You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.03 | প্রাথমিক প্রতিরােধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম (২৬ মার্চ-৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল) - পাক বে ডকইয়ার্ড অপারেশন - সংগ্রামের নোটবুক
প্রাথমিক প্রতিরােধ ও সশস্ত্র সংগ্রাম (২৬ মার্চ-৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সাল)
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তম নদীবন্দর ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল। মহকুমা শহর নারায়ণগঞ্জ। শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত এ শহর কয়েক’শ বছর ধরে শিল্প ও বাণিজ্য নগরী হিসেবে গড়ে ওঠে। এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম এবং বিশ্বের অন্যতম পাটকল আদমজী জুট মিল নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে অবস্থিত। তা ছাড়া গােদনাইলে ছিল দেশের বৃহত্তম তেলের ডিপাে এবং সিদ্ধিরগঞ্জে গুরুত্বপূর্ণ বৈদ্যুতিক পাওয়ার স্টেশন। বেশ কয়েকটি ডক ইয়ার্ডও ছিল নারায়ণগঞ্জে। ঢাকার সাথে সড়ক ও নৌ-যােগাযােগ ব্যবস্থার সুবিধার কারণে এবং ঢাকার সন্নিকটে হওয়ায় নারায়ণগঞ্জের বাণিজ্যিক ও সামরিক গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। শীতলক্ষ্যা নদী পদ্মা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীতে সংযুক্ত হয়ে গােটা বাংলাদেশকে নৌপথের মাধ্যমে সংযুক্ত করেছে। নারায়ণগঞ্জ রেলপথে ঢাকা ও নরসিংদীর সাথে যুক্ত। নারায়ণগঞ্জে ৭টি থানা: নারায়ণগঞ্জ সদর, ফতুল্লা, আড়াইহাজার, সােনারগাঁও, রূপগঞ্জ, বন্দর এবং সিদ্ধিরগঞ্জ। এটি ছিল ঢাকা জেলার ১টি মহকুমা। ১৯৭১ সালে মুন্সিগঞ্জও ছিল ঢাকা জেলার ১টি মহকুমা। মুন্সিগঞ্জের ৬টি থানা: মুন্সিগঞ্জ সদর, টঙ্গীবাড়ি, গজারিয়া, লৌহজং, শ্রীনগর এবং সিরাজদিখান। ঢাকা থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ যাতায়াত ব্যবস্থায় অসুবিধার কারণে ছিল প্রত্যন্ত । মুন্সিগঞ্জ মহকুমার দক্ষিণে পদ্মা এবং পূর্বে মেঘনা নদী। এ দুই বিশাল ও বিখ্যাত নদী মিলেছে এ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্বে। উত্তরে ধলেশ্বরী নদী পূর্ব দিকে বয়ে গিয়ে মেঘনা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। ধলেশ্বরী নদীর প্রায়। সমান্তরালভাবে পূর্ব-পশ্চিমে বয়ে গেছে ইছামতি নদী। পশ্চিমে গিয়ে ইছামতি একেবেঁকে প্রবাহিত।
মেঘনার শাখা ফুলদি নদী গজারিয়া থানার ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে উত্তরে। শ্রীনগর খাল লৌহজং ও শ্রীনগর থানাকে উত্তর-দক্ষিণে বয়ে সংযুক্ত করেছে। ব্রহ্মপুত্র নাম ধরে একটি নদ পদ্মা ও মেঘনা নদীতে যােগ। দিয়েছে এ অঞ্চলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। পদ্মা, মেঘনা ও ইছামতি নদীর অসংখ্য শাখা এ মহকুমার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। তা ছাড়া লৌহজং, শ্রীনগর ও সিরাজদিখান থানা এলাকার পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে আড়িয়াল বিল নামে বিস্তৃত জলাশয়। মুন্সিগঞ্জ মহকুমা প্রকৃত অর্থেই নদীমাতৃক। নদী না পেরিয়ে সরাসরি মুন্সিগঞ্জ পৌছার কোনাে সড়ক পথ নেই। ঢাকা থেকে ফেরির সাহায্যে ধলেশ্বরী নদী পেরিয়ে মুন্সিগঞ্জ যাওয়ার পথ। মহকুমা সদর থেকে থানা সংযােগকারী সড়কে কেবল শুষ্ক মৌসুমে গাড়ি চলে। মুন্সিগঞ্জ প্রায় পুরােপুরিই জলপথ নির্ভর। মুন্সিগঞ্জের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থার কারণে এর গুরুত্ব ছিল কম। রণকৌশলগত গুরুত্ব স্বভাবতই ছিল আরও কম।
নারায়ণগঞ্জের সার্বিক গুরুত্বের কারণে পাকিস্তানি সৈন্যরা ২৬ মার্চ সকালেই নারায়ণগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে। নারায়ণগঞ্জ শহরের উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সড়কে মাসদাইর নামক স্থানে কয়েক’শ প্রতিবাদী জনতা রাইফেল নিয়ে প্রতিরােধ করে। এ প্রতিরােধে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় লােক ছাড়াও মুন্সিগঞ্জ থেকে জনতা এসে যােগ দেয়। এ সশস্ত্র প্রতিরােধ প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী হয়। পরবর্তী সময় নারায়ণগঞ্জ শহরের পশ্চিমে চাষাঢ়া এলাকায় আরেকটি সশস্ত্র প্রতিরােধ গড়ে তােলা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আধুনিক অস্ত্রের বিপরীতে কেবল .৩০৩ রাইফেল এবং প্রশিক্ষণহীন, অসংগঠিত জনতার এ প্রতিরােধ স্বভাবত এবং কার্যত কোনাে ফল আনতে পারে নি। পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায় বাধাহীনভাবে নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করে তাদের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করে। অবশ্য তাদের এ একচেটিয়া কর্তৃত্ব বেশি দিন টেকে নি। মুক্তিযােদ্ধারা গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে পাক বে ডকইয়ার্ড, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন ও নদীবন্দরে অবস্থিত জাহাজ ধ্বংস ও বার বার রেইড ও অ্যামবুশ পরিচালনার মাধ্যমে শক্রর সমূহ ক্ষতিসাধন করেন। নারায়ণগঞ্জ ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত ঘাঁটি। মুন্সিগঞ্জ সার্বিকভাবে কম গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় পাকিস্তানি সৈন্যরা প্রায় ৩ সপ্তাহ পরে ১৭ এপ্রিল সেখানে পৌছায়। নদীমাতৃক এলাকা বলে প্রথমে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত থাকে। মুন্সিগঞ্জে প্রবেশ করেই তারা কয়েকজন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতার বাড়িতে আগুন দেয়। তাদের মধ্যে মােসলেউদ্দিন, মােহাম্মদ হােসেন বাবুল, ডা. এম এ কাদের, দেলােয়ার হােসেন অন্যতম। আশঙ্কা ছিল মুন্সিগঞ্জ দখলে তাদের প্রতিরােধের সম্মুখীন হতে হবে কিন্তু বাস্তবে তাদের সে আশঙ্কা সত্যি হয় নি।
মুন্সিগঞ্জে পাকিস্তানি বাহিনীর সংখ্যাও ছিল খুব কম, আনুমানিক ৫০৬০জন। কোনাে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা না থাকায় কেবল তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে অখণ্ড পাকিস্তানের কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ বহাল রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। শহরের হরগঙ্গা কলেজে তারা ঘাঁটি স্থাপন করে। ২৫ মার্চ রাতে ইপিআর সদর দপ্তর পিলখানায় বাঙালি ইপিআর সদস্যদের উপর পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করলে অপ্রস্তুত বাঙালি ইপিআর সৈন্যরা সাধ্যমতাে প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। কিন্তু তাতে ফল হয় নি। তাদের বহু সদস্য শহিদ হন, অনেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন, অনেকে বন্দি হন। | বন্দি বাঙালি সৈন্যদের কাছ থেকে পরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ লিখিত অঙ্গীকার নেয় যে, তারা যদি পালিয়ে না যায় এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও ইস্ট পাকিস্তান সিভিল। আমর্ড ফোর্সেস (EPCAF)-এর সঙ্গে থেকে যুদ্ধ করতে রাজি হয়, তাহলে তাদের মুক্তি দেওয়া হবে। প্রাণের ভয়ে বাঙালি সৈন্যরা এ মুচলেকা প্রদান করে। মুক্তি লাভ করে। পরবর্তী সময় পাকিস্তানি বাহিনী বাঙালি এ ইপিআর সৈন্যদের মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনে ব্যবহার করে। আক্রমণে ও অগ্রাভিযানে বাঙালি সৈন্যদের তারা সামনে রাখত, যেন মুক্তিবাহিনীর প্রথম গুলি তাদের গায়ে লাগে। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের সৈন্য ঘাটতি পূরণ করার উদ্দেশ্যে এ সকল ইপিআর বাঙালি সৈন্য এবং বাঙালি পুলিশদের প্রত্যন্ত এলাকার থানাগুলােতেও মােতায়েন রাখে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুন্সিগঞ্জের ৬টি থানার প্রায় সব কয়টিতে বাঙালি ইপিআর ও পুলিশ মােতায়েন করে। ২৬ মার্চ ও তার পূর্বে ছাত্র-জনতা নারায়ণগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের ট্রেজারি থেকে আনসারদের জন্য সংরক্ষিত রাইফেল ও গুলি ছিনিয়ে নেয়। এ অস্ত্রগুলােই হয় সশস্ত্র প্রতিরােধের প্রথম হাতিয়ার।
জুন মাস থেকেই নারায়ণগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অপারেশন শুরু করেন। কিন্তু মুন্সিগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অপারেশন শুরু করতে করতে আগস্ট মাস এসে যায়। যদিও মুন্সিগঞ্জ সদরে পাকিস্তানিদের দালাল ও সাহায্যকারী শান্তি কমিটির সমাবেশে ২ বার সশস্ত্র আক্রমণ করে তাদের সন্ত্রস্ত করে তােলা হয়। অপরিহার্য না হলে পাকিস্তানি সৈন্যরা নৌপথে যাতায়াত পরিহার করত। | ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ ছিলেন প্রখর ধীশক্তি ও দূরদর্শী অফিসার। তাঁর বিচক্ষণতা এবং যুদ্ধ সম্পর্কিত প্রচলিত ও অপ্রচলিত ধারণা ছিল সৃজনশীল ও স্বচ্ছ। তিনি তার যুদ্ধের পরিকল্পনার সহযােগী হিসেবে পেয়েছিলেন আরেক অসাধারণ অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (SSG) ক্যাপটেন এটিএম হায়দারকে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালী ও ফরিদপুর এলাকায় এ দুই অফিসার তাদের মেধার জোগান দিয়ে ইস্পাতকঠিন কিছু তরুণ দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘অন্ধকার ঘরে সাপ’- এ আতঙ্কে আতঙ্কিত করেছিলেন তাঁরা। এ দুই অফিসার সৌভাগ্যক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের এবং সরকারি বিভাগের বিভিন্ন সহযােগীপেয়েছিলেন। তাঁদেরই ১জন ছিলেন বিদ্যুৎ উন্নয়ন বাের্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মমিনুল হক ভূঁইয়া। মমিনুল হক ভূঁইয়ার স্মৃতিশক্তি ছিল।
কিংবদন্তিতুল্য। বাংলাদেশের বিশেষ করে ঢাকা ও আশপাশের অঞ্চলে অবস্থিত। বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নকশা তিনি স্মৃতি থেকে প্রায় হুবহু তুলে আনতে পারতেন। তাঁর। আঁকা নকশা অনুযায়ী খালেদ-হায়দার সেগুলাে ধ্বংসের পরিকল্পনা করতেন। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন, উলন পাওয়ার স্টেশন, রামপুরা পাওয়ার স্টেশনসহ বহু পাওয়ার স্টেশন মমিনুল হক ভূঁইয়ার তৈরি নকশা অনুযায়ী ধ্বংস করা হয়। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গী ও নরসিংদীর বহু শিল্পকারখানা বিদ্যুতের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আঁধারে প্রায়ই ডুবে থাকত এসব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা।
পাক বে ডকইয়ার্ড অপারেশন
পাক বে ডকইয়ার্ড পরিচিতি নারায়ণগঞ্জ শহরের পূর্ব প্রান্তে এবং শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড়ে বন্দর থানা এলাকায় নবীগঞ্জ-কাইত্যাখালীতে পাক বে ডকইয়ার্ডের অবস্থান। ব্যক্তিমালিকানাধীন এ প্রতিষ্ঠান জাহাজ তৈরি, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ছাড়াও জাহাজের ব্যবসা করত। এটি ছিল ওয়ার্কশপ কাম ডকইয়ার্ড। পূর্ব পাকিস্তানে টাগ, লঞ্চ, সি ট্রাক, পন্টুন, ফেরি ও বার্জের বহরের ব্যক্তিমালিকানাধীনে সবচেয়ে বড়াে ব্যাবসা ছিল পাক বে কোম্পানির। সরকারি প্রতিষ্ঠান পূর্ব পাকিস্তান রিভার স্টিমার সার্ভিস’-এর পরই ছিল পাক বে’র ব্যাবসার প্রসার । অবাঙালি আনােয়ার আহমেদ কালুন ছিলেন পাক বে’র মালিক। প্রতিষ্ঠানটির হেড অফিস ছিল ঢাকা শহরের ১৬, মতিঝিল। প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন অফিসাররা ঢাকার গুলশান এলাকায় বাস করতেন এবং প্রতিদিন এখান থেকে নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত করতেন। এ ডকইয়ার্ডে ২টি স্লিপওয়ে (Slipway) এবং ১টি মাডওয়ে (Mudway) ছিল। ২০০ টন পর্যন্ত জাহাজ এখানে তৈরি ও মেরামত করা যেত। এ ডকইয়ার্ডে ২০ ফুট দীর্ঘ ফাইবার গ্লাস বােট তৈরির প্ল্যান্ট ছিল। ইপিআর তাদের ছােটো নৌযান পাক বে ডকইয়ার্ডে মেরামত করাত। পরিস্থিতি পাকিস্তানি সামরিক সরকার নদীপথে চলাচল এবং রসদ পরিবহণে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সম্মুখীন হতাে। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৪টি গানবােট ছিল: বিএনএস ঢাকা, বিএনএস কুমিল্লা, বিএনএস যশাের ও বিএনএস রাজশাহী। নদীমাতৃক বাংলাদেশে এ নৌশক্তি ছিল নিতান্তই অপ্রতুল।
তারা স্টিলৰডির বিভিন্ন ধরনের নৌযানে ঘূর্ণায়মান মেশিনগান, মর্টার, ভারী মেশিনগান (.৫০ ইঞ্চি ব্রাউনিং বা ১২.৭ মিমি) বসিয়ে যুদ্ধক্ষম নৌযানে রূপান্তর করে। পাক বে ডকইয়ার্ডে এ জাহাজগুলাের রূপান্তর করা হতাে। রূপান্তরিত নৌযানগুলাে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রচণ্ড ধারায় গুলি বর্ষণের মাধ্যমে আতঙ্কের সৃষ্টি করত। নদী ও জলপথে মুক্তিযােদ্ধারা নৌকাযােগে (তখন ইঞ্জিন বােট ছিল না) যাতায়াত করতেন। যন্ত্রচালিত ও রূপান্তরিত গানবােটগুলােয় বালির বস্তা (Sand Bag) বসিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণ থেকে নিরাপদ করা হতাে। মােদ্দা কথায়, তথাকথিত এ গানবােটগুলাের উপস্থিতি জনগণের মধ্যে ভয়াবহ আতঙ্ক সৃষ্টি করত। তারপরও পাকিস্তানিরা যন্ত্রচালিত নৌযানের অভাব অনুভব করতে থাকে।
বিশেষ করে এমন সব ছােটো আকারের নৌযান বা স্পিডবােট, যা সহজে ছােটো ছােটো খাল এবং অগভীর জলাশয়ে প্রবেশ করতে পারত। এ উদ্দেশ্যে পাকিস্তানি কূটনীতিবিদরা জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনকে (UNHCR – United Nations High Commission for Refugees) বােঝাতে সক্ষম হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে যথেষ্ট খাদ্যশস্য থাকা সত্ত্বেও গাড়ি ও নৌযানের অভাবে তা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছানাে যাচ্ছে না। খাদ্যশস্যের যথাযথ বণ্টনের অভাবে পূর্ব পাকিস্তানে অযাচিত দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যশস্য পরিবহণের জন্য প্রয়ােজনীয় গাড়ি ও ছােটো-বড়াে বিভিন্ন ধরনের নৌযান প্রদান করে। পূর্ব পাকিস্তানে অসামরিক কর্তৃপক্ষের মতামত অগ্রাহ্য করে এবং জাতিসংঘের উদ্বাস্তু কমিশনের নিয়মনীতি তােয়াক্কা না করে এসব যানবাহন পাকিস্তানি। বাহিনী সামরিক কাজে ব্যবহার করতে শুরু করে। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া। জলযানও তারা সামরিক অপারেশনে ব্যবহার করতে থাকে। এ বিষয়ে অবগত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাসিসটেন্ট সেক্রেটারি অব স্টেটস, জোসেফ বিসকো। জাতিসংঘ, জেনেভায় পাকিস্তানি প্রতিনিধি আগা হিলালিকে ডেকে অভিযােগ করেন। মে মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ১৪জন সেক্রেটারিকে বাংলাদেশে (তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান) বদলি করা হয়। তাদেরই ১জন, হাসান জহির। 61913 Planning Board and Programme Adminstrator of the Cyclone-affected Areas-এর Member হিসেবে কাজ করেন।
১৬ ডিসেম্বরের পর তিনি যুদ্ধবন্দি হিসেবে ভারতে এবং পরে নিজ দেশে পাকিস্তান ফেরত যান। হাসান জহির তার বই ‘Separation of East Pakistan’ লিখেন, “….There were frequent clashes between the civil officers, engaged in food distribution, and the local army commanders on the use of available transport. In spite of government instructions, the local army formation would just seize the vehicles, river vessels, and even railway trains, and that would be that, by the time the matter was reported by the district officer to the chief secretary, who took it up with Major-General Farman Ali, who contacted Eastern Command, the movement programme had already been dislocated to the despair of hard-pressed civil officials. The problem was not merely at the local level. In the second week of July, the resident representative of the UNDP was complaining to the Secretary, EC & EA Division that the UN vehicles, launches, and equipment were still under requisition of the martial law authorities in East Pakistan. On 5 June, Sisco had complained to Hilaly about the public relations problems created for the administration by the reports of US boats donated for relief operations in East Pakistan being used for military purposes……… In the transport sector, the request for landing craft of various types was not endorsed, presumably because in the earlier months the LCTs had become associated with military use. Malik in a letter to El-Tawil, on 2 August, mildly protested against the reduction in various relief items by the UN in the ‘initial requests’ incorporated in the press release of 16 July, and hoped that they would be restored to their original form ‘in your future announcement for our immediate relief needs.” সড়ক পথ মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের কারণে সাধারণত নিরাপদ ছিল না।
পাকিস্তান বাহিনীর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল, এসব নৌযানে করে তাদের সৈন্য দূরদূরান্তেও দ্রুত পৌছানাে। পরিকল্পনা ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ যেভাবেই হােক। তার সদর দপ্তরে এ সংবাদ পান। তিনি অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে এবং বুদ্ধিমত্তার। সাথে অনুধাবন করেন যে, এ ধরনের স্পিডবােটগুলাে বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জে অবাধে ঢুকে গেলে মুক্তিযােদ্ধারাই শুধু নয়; গােটা জনগণের উপর এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে। জনগণের উপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মাত্রাও। বেড়ে যাবে। তিনি পাকিস্তান বাহিনী এ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ইতােমধ্যে তারা ৩০০টির বেশি স্পিডবােটের ইঞ্জিন (OBM – Out Board Motor) পাক বে ডকইয়ার্ডে নিয়ে আসে। এখানে ফাইবার। গ্লাসের স্পিডবােট তৈরি শুরু হয় এবং কয়েকটি বােট তৈরি হয়ে যায়। মে মাসের শেষ সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জের বিএ ক্লাসের ছাত্র গিয়াসউদ্দিন আহমেদ ২ নম্বর সেক্টর সদর দপ্তরে পৌঁছেন। গিয়াসউদ্দিনের বড়াে ভাই মােহাম্মদ আবদুল মালেক পাক বে’র সাথে ব্যাবসা করেন। তিনি ছিলেন ১জন প্রথম শ্রেণির শিপ বিল্ডার। সেখানে নৌযান তৈরি করতেন এবং পাক বে’তে। যন্ত্রাংশ সরবরাহ করেন। বড়াে ভাইয়ের ব্যবসার সুবাদে গিয়াসউদ্দিন বহুবার। পাক বে’র ভিতরে ঘুরে ঘুরে দেখেছেন। পাক বে’র অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা, মেশিনারি ও প্ল্যান্টের অবস্থান সবই তার স্মৃতিতে। মেজর খালেদ মােশাররফ ও ক্যাপটেন এ টি এম হায়দার গিয়াসউদ্দিনকে পাক বে’র একটি বালির মডেল তৈরি করতে বলেন। মেলাঘরে গিয়াসউদ্দিন পাক বে’র একটি মডেল তৈরি। করেন।
এ ২জন অফিসার গিয়াসউদ্দিনের কাছ থেকে বিস্তারিত ব্রিফিং নেন। পরদিন মেজর খালেদ ও ক্যাপটেন হায়দার পাক বে’র ফাইবার বােট (স্পিডবােট) তৈরির প্ল্যান্ট কীভাবে ধ্বংস করতে হবে, গিয়াসউদ্দিনকে সব বুঝিয়ে দিলেন। গিয়াসউদ্দিনের সাথে আরও ৭জন মুক্তিযােদ্ধাকে ক্যাপটেন হায়দার প্লস্টিক এক্সপ্লোসিভ ব্যবহারের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করেন। তিনি স্পিডবােট তৈরির প্ল্যান্টটি কীভাবে ধ্বংস করতে হবে তা বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেন। জুন মাসের মাঝামাঝি এ অপারেশন কার্যকরী করার জন্য নির্দেশ দিয়ে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে দলটিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করানাে হয়। পাক বে’র নিজস্ব নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল । জনসাধারণের জন্য পাক বে ছিল। দুর্গম। যেহেতু সামরিক নৌযান এখানে তৈরি, মেরামত ও রূপান্তর করা হতাে তাই পাক বে’র নিরাপত্তা প্রহরী ছাড়াও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি দল এখানে পাহারা দিত। পাকিস্তানি সেনাদের এ দলটি পাক বে’র ঘাটিতে নােঙর করা ১টি ভাসমান জাহাজে থাকত। তা ছাড়া রাজাকাররা নিরাপত্তা কাজে এদের সহায়তা করত। যুদ্ধের বর্ণনা ৮-৯ জুন গিয়াসউদ্দিন তার দল নিয়ে নারায়ণগঞ্জ প্রবেশ করেন। তারপর শুরু। হয় বিস্তারিত রেকি, পর্যবেক্ষণ ও তথ্যসংগ্রহ। বড়াে ভাই এম এ মালেকের। সাথে স্বাচ্ছন্দ্যে গিয়াসউদ্দিন পাক বে’র ভিতরে চলে যান। মেশিনারি ও প্রহরীদের সর্বশেষ অবস্থান ও সময়সূচি সম্বন্ধে অবগত হন। নিজস্ব দল ছাড়াও বিশ্বস্ত কিছু স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধার সাথে অপারেশনের সমন্বয়সাধন করা হয়। এসব প্রক্রিয়ায় কিছু অতিরিক্ত সময় ব্যয় হয়। জুনের মাঝামাঝি অপারেশন পরিচালনার কথা থাকলেও সময় কিছুটা পিছিয়ে যায়। অপারেশনের চূড়ান্ত দিনক্ষণ নির্ধারণ করা হয় ২৩ জুন রাত ৯টায়। কোনাে প্রহরী হত্যা না করে অর্থাৎ নিঃশব্দে স্পিডবােট তৈরির প্ল্যান্টটি ধ্বংস করা হবে। কারণ, বিস্ফোরণের আগে গােলাগুলি হলে পরিকল্পনা অনুযায়ী এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করার সময় ও সুযােগ পাওয়া যাবে না এবং পাকিস্তানি সেনারা সতর্ক হয়ে যাবে । 
স্থানীয় কয়েকটি মুক্তিযােদ্ধা দলকে দায়িত্ব দেওয়া হলাে পাকিস্তানি সেনাদের কভারিং ফায়ারের মধ্যে রাখার জন্য। ১টি দলকে দায়িত্ব দেওয়া হয় অপারেশনের আধা ঘণ্টা আগে অর্থাৎ সাড়ে ৮টায় ডকইয়ার্ডসহ গােটা এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য। পরিকল্পনা মতাে গিয়াসউদ্দিন এবং তার দল শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্ব পাড় থেকে নৌকায় নদী পেরিয়ে পাক বে। এলাকায় প্রবেশ করেন। ততক্ষণে বিদ্যুতের অভাবে গোটা এলাকা নিকষ অন্ধকারে ডুবে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের দিক থেকে (শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড় থেকে) নৌকা নিয়ে বে এলাকায় নামেন। চারদিকে কঠোর সামরিক প্রহরা। ঘূর্ণায়মান ফ্লাড লাইট চতুর্দিকে বসানাে। অপারেশন শেষে তারা ফিরবেলক্ষণখােলা ঘাট হয়ে। গিয়াসউদ্দিন ও তার সহযােদ্ধারা নির্বিঘ্নে যথাস্থানে। এক্সপ্লোসিভ স্থাপন করে ডকইয়ার্ডের বাইরে বেরিয়ে আসেন। রাতের নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে এবং গােটা এলাকা প্রকম্পিত করে বিস্ফোরিত হলাে পাক বে ডকইয়ার্ড।
এবার ঝুঁকিপূর্ণ প্রত্যাহারের পালা। বিস্ফোরণের শব্দের সাথে সাথে প্রহরারত শক্র লক্ষ্যহীনভাবে এলােপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। গিয়াসউদ্দিন ও তার দল শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লক্ষণখােলা ঘাটে পৌছে দেখে, ৫-৬টি নৌকা আছে কিন্তু মাঝি নেই । এমন সময় এগিয়ে আসেন এক সাহসী যুবক জাফর উল্লাহ সাউদ। জীবনের ঝুঁকির বিনিময়ে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের নদী পার করে দেন। ফলাফল বে ডকইয়ার্ড ধ্বংসের সাথে শুধু মুক্তিযােদ্ধারাই নন, জনগণও উল্লসিত হয়ে ওঠেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মক্ষমতা, দক্ষতা ও সাহসে জনগণ আরও আশাবাদী। হয়। এ অপারেশনের সংবাদ বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, আকাশবাণী, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র ছাড়াও বিভিন্ন দেশের রেডিও ও টেলিভিশনে। প্রচারিত হয়। টেলিভিশনে পাক বের ধ্বংসস্তুপের ছবিও দেখানাে হয়। পাক বে। অপারেশনের পূর্বে এত বড়াে ধ্বংসাত্মক অপারেশন আর করা হয় নি। পাক বে’র অবাঙালি সুপারিনটেনডেন্ট ইঞ্জিনিয়ার জি কে বালুচ, গিয়াসউদ্দিনের বড়াে ভাই এম এ মালেক এ অপারেশনে বিশেষ অবদান রাখেন। জাতিতে বালুচ হলেও জি কে বালুচ শক্র সম্বন্ধে শুধু তথ্য দিয়ে নয়, প্রত্যক্ষ সহযােগিতা করতেন মুক্তিযুদ্ধের জন্য। এক সময় বেলজিয়াম (Belgium) নামের ১টি জাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বে’তে আসে এবং দ্রুত মেরামত করে দিতে বলা হয়, কেননা এ জাহাজে সেনা দল পরিবহণ করা হবে। জি কে বালুচ সামান্য যান্ত্রিক ত্রুটির এ জাহাজটি যেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী সৈন্য পরিবহণের জন্য ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য বিশ্বস্ত কারিগর দিয়ে রাতারাতি জাহাজটির ইঞ্জিনের বিভিন্ন অংশ খুলে ফেলেন।
তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন যে, ইঞ্জিনের মধ্যে ক্রটি আছে, গােটা ইঞ্জিন খুলে ‘ওভারহল’ করতে হবে। বেলজিয়াম’ জাহাজ আর কখনাে মেরামত করা সম্ভব হয় নি। মানবতার জন্য নিজ জীবন বিপন্নকারী এক মানুষের নাম জি কে বালুচ। নির্দেশ অনুযায়ী গিয়াসউদ্দিন তার দলসহ ২৬ জুন সেক্টর সদর দপ্তর মেলাঘর পৌঁছান। মেজর খালেদ মােশাররফ ও ক্যাপটেন হায়দার এ যােদ্ধাদের বিশেষ অভিনন্দন জানান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ডেলটা (D) সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিংয়ের বিশেষ আমন্ত্রণে মেলাঘর থেকে ক্যাপটেন শওকত আলী আগরতলার কাছে শালবাগান নামক এলাকায় ৯১ বিএসএফ-এর সদর দপ্তরে তাদের নিয়ে যান। যেখানে ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং। গিয়াসউদ্দিনকে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং উপস্থিত আরও অফিসারদের সাথে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন এবং তাঁর ও তাঁর। সহযােদ্ধাদের সাহস ও শৌর্যের ভূয়সী প্রসংসা করেন। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং অত্যন্ত বিনয়ের সাথে গিয়াসউদ্দিন ও তার সহযোদ্ধাদের জন্য ২০০ টাকা, ৪ কার্টুন উন্নতমানের বিস্কুট, ২ কার্টুন পানামা সিগারেটসহ কিছু উপহার সামগ্রী তুলে দেন। তিনি ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ১টি ইংরেজি পত্রিকা (পত্রিকার নাম এখন কারাের মনে নেই) বের করে পাক বে ধ্বংসের সঠিক সংবাদ দেখান। ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং পাক বে অপারেশনের বিস্তারিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শােনেন। প্রায় ৯০ মিনিট ধরে। বিদায়ের সময় গাড়ি পর্যন্ত এসে তাদের বিদায় জানান। এ অপারেশনে গিয়াসউদ্দিন ছাড়াও যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন: ১. আতাউর ২. মতিন ৩. বাতেন ৪. নুরুজ্জামান ৫. সবুজ ৬. কুতুব ৭. মিলন ৮. পুতুল ৯. বাবুল ১০. সামসুদ্দিন প্রমুখ । ২ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফের ভাষ্য 
“আমার কাছে খবর আসে যে, শত্রুরা ‘পাক বে’ কোম্পানিকে ৩০০ ফাইবার গ্লাস স্পিডবােট তৈরির নির্দেশ দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জের পাক বে’ ডকইয়ার্ডে এসব স্পিডবােট তৈরির কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এ পাক বে কোম্পানির ১জন অফিসারের ভাই আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল। সে এসে খবর  দেয় যে, এ স্পিডবােটে লাগানাের জন্য ৩০০ ইঞ্জিন সদ্য আনা হয়েছে এবং  সেগুলাে পাক বের গুদামে মজুত রাখা আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সে ছেলেটিকে আরও ১০জন গেরিলা মনােনয়ন করার নির্দেশ দিই এবং এ সিদ্ধান্তে পৌছি যে, এ মেশিনগুলােকে এখনই ধ্বংস করে দিতে হবে। কারণ, ফাইবার গ্লাস। স্পিডবােট প্রস্তুত হয়ে গেলে শত্রুদের গতিবিধি অনেক গুণ বেড়ে যাবে, এ বর্ষার মওসুমে শত্রু সেনারা বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌছতে পারবে। তখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূর গ্রামের গোপন অবস্থানগুলাে। অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। নির্দেশমতাে মনােনীত দলটিকে প্রশিক্ষণের পর।
নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দিই। নারায়ণগঞ্জে এসে তারা প্রথম ‘পাক বে’র গুদামটি রেকি (অনুসন্ধান) করে এবং জানতে পারে যে, ২জন পুলিশ ও ২জন চৌকিদার যে গুদামটিতে মেশিনগুলাে রাখা আছে, সেখানে পাহারা দিচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমার দলটি অতর্কিতে পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলে এবং পুলিশ ও চৌকিদারদের একটি কামরায় বন্দি করে রাখে। গুদামের তালা ভেঙে গুদামে প্রবেশ করে। গুদামের ভিতর ডিজেল ও পেট্রোল ছিল। সেগুলাে সব মেশিনের উপর ঢেলে দেয় এবং যে-সব ফাইবার গ্লাসের নৌকা প্রস্তুত ছিল, তাতেও ঢেলে দেয়। তারপর অগ্নিসংযােগ করে বেরিয়ে আসে। কয়েক সেকেন্ডের ভিতর সমস্ত মেশিনে এবং ফাইবার গ্লাস নৌকাগুলােয় আগুন লেগে যায় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। এ বিস্ফোরণে শক্রদের সমস্ত মেশিন এবং ৩০০ নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়। সামগ্রিক মূল্যায়ন। পাক বে ডকইয়ার্ড অপারেশন মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সময়ের সাহসী ও সময়ােপযােগী একটি অপারেশন। এ অপারেশনে শুধু পাক বে’র মেশিন ও যন্ত্রের ক্ষতি হয়েছে তাই-ই নয়, এ অপারেশন বিশ্ব বাসীর কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের পৌছে দিয়েছে। যুদ্ধের মাঠে শত্রুকে পরাজিত করতে পারাই জয়। শক্রর পরিকল্পনায় আঘাত হেনে তাকে পরাভূত করা আরও বড়াে জয়। এ অপারেশনে সেটাই করলেন মেজর খালেদ মােশাররফ, ক্যাপটেন হায়দার আর ইস্পাতকঠিন চিত্তের কিছু তরুণ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড