বন্দরের যুদ্ধ-২
বন্দরে এইচ এম সেন রােড ও এ এম শাহ রােডের মিলন স্থান অর্থাৎ বন্দর গার্লস স্কুলের বিপরীতে অবাঙালি ও রাজাকার পরিবেষ্টিত ১টি পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্পে মিলিশিয়া গ্রুপ, পাকিস্তান নৌবাহিনীর নৌসেনা, উর্দু কবি তাজকিন তামান্না, আদমজী জুট মিলের সরদার, শান্তি কমিটির সদস্য ও রাজাকার অধিনায়ক আহম্মেদ সরদার, সর্বমােট ২৫-৩০জন সব সময় জমায়েত হতাে। বন্দর থানার সব ইউনিয়নকে পরিচালনা করা হতাে এ ক্যাম্প থেকে। এ ক্যাম্পটি বন্দরের কেন্দ্রীয় ক্যাম্প নামে পরিচিত ছিল। ক্যাম্পের চারদিকে শক্রর আরও ১৫টি ক্যাম্প ছিল এবং প্রতিটি ক্যাম্পেই পাকিস্তানি সৈন্য দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা ছিল। উল্লেখ্য যে, নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দর ও শহরকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করার জন্য শক্ররা বন্দরের ক্যাম্পগুলােকে অস্ত্রশস্ত্র ও রাজাকার, দালাল এবং অবাঙালিদের দিয়ে সব সময়ই ঘিরে রাখত। ফলে তাদের কেন্দ্রীয় ক্যাম্পটি ধ্বংস করা একান্ত প্রয়ােজন হয়ে পড়ে। দীর্ঘ ১ মাস যাবৎ রেকি ও পরিকল্পনা করার পর ঐ কেন্দ্রীয় ক্যাম্পটির উপর ২৮ আগস্ট সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটের সময় হামলা করা হয়। অপারেশনটি ছিল অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। কারণ, দিনের বেলায় বন্দরে ঢােকা সম্ভব নয় বলে ভাের ৪টার সময়ে নৌকা দিয়ে বন্দরের ভিতরে অপারেশন স্কুল থেকে ৪০০ গজ দূরে অবস্থান নেয়া হয়, যার ফলে বহু হিসাবনিকাশ করে তারপর ব্যবস্থা নেয়া হয়। কারণ, এ অপারেশন করার জন্য ৩ মাইল দূরে কাইকারটেক নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধাদের শেল্টার থেকে নৌকা বেয়ে বন্দরে ভােররাতে প্রবেশ করতে হয় এবং সুযােগের প্রতীক্ষায় থাকতে হয়।
সে সময়ে প্রতীক্ষার প্রহর ছিল বড়ােই যন্ত্রণাদায়ক। কে-কখন দেখে ফেলে, কোন পাকিস্তানপ্রেমিক খবর দিয়ে দেয় তাদের প্রভুদের কাছে। পর পর ৬ দিন বন্দরে প্রবেশ করেও ব্যর্থ হন মুক্তিযােদ্ধারা। ২ বার রাজাকাররা মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধ করায় কোমরপানিতে ধইঞ্চে গাছের বাগানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মুক্তিযােদ্ধাদের দাড়িয়ে থাকতে হয়। এ অপারেশনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১জন সৈন্য ও নৌবাহিনীর ১জন নৌসেনাসহ ২জন নিহত হয়। সর্বমােট প্রায় ৩০-৪০জন হতাহত হয়। অপারেশনে শত্রুপক্ষের গুলিতে মুকিএযাদ্ধা জি কে বাবুলের মাথায় গুলি লাগলেও সামান্য আহত হন। | যুদ্ধ পরিকল্পনায় প্রধান ভূমিকা ছিল সাহাবুদ্দিন খান সবুজের। অপারেশনে। অংশগ্রহণ করেন: ১. জি কে বাবুল ২. দুলাল ৩, মােবারক ৪. হাতেম ৫. টুকু।
রেললাইন অপারেশন (বন্দর)
ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ শহরের প্রবেশ মুখেই চাষাড়া রেললাইন অবস্থিত। রেলপথে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাতায়াতে বাধা সৃষ্টি করার লক্ষ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা চাষাড়া এলাকায় রেললাইন ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। অধিনায়ক আব্দুল আজিজ, নাসির উদ্দিন, আলাউদ্দিন, মােস্তফা, আব্দুল আজিজ ও আব্দুর রব ঢালী ভারতের ওস্পিনগরে প্রশিক্ষণ শেষে ৩ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়কের কাছে রিপাের্ট করার পর তাদের আরও ১৫ দিনের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে নারায়ণগঞ্জে পাঠানাে হয়। সেখানে নবীগঞ্জের মােতালেব মিয়ার বাড়িতে থেকে তারা ১টি পাটের গুদামে আগুন ধরিয়ে দেন এবং বন্দর রেললাইনে টহলদার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ট্রাকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করেন। পরবর্তী সময় ৮ সেপটেম্বর তারা চাষাড়া রেললাইনে অ্যান্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করেন। কিন্তু প্রয়ােজনীয় চাপের অভাবে মাইন বিস্ফোরণ ঘটে নি। পরে পাকিস্তানি সৈন্য বহনকারী ট্রেন রেললাইনের উপর আসা মাত্র তারা ২০০ গজ দূর থেকে চার্জ অন করেন। বিকট শব্দে মাইন বিস্ফোরিত হয় এবং ট্রেনের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এ অপারেশনে পাকিস্তানি সৈন্যদের কোনাে হতাহতের সংবাদ পাওয়া যায়নি।
ফতুল্লা রেলসেতু অপারেশন
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময় পুরাে নারায়ণগঞ্জ জেলায় একটি বড়াে অপারেশন ছিল। ফতুল্লা রেলসেতু ধ্বংস করা। রেলসেতুটি ধ্বংস হওয়ার ফলে একদিকে যেমন শক্ররা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল, অন্যদিকে এ অপারেশনের সাফল্য সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধাসহ স্বাধীনতাপ্রিয় সব বাঙালির মনােবল শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কের উপর অবস্থিত ফতুল্লা নারায়ণগঞ্জের একটি থানা। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ঢাকা সেনানিবাস থেকে ট্রেনযােগে পাকিস্তানি সৈন্যরা ফতুল্লা রেলসেতুর উপর দিয়ে নারায়ণগঞ্জ যেত। সেখান থেকে জলপথে স্টিমার, লঞ্চ, স্পিডবােটযােগে দেশের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে যেত এবং সিএসডি গােডাউন থেকে খাদ্য নেয়া হতাে ঢাকা সেনানিবাসে। এসব কারণে ফতুল্লা রেলসেতু ধ্বংস করে তাদের ট্রেন যােগাযােগ অচল করে দেওয়া অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে।
মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন আস্তানা ছিল জালকুড়িতে। ফতুল্লা রেলসেতুর। প্রহরার অবস্থান রেকি করার জন্য ২-৩ বার চেষ্টা চালানাে হয়। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা অধিনায়ক আলী হােসেনের বাড়িতে বসে আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেন। উত্তর-দক্ষিণ বরাবর ঢাকানারায়ণগঞ্জ রেলপথ। রেলপথ থেকে পূর্ব-পশ্চিমে ক্রস করেছে আইলপাড়া সড়ক। আইলপাড়া সড়ক পথে রেললাইন ক্রস করে পশ্চিমে প্রায় ১০০ মিটার। দূরে ক্যারলিন মিলে শত্রুর ঘাটি অবস্থিত। এ ক্রস পয়েন্টের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে বটগাছের নিচে ১০-১৫জন রাজাকার পালাক্রমে দিনরাত সেতু পাহারা দেয়। ক্যারলিন মিল থেকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ৩-৪ ঘণ্টা পর পর রাজাকারদের দেখে যেত ডিউটি ঠিকমতাে চলছে কি না। জালকুড়ি গ্রামের দক্ষিণ-পশ্চিমে মুক্তিযােদ্ধাদের টার্গেট ফতুল্লা নলখালী রেলসেতু। পরিকল্পনা করা হয়, রেল ক্রসিংয়ের ১০০ মিটার দূরে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নিবেন এবং ৭-৮জন ঢালু দিয়ে ক্রলিং করে আচমকা উঠে গিয়ে রাজাকারদের আত্মসমর্পণ করানাে হবে। তারপর ক্ষিপ্রগতিতে সেতুর চার কোণে ৪টি এবং সেতুর মাঝের পিলারে বসানাে হবে ১টি এক্সপ্লোসিভ। • অপারেশন শেষে উত্তর-পূর্ব দিকে বিলের মাঝে ১টি হিজল গাছের কাছে আসার জন্য বলা হলাে সবাইকে।
১২ সেপ্টেম্বর, রবিবার বিকাল ৫টায় মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক আলী হােসেনের বাড়িতে সবাইকে ডাকা হয়। এক্সপ্লোসিভ রাখা হয়েছিল ফিরােজ মাস্টারের বাড়িতে। এক্সপ্লেসিভের খোঁজ নেয়ায় ফিরােজ মাস্টারের মা জানালেন, পাকিস্তানি বাহিনীর আসার কথা শুনে ছাইয়ের স্কুপ থেকে বস্তা তুলে নিয়ে পুকুরে ফেলে দিয়েছেন। পরে পুকুর থেকে বস্তা তােলা হলাে। এক্সপ্লোসিভের তেজ কমে গেছে ভেবে প্রয়ােজনের চেয়ে প্রায় ৩ গুণ বেশি। এক্সপ্লোসিভ দিয়ে ৫টি চার্জ তৈরি করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক নিয়ে পূর্বপরিকল্পিত গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রাত ৮টায় রওনা দেন। পরিকল্পনা মােতাবেক ৩০ মিনিটের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা নির্ধারিত স্থানে উপস্থিত হন। মফিজ উদ্দিন, মহিউদ্দিন মােল্লা, ফজলুল হক, আক্কাস আলী, এহসান কবির রহমান, কামাল হােসেন, আ, মতিন ও বদিউল আলম তাদের সুকৌশলী প্রচেষ্টায় রাজাকার বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। অবশিষ্ট সবাই বিস্ফোরকের চার্জারগুলাে নিয়ে দ্রুতগতিতে সেতুর চার কোণে ৪টি এবং মাঝের পিলারে ১টি চার্জ লাগান। প্রাইমার কর্ডের ৫ মাথা একত্র করে ডিটেনেটর সঠিক বিন্দুতে ঢােকানাে হয় এবং ৪৫ সেকেন্ডের টাইম ফিউজে দিয়াশলাই কাঠি দিয়ে আগুন লাগানাে হয় সাথে সাথে সবাইকে পরিকল্পিত আইলপাড়া রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। রাজাকাররা অন্য পথ দিয়ে ঘুরে গিয়ে পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে খবর দেওয়ার সাথে সাথে এক দল সৈন্য দৌড়ে সেতুর কাছে আসে মুক্তিযােদ্ধাদের ধরতে।
সেতুর কাছে পৌছানাের সাথে সাথে বিস্ফোরণের গগনবিদারী শব্দ ১০ বর্গমাইল এলাকা প্রকম্পিত করে ফেলে। যে কয়েকজন। সৈন্য সেতুর কাছাকাছি অবস্থানে এসে পড়েছিল, তাদের মধ্যে ৬জন সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুরবণ করে। অন্যদিকে, শত্রু প্রহরায় নারায়ণগঞ্জ থেকে ১টি মালবাহী ট্রেন ঠিক এ সময়ে ঢাকার দিকে যাওয়ার পথে সেতুতে এসে বিস্ফোরণের কবলে পড়ে ধ্বংসস্থূপে পরিণত হয়। ফলে পাকিস্তানি বেশ কয়েকজন সৈন্য তাৎক্ষণিক মৃত্যুররণ করে এবং অবশিষ্টরা হতাহত অবস্থায় আর ঢাকার দিকে যেতে পারে নি। এ অপারেশনে হামিদ মােল্লা ও মহিউদ্দিন আহমদ সামান্য আহত হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা এ পরাজয়ে রাগে, ক্রোধে মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষতি। করতে না পারলেও এলাকার ২২জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড