You dont have javascript enabled! Please enable it!
নারায়ণগঞ্জ জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আয়তন: আয়তন ৭৫৯.৫৭ বর্গকিলােমিটার। উত্তরে নরসিংদী এবং গাজীপুর জেলা, দক্ষিণে মুন্সিগঞ্জ জেলা, পশ্চিমে ঢাকা জেলা, পূর্বে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং কুমিল্লা জেলা। এ জেলাটি শীতলক্ষ্যা, মেঘনা, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, বুড়িগঙ্গা, বালু ও ধলেশ্বরী নদীর পলি গঠন দ্বারা বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। নারায়ণগঞ্জ দেশের বৃহত্তম নদীবন্দর ও প্রধান ব্যাবসাবাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত।
প্রশাসন: জেলা শহর নারায়ণগঞ্জ পৌরসভা সৃষ্টি হয় ১৮৭৬ সালে। ৮টি। ওয়ার্ড ও ৭৬টি মহল্লা নিয়ে জেলা শহর গঠিত। নারায়ণগঞ্জ মহকুমা সৃষ্টি ১৮৮২ সালে এবং মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করা হয় ১৯৮৪ সালে। উপজেলা ৫টি, ইউনিয়ন ৪৭টি, মৌজা ৮৮১টি, গ্রাম ১,৩৭৪টি, পৌরসভা ২টি, ওয়ার্ড ১২টি, মহল্লা ১১৫টি। প্রাচীন নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ: সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি (১৩৮৯-১৪১১), বাবা সালেহ মসজিদ (১৪৮১), গােয়ালদী মসজিদ। (১৫১৯), সুলতান জালাল উদ্দিন ফতেহ শাহের এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ (১৪৮৪), হাজিগঞ্জের ঈশা খাঁর কেল্লা, সােনাকান্দা দুর্গ, পাগলা ব্রজ, কদমরসুল দরগা, বন্দর শাহী মসজিদ উল্লেখযােগ্য। ঐতিহাসিক ঘটনাবলি: ঈশা খাঁর আমলে বর্তমান সােনারগাঁও উপজেলাকে রাজধানী করা হয়। প্রাচীন কাল থেকে এ উপজেলাটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ফতুল্লায় মর্মান্তিক গণহত্যায়। পাকিস্তানি বাহিনী ১৩৯জন লােককে হত্যা করে। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানঃ মসজিদ ২,০০৬টি, মন্দির ৮২টি, গির্জা ৪টি, তীর্থস্থান ৪টি, আশ্রম ১টি। উল্লেখযােগ্য প্রতিষ্ঠান: সােনারগাঁওয়ের লােক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন, নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাব।
শিল্প ও কলকারখানা: আদমজী জুট মিল (বর্তমানে বিলুপ্ত), চিত্তরঞ্জন কটন মিল, লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিলস্, ঢাকেশ্বরী মিলস্, স্টার পার্টিকেল বাের্ড মিলস্ লিমিটেড, মৌসুমী ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ঢাকা ভেজিটেবল অয়েল মিলস্, হােসেন পেপার মিল, মওলা টেক্সটাইল, আরএম স্টিল মিল, হরিপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, হােসিয়ারি শিল্প, ডাইং মিল, অ্যালুমিনিয়াম ফ্যাক্টরি। তা ছাড়া কাঁচপুরে দেশের বৃহত্তম শিল্প নগর রয়েছে। কুটিরশিল্প: তাঁতশিল্প এখানকার বিখ্যাত কুটিরশিল্প। রূপসী ও কাজীপাড়া। জামদানি শাড়ি এবং হােসিয়ারি শিল্প নারায়ণগঞ্জের বিখ্যাত শিল্প। হাটবাজার ও মেলা: হাটবাজার ১৬২টি। উল্লেখযােগ্য হাটবাজার: কদমরসুল দরগা, লাঙলবন্দ, বারদি ও লক্ষ্মীনারায়ণ আখড়া। মেলা ২২টি, ব্রহ্মচারীর মেলা, হামদাদির পাগলা মেলা, চড়ক মেলা উল্লেখযােগ্য।  প্রধান রপ্তানি দ্রব্য: ফল ও ফলজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, জামদানি শাড়ি এবং হােসিয়ারি সামগ্রী। নারায়ণগঞ্জ, বন্দরনগরী: ঢাকা জেলার সাবেক মহকুমা থেকে ১৯৮৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি এটি জেলায় উন্নীত হয়। নারায়ণগঞ্জ বাংলাদেশের ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে বেশ পুরােনাে ও গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে। এবং গঞ্জ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। ১৭৬৬ সালে হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতা। বিকন লাল পাণ্ডে (বেণুর ঠাকুর বা লক্ষ্মীনারায়ণ ঠাকুর নামেও পরিচিত) ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছ থেকে এ অঞ্চলের মালিকানা গ্রহণ করেন। তিনি প্রভু নারায়ণের সেবার ব্যয়ভার বহনের জন্য উইলের মাধ্যমে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। অবস্থিত মার্কেটকে দেবােত্তর সম্পত্তি হিসেবে ঘােষণা করেন। তাই পরবর্তীকালে এ স্থানের নাম হয় নারায়ণগঞ্জ।
কালেক্টরেটের প্রারম্ভিক দলিলদস্তাবেজে নারায়ণগঞ্জ নামের উল্লেখ আছে। ঢাকা থেকে ২০ কিলােমিটার দূরে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকায় পাললিক মাটি জাতীয় সমতল ভূমিতে অবস্থিত নারায়ণগঞ্জ। শহরের জনসংখ্যা ১.৫ মিলিয়ন। শহরের পূর্ব পার্শ্বে শীতলক্ষ্যা নদী এবং দক্ষিণ ও পশ্চিমে বুড়িগঙ্গা নদী। শীতলক্ষ্যা নদী পুরাে শহরটাকে নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি এলাকা এবং কদমরসুল মিউনিসিপ্যালিটি এলাকা এ দুভাগে বিভক্ত করেছে। মৌসুমি বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা দূর করতে এ এলাকায় অসংখ্য ছােটোখাটো কৃত্রিম খাল খনন করা হয়েছে। এখানকার বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ২,৩৭৬ মিলিমিটার। ৮০-৯০% বৃষ্টিপাত সংঘটিত হয় মে-অক্টোবর। মাসের মধ্যে। নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় ১৮৭৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর। তখন এর লােকসংখ্যা ছিল ২৭,৮৭৬জন এবং আয়তন ৪,৫ বর্গমাইল। ১২জন কমিশনারের মধ্যে ৪জন ছিলেন মনােনীত এবং ৮জন নির্বাচিত। তাদের মধ্যে ১জন ছিলেন শহরের গুরুত্বপূর্ণ পাট ব্যবসায়ী। তিনিই অতীতে সবসময় চেয়ারম্যান হতেন। দলিল-দস্তাবেজে প্রাপ্ত প্রমাণপত্র অনুসারে ধরে নেয়া যায় যে, এ মিউনিসিপ্যালিটিকে বাংলা প্রদেশের মডেল মিউনিসিপ্যালিটি বলা হতাে।
নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির প্রথম নির্বাচিত বাঙালি চেয়ারম্যান ছিলেন সৈয়দ মােহাম্মদ সালেহ। ঢাকা জজকোর্টের ঘােষণা মােতাবেক ১৯৫২ সালে নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটির এলাকা সম্প্রসারণ করে ৭.৫ বর্গমাইল করা হয়। মিউনিসিপ্যালিটিতে পুরােনাে ১টি হাসপাতাল (নারায়ণগঞ্জ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল) ছিল। এটি ১৮৮২ সালে হরকান্ত ব্যানার্জীর সহায়তায় নির্মিত হয়। শুরুতে এর শয্যা সংখ্যা ছিল ৩০ এবং বহু বছর যাবৎ মিউনিসিপ্যালিটি এর। তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ করেছে। ১৮৬৬ সালে নারায়ণগঞ্জে ১টি সরকারি ডাকঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৭৭ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ প্রথম টেলিগ্রাম সুবিধা চালু করা হয়। ১৮৮২ সালে। ব্যাংক অব বেঙ্গল সর্বপ্রথম নারায়ণগঞ্জে টেলিফোন প্রবর্তন করে। নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি এলাকার রাস্তাঘাটের সমস্ত বাতি কেরােসিন তেলে জ্বলত। ১৯৩১ সালের ৩০ সেপটেম্বর নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি চট্টগ্রাম ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির সহায়তায় শহরে বৈদ্যুতিক সংযােগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়। ১৯৪৭ সালের পর শিল্পায়নের ব্যাপক সম্প্রসারণের ফলে অনেক বেশি বৈদ্যুতিক শক্তির প্রয়ােজন দেখা দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জে ৪০,০০০ কিলােওয়াট ক্ষমতার ১টি তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইতােমধ্যে নারায়ণগঞ্জে নিজস্ব পাওয়ার হাউজও স্থাপন করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ মিউনিসিপ্যালিটি বর্তমানে ১৮.৭০ বর্গকিলােমিটার বিস্তৃত। এ মিউনিসিপ্যালিটিতে ১টি গণ গ্রন্থাগার (প্রতিষ্ঠিত ১৯২৯) আছে। এর সংগ্রহশালায় রয়েছে ১৬,০০০ বই। গ্রন্থাগারটি নিয়মিতভাবে ১৭টি সাময়িকী এবং ৯টি দৈনিক পত্রিকা রাখে।
নারায়ণগঞ্জ শহরে জাপান সরকারের আর্থিক সহায়তায় নির্মিত ২০০ শয্যা বিশিষ্ট ১টি অত্যাধুনিক হাসপাতাল আছে। নারায়ণগঞ্জ বন্দরনগর ৩টি পাকা রাস্তা, মিটারগেজ রেললাইন এবং বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার নৌপথ দ্বারা ঢাকার সাথে যুক্ত। ১৮৬২ সাল থেকে নারায়ণগঞ্জের সাথে স্টিমার যােগাযোেগ শুরু হয়। সে সময় থেকেই গােয়ালন্দ থেকে নারায়ণগঞ্জ হয়ে স্টিমার ও রেলগাড়ি ঢাকা ও কলকাতা পেীছাত। নারায়ণগঞ্জ তখন ঢাকার বন্দর হিসেবে বেশ পরিচিত ছিল। শহরটি যমুনার মুখে অবস্থিত সিরাজগঞ্জের পূর্ব দিকে ব্যাবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থল হিসেবে গড়ে ওঠে এবং কলকাতা, সিলেট, আসাম ও কাছাড়ের সাথে নৌ-যােগাযােগ দ্বারা সংযুক্ত হয়। কলকাতার সাথে বাণিজ্যিক লেনদেনের বিরাট অংশ যথা: আমদানিকৃত কাপড়, লবণ ও নিত্যব্যবহার্য পণ্যসামগ্রী এবং এ দেশে উৎপাদিত সব ধরনের রপ্তানি দ্রব্যসামগ্রী বিশেষত পাট ও তেল বীজ পরিবহণ নারায়ণগঞ্জ বন্দরের মাধ্যমেই সম্পন্ন হতাে। এ বন্দরের সাথে চট্টগ্রাম বন্দরের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান চলত। চট্টগ্রাম। বন্দর থেকে আনা হতাে আমদানিকৃত তুলা, টিম্বার, তেল, চামড়া, চামড়াজাত পণ্য ইত্যাদি এবং এ বন্দর থেকে রপ্তানি করা হতাে তামাক, মৃৎশিল্পসামগ্রী এবং অন্যান্য দেশজ পণ্যসামগ্রী। নারায়ণগঞ্জ বন্দরের সাথে রেঙ্গুন (বর্তমান। ইয়াঙগুন) ও আকিয়াবের বাণিজ্যিক আদান-প্রদান হতাে। আমদানি করা হতাে টিম্বার, তুলা, খয়ের ইত্যাদি এবং রপ্তানি করা হতাে তামাক, পান-সুপারি ইত্যাদি। ১৮৭৯ সালে ব্রিটিশ সরকার নারায়ণগঞ্জ বন্দরকে করমুক্ত বন্দর হিসেবে ঘােষণা করে। ফলে অনেক ইংরেজ আকৃষ্ট হয়ে নারায়ণগঞ্জে অফিস স্থাপন করে এবং ব্যাবসাবাণিজ্য শুরু করে। বর্তমান নারায়ণগঞ্জ বন্দর আনুষ্ঠানিকভাবে উদবােধন করা হয় ১৯৫৫ সালে।
বন্দরে ১টি দোতলা টার্মিনাল ভবনসহ ১টি আরসিসি জেটি এবং ১০টি প্ল্যাটফর্মযুক্ত জেটি আছে। গুদাম নির্মাণ করা হয়েছে ৬২,০০০ বর্গফুট (৫,৭৬০ বর্গমাইল) এলাকাব্যাপী। অনেক ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকারখানায় নিজেদের স্থাপনায় পাট ও পাটজাত দ্রব্যের প্রস্তুত প্রক্রিয়া সম্পন্নকরণের সুযােগসুবিধাসংবলিত নিজস্ব ব্যবস্থা রয়েছে। নারায়ণগঞ্জ বন্দরই ঢাকাকে হালকা শিল্পে সমৃদ্ধ করে গড়ে তুলেছে এবং নারায়ণগঞ্জ এখন বস্ত্র প্রস্তুত শিল্পের জাতীয় কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। শিল্পকারখানাগুলাে সুতা কাটা, সুতার রং করা/ব্লিচ করা, কাপড় বুননসহ পরিপূর্ণ কাপড় প্রস্তুতের সব ধাপ সম্পাদন করে। তাতে কাপড় বুনন ও তৈরি পােশাকসহ অন্যান্য কাপড় উৎপাদন করে। অন্যান্য শিল্পকারখানার মধ্যে রয়েছে সাবান তৈরির কারখানা, মােজা ও অন্তর্বাস বুনন কারখানা, ধাতু উৎপাদন এবং ধাতু ও কাঠের তৈরি আসবাবপত্র প্রস্তুতের কারখানা। ক্রমে নারায়ণগঞ্জ ব্যাবসাবাণিজ্যের কেন্দ্রস্থলরূপে গুরুত্ব লাভ করতে থাকে। সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে পর্তুগিজ ও ইংরেজ ব্যবসায়ীরা এ দেশে আসার পর সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম ভাগে মীরজুমলার শাসনামল পর্যন্ত শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম তীরাঞ্চল ছিল ব্যাবসাবাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর পূর্ব পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ খুব বেশি ব্যস্ত এলাকা ছিল না। ১৮৩০ সালে বৈদেশিক কোম্পানি র্যালি ব্রাদার্স সর্বপ্রথম নারায়ণগঞ্জে পাটের ব্যবসা শুরু করে এবং আসামের অনেক কোম্পানিকে এ বন্দরের মাধ্যমে পাশ্চাত্য দেশসমূহে পাট রপ্তানি করতে সহায়তা করে। নারায়ণগঞ্জে পাট বিক্রয়ের কারবার শুরু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাটের উপর তেমন বিধিনিষেধ চালু ছিল না, তবে দরদাম করার পর ওজন করার ব্যবস্থা করা হতাে, নমুনা হিসেবে ১টি কিংবা ২টি বান্ডিল খুলে পাটের মান নিরূপণ করা হতাে। নিম্ন মানের নমুনা পাওয়া গেলে বিক্রেতা তা কম দামে বিক্রয় করতে বাধ্য হতাে। সেখানে কোনাে নিয়মিত বাজার ছিল না, কিন্তু ব্যাপারীরা পাট বিক্রেতাদের গুদাম থেকে নৌকা বােঝাই করে বিক্রয়ের জন্য পাট নিয়ে আসত।
ব্যাপারীরা মাঝেমধ্যে পাট কেনার আগে আধা ডজনের মতাে বিভিন্ন আড়ত ঘুরে তারপর পাট কেনার সিদ্ধান্ত নিত। তবে নারায়ণগঞ্জই পাট বেচাকেনার একমাত্র কেন্দ্রস্থল ছিল না। ব্যবসায়ীরা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে মফস্বলের অনেক কেন্দ্র থেকে পাট ক্রয় করত এবং জুলাই মাস থেকে পাট সংগ্রহ করে নৌকা বােঝাই করে নদীপথে নিয়ে আসত। ১৯০৭-০৮ সালে নারায়ণগঞ্জে ২০টি ফার্ম পাট কেনার কাজে নিয়ােজিত ছিল। এ ফার্মগুলাে কাঁচা পাট ক্রয় করে গাইট তৈরি করে কলকাতার কারখানায় সরবরাহ করত। এর মধ্যে ১৮টির মালিকানা ছিল ইউরােপীয়ানদের এবং ২টির মালিকানা ছিল ভারতীয়দের। ফার্মসমূহ সরাসরি উৎপাদকদের কাছ থেকে পাট ক্রয় করত। যারা ব্যাপারীদের মাধ্যমে পাট ক্রয় করতাে তারা ফার্মের কাছ থেকে অগ্রিম গ্রহণ করে নিজেদের নৌকায় করে নারায়ণগঞ্জে পাট নিয়ে আসত। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর সাধারণ পাটের বাজার নারায়ণগঞ্জ রাতারাতি ১টি পাট শিল্পকেন্দ্রে পরিণত হয়। সমস্ত পাটজাত শিল্পকারখানা ও ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হয় কলকাতাকেন্দ্রিক ভারতীয়দের মূলধন নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তান ‘সােনালি আঁশ পাটে সমৃদ্ধ হলেও এখানে কোনাে পাটকল ছিল না এবং পাটের গাইট বাঁধাইয়েও ছিল দুর্বলতা। সে কারণে স্বল্প সময়ের মধ্যে দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বৈদেশিক চাহিদা মেটানাের জন্য ব্যবসায়ীরা নতুন কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিবার আদমজী নারায়ণগঞ্জে প্রতিষ্ঠা করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ নতুন ১টি পাট কারখানা। ১৯৫১ সালের ১২ ডিসেম্বর আদমজী পাটকল উৎপাদন শুরু করে। অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের বাওয়া গ্রুপ শহরের প্রথম পাটকল প্রতিষ্ঠা করে শীতলক্ষা নদীর পূর্ব তীরবর্তী অঞ্চলে, নারায়ণগঞ্জের সােনাকান্দায়। এ পাটকল ১৯৫১ সালের ১৮ মে উৎপাদন শুরু করে। নারায়ণগঞ্জের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান সােনারগাঁও, যা সমগ্র ভারতবর্ষের মধ্যে সবচেয়ে সেরা মানের এবং সুন্দরতম কাপড় প্রস্তুতের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলে ১৫৮৩ সালে র্যালফ ফিচ বর্ণনা করেছেন।
সূক্ষ্ম বা মিহি মসলিন তৈরির জন্য সােনারগাঁও ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এ কর্মকর্তা ১৮৩০-৩১ সালে কমিটি অব দ্য ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে বলেছিলেন যে, ঢাকার নিকটবর্তী অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের সুন্দর কাপড় প্রস্তুত হয়, সেখানেই চমৎকার মসলিন প্রস্তুত হয়, এজন্য প্রয়ােজনীয় তুলাও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে স্থানীয়ভাবে আবাদ হয়। নারায়ণগঞ্জের ঢাকেশ্বরী কটন মিল সূর্যকুমার বসু কর্তৃক শীতলক্ষার তীরে স্থাপিত হয় ১৯২৭ সালে। এটাই ছিল ব্রিটিশ আমলে সমগ্র ঢাকা জেলায় প্রথমটেক্সটাইল মিল। চিত্তরঞ্জন কটন মিল স্থাপিত হয় ১৯২৯ সালে। ১৯৩২ সালে জগন্নাথ কলেজের রসায়ন বিষয়ের অধ্যাপক রমেশচন্দ্র রায়চৌধুরী স্থাপন করেন। লক্ষ্মীনারায়ণ কটন মিল। ১৯৩৭ সালে দ্বিতীয় ঢাকেশ্বরী কটন মিল চালু করা হয়। তা ছাড়া নারায়ণগঞ্জ অন্তর্বাস-জাতীয় পােশাক প্রস্তুতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মধ্যে প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। সতীশচন্দ্র পাল ১৯২১ সালে প্রথম এ ধরনের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। কারখানাটির নামকরণ করা হয় হংস হােসিয়ারি। এটি টানবাজার এলাকায় অবস্থিত। এটি একসাথে ৪টি হস্তচালিত রিবন মেশিনে উৎপাদন শুরু করে।
নারায়ণগঞ্জে অন্তর্বাস-জাতীয় পােশাক তৈরির কারখানার সম্প্রসারণ ঘটে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে। যােগাযােগ ব্যবস্থা ভালাে থাকায় এখানে কাঁচামাল সহজলভ্য হয় এবং এখানে উৎপাদিত দ্রব্যসামগ্রী ও বয়নকৃত পােশাক-আশাক ধৌতকরণেরও ভালাে ব্যবস্থা ছিল। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ তৈরি পােশাক শিল্পের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে এবং অনেক বড়াে বড়াে তৈরি পােশাক রপ্তানি কারখানা এখানে স্থাপিত হয়েছে। ডজন খানেকের বেশি সাবান উৎপাদন কারখানা নারায়ণগঞ্জে মান সম্পন্ন সাবান উৎপাদন করে চলছে। এর মধ্যে কিছু কিছু জাতীয়ভাবে সুপরিচিত। এখানে কিছু সিলিকেট তৈরির কারখানাও স্থাপিত হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি বড়াে ময়দা কল আছে। ১৯৪৭ সালের আগে নারায়ণগঞ্জে ময়দা আসত কলকাতা থেকে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!