You dont have javascript enabled! Please enable it!
বার্মা ইস্টার্নের বিদ্যুৎ ট্রান্সফর্মার ধ্বংস
সিদ্ধিরগঞ্জ থানার শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় ঘেঁষে বার্মা ইস্টার্ন ডিপাে অবস্থিত। ডিপাে থেকে পশ্চিমে একটি রাস্তা, সিঅ্যান্ডবি রােডে এসে মিলেছে। সিঅ্যান্ডবি রােডের ভাঙার পুল থেকে ইএসএসও (ESSO) রােড পর্যন্ত প্রায় ৫০০ গজ দূরত্বের মাঝখানে বার্মা ইস্টার্ন। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার মুক্তিযােদ্ধারা এ দিনটিকে ঘিরে কিছু একটা করে তাদের ধিক্কার জানাবে বলে সিদ্ধান্ত নেন। সে মােতাবেক মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ১৬ আগস্ট বার্মা ইস্টার্নের বিদ্যুৎ ট্রান্সফর্মারটি বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। ১৬ আগস্ট রাত ১টা ৩৫ মিনিটে মুক্তিযােদ্ধারা ভাঙার পুল থেকে দৌড়ে বার্মা ইস্টার্ন মােড়ে ট্রান্সফর্মারটির কাছে যান এবং যথারীতি ৫০ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ দিয়ে টাইম ফিউজে আগুন দিয়ে সাথে সাথেই আবার দৌড়ে পশ্চিম দিকের বিলে আসেন। এরই মধ্যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণে সমস্ত এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং ট্রান্সফর্মারটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে বার্মা ইস্টার্নসহ গোটা আদমজী এলাকা অন্ধকার হয়ে যায়।
সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের অপারেশন
নারায়ণগঞ্জ জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে কাঁচপুর ব্রিজ সংলগ্ন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা ও পাওয়ার স্টেশন অবস্থিত। অধিনায়ক কাজী কামাল উদ্দিনের নেতৃত্বে ১১জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি গেরিলা দলকে ৬ আগস্ট সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন। আক্রমণ করার জন্য পাঠানাে হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে রকেট লঞ্চার, ২ ইঞ্চি। মর্টার এবং কিছু ক্ষুদ্র অস্ত্র ও এক্সপ্লোসিভ দেওয়া হয়। ‘কে’ ফোর্স সদর দপ্তর থেকে মুক্তিযােদ্ধারা ৮ আগস্ট পাওয়ার স্টেশন এলাকায় পৌঁছেন। সেক্টর সদর। দপ্তর থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল যে, ১৪ আগস্টের পূর্বে যেকোনাে সময়ের মধ্যেই যেন তারা পাওয়ার স্টেশনটি ধ্বংস করে দেন। পাওয়ার স্টেশন এলাকা রেকি ও পর্যবেক্ষণ করে মুক্তিযােদ্ধারা বুঝতে পারেন যে, বাইরে থেকে কোনােক্রমেই সেটা ধ্বংস বা আক্রমণ করা সম্ভবপর নয়। কারণ, পাওয়ার স্টেশনের সবদিকেই পাকিস্তানি সৈন্যরা কড়া প্রহরার। ব্যবস্থা করেছে এবং চতুর্দিকে ৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন দেয়ালকে আরও ৩ ফুট উচ্চতায় পরিণত করেছে। দেয়ালের উপর কাটাতারের বেড়াও স্থাপন করা হয়েছে। তা ছাড়া তারা পাওয়ার হাউজের চতুর্দিকে অ্যান্টি-পারসােনেল মাইন।
পুতে রেখেছে এবং বিদ্যুৎ সঞ্চালিত বৈদ্যুতিক তারও স্থাপন করে রেখেছে। শক্র ব্যাপক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে মুক্তিযােদ্ধারা বেঁধে দেওয়া নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পাওয়ার হাউজ আক্রমণ করতে ব্যর্থ হন। কাজী কামাল। বাধ্য হয়ে পরিকল্পনা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেন। অধিনায়ক কামাল পাওয়ার হাউজে কর্মরত মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কোনাে কর্মচারীর সাথে যােগাযােগ স্থাপন। করতে তার সহযােদ্ধা ইব্রাহিমকে পরামর্শ দেন। উদ্দেশ্য, বাইরে থেকে অতি সতর্কতার সাথে যদি পাওয়ার হাউজের অভ্যন্তরে এক্সপ্লোসিভ নেয়া যায়, তবে। মেকানিক্যাল স্টাফের মাধ্যমে এক্সপ্লোসিভ দ্বারা পাওয়ার হাউজ ধ্বংস করা সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা মােতাবেক মুক্তিযােদ্ধারা পাওয়ার হাউজের ৩জন কর্মচারীর সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। কর্মচারীরা হলেন মকবুল, কাদের ও সহকারী। ফিটার সামছুল হক। যেহেতু সামছুল হক পাওয়ার হাউজের অভ্যন্তরীণ স্টাফ ছিলেন, তাই মকবুল, কাদের ও সামছুলকেই অপারেশন করার দায়িত্ব নেয়ার। জন্য অনুরােধ করেন। এ অপারেশনকে কৃতকার্য করার জন্য সামছুল হক তার ছােটো ভাই নুরুল হকের সাহায্য নেন। নুরুল হক পাওয়ার হাউজের ম্যানেজারের গাড়ির চালক ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা ইব্রাহিম অপর মুক্তিযােদ্ধা। মান্নানের মাধ্যমে ২২ পাউন্ড প্লাস্টিক এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার হাউজের ১ মাইল দূরত্বের মধ্যে রাখার ব্যবস্থা করেন। যেখান থেকে ড্রাইভার নুরুল হক। এক্সপ্লোসিভ নিয়ে তার গাড়ির দরজার ভিতরের অংশে ক্রু খুলে দরজার। অভ্যন্তরে এক্সপ্লোসিভ লুকিয়ে রেখে পুনরায় স্কু লাগিয়ে দেন। এক্সপ্লোসিভসহ ইব্রাহিম, সামছুল হক ও চালক নুরুল হক গাড়ি নিয়ে সতর্ক পাকিস্তানি গার্ড বেষ্টিত ৪টি গেট অতিক্রম করেন। প্রতিটি গেটেই পাকিস্তানি সৈন্যরা গাড়িটি পুখানুপুঙ্খভাবে তল্লাশি করে কিন্তু কোনাে কিছুই খুঁজে পায় নি। গাড়িটি নিয়ে পাওয়ার হাউজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে ড্রাইভার নুরুল হক। গাড়ির দরজার স্কু খুলে এক্সপ্লোসিভ বের করে কেমিক্যাল প্ল্যান্টের একটি টাবে। রাখেন এবং সুযােগ বুঝে সেগুলাে তার ভাই সামছুল হককে প্রদান করেন। এর পর অন্য একদিন একইভাবে আরও ৬০ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ পাওয়ার হাউজের অভ্যন্তরে প্রবেশ করানাে হয়। 
১৬ আগস্ট সামছুল হক ও নুরুল হক দুই ভাই মিলে নির্দিষ্ট ৪টি টাওয়ারের গায়ে অতি সতর্কতার সাথে এক্সপ্লোসিভ ভালাে করে রশি দিয়ে শক্তভাবে বেঁধে রাখেন এবং তার উপর মাটি চাপা দিয়ে ডিটোনেটর সেফটি ফিউজ ও প্রাইমার কর্ড লাগান। এভাবে ৪টি টাওয়ারে এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে। সময়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন। খুব সতর্কতার সাথে ফিউজে আগুন। দেওয়া হয় এবং ২ মিনিটের মধ্যে ৪টি টাওয়ার বিকট শব্দে বিধ্বস্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা ও তার আশপাশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়।
রূপসী বাজার অপারেশন
রূপগঞ্জ থানার শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রূপসী বাজারের অবস্থান। ২৩ আগস্ট সকাল ৯টায় রূপসী বাজার যখন ক্রেতা-বিক্রেতায় ভরপুর, এমনি এক সময় ৪টি ক্ষুদ্রাকৃতি জলযানযােগে পাকিস্তানি সেনাদের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ১টি দল রূপসী বাজারের দক্ষিণ প্রান্তের শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব তীরে রূপসী বাজারে কমান্ডাে স্টাইলে লাফিয়ে নেমে পড়ে। সেনা সদস্যদের ২ লাইনে বিভক্ত হতে দেখে বাজারে অবস্থানরত জনসাধারণ ছােটাছুটি শুরু করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আ, রহমান, শাহাজাহান ভূইয়া, কবীরউল্লাহ, টুকু মিয়াসহ বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে যায়। অপর দলটি বাজারে অগ্নিসংযােগ এবং মালামাল লুটতরাজ করে এবং অবস্থানরত জনসাধারণকে জিম্মি করে মালামাল বােটে তুলতে থাকে। অপর দিকে, শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত রূপসী বাজারের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধা পারভেজের (খসরু) দল সন্তর্পণে শত্রুর মােকাবিলা করার জন্য দ্রুত তৈরি হতে থাকে। ক্রলিং করতে করতে খসরুর দল বাজারের দক্ষিণ পার্শ্বে কমল মাঝির বাড়ির কলাবাগানের পিছনে গিয়ে সুবিধাজনক স্থানে অবস্থান নিয়ে এলএমজি বসিয়ে শত্রু ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকে। এ সময় পারভেজের পিছনে এলএমজি নিয়ে আরও প্রস্তুত থাকেন মুক্তিযােদ্ধা রুমী। ইতােমধ্যেই শত্রু সমগ্র বাজার এবং আ. মােতালিব খানের রাইস মিলটি সম্পূর্ণভাবে অগ্নিসংযােগ করে ভস্মীভূত করে দেয়।
শত্রু ক্যাম্পে ফেরার পথে শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরে উদ্দেশ্যহীনভাবে প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ করতে থাকলে নিমােক্ত ব্যক্তিগণ গুলি ও শেলের আঘাতে শহিদ হন। ১. আমির আলী (পিতা: মৃত শহর আলী, গ্রাম: গন্ধর্বপুর) ২. এমরান মিয়া (পিতা: মৃত সৈয়দ আলী, গ্রাম: রূপসী) ৩. আমু প্রধান (পিতা: মৃত পারব আলী, গ্রাম: রূপসী) ৪. টুকু (পিতা: মৃত পােড়াই ব্যাপারী, গ্রাম: রূপসী)। ৫. রমিজ উদ্দিন (পিতা: মৃত সাহাজ উদ্দিন, গ্রাম: গন্ধর্বপুর)। কমল মাঝির বাড়িতে অপেক্ষমান অধিনায়ক খসরু ও তাঁর অন্যতম সহযােদ্ধা রুমী গভীর উৎকণ্ঠা নিয়ে দৃষ্টি রাখেন শত্রু বহনকারী জলযানগুলাের ফিরে আসার দিকে। ২-৩ মিনিটের মধ্যেই দেখা গেল তাদের জলযানগুলাে রূপসী বাজার বরাবর শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরে পূর্ব গ্রামের প্রায় চর ঘেঁষে তাদের গন্তব্যস্থান লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের ক্যাম্পের দিকে এগিয়ে আসছে। খসরু ও রুমী রেঞ্জের আওতায় আসার অপেক্ষায় ট্রিগারে আঙুল রেখে তাকিয়ে থাকেন শক্রর ৪টি জলযানের দিকে। ততক্ষণে পূর্ব গ্রামের চরের তীর ঘেঁষে শত্রু বহনকারী জলযানগুলাে এলএমজি’র পুরাে আওতায় এসে পড়লে গর্জে ওঠে তাদের এলএমজিসহ সব হাতিয়ার। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলি বর্ষণে জলযানগুলাে নদীর মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। এ অবস্থায় জলযান বহর থেকে শিলাবৃষ্টির মতাে নদীর উভয় তীরে গােলা বর্ষণ করতে করতে শীতলক্ষার বুক চিরে শত্ৰু বাওয়ানী ক্যাম্পের দিকে চলে যায়। পরবর্তী সময় ডেমরা বালুঘাটে জলযানগুলাে ভিড়ার সাথে সাথে দেখা গেল, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি অ্যাম্বুলেন্স অপেক্ষমাণ।
শত্রু বহনকারী জলযান থেকে ৫জন মৃত এবং ১২জন আহত সেনা সদস্যকে তুলে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সটি রওনা হয়ে গেল ঢাকা অভিমুখে। এ সময় নদীর ঘাটে শত শত শ্রমিক এ দৃশ্য অবলােকন করে। মাত্র ১২জন মুক্তিযােদ্ধা শক্রর ৪টি বােট আক্রমণ করেন হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতিতে। প্রথাগত যুদ্ধের কোনাে নিয়মের মধ্যে না পড়লেও মুক্তিযােদ্ধারা অদম্য সাহস ও দৃঢ় চিত্তের বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন এ যুদ্ধে। নিজেদের কোনাে ক্ষতি হয় নি। এ ধরনের ছােটো ছােটো যুদ্ধই শত্রুকে তাদের অবাধ বিচরণ থেকে বিরত রাখে।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

 

কুইজ
প্রশ্ন – শত্রুরা পালিয়ে কোথায় যায়?
ক) বালুঘাট ক্যাম্পের দিকে
খ) বাওয়ানি ক্যাম্পের দিকে
গ) রূপগঞ্জ ব্রিজের দিকে
ঘ) কোনটিই নয়।
(কুইজের নিয়মঃ আপনার উত্তর, নাম আর যে মোবাইল নাম্বারে রিচার্জ পাঠানো হবে সেই নাম্বারটি এই পোস্টের কমেন্টে দেবেন। প্রিপেইড বা পোস্ট পেইড হলেও উল্লেখ করবেন। প্রথম ১০ জনকে মোবাইলে ২০ টাকা রিচার্জ পাঠানো হবে। আমাদের আর্থিক সঞ্চয় কম থাকায় এবং ছাত্ররা যাতে বেশী মাত্রায় কুইজের দিকে ঝুঁকে না যায় সেকারণে টাকার পরিমাণ কম রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ার প্রতি আগ্রহী করার উদ্যেশ্যে পোস্টের সাথে কুইজ রাখা হয়েছে। প্রথমে সকল কমেন্ট গোপন রাখা হবে যাতে একজনেরটা দেখে আরেকজন কমেন্ট না করে। কুইজের শেষে কমেন্ট উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।)

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!