেই। কোঅপারেটিভ প্রবেশপথে ছােটো ১টি ইটখােলা। প্রহরীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই মুক্তিযােদ্ধারা ভিতরে ঢুকে পড়েন। গেটে এক যােদ্ধাকে রেখে ক্ষিপ্রতার সাথে পাটবােঝাই গােডাউনে মুক্তিযােদ্ধারা দৌড়ে গিয়ে চটের টুকরােতে কেরােসিন ছিটিয়ে আগুন জ্বালিয়ে গােডাউনের ভিতরে নিক্ষেপ করতেই পাটে আগুন ধরে যায়। গােডাউনে এভাবে আগুন জ্বালিয়ে মুক্তিযােদ্ধারা খুব সহজে নিরাপদ স্থানে ফিরে আসেন।
জাঙ্গির অপারেশন
১৯৭১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। কাঞ্চন শিল্পাঞ্চলের আশরাফ জুট মিলে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পের অবস্থান ছিল। শত্রুরা ঐ মিলের ১টি গানবােট নিয়ে প্রায়শ শীতলক্ষ্যা নদীতে টহল দিত। এ সময়টিতে ১০ দিন অন্তর অন্তর ক্যাম্পের সেনা দল ক্যাম্প পরিবর্তন করত। শত্রুর উৎপাতে তখন জনগণ অতিষ্ঠ। স্থানীয়ভাবে নদীর উভয় তীরে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর ক্যাম্প পরিবর্তনের সুনির্দিষ্ট তারিখ জানতে পারেন এবং সে মােতাবেক উভয় তীরের মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে একটি সফল অপারেশনের কথাবার্তা চূড়ান্ত করা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী বাজারের নিকটবর্তী নদীর বাঁকে নদীর পূর্ব তীরে ২টি এবং পশ্চিম তীরে ৩টি স্থানে জাঙ্গির গ্রামের পূর্ব পাশে সুবিধাজনক স্থানে বাংকার করে মাে. এনায়েত আলীর নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করেন। ২৪ সেপ্টেম্বর রাতে উভয় তীরের মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ প্রক্রিয়ার ধরন নিরূপণ ও কৌশল নির্ধারণে পশ্চিম তীরে একত্র হয়ে একটি গুপ্ত স্থানে তাদের সর্বশেষ আলােচনা পর্ব সমাপ্ত করেন। এ সভায় মুক্তিযােদ্ধা মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদকে সংকেত হিসেবে বাঁশিতে জোরে এবং লম্বা সুরে ফু দেওয়ার সাথে সাথে পশ্চিম তীরের ১টি বাংকার থেকে গানবােটের চালককে লক্ষ্য করে গুলি করার দায়িত্ব দেওয়া হয় মুক্তিযােদ্ধা রতনকে। পরদিন ২৫ সেপ্টেম্বর প্রতীক্ষিত সময়টি ঘনিয়ে আসে ১৯ সদস্যবাহী।
গানবােটটি বিকাল ৩টায় মুক্তিযােদ্ধাদের দৃষ্টিগােচর হয়। মুক্তিযােদ্ধারা সবাই সক্রিয় হয়ে ওঠেন এবং যে মুহূর্তে শত্রু বহনকারী গানবােটটি উভয় তীরে অবস্থানরত বাংকারের মধ্যবর্তী স্থানে পৌছায়, তখন পূর্ব সিদ্ধান্ত মােতাবেক অধিনায়ক মেজবাহ উদ্দিন আহম্মেদ বাঁশিতে ফুঁ দেওয়ার সাথে সাথে নদীর পশ্চিম তীরে অবস্থানরত বাংকার থেকে মুক্তিযােদ্ধা রতন এলএমজির ফায়ার শুরু করেন। আকস্মিকভাবে গানবােটটি হঠাৎ তার গতিপথ থেকে নদীতে চক্কর দিতে থাকে। দিশেহারা হয়ে গানবােটে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যরা এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মিলিত ক্রস ফায়ারে বােটটি তখন নদীর পশ্চিম তীরে চরে আটকে যায়। ততক্ষণে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড গুলি বর্ষণে শত্রুপক্ষের গুলি বর্ষণ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। এমনি সময়ে মুক্তিযােদ্ধা রতন, আমানউল্লাহ ও ফিরােজ অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে একযােগে গানবােটে লাফিয়ে উঠে গানবােটে পড়ে থাকা শত্রুর উপর আরেক দফা গুলি বর্ষণ ও বেয়নেট চার্জ করে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করেন। এ অপারেশনে অন্যান্য যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা, সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন: ১. বিল্লাল হােসেন ২. আবু জাহান। ৩. রেফায়েত উল্লাহ ৪. দিল মােহাম্মদ ৫. আ. রউফ। ৬. মনিরুজ্জামান খান ৭. সিরাজ ৮. মান্নান ৯, নাসির ১০. রঞ্জিত কুমার ১১. সন্তোষ ১২. আ, রব ১৩, আফজাল হােসেন। ১৪. আ. রহিম ১৫. ইসহাক প্রমুখ। জাঙ্গির অপারেশনে গানবােট চালক এবং ১৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। অপর দিকে, মুক্তিযােদ্ধারা সবাই অক্ষত থাকেন। হানাদার বাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গােলাবারুদ ইছাপুরায় অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্পে গিয়াসউদ্দিনের কাছে জমা দেওয়া হয়। এ অপারেশনের সংবাদ স্বাধীন বাংলা। বেতারকেন্দ্র ও বিবিসি থেকে ফলাও করে প্রচার করা হয়।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!