You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার যুদ্ধ - ছয়দানার যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
বাংলাদেশ সমরাস্ত্র কারখানার যুদ্ধ
তদানীন্তন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ বিশেষ মিলিটারি স্থাপনাটি বর্তমানে গাজীপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত। গাজীপুর জেলা সদর থেকে ৫ কিলােমিটার উত্তরে এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ প্রধান সড়কের ৪ কিলােমিটার পূর্ব দিকে স্থাপনাটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তঙ্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন সেক্টরে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যায়ক্রমিক পরাজয়ের পরও তারা শেষ পর্যন্ত। গুরুত্বপূর্ণ এ সমরাস্ত্র কারখানা দখলে রাখার চেষ্টা করে। সে কারণেই পর্যাপ্ত। রেশন, গোলাবারুদ ও স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রসহ বেশ কিছু পাকিস্তানি সৈনিক সমরাস্ত্র কারখানাকে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে রেখেছিল। স্বয়ংক্রিয় ও আধা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্রসহ ১জন সুবেদারের নেতৃত্বে প্রায় ১ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা এখানে অবস্থান নিয়েছিল এবং সব মিলিয়ে এ এলাকার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যাও ছিল প্রায় ১ কোম্পানি। ডিসেম্বর মাসের প্রথম থেকেই মুক্তিযােদ্ধারা সমরাস্ত্র কারখানায় অবস্থান গ্রহণকারী পাকিস্তানি সেনাদের উৎখাত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন এবং এ প্রচেষ্টারই অংশ হিসেবে মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দিক থেকে আক্রমণের মাধ্যমে সমরাস্ত্র কারখানার পাকিস্তানি সেনাদের ব্যতিব্যস্ত করে তােলেন। কিন্তু তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কাছে মুক্তিযােদ্ধারা বার বার। পরাজিত হন। মুক্তিযােদ্ধাদের চতুর্মুখী আক্রমণ দ্বারা সমরাস্ত্র কারখানাকে। শত্রুমুক্ত করতে ব্যর্থ হলে পরবর্তী পর্যায়ে মিত্র বাহিনীর সহায়তায় ১৫ ডিসেম্বর।
বিমান থেকে শক্রর এ শক্ত অবস্থানের উপর বােম্বিং করা হয়। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি সাধিত হয়। মিত্র বাহিনী হেলি লিফটিংয়ের মাধ্যমে তাদের অবশিষ্ট জওয়ানদের ঢাকায় ফিরিয়ে নিয়ে যায়।  সমরাস্ত্র কারখানার এ যুদ্ধে কারখানার অনেক কর্মচারী ছাড়াও বেশ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা শাহাদতবরণ করেন। তাদের মধ্যে শহিদ মুক্তিযােদ্ধা জসিম উদ্দিন উল্লেখযােগ্য। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এ সমরাস্ত্র কারখানার। পার্শ্বে মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় স্বাধীনতা যুদ্ধের শহিদদের স্মরণে ১টি স্মৃতিফলক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যা এসব বীর মুক্তিযােদ্ধার কথা আজও প্রতি মুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেয়।
ছয়দানার যুদ্ধ
জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে ৩ কিলােমিটার দক্ষিণে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বাের্ড বাজার নামক স্থানের সন্নিকটে ছয়দানার অবস্থান। ডিসেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে বিপর্যস্ত পাকিস্তানি সেনারা গাজীপুরের বিভিন্ন স্থান থেকে তাদের অবস্থান গুটিয়ে নিয়ে ঢাকার দিকে চলে যেতে মনস্থ করে। ফলে জয়দেবপুর থেকে তাদের অবস্থান গুটিয়ে নিয়ে তারা ঢাকার পথে জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে জড়াে হয়। তা ছাড়া সমরাস্ত্র কারখানা ও রাজেন্দ্রপুর অর্ডন্যান্স ডিপাে ছেড়েও পাকিস্তানি বাহিনী ঐ একই সময়ে চৌরাস্তায় এসে জড়াে হতে থাকে। শুধু তা-ই নয়, উত্তর রণাঙ্গনের ময়মনসিংহ, জামালপুর ও টাঙ্গাইল থেকেও তারা মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর প্রবল তাড়া খেয়ে পিছু হটতে থাকে এবং ঢাকার পথে তারাও জয়দেবপুর চৌরাস্তায় এসে জড়াে হয়। এর আগে মিত্র বাহিনী, মুক্তিবাহিনী ও টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী চৌরাস্তা ধরে পিছু হটে আসার পথে কড়া ব্রিজ ধ্বংস করে দিয়ে আসে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর পশ্চাদ্ধাবন করা মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী তাদের পিছনে থেকে আক্রমণের দিক পরিবর্তন করে কাশিমপুরের দিকে চলে যায় এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে চলে গিয়ে একটা অবরােধ অবস্থায় ফেলে তাদের পরাজিত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে।
গাজীপুর চৌরাস্তা ও আশপাশের এলাকায় পাকিস্তানি সেনারা অবস্থান নেয় এবং ছয়দানা এলাকার রাস্তার উভয় দিকে ট্রেঞ্চ খুঁড়ে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নেন। ১৫ ডিসেম্বর দুপুরের পরই চৌরাস্তায় জড়াে হওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর। বিরাট ১টি কনভয় ঢাকার পথে রওনা হয়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ঢাকা প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে চৌরাস্তার দক্ষিণে ছয়দানা এবং রাস্তার পাশে আগে থেকেই করে রাখা ট্রেঞ্চে অবস্থান নেয়। তা ছাড়া কাশিমপুরে জড়াে হওয়া মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের ঢাকা রওনা হওয়ার খবর পেয়ে তাদের উপর কামান ও মর্টারের গুলি বর্ষণ করলে সাথে সাথে রাস্তার পার্শ্ববর্তী ট্রেঞ্চগুলাে থেকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে তারা দিশেহারা ও নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে। জয়দেবপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর প্রবল আক্রমণ এবং তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতির খবর সে রাতেই ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তানি সেনারা জানতে পারে। এ খবর তাদের ভীষণ বিচলিত করে তােলে। ফলে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায়। কারণ, পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিজয়ের প্রাক্কালে ঢাকার সন্নিকটে এটাই ছিল সর্বশেষ ও সবচেয়ে বড়ো ধরনের আক্রমণাভিযান। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতিও ছিল প্রচুর। আর তাই এ কথা বলা হয়ে থাকে যে, জয়দেবপুরের মাটিতেই প্রথম যেমন ১৯ মার্চ সশস্ত্র প্রতিরােধ যুদ্ধের সূচনা হয়েছিল, তেমনি  বিজয়ের প্রাক্কালে অর্থাৎ ১৫ ডিসেম্বর এ জয়দেবপুরের মাটিতেই সংঘটিত হয়েছিল সর্বশেষ বড়াে ধরনের যুদ্ধ।
১৬ ডিসেম্বর ভােরে স্পষ্টতই প্রমাণ হয়ে যায় যে, পাকিস্তানি সেনারা আর জয়দেবপুরে নেই। তাই ঐদিন ভােরেই বিজয়ী মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ের আনন্দে উফুল্ল হয়ে বীরের বেশে জয়দেবপুরে প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণভার গ্রহণ করেন। এভাবেই জয়দেবপুরে পাকিস্তানি সেনাদের নয় মাসের দখলদারিত্বের অবসান ঘটে এবং ১৬ ডিসেম্বর সকালে বিজয়ের দীপ্ত চেতনায় স্পন্দিত বীর মুক্তিযােদ্ধারা মুক্ত করেন এ বীরপ্রসূ এলাকাকে। ১৫ ডিসেম্বর রাত পর্যন্ত বিরামহীন এ যুদ্ধে ঢাকার পথে রওনা হওয়া পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি বহুলাংশে ধ্বংস হয়ে যায়। অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা মারা পড়ে এবং বিনষ্ট হয় তাদের প্রচুর যানবাহন আর গােলাবারুদ, এমনকি পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি ট্যাংকও এখানে ধ্বংস হয়। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে গােলাগুলিতে ১৪ ও ১৫ ডিসেম্বর যে-সকল মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন, তারা হলেন: ১. বদরুজ্জামান ২. জসিম ৩. শরাফত ৪. মাজেদ ৫. নিজাম ৬. সালাম ৭. গালিব ৮, খােরশেদ ৯. গােমেজ ১০. লাবিব প্রমুখ।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড