You dont have javascript enabled! Please enable it!
নারায়ণগঞ্জে প্রথম নৌ-কমান্ডাে অপারেশন
পটভূমি বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সদর দপ্তরে ১১-১৭ জুলাই পর্যন্ত সশস্ত্রবাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। সম্মেলনে সশস্ত্র সংগ্রামের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা বাংলাদেশকে সম্মুখযুদ্ধের সুবিধার জন্য ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয় এবং সেক্টর অধিনায়ক মনােনীত করা হয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহ ও কুড়িগ্রামের রৌমারী ও রাজিবপুর থানা অন্তর্ভুক্ত করে ১১ নম্বর সেক্টর গঠন করা হয় (৫-৬ নম্বর সেক্টরের মধ্যাঞ্চল) আগস্ট মাসে। প্রাথমিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চলকে ১০ নম্বর সেক্টরের এলাকা নির্ধারণ করা হয়। পরবর্তী সময় এলাকাটি রণকৌশলগত বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ অনুভূত হয়। তা ছাড়া তখন বার্মা (বর্তমানে মায়ানমার) পাকিস্তানের বন্ধু ভাবাপন্ন ছিল। বার্মার সাথে সীমান্ত থাকার কারণে নতুন শত্রু সৃষ্টি করা থেকে বাংলাদেশ বিরত থাকতে সিদ্ধান্ত নেয়। অতঃপর সমুদ্র ও অভ্যন্তরীণ নৌ অঞ্চলকে ১০ নম্বর সেক্টর হিসেবে ঘােষণা দেওয়া হয়। ৩০ মার্চ ফ্রান্সের তুলন (Toulon) পােতাশ্রয় থেকে পালিয়ে আসেন ৯জন বাঙালি সাবমেরিনার। ফ্রান্স থেকে কেনা মােট ৩টি ডেফনে (Dephne) ক্লাস সাবমেরিনের ২টি – পিএনএস হাঙর (PNS Hangor) ও পিএনএস শুশুক (PNS Shushuk) ইতােমধ্যেই করাচি পৌছে যায়। তৃতীয় সাবমেরিন পিএনএস ম্যাংগো (Mangro) পরদিন ৩১ মার্চ পাকিস্তানের করাচি বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করার কথা। তুলন থেকে পালিয়ে আসা ৯জনের মধ্যে ৮জন সাবমেরিনার ভারতে পৌছতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদীবন্দরে। তাদের অপারেশন পরিচালনা করার অপার আগ্রহে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এক পর্যায়ে একমত হয়। বিভিন্ন রকম জিজ্ঞাসাবাদ ও মতবিনিময়ের পর ভারতীয় নৌবাহিনীর উদ্যোগে তাদের বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
নৌসেনাদের নাম ও র্যাংক নিমে উল্লেখ করা হলাে: ১, সৈয়দ মােঃ মােশাররফ হােসেন, ইঞ্জিন রুম আর্টিফিসার (ইআরএ)-৪ ২. আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী, রেডিও অপারেটর জেনারেল (আরওজি)-১ ৩. গাজী মােঃ রহমত উল্লাহ, চীফ রেডিও আটিফিসার (সিআরএ)। ৪. বদিউল আলম, ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক (ইএম)-১ ৫. আমানউল্লাহ শেখ, ইলেকট্রিক আটিফিসার (ইএ) ৬. আহসান উল্লাহ, ইঞ্জিনিয়ারিং মেকানিক (ইএম)-১ ৭. আবিদুর রহমান, স্টুয়ার্ড, সাপ্লাই অ্যান্ড সেক্রেটারিয়েট বিভাগ। ৮. আবদুর রকিব মিয়া, ইলেকট্রিক্যাল মেকানিক (ইএম)-১। এ ৮জন সাবমেরিনারকে ভারতীয় নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দিল্লির অদূরে যমুনা নদীতে ২২ এপ্রিল থেকে ৮ মে পর্যন্ত বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদীর তীরে পলাশিতে নৌ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তােলা হয়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির শেষ যুদ্ধের প্রহসনের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তার সিংহাসন হারান চিরতরে। তারপর ২১৪ বছর পর স্বাধীনতার এ অস্তমিত সূর্য আর উদিত হয় নি বাংলার আকাশে। ১৩ মে পূর্ণাঙ্গ পরিসরে এ নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণ ক্যাল্প চালু করা হয়। এ ক্যাম্পের অবস্থান, কর্মকাণ্ড ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে সর্বাত্মক গােপনীয়তা রক্ষা করা। হয়। গােপনীয়তার স্বার্থে পলাশির এ ক্যাম্পের নাম দেওয়া হয় সি-২-পি (C-2-P)। চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্রবন্দর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যবহারের জন্য অচল। করে দেওয়া এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-বন্দরগুলােকে ব্যবহার অযােগ্য করে দেয়ার প্রধান উদ্দেশ্যে নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণের আয়ােজন করা হয়। মানুষের খাবার, যানবাহনের জ্বালানি এবং অস্ত্র ও অস্ত্রের গুলি, গােলা, বিস্ফোরক ইত্যাদির জন্য চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর তথা বঙ্গোপসাগর শত্রুমুক্ত রাখা ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর জন্য অপরিহার্য।
উল্লিখিত খাদ্যশস্য ও পণ্য বাংলাদেশে যথেষ্ট ছিল না বা তৈরি হতাে না। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ নদী বন্দরগুলাে ব্যবহার অযােগ্য করতে পারলে পাকিস্তানি বাহিনীর সড়ক পথ ব্যবহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে। যেহেতু সারা দেশের রেলপথ অচল করে ফেলা হয়েছিল এবং আকাশপথে সৈন্য ও রসদ পরিবহণ তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না তাই তাদের চলাচল প্রধানত সড়ক পথের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে। সড়ক পথে ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের অ্যামবুশ করে যুদ্ধের ভারসাম্য নিজেদের অনুকূলে আনার লক্ষ্যে নৌকমান্ডােদের কঠিন ও কঠোর প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়। চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, দাউদকান্দি, গাইবান্ধা ইত্যাদি যে-সব এলাকায় সমুদ্র ও নদী বন্দর রয়েছে, সেসব এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষিত এবং শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ তরুণদের নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণের জন্য বাছাই করা হয়। ভারতে অবস্থিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও ট্রানজিট ক্যাম্প থেকে এ তরুণদের নিবাচন করা হয়। যেহেতু মুক্তিযুদ্ধে কোনাে বাংলাদেশি নৌবাহিনীর অফিসার ছিল না, সেহেতু প্রধানত ভারতীয় নৌবাহিনীর সৰ্ব্বক তত্ত্বাবধানে পলাশি। ক্যাম্পের প্রশিক্ষণ ও প্রশাসন পরিচালিত হয়। কঠিন নির্বাচন পদ্ধতির মধ্য দিয়ে ৩১৫ জন সুঠামদেহী মুক্তিযােদ্ধাকে নিয়ে শুরু হয় প্রথম ব্যাচের প্রশিক্ষণ। মধ্য আগস্টের প্রথম নৌ-কমান্ডাে অভিযানে এ ব্যাচের মধ্য থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৪টি নদীবন্দরে ৪ গ্রুপে ১৬০জন কমান্ডােকে পাঠানাে হয়।
পরবর্তী সময়ে আরও মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রহ করে ২টি ব্যাচে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। প্রশিক্ষণের জন্য সংগৃহীত মােট ৫১৫জন মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ২০জন। পলাশি পৌছলেও তারা শেষ পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিতে পারেন নি। এ হিসেবে প্রশিক্ষণ পাওয়া মােট নৌ-কমান্ডাের সংখ্যা ৪৯০জন। এর মধ্যে ৮জন ফ্রান্সের তুলন থেকে পালিয়ে আসা সাবমেরিনার, যারা পলাশিতে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব পালনের পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব দেন এবং বিভিন্ন নৌ-অভিযানেও সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। স্থলযুদ্ধের সাথে সাথে যে-সব সেক্টর অঞ্চলে নৌ অপারেশন চালানাে প্রয়ােজন, সেসব সেক্টর অধিনায়কদের সাহায্য ও সহযােগিতায় নৌ-কমান্ডাে অপারেশন কার্যকর করা হয়। নৌ-কমান্ডাে গঠনে ভারতীয় সর্বোচ্চ মহলের নীতিগত অনুমােদন থাকলেও ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশন জ্যাকপটের ‘ডি’ (ডেলটা) সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং নৌ-কমান্ডাে নির্বাচনে এবং পলাশিতে নৌ-কমান্ডাে ক্যাম্প স্থাপনে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন। কার্যকরী পর্যায়ে ভারতীয় নৌবাহিনীর সাবমেরিনার অধিনায়ক মােহন নারায়ণ রাও সামন্ত, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার জর্জ মার্টিস, লেফটেন্যান্ট সুশীল কুমার দাস, লেফটেন্যান্ট ভিপি কপিল এবং অন্যান্য অফিসাররা।
অসামান্য অবদান রাখেন। জুলাই মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর বাঙালি অফিসার ক্যাপটেন মিহির কুমার রায়কে প্রধানত বাংলাদেশের নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের পরিকল্পনার জন্য ডিরেক্টর, নেভাল ইন্টেলিজেন্স পদে নিয়ােগ দেওয়া হয়। নৌকমান্ডাে অপারেশন পরিকল্পনায় তিনি কার্যকরী ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৫ সালে ভাইস অ্যাডমিরাল মিহির কুমার রায় তার ‘War in the Indian Ocean বইয়ে নৌ-কমান্ডােদের সংগঠন সম্বন্ধে লেখেন, “The Mukti Bahini frogmen were grouped in four task forces located at Chittagong, Chalna/Khulna, Naryanganj and Daudkandi/Chandpur. Each sector was in turn allotted four task units generally comprising personnel who hailed from that sector. A task unit in turn comprised 10 task elements. And each task element had three frogmen armed with one neutrally buoyant limpet mine (later increased to two), one grenade as also a knife, swimming fins and a wrist compass. In addition, a task unit was allotted a loaded rifle. This unsung and untold saga of the Bangladesh frogmen is an incredible story and arouses both admiration and amazement for the amount of damage they inflicted on the enemy with such sparse tools in their inventory. The achievement of the Bangladesh frogmen in sinking or damaging over 100.000 tons of shipping remains unparalleled in the liberation history of littorals in the ‘Ocean of Destiny’.”
মাঝারি গামলা আকারের লিমপেট মাইনের ওজন সর্বসাকুল্যে ৫ কেজি। এ মাইনের মুখ ‘পারকাশন ক্যাপ’ নামক একটি রবার কিংবা প্লাস্টিকের পাতলা। আবরণ দিয়ে ঢাকা থাকে। আবরণটি দেওয়া হয় মূলত মাইনের মুখের চৌম্বক। শক্তিকে সম্ভাব্য লােহা কিংবা ইস্পাতের আকর্ষণ থেকে আড়াল রাখার জন্য। এ মুখে চুম্বকের ৬টি পাত লাগানাে থাকে। জলযানের লােহা কিংবা ইস্পাতে মাইন লাগানাের সময় মাইনের মুখ থেকে পাতলা আবরণটি খুলে নিতে হয়। এ অবস্থায় মাইনটি নির্দিষ্ট স্থানে চৌম্বক শক্তির আকর্ষণে শক্ত হয়ে আটকে যায়। এর আগে ধারালাে কিছু একটা দিয়ে জলযানের নির্দিষ্ট স্থানের পিচ্ছিল শ্যাওলা সরিয়ে ফেলতে হয়। যথাস্থানে মাইন এভাবে বসিয়ে দেয়ার আনুমানিক ৪০৪৫ মিনিট পর সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। মাইন লাগানাের পর। মােটামুটি ৫০০ গজ দূরে অবস্থান নিতে পারলেই পানিতে বিস্ফোরিত এ মাইনের আঘাত থেকে আত্মরক্ষা করা সম্ভব। প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার পর মূল অভিযানে যাওয়ার আগে কমান্ডােদের যাবতীয় গােপনীয়তা সম্পর্কে শেষ বারের মতো দীক্ষা দেওয়া হয়। কঠোরভাবে বলে দেওয়া হয়, সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে পৌছে লােকালয়ে নিজেদের প্রকৃত পরিচয় কোনাে অবস্থাতেই প্রকাশ করা যাবে না। কোথায় যাওয়া হচ্ছে এবং কেন যাওয়া হচ্ছে, সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ নীরবতা পালন করতে হবে। এমনকি স্থল-মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের কাছেও বিশেষ প্রয়ােজন ছাড়া গােপনীয়তা ফাস না করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
অপারেশনে যাওয়ার আগে বিদায়কালীন অপারেশন সফল করার জন্য প্রত্যেক নৌ-কমান্ডােকে সাথে দেওয়া হয় ১টি সুইমিং কস্টিউম, ২টি করে লিমপেট মাইন, ১ জোড়া ফিনস, ১টি ধারালাে ছুরি ও হ্যান্ড গ্রেনেড । কয়েকটি দলে বিভক্ত নৌ কমান্ডােদের প্রতিটি দলের সাথে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং প্রয়ােজনীয় গুলিও দেওয়া হয়। এর সাথে পথখরচের জন্য কিছু পাকিস্তানি। টাকা। সবশেষে প্রত্যেক অধিনায়কের হাতে তুলে দেওয়া হয় ১টি করে এক ব্যান্ড ট্রানজিস্টার। নৌ-কমান্ডাে অপারেশনের আওতায় ছিল বাংলাদেশের সব নদী ও সমুদ্রবন্দর। এ পরিকল্পনার আওতায় মধ্য আগস্টের সূচনা লগ্নে ৪টি প্রধান নদী। ও সমুদ্রবন্দরকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। এগুলাে হচ্ছে চট্টগ্রাম, মংলা, চাদপুর ও নারায়ণগঞ্জের নদী বন্দরসমূহ। পলাশিতে নৌ-কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ শেষ হওয়ার আগেই অপারেশনের অভিযান পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং পরিকল্পনা। প্রণয়নে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অপারেশন। চালানাের জন্য বাংলাদেশের সমুদ্র ও নদী বন্দরগুলাে চিহ্নিতকরণ ও নদনদীর মানচিত্র পর্যবেক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট সময়ের চন্দ্র তিথি, জোয়ারভাটা, বাতাস ও স্রোতের গতিপ্রকৃতি প্রভৃতি নানাবিধ তথ্য পর্যালােচনা করে দেখা হয়। বন্দরগুলােতে জাহাজের অবস্থান এবং সেখানে পাকিস্তানি সৈন্যদের তৎপরতা সম্পর্কেও বিশদ খোঁজখবর নেয়া হয়। এ সময় বাংলাদেশের নদী ও সমুদ্রবন্দরগুলাের আশপাশের এলাকায় নিরাপত্তার কারণে সাধারণ নৌচলাচলের উপর কোথাও কোথাও নিষেধাজ্ঞা আরােপ করা হয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা গানবােট নিয়ে নদীবন্দর, বিভিন্ন মােহনা এবং নদীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলােয় প্রায় নিয়মিত টহল অব্যাহত রাখে।
পাকিস্তানিদের শকুন চোখা এসব টহল যানগুলােকে ফাকি দিয়ে কীভাবে নৌঅপারেশন চালানাে যাবে, অপারেশনের সময় বা অপারেশনে যাওয়া-আসার পথে নৌ-কমান্ডােরা কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারে কিংবা বন্দর রক্ষায় পাকিস্তানি সৈন্যরা কোথায় কোথায় অবস্থান নিয়ে থাকতে পারে, তার পূর্ণাঙ্গ বিষয়াদি অত্যন্ত সতর্কতার সাথে খতিয়ে দেখা হয় পরিকল্পনা প্রণয়নের সময়। অনেক আলাপ-আলােচনা এবং পক্ষে-বিপক্ষে সব দিক বিবেচনার পর। অবশেষে অপারেশন কার্যক্রম শুরু করার তারিখ নির্ধারণ করা হয় ১৪ আগস্ট। পরিকল্পনা ১৪ আগস্ট পাকিস্তানিদের কাছে তাদের জাতীয় জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্ববাহী দিবস হিসেবে চিহ্নিত। ঐ দিন তাদের স্বাধীনতা দিবস। স্বভাবতই দিবসটি তারা আনন্দ-উল্লাস আর পান-ভােজনের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করে থাকে। ধরে নেয়া হয়, স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের কারণে ১৪ আগস্ট বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনী বড়াে ধরনের কোনাে সামরিক অভিযানে যাবে একই কারণে তাদের নিরাপত্তামূলক সতর্কতায়ও কিছুটা শৈথিল্য আসতে পারে। আর এ সুযােগটি সযত্নে কাজে লাগানাের জন্যই অপারেশন পরিচালনার উপযুক্ত সময় হিসেবে ১৪ আগস্টের রাতটিকে বেছে নেয়া হয়।
অপারেশন কার্যক্রম সফল হলে তার সুফল পাওয়া যাবে দুইভাবে অপারেশনের সাফল্যে আনন্দে উল্লাসরত পাকিস্তানিদের মনােবল যেমন ভেঙে পড়বে, তেমনি নৌ-কমান্ডােদের বিশেষ দিনের এ সাফল্য বহির্বিশ্বে প্রচারও পাবে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি। এ উদ্দেশ্য সাধন সম্ভব হলে এপ্রিলের শেষ দিকে ভারতের মাটিতে নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠনের সামনে যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল, তারই বাস্তব প্রতিফলন পাওয়া যাবে।  এদিকে বাংলাদেশে মধ্য আগস্টে ঘটনার প্রকৃত পটভূমি তৈরি হয় অন্য রকম করে। এমন একটি আশঙ্কা আগেভাগেই ছড়িয়ে যায় যে, ১৪ আগস্টের স্বাধীনতা দিবসে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বড়াে ধরনের অভিযান চালাতে পারেন। এমনও হতে পারে, পাকিস্তানি সৈন্যরা নিজেরাই তাদের মধ্যে এ আশঙ্কার জন্ম দিয়েছিল। এর ফলে স্বাধীনতা দিবসের উৎসব-আয়ােজন পরিহার করে তারা সম্ভাব্য বড়াে ধরনের গেরিলা হামলার মােকাবিলায় প্রস্তুতি গ্রহণ করে। তাদের মধ্যে সতর্কতার মাত্রা না কমে বরং আরও বেড়ে যায়। ১৪ আগস্টের আগে থেকেই তারা সংবেদনশীল স্থানগুলােয় প্রহরা জোরদার করে। সম্ভাব্য এলাকাগুলােয় তল্লাশির মাত্রাও বাড়িয়ে দেওয়া হয়। রাত্রিকালীন কারফিউ আরও কড়াকড়ি হতে থাকে শহর-নগরগুলােয়। কিন্তু ভারতে অপারেশন পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়ে গেছে অনেক আগেই। এ পরিকল্পনায় আর কোনাে পরিবর্তন আনার সুযােগ নেই। তবে অপারেশনের নির্ধারিত সময় ঘনিয়ে আসার শেষ মুহূর্তে পাকিস্তানি বাহিনীর গৃহীত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা অপারেশন প্রণয়নকারীদের খানিকটা ভাবিয়ে তােলে। কিন্তু তারপরও পরিকল্পনার মূল কার্যক্রমে পরিবর্তন আনার কোনাে তাগিদই অনুভূত হলাে না। ধরে নেয়া হয়, ১৪ আগস্ট স্থল-গেরিলাদের বৃহত্তর হামলা হতে পারে, এ আশঙ্কার বশবর্তী হয়ে শক্র স্থলভাগে সতর্কতা জোরদার করে থাকবে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে তখন পর্যন্ত পাকিস্তানি সৈন্যরা জলভাগে মুক্তিবাহিনীর কোনাে হামলার মুখােমুখি হয় নি।
খণ্ড খণ্ড আকারে যুদ্ধ যা হয়েছে, তা সীমাবদ্ধ থেকেছে স্থলভাগেই। প্রকৃতপক্ষে তখনাে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিরােধ যুদ্ধের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যুদ্ধ তার সামগ্রিক ও সুসংগঠিত রূপ পায় নি। এ অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী স্থল-গেরিলাদের হামলা প্রতিরােধের জন্যই প্রস্তুতি নেবে। জলভাগে হামলা কিংবা চোরাগােপ্তা কোনাে অভিযান হতে পারে, তা তারা চিন্তাও করবে না, এটাই স্বাভাবিক। সম্ভবত এসব বিবেচনা করেই অপারেশন কার্যক্রম শুধু তারিখ পরিবর্তন ছাড়া বাকি অংশ পূর্বাপর অপরিবর্তিতই রাখা হয়। ঠিক হলাে, পাকিস্তানি বাহিনীর যাবতীয় সতর্কতার মধ্য দিয়ে এ দুঃসাহসিক কার্যক্রম শুরু করা হবে। নৌ-কমান্ডাে অপারেশন এমন একটি অভিযান, যা এ অভিযানের সাথে সম্পৃক্ত ১জন মাত্র কমান্ডাে শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়লেই পুরাে আয়ােজন পন্ড হয়ে যাবে। সে ক্ষেত্রে বিফল হয়ে যাবে গােটা পরিকল্পনা। প্রায় ৩ মাসের শ্রম ও প্রশিক্ষণ অর্থাৎ সামগ্রিক আয়ােজনই মাঠে মারা যাবে। যে কারণে জীবিতাবস্থায় ধরা পড়ার সম্ভাব্য সমস্ত পথ পরিহার করে চলার নির্দেশ দেওয়া হশেষ পর্যন্ত অপারেশনের কার্যক্রম শুরু করার তারিখ চূড়ান্তভাবে ঠিক করা হয় ১৫ আগস্ট, পাকিস্তান দিবসের পরদিন। তারিখ পরিবর্তনের এ গােপন তথ্যটি নৌ-কমান্ডােদের অধিনায়ক ছাড়া দলের আর কাউকেই জানানাে হয় নি। কেবল তাদেরই এ ব্যাপারে বিশেষ নির্দেশ দেওয়া হবে সংকেতের মধ্য দিয়ে। অর্থাৎ অপারেশন শুরু করার জন্য এখানে সংকেতই মূল নির্দেশিকা হিসেবে কাজ করবে। আর এ সংকেত ইথারে ভাসিয়ে নেয়ার কাজটি সমাধা করবে দলনেতাকে দেওয়া উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রানজিস্টারটি। অভিযানের যাত্রা পর্ব।
শুরু হয়ে যায় ৬-১০ আগস্টের মধ্যেই। | পলাশিতে প্রশিক্ষণ চলার শেষ দিকে এক ফাকে গােপনে ৮জন সাবমেরিনারকেই বিশেষ বিমানে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয় বিশেষ নির্দেশনা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। দিল্লিতে সামরিকবাহিনীর একটি সুরক্ষিত কক্ষে তাদের এ গুরুত্ববাহী নির্দেশনামা বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এখানে তাদের টেপরেকর্ডারে পুরােনাে দিনের ২টি বাংলা গান পর পর বাজিয়ে শােনানাে হয়। প্রথম গানটির প্রথম চরণ আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি – সন্ধ্যা। মুখােপাধ্যায়ের গান। দ্বিতীয় গানটি পঙ্কজ কুমার মল্লিক কিংবা কে এম সায়গলের গাওয়া – ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান। এ গান ২টি পর্যায়ক্রমে ঘুরিয়ে কয়েকবার বাজিয়ে শােনানাে হয়, যাতে গানের প্রথম কলি। বহুদিন মনে রাখা যায়। অনেকক্ষণ গান ২টি শােনানাের পর টেপরেকর্ডার বন্ধ। করা হয়। এবার মৌখিক নির্দেশে এর মর্মার্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়। গান ২টির। গুরুত্ব বােঝাতে গিয়ে বলা হয়, এ গান শােনার উপরই নির্ভর করবে অপারেশন কার্যক্রমের প্রস্তুতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। কিন্তু সময়মতাে গান শুনতে ব্যর্থ হলে। সব পরিকল্পনাই পণ্ড হয়ে যাবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মান বাহিনী দখলীকৃত ফরাসি উপকূলে মিত্র বাহিনীর গােপন অভিযান পরিচালনার সময় রেডিওতে অনুষ্ঠান প্রচারের ভিতর এ রকম সাংকেতিক সংগীত ব্যবহার করা হয়েছিল। বিবিসি থেকে সমপ্রচারিত গানের সংকেত অনুসরণ করে ১৯৪৪ সালের ৬ জুন মিত্র বাহিনীর দেড় লক্ষাধিক সৈন্য অবাধে অবতরণ করে ফ্রান্সের নরমান্ডি উপকূলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে জার্মান নেতৃত্বাধীন অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে মিত্রবাহিনীর বিজয় ধারার সূচনাকারী এ অপারেশনের নাম ছিল অপারেশন ওভারলর্ড (Operation Overlord)। সমরবিদেরা বলেন, অপারেশন ওভারলর্ড ব্যর্থ হলে জাপানের হিরােশিমা-নাগাসাকির পরিবর্তে যুক্তরাষ্ট্রকে জার্মানির বার্লিন ও ফ্রাঙ্কফুর্টে আণবিক বােমা ফেলতে হতাে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাফল্যের এ গােপন কৌশলটি ২৭ বছর পর ব্যবহার করা হয় দক্ষিণ এশীয় বলয়ের একটি গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে!দিল্লিতে ভারতীয় সমরবিদেরা অনুরূপ সাংকেতিক সংগীত বেছে নিয়ে তা সবিস্তারে বুঝিয়ে দিলেন পালিয়ে আসা সাবমেরিনারদের। তাদের বলা হয়, মূল অপারেশন শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে থেকেই আকাশবাণীর সংগীতানুষ্ঠানগুলাে মনােযােগ সহকারে নিয়মিত শুনতে। আকাশবাণী কলকাতার ‘খ’ কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত নিয়মিত সাধারণ অনুষ্ঠানের একটি বিশেষ সময়ে বাজানাে হবে প্রথম গানটি। তবে ঠিক কয়টায় এ গান বাজানাে হবে, সে ব্যাপারে কোনাে আগাম তথ্য দেওয়া হলাে না। তবে নির্দেশ থাকল, প্রথম গানটি শােনার সাথে সাথেই অপারেশন শুরু করার যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করে এমনকি প্রয়ােজনে জীবন বিসর্জন দেওয়ার জন্যও তৈরি থাকতে হবে। প্রথম গান শােনার পর দ্বিতীয় গানটি শােনার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। দ্বিতীয় গান বাজানাে হবে একই বেতারকেন্দ্র থেকে প্রথম গান বাজানাের ঠিক ২৪ ঘণ্টা পর। গান ২টি শােনার জন্য প্রয়ােজনীয় বেতারযন্ত্র সময়মতােই তাদের দেওয়া হবে বলেও জানিয়ে দেওয়া হয়। শেষ গানটি শােনার পর সাথে ট্রানজিস্টার রাখার প্রয়ােজনীয়তাও ফুরিয়ে যাবে। তখন এটি ফেলে দিলেও চলবে। কিন্তু দ্বিতীয় অর্থাৎ শেষ গান শােনার সাথে সাথে শত্রুপক্ষের নির্দিষ্ট টার্গেটগুলােতে আঘাত করার জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে এবং ঐ দিন। মধ্যরাতেই পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হােক, নির্দ্বিধায় পানিতে নেমে পড়তে হবে। রাত ১টা-২টার মধ্যে অভিযান শুরু করার সময়সীমা নির্ধারিত। কাজেই শেষ গান শােনার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রয়ােজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে অপারেশন শুরু করতে হবে। এর আগে টার্গেট নির্দিষ্ট করার কাজ সেরে রাখতে হবে দিনের আলােয়।  প্রয়ােজনে অপারেশনে নামার আগে শেষ বারের মতাে। টার্গেটগুলাে দেখে নেয়া যেতে পারে। কিন্তু অপারেশন থেকে পিছানাে যাবে না। কোনাে অবস্থাতেই।
যুদ্ধের বর্ণনা
৭ আগস্ট অন্য দলগুলাের সাথে নারায়ণগঞ্জ অপারেশনের জন্য নির্ধারিত কমান্ডােদের পলাশির প্রশিক্ষণ ক্যাম্প থেকে সড়ক পথে নিয়ে আসা হয় ব্যারাকপুরে। পরদিন দমদম বিমানবন্দর হয়ে আকাশপথে তারা এসে পৌঁছেন আগরতলা। ভারত ভূখণ্ডের মধ্যে আগরতলাই হচ্ছে শেষ ঘাঁটি। তাদের নিরাপদ অবস্থানের জন্য এখানে রয়েছে নিউ ক্যাপ নামে ১টি স্বতন্ত্র ক্যাপ। আগরতলার নিউ ক্যাম্পে পৌছার কিছুক্ষণ পর ভারতীয় নৌবাহিনীর ১জন অফিসার কমান্ডাে দলের নেতা আবিদুর রহমানকে একাকী আড়ালে ডেকে নিয়ে অপারেশনের যাবতীয় নির্দেশনামা শেষ বারের মতাে বুঝিয়ে দেন। তিনি তাঁর কোটের পকেট থেকে ১টি ছােটো ট্রানজিস্টার বের করে আবিদের হাতে দিয়ে এর আগে দিল্লিতে বাজিয়ে শােনানাে সাংকেতিক গান ২টির কথা পুনরায় স্মরণ করিয়ে দেন। তারপর নিউ ক্যাম্পে ফিরে এসে কমান্ডাে দলের সামগ্রিক কমান্ডােদের। ধারণা করা হয়েছিল, অপারেশনের সফল বাস্তবায়নে নৌ-কমান্ডােদের মধ্যে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কিছু মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠলেও তা ব্যাপকতা পায় নি। বলা যায়, এ ক্ষেত্রে ভারতীয় সমর পরিকল্পনাবিদদের আশঙ্কাকে নৌ-কমান্ডােরা তাদের দুঃসাহস, কৌশল ও পারদর্শিতা দিয়ে অতিক্রম করে যেতে পেরেছিলেন। এতে ভারতীয় সমরবিদরাও কম বিস্মিত হন। নি।
 
অস্ত্রশস্ত্র, মাইন ও সাজসরঞ্জামও তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়। অপারেশনের মূল অস্ত্র হিসেবে তার দলের মােট ২০জন কমান্ডাের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক লিমপেট মাইন দেওয়া হয়। নারায়ণগঞ্জের শেষ আশ্রয় স্থল পর্যন্ত পথ চিনিয়ে নেয়ার জন্য সাথে দেওয়া হলাে গাইড। ৮ আগস্ট রাতেই এ দল সীমান্ত অতিক্রম করে ঢুকে পড়ে অবরুদ্ধ স্বদেশের মাটিতে। যাত্রা পথের নিরাপত্তার কথা ভেবে অন্য দলগুলাের মতাে তাদেরকেও অনেক ঘুরপথ ধরে এগােতে হয় নারায়ণগঞ্জের দিকে। তবে পথে বড়াে ধরনের কোনাে বাধার মুখােমুখি হতে হয় নি। ফলে শেষ আশ্রয় স্থল। পর্যন্ত পৌছাতে এ দলের সময়ও লাগে অনেক কম। অন্য দলগুলাের মধ্যে চট্টগ্রামমুখী কমান্ডাে দলটিকেই যাত্রা পথে সবচেয়ে বেশি প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তাদের যাত্রা পথের গােটা আয়ােজনটাই ছিল জটিল এবং একই সাথে বিপৎসংকুল। কিন্তু সবচেয়ে দীর্ঘ ও কষ্টের পথ অতিক্রম করতে হয় মংলা বন্দরের জন্য নির্বাচিত কমান্ডাে দলকে। এ দলের যাত্রা পথে পুরােটাই ছিল নৌপথ। কিন্তু নারায়ণগঞ্জ বন্দরের জন্য নির্ধারিত দলটি অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই তাদের আশ্রয়স্থলে এসে পৌছে যায়। এত অল্প সময়ের মধ্য আগস্টের প্রাথমিক ধাপের অভিযানে আর কোনাে দল লক্ষ্যস্থলে পৌঁছাতে পারে নি।  এ দলটি ১১ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ এসে পৌছে। বন্দরের কাছাকাছি এক বাড়িতে তারা আশ্রয় নেয়। অপারেশন শুরু করার জন্য তখন পর্যন্ত অনেক সময় বাকি। নির্দিষ্ট সংকেত না শােনা পর্যন্ত কোনাে অবস্থাতেই অপারেশন শুরু করা যাবে না। এ সংকেত কেবল অধিনায়কই টের পাবেন। আর কারােরই তা জানার কথা নয়। আশ্রয় স্থলে পৌঁছার পর থেকেই কমান্ডােরা অপারেশনের জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। তারা অধিনায়ককে এ ব্যাপারে তাড়া দিতে থাকেন। কিন্তু আবিদুর রহমান তার সিদ্ধান্তে অটল। অপারেশন এখনই শুরু করা সম্ভব নয়। এরই মধ্যে বন্দর এলাকায় কয়েক দফা রেকি করা হয়। প্রতিদিনই সন্ধানী। দল পাঠানাে হয় সেখানে। অধিনায়ক নিজেও কয়েকবার বন্দর পর্যবেক্ষণ করেন।
সেখানে জাহাজের সংখ্যা প্রতিদিনই ওঠানামা করছে। বিভিন্ন স্থান থেকে জাহাজ আসছে। মালামাল খালাস হয়ে যাওয়ার পর কোনাে কোনােটি ফিরে যাচ্ছে অন্যত্র। অজ্ঞাত কারণে ২-১টি নােঙর করে থাকে নদীর মধ্যে। কোনাে কোনাে জাহাজ থেকে মালামাল খালাসই করা হয় নি। সেগুলাে বন্দরের জেটিতেই ভেড়ানাে আছে। এখন যে-কোনাে রাতেই অপারেশন চালানাে যায়। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না প্রয়ােজনীয় সংকেত না পাওয়ার কারণে। অধিনায়ক সর্বক্ষণই ছােটো ট্রানজিস্টারটি তার কাছে কাছে রাখেন। বিশেষ সময়ে গভীর মনােযােগ দিয়ে কলকাতা কেন্দ্রের বাংলা সংগীতানুষ্ঠানগুলাে শােনেন। কিন্তু

কাক্ষিত সংগীতটি যেন আর শােনা যায় না। অপারেশনের জন্য কমান্ডােরা দিন। দিন অধৈর্য হয়ে উঠছেন। কেউ কেউ বিরক্তও হচ্ছেন অধিনায়কের উপর। অধিনায়ক নিজেও মাঝে মাঝে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠেন। অবশেষে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার পর ইথারে ভেসে আসে সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের সুরেলা কণ্ঠ ‘আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি’। অনেকের সাথে অধিনায়কও শুনলেন গানটি। তবে এর সাংকেতিক অর্থ এ মুহূর্তে তিনি ছাড়া আর কেউই বুঝতে পারলেন না। প্রথম গান শােনার সাথে সাথেই আবিদুর রহমানের মধ্যে চাপা উত্তেজনা শুরু হয়। আর মাত্র ২৪ ঘন্টা ।। তারপর নিশ্চয়ই অপর গানটিও শােনা যাবে। এ সময়ের মধ্যে পুনরায় সন্ধানী দল পাঠাতে হবে বন্দরের দিকে। কেননা আগের দিনের রেকি করা জাহাজের অবস্থান সময়ের ব্যবধানে পালটে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে অপারেশন চালাতে গিয়ে বিভ্রান্তির শিকার হবেন কমান্ডােরা। সন্ধ্যা মুখােপাধ্যায়ের কণ্ঠে প্রথম গান শােনার পরদিন বন্দরে সন্ধানী দল পাঠানাে হয়। সন্ধ্যার পর দ্বিতীয় গানটিও শােনা যাবে এবং সে রাতেই চালাতে হবে অপারেশন।
অধিনায়ক গান শােনার পর কমান্ডােদের নিয়ে পরামর্শ বৈঠকে বসলেন। বৈঠকে তাদের আভাস দেওয়া হলাে যে, খুব শিগগির সব উকণ্ঠা। আর অপেক্ষার অবসান ঘটবে। আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা পর অপারেশনের জন্য পুরাপুরি প্রস্তুতি নেয়া যাবে। পরদিন সকালে শেষবারের মতাে রেকি করা হয় বন্দরে। অধিনায়ক আবিদ নিজেও দেখে এলেন কোন জাহাজ কোথায় অবস্থান করছে। মােট ৫টি জাহাজ রয়েছে বন্দরে। জাহাজগুলাে ধ্বংসের জন্য প্রতি গ্রুপে ৩জন করে ১৫জন কমান্ডােই যথেষ্ট। ১টি জাহাজে ৩টি করে লিমপেট মাইন লাগিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে এবং সেগুলাে ঠিকমতাে বিস্ফোরিত হলে কোনো জাহাজই পানির উপর ভেসে থাকতে সক্ষম হবে না। ১৫ আগস্ট। সন্ধ্যার পর ট্রানজিস্টারে দ্বিতীয় গানটিও যথারীতি শােনা গেল ‘আমি তােমায় যত শুনিয়েছিলাম গান। অধিনায়ক এবার তার সঙ্গীদের শেষ নির্দেশ দিলেন চূড়ান্তভাবে তৈরি হওয়ার জন্য। ৫জন কমান্ডাে ডাঙায় রেখে বাদ। বাকি ১৫জনকে ৫টি ভাগে ভাগ করা হয়। এক ভাগে অন্তর্ভুক্ত হন অধিনায়ক। নিজে। ৫টি দল বন্দরের ৫টি জাহাজে মাইন স্থাপনের জন্য পানিতে নামবে। স্থলভাগের কমান্ডােরা নদীর তীরে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকবেন প্রতিপক্ষের সম্ভাব্য হামলা মােকাবিলার জন্য। রাত ১২টার দিকে কমান্ডাে দল অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হয়ে বেরিয়ে পড়ে ক্যাম্প থেকে। নারায়ণগঞ্জের পূর্ব পাড়ে সােনাকান্দা গ্রামের ভিতর দিয়ে বন্দর সােজা নদীর পাড়ে এসে তারা পেীছে। এ স্থানটির দুই দিকে অত্যন্ত কাছাকাছি দূরত্বে অবস্থান করছে পাকিস্তানি সৈন্য। তা সত্ত্বেও এ বিপৎসংকুল স্থান বেছে নেয়া হয় অপারেশনের জন্য। জায়গাটি অপেক্ষাকৃত বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও টার্গেট স্থলের দূরত্ব এখান থেকে অনেকটা কাছে।
নদীর পাড় ধরে পাকা রাস্তা। রাস্তার ডান পাশে পাকিস্তানি সৈন্যদের। অবস্থান আড়াল করে এক পাশে সারিবদ্ধ দোকানের পিছনে এসে জড়াে হয় কমান্ডােরা। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি। আশপাশে কোথাও কেউ নেই। ওপারে বন্দরের তীব্র আলাে। এ আলাের ক্রমহ্রাসমান আভাস এপারেও এসে পড়েছে। তবে রাস্তার পূর্ব পাশের দোকান বহরের দিকটা মােটামুটি অন্ধকার। এ অন্ধকার গলিয়ে ৩জনের ৩টি গ্রুপকে নিঃশব্দে নামিয়ে দেওয়া হয় নদীতে। তারা ফিনস। পায়ে ডুবসাঁতার দিয়ে এগিয়ে যায় বন্দরের দিকে। পিছনে ২টি গ্রুপ তখন পর্যন্ত অবস্থান করছে দোকানের আড়ালে। অধিনায়ক নিজেও রয়েছেন গ্রুপগুলাের সাথে। এ গ্রুপ ২টি প্রস্তুতি নিয়ে দোকানের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা মাত্রই। কোথেকে অস্ত্র হাতে এক রাজাকার সেখানে এসে হাজির। ১টি রাইফেল তার। কাধে ঝােলানাে। এর আগে যে পথে রাস্তা অতিক্রম করে কমান্ডােদের ৩টি গ্রুপ নদীতে নেমে গেছে, রাজাকারটি ঠিক সেখানে এসে রাস্তার উপর দাড়িয়ে হাঁকডাক শুরু করে দেয়। নির্জন অন্ধকার নদীর তীরে রাজাকারটি সম্ভবত নিজেও ভয় পাচ্ছে। ভয় তাড়ানাের জন্যই সে বিরতি দিয়ে একটু পর পরই হাঁক দিতে থাকে। অল্প পিছনে দোকানের আড়ালে কমান্ডােদের অস্তিত্ব সম্পর্কে তার কোনাে ধারণাই নেই। খুবই বিরক্তিকর ও বিপজ্জনক অবস্থা। রাজাকারটি একেবারেই নড়ছে না। কাধে ঝোলানাে রাইফেলের বাটে একহাত রেখে সে নির্বিকার এবং নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার উপর। তার মুখ কোণাকুনি নদীর দিকে। পিছনে দোকানের আড়ালে অধৈর্য অপেক্ষায় প্রহর গুণছেন কমান্ডােরা। সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে। অগ্রবর্তী ৩টি গ্রুপ ততক্ষণে এগিয়ে গেছে অনেক দূর। আর অপেক্ষা করা চলে না। রাজাকারটিও যে শিগগির এ স্থান ত্যাগ করবে, এমন মনে হচ্ছে না।
এ অবস্থায় কমান্ডােরা তাকে খুন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। তা ছাড়া আর কোনাে সহজ উপায় নেই পথ পরিষ্কার করার। দোকানের আড়ালে আবছা অন্ধকারে নিজেদের মধ্যে ফিসফাস আলাপ করে এ ব্যাপারে পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়। রাজাকার খতম করার দায়িত্ব নিলেন স্বয়ং অধিনায়ক আবিদ। সম্ভাব্য পালটা হামলা মােকাবিলার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হলাে সঙ্গীদের। রাজাকার হত্যা করার কাজ সারতে হবে। নিঃশব্দে। খুব কাছাকাছি রয়েছে পাকিস্তানি সৈন্যদের সতর্ক অবস্থান। সামান্য শব্দ কিংবা চিকার হলেই বড়াে ধরনের বিপদ ঘনিয়ে আসতে পাবে। কাজেই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা যাবে না। ওকে খুন করতে হবে ছুরি দিয়েই। অধিনায়ক তার দলবলসহ আরও একটু কাছাকাছি এগিয়ে আসেন রাজাকারের দিকে। তারপর তিনি কোমর থেকে জাহাজের শ্যাওলা পরিষ্কার করার ছুরিটি বের করেন। প্রচণ্ড ধারালাে ইস্পাতের ছুরি। সঙ্গীদের পিছনে রেখে শক্ত হাতের মুঠোয় ছুরি চেপে ধরে আবিদ ক্রলিং করে এগিয়ে যান রাস্তার দিকে। রাস্তার উপর দাঁড়ানাে রাজাকারটিও যেন ধরা দেয়ার জন্যই প্রস্তুত হচ্ছে। সবকিছুই ঘটে যাচ্ছে তার অজ্ঞাতে। নিঃশব্দে ক্রলিং করে আবিদ যখন। রাস্তার কিনারে এসে পৌঁছেন, ঠিক সে সময় সামনের উলটাদিকে মুখ করে দাড়িয়ে থাকা রাজাকার তার কাধ থেকে ঝুলন্ত রাইফেলটি নামিয়ে এনে দুই পায়ের মাঝামাঝি হেলান দিয়ে রাখে। সে এখন বিড়ি ধরাবে। ঠোটের সাথে চেপে রাখা বিড়িতে আগুন দেওয়ার জন্য দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বালানাের সাথে সাথে আবিদ এক লাফে ঝাপিয়ে পড়েন তার উপর। তিনি প্রথমেই এক ঝটকায় রাইফেলটি ছোঁ মেরে ছিনিয়ে নেন। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে যায় যে, রাজাকারটি কিছু বুঝে উঠার আগেই দুই দিক থেকে ২টি স্টেনের ঠাণ্ডা পৰ্শ তার ঘাড়ে এসে ঠেকে। এ অসহায় অবস্থার মধ্যে অনিবার্য মৃত্যুভয়ে হাউমাউ করে সে। কেঁদে ওঠে। কমান্ডােদের হাত-পা জড়িয়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চেয়ে ব্যাকুল হয় রাজাকারটি। শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হলাে না। নতুন পরিকল্পনা মাথায় আসে কমান্ডােদের।
তারা ছিনিয়ে নেয়া রাইফেলের গুলি বের করে সেটা আবার তাকে ফিরিয়ে দেয়। মৃত্যুভয়ে রাজাকার তখন যে-কোনাে নির্দেশ মেনে নিতে রাজি। তাকে বলা হলো, রাস্তায় দাড়িয়ে আগের মতােই হাঁকডাক দিতে, যাতে গােটা পরিস্থিতি পূর্বাপর স্বাভাবিক থাকে। হুশিয়ার করে দেওয়া হয় নির্দেশ মতাে কাজ না করে কোনাে চাতুর্যের আশ্রয় নেয়া হলে পিছন থেকে গুলি করা হবে তাকে। তারপর স্থলভাগের কমান্ডােরা আবার গিয়ে আশ্রয় নেয় দোকানের আড়ালে। আর নৌ-কমান্ডােদের ৩জনের ২টি গ্রুপ দাড়িয়ে থাকা রাজাকারের সামনে দিয়েই ফিনস পায়ে লাগিয়ে নেমে যায় নদীতে। অবস্থাটি এখন এ রকম যেন রাজাকারটি পাকিস্তানি জাহাজ ধ্বংস করতে যাওয়া কমান্ডােদের পাহারা দিচ্ছে। সে গুলিবিহীন রাইফেল হাতে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নদীর দিকে। পিছনে দোকানের আড়ালে কমান্ডােদের স্টেনগানের ব্যারেল তখন তার দিকে। তাক করে আছে, এটা সে বুঝতে পারে। রাজাকারটি তখন পর্যন্ত জানে না তার সামনে বন্দরের নদীতে কী ঘটতে যাচ্ছে। উদোম শরীরের নিরস্ত্র কমান্ডােরা সাঁতার কেটে এভাবে কোথায়ই বা যাচ্ছে। মাঝপথের প্রতিবন্ধকতা দেখা দেওয়ার আগেই কমান্ডােদের যে ৩টি গ্রুপ নদীতে নেমে যায়, তারা ততক্ষণে যার যার জাহাজে মাইন লাগানাে শেষ করেছে। তারপর বিলম্বিত গ্রুপ ২টিও নির্বিঘ্নে জাহাজে মাইন বসিয়ে দ্রুত সাতরিয়ে ফিরে আসে নদীর পূর্ব পাড়ে। সেখানে দোকানের পিছনে তারা আবার। একত্র হয়। ক্যাম্পের দিকে ফিরে যাওয়ার সময় হঠাৎ তাদের চোখ পড়ে রাস্তার । উপর। সেখানে রাজাকারটি নেই। কোন ফাকে সে সটকে পড়েছে তাড়াহুড়ার মধ্যে কেউ খেয়ালই করে নি। ঠিক এ সময় নদীতে বিস্ফোরণ শুরু হয়। বন্দরের জলরাশি এবং দুই পাড় প্রকম্পিত করে পর পর ১৫টি মাইনই বিস্ফোরিত হয়। এর সাথে ভীতিবিহ্বল পাকিস্তানি সৈন্যদের গােলাগুলি তাে। আছেই। সাথে বিকট শব্দে বেজে ওঠে সাইরেন। সব মিলিয়ে এখানেও সৃষ্টি হলাে এক প্রলয়ংকরী অবস্থা। ঐ রাতে প্রায় একই সময় একই অবস্থার সৃষ্টি হয় বাংলাদেশের আরও ৩টি নৌবন্দরে। শেষ পর্যন্ত কমান্ডােরা একটি গুলিও খরচ না করে নিরাপদে ফিরে আসে আশ্রয় ক্যাম্পে। পালিয়ে যাওয়া ভীত রাজাকারটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঘটনার আসল রহস্য উদ্ঘাটনে সক্ষম হয়েছে।
পরদিন সকালে আবিদ ১জন সঙ্গী সাথে নিয়ে বন্দরের পরিবর্তিত অবস্থা পর্যবেক্ষণে যান। গত রাতের অপারেশনের সফলতার খবর তারা পথিমধ্যেই শুনতে পান। লিমপেট মাইনের আঘাতে বন্দরে ৫টি জাহাজ ডুবে গেছে। এ খবরে অপরিসীম আনন্দে ভরে ওঠে তাদের বুক। তারা হাটতে হাটতে এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ কারাের ডাক শুনে চমকে দাঁড়ান। গত রাতের বেঁচে যাওয়া রাজাকারটি পিছন থেকে ডাকতে ডাকতে দৌড়ে আসে। প্রকাশ্য দিনের আলােতে তাকে এভাবে দৌড়াতে দেখে আতঙ্কিত হন কমান্ডােরা। কিন্তু একটু পরই বােঝা গেল বিপদের তেমন কিছু নেই। অজ্ঞাতনামা এ রাজাকার কাছে এসে আশ্বাস দিয়ে জানায় যে, সে তাদের কোনাে ক্ষতি করবে না। সম্ভব হলে উপকারই করবে। শেষ পর্যন্ত সে তার কথা ভঙ্গ করে নি। অধিনায়ক আবিদ তাঁর সঙ্গী এবং রাজাকারটিকে নিয়ে কথা বলতে বলতে নদীর পাড় ধরে হেঁটে এগােচ্ছেন। আশপাশের কোনাে লােক তাদের সন্দেহ করছে বলে মনে হয় না। আবিদ সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন চারদিকে। সহসা তিনি লক্ষ্য করলেন, সামনে ১টি রিকশায় ২জন পাকিস্তানি সৈন্য এগিয়ে আসছে তাঁদের দিকে। তিনি সাথে থাকা রাজাকারের ভূমিকা নিয়ে এবার চিন্তিত হলেন। রাজাকারটি বিশ্বাসঘাতকতা করবে নাতাে! রিকশাটি তাদের কাছাকাছি এসে থামে। ২জন সৈন্য রিকশা থেকে নামতে নামতে হাতের ইশারায় রাজাকারকে ডাকে । নিশ্চয়ই সে তাদের পরিচিত। আতঙ্কে বুক দুরুদুরু করতে থাকে কমান্ডােদের। আবিদের পকেটে ১টি পিস্তল আছে। গুলি ভরাই তাতে। কিন্তু সঙ্গীটির কাছে কোনাে অস্ত্রই নেই। আবিদ মনে মনে প্রস্তুত হলেন যেকোনাে পরিস্থিতি মােকাবিলার জন্য। কিন্তু না, তেমন কোনাে বিপদ ঘটলাে না এখানেও। রাজাকারের সাথে কিছু কথা বলে সৈন্যরা আবার রিকশায় চেপে কমান্ডােদের সামনে দিয়ে এগিয়ে যায়। তারপর রাজাকারের সহায়তায় তারা। নির্বিঘ্নে হেঁটে চলে আসেন নিরাপদ এলাকার দিকে।
ফলাফল
১৫ আগস্ট নারায়ণগঞ্জ বন্দরে নৌ-কমান্ডাে অপারেশন ৫টি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। এ অপারেশন পাকিস্তানি বাহিনীর বিশ্বাসের ভীত নাড়িয়ে দেয়। পৃথিবীর সব গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা, রেডিও ও টেলিভিশনে প্রচারিত হয় ১৫ আগস্টের বাংলাদেশের ৪টি বন্দরের জাহাজ ডােবানাের সংবাদ। টেলিভিশনে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। উল্লসিত ও উৎসাহিত হন। নৌ-কমান্ডােরা।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!