মানিকগঞ্জ জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আয়তন: ১৩৭৮.৯৯ বর্গকিলােমিটার উত্তরে টাঙ্গাইল জেলা, দক্ষিণে ফরিদপুর। ও ঢাকা জেলা, পূর্বে ঢাকা জেলা, পশ্চিমে পাবনা ও রাজবাড়ি জেলা। প্রধান নদী: পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, ইছামতি ও কালীগঙ্গা। প্রতিবছর এ জেলার বিস্তৃত এলাকা বিশেষত হরিরামপুর, শিবালয় ও দৌলতপুর উপজেলার নদীতীরবর্তী এলাকা নদী ভাঙনের শিকার হয়। প্রশাসন: ১৮৪৫ সালে মানিকগঞ্জ মহকুমা সৃষ্টি এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। পৌরসভা ১টি, উপজেলা ৭টি তথা: মানিকগঞ্জ সদর, সিঙ্গাইর, শিবালয়, সাটুরিয়া, হরিরামপুর, ঘিওর ও দৌলতপুর, ৬৫টি ইউনিয়ন, ১,৩৫৭টি মৌজা, ১,৬৪৭টি গ্রাম।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: ১৯টি কলেজ, ১৩০টি হাই স্কুল, ৭টি জুনিয়র হাই স্কুল, ১টি প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ১টি ভােকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, ৮৭টি মাদ্রাসা, ১টি সংগীত বিদ্যালয়, ১টি টোল, ৪৫৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ১৩১টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২৯০টি এনজিও পরিচালিত শিক্ষাকেন্দ্র, ২টি কমিউনিটি বিদ্যালয়, ২২৫টি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র, ১০টি স্যাটেলাইট বিদ্যালয় । সুখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান: সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ (১৯৪২), সরকারি মহিলা কলেজ (১৯৭২), দড়গ্রাম ভিকু মেমােরিয়াল কলেজ (১৯৬৬), খােন্দকার নূরুল হােসেন ল একাডেমি, মানিকগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (১৮৮৪), সুরেন্দ্র কুমার সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় (১৯৩৮), মানিকগঞ্জ ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা (১৯৫৩), প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, বালিয়াটি ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় (১৯১৯), ঘিওর ডি এ হাই স্কুল, জয়মণ্ডপ উচ্চ বিদ্যালয় (১৯২১), তেওতা একাডেমি (১৮৯১)। প্রধান কৃষি ফসল: ধান, পাট, আখ, গম, তামাক, সরিষা, তিল, আলু, চিনাবাদাম, পেঁয়াজ, মরিচ, রসুন, খেসারি, মাষকলাই, শাকসবজি।
বিলুপ্ত বা প্রায় বিলুপ্ত ফসল: কাউন, চিনা, তিসি, যব, অড়হর, ভুট্টা, মিষ্টি আলু। প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক: মত্তের মঠ, শ্রী শ্রী আনন্দময়ী কালীবাড়ি, রজনী ভবন ও ঝােভাত ভবন, নারায়ণ সাধুর আশ্রম, শিববাড়ি মন্দির, বাইমাইলের নীলকুঠি (সদর), ফোর্ড নগরের দুর্গ, বায়রা নীলকুঠি, দত্ত-গুপ্তদের বাসভবন, আনন্দকুঠি ও মন্দির, সেনবাড়ি ও দুর্গামণ্ডপ, ইমামপাড়া জামে মসজিদ, ইব্রাহীম শাহের মাজার, একডালা দুর্গ (শিবালয়), কাটাসগড় দুর্গ, ঢাকীজোড়ার দুর্গ, দশচিড়া বৌদ্ধ বিহার ও স্থূপ, নবরত্ন মঠ, তেওতা জমিদারবাড়ি, মাচাইন মসজিদ, শাহ রুস্তমের মাজার, টেপড়া কালীমন্দির, শ্রীবাড়ি, তেওতার বালিয়াটির জমিদার প্রাসাদ (সাটুরিয়া), ধানকোড়া জমিদারবাড়ি, কালু শাহের মাজার, গৌরাঙ্গ মঠ, শ্রীবাড়ি বড়ােটিয়া গ্রামের নীলকুঠি (ঘিওর) পাঁচথুবির বৌদ্ধ বিহার, ঝিটকা লােকমানিয়া দরগা (হরিরামপুর)। ঐতিহাসিক ঘটনাবলি: হরিরামপুর উপজেলায় ইছামতি নদী তীরবর্তী যাত্রাপুর ও ডাকচরায় মােগল বাহিনীর সঙ্গে মুসা খানের নেতৃত্বে বারাে ভুইয়াদের সম্মিলিত বাহিনীর এক যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে বারাে ভূইয়াদের পরাজয় ঘটে এবং মধ্যভাটি এলাকায় মােগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এ জেলায় নীলবিদ্রোহ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন ২৮ অক্টোবর ৩ শতাধিক পাকিস্তানি সেনার ১টি দল সিঙ্গাইর ক্যাম্প অভিমুখে রওনা হলে নূরানীগঙ্গা খালের মােড়ে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে পাকিস্তানি সেনাদের ৩টি নৌকা ডুবে যায় এবং ১জন মেজরসহ ৩ শতাধিক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ২২ নভেম্বর ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্বিচার গুলি বর্ষণে ৪১জন গ্রামবাসী শহিদ হন। এ মাসেই পাকিস্তানি সেনারা শিবালয় উপজেলার নয়াবাড়িতে অবস্থিত মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্প আক্রমণ করলে দুই পক্ষের মধ্যে ৪ ঘণ্টাব্যাপী যুদ্ধ চলে এবং শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা পশ্চাদপসরণ করে। ১২ ডিসেম্বর মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কাগজীনগর গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে পাকিস্তানি সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বালিয়ারটেকে মুক্তিযােদ্ধাদের এক সংঘর্ষ হয়। এতে ১জন পাকিস্তানি সেনা বন্দি হয় এবং মুক্তিযােদ্ধা নওশের মােল্লা শহিদ হন। ১৫ ডিসেম্বর পলায়নপর পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে গাজিন্দা গ্রামে মুক্তিযােদ্ধাদের।
এক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। তাতে গাজিন্দা গ্রামের মুক্তিযােদ্ধা আমিনুর রহমান, ছলেউদ্দিন, শরীফুল ইসলাম ও রহিজ উদ্দিন শহিদ হন। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব: আচার্য দীনেশচন্দ্র সেন (মৈমনসিংহ গীতিকা ও পূর্ববঙ্গ গীতিকা’র সংগ্রাহক ও সম্পাদক), রফিকউদ্দিন আহমদ (বাহান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহিদ), খান মােহাম্মদ মঈনুদ্দিন (বিশিষ্ট সাহিত্যিক), খান। আতাউর রহমান (চিত্রপরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও অভিনেতা)। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও বধ্যভূমি: সাটুরিয়া পাইলট হাই স্কুল এলাকা, প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট এলাকা, তরা ঘাট বলাই বাবুর বাড়ি গণকবর, থানা পুকুরের পার্শ্ববর্তী এলাকা, মানিকগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডের পশ্চিম পার্শ্বস্থ চত্বর। শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ: স্মৃতিস্তম্ভ, তেরশ্রী (ঘিওর)।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড