জয়দেবপুর চৌরাস্তা থেকে প্রায় ১০ কিলােমিটার পশ্চিমে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উভয় পার্শ্বে মৌচাক এলাকা বিস্তৃত। রণকৌশলগত দিক থেকে ঢাকার সাথে টাঙ্গাইলের যােগাযােগ রক্ষার জন্য এ এলাকাটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তাই প্রথম থেকেই এ এলাকার কর্তৃত্বের উপর নজর ছিল উভয় পক্ষেরই। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই তাদের সেনা ও রসদ আনা-নেয়ার কাজে এ রাস্তা ব্যবহার করত। ২৫ মার্চের গণহত্যার পর স্বাধীনতা যুদ্ধের বাতাস এ এলাকাতেও ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতাে। ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর প্লাটুন অধিনায়ক সিদ্দিক হােসেন ও সেকশন অধিনায়ক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে প্রায় ১০০জন মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি যানবাহন কলামের উপর অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করে। সম্পূর্ণ দলটি ৩ ভাগে বিভক্ত হয়ে অ্যামবুশ পরিচালনা করে। প্রথম দলটি মৌচাক বাজারে, দ্বিতীয় দলটি মৌচাক বাজার থেকে ২০০ গজ পশ্চিমে বড়ােপুকুর পাড়ে এবং অপর দলটি জংশন এলাকায় অবস্থান নেয়। সকাল ১০টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের কনভয়টি কিছু অসামরিক যানবাহনসহ জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের দিকে যাত্রা শুরু করে। আনুমানিক ১১টার দিকে মৌচাক এলাকায় পৌছানাের পর মুক্তিযােদ্ধাদের সমন্বিত আক্রমণের মুখে পড়ে।
এ অ্যামবুশে মুক্তিবাহিনীর ফাদে প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী পাকিস্তানি বাহিনীর সর্বমােট ২-৩টি যানবাহন থাকার কথা। সে তথ্যের ভিত্তিতে সমগ্র অ্যামবুশ দল ৩টি উপদলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেন। কিন্তু কার্যত পরে দেখা যায়, সেখানে যানবাহনের সংখ্যা ছিল বেশি। এ পরিস্থিতিতে মুক্তিযােদ্ধারা ঘাবড়ে না গিয়ে দ্রুত নিজেদের পরিকল্পনার পরিবর্তন করেন এবং তা সম্পূর্ণরূপে কার্যক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করেন। | যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী সম্পূর্ণরূপে পরাস্ত হয়ে রণে ভঙ্গ দেয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয় এবং ৩টি গাড়ি টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যায়। একই এলাকায় ১৯৭১ সালের ১৩ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা। ১টি কনভয়ের উপর আক্রমণ করেন এবং কিছু গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেন।
কালিয়াকৈর বাজারের যুদ্ধ
গাজীপুর জেলাধীন কালিয়াকৈর থানার অন্তর্গত কালিয়াকৈর বাজার ঢাকা টাঙ্গাইল মহাসড়কের চন্দ্রা মােড় থেকে প্রায় ১৫ কিলােমিটার উত্তর-পশ্চিমে তুরাগ নদীর তীরে অবস্থিত। রণকৌশলগত দিক থেকে এ বাজারটির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। এ এলাকায় মূলত পাকিস্তানি বাহিনীর ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১টি কোম্পানি মেজর ইউসুফ খানের নেতৃত্বে অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি বাহিনীর এ কোম্পানি প্লাটুন ও সেকশনে বিভক্ত হয়ে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও গােলামবাড়িয়া হাই স্কুল, লতিফপুর-বাইলকা ব্রিজ, সূত্রাপুর শিমুলতলা ব্রিজ এবং কালিয়াকৈর পুরাতন থানা কমপ্লেক্সে অবস্থান নেয়। অপর পক্ষে মুক্তিবাহিনীর প্রায় ২টি কোম্পানি এ এলাকায় যুদ্ধরত ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী এ এলাকায় কয়েকটি সংঘর্ষে লিপ্ত ছিল। পুরাতন থানা কমপ্লেক্সে শত্রু সেনারা অবস্থান নেয় এবং চাপাইর ব্যাপারী পাড়া হাই স্কুলে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান নেন। আনুমানিক ১ প্লাটুন সৈন্য শক্রপক্ষে ছিল, পক্ষান্তরে আনুমানিক ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। মুক্তিবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন ইপিআর। হাবিলদার আব্দুল হাকিম। ১৯৭১ সালের ২২ অক্টোবর রাত আনুমানিক ১০টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা চাপাইর ব্যাপারী পাড়া হাই স্কুল থেকে তুরাগ নদী অতিক্রম করে পুরাতন থানা কমপ্লেক্সে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ করেন। যুদ্ধ প্রায় ভাের পর্যন্ত চলতে থাকে এবং ৪টার দিকে মুক্তিবাহিনীর নিজস্ব ঘাঁটি ফুলবাড়িয়ার দিকে প্রত্যাবর্তন করে। পুরাতন থানা কমপ্লেক্সে মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের ২টি বাংকার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং ৫জন রাজাকার ও ৭জন পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলেই মারা যায়। মুক্তিবাহিনী সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় প্রত্যাবর্তন করে।
ধীরাশ্রমের যুদ্ধ
জয়দেবপুর ও টঙ্গী রেল স্টেশনের মধ্যবর্তী স্থানে ময়মনসিংহ রেললাইন বরাবর ধীরাশ্রম রেল স্টেশন অবস্থিত। গাজীপুর রেল স্টেশন ও রাজবাড়ি ছিল তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্প। মুক্তিযােদ্ধারা ধীরাশ্রম রেল স্টেশনের আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত ধীরাশ্রম এলাকায় অল্প কিছু সাহসী। যুবকের সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ ও পাকিস্তানি বাহিনীর অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচার ব্যতীত তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে নি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে গাজীপুর রেল স্টেশন এলাকার আশপাশে প্রশিক্ষণ ফেরত মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের খবর জেনে স্থানীয় রাজাকার ও জয়দেবপুরে অবস্থিত শত্রু সেনারা একত্র হয়ে বিভিন্ন অবস্থানের মুক্তিযােদ্ধাদের উপর আক্রমণ করে। এতে ধীরাশ্রম এলাকার নলের পুকুরকে কেন্দ্র করে সম্পূর্ণ এলাকা বিক্ষিপ্ত যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর এ আক্রমণ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা সুপরিকল্পিতভাবে প্রতিহত করায় পাকিস্তানি বাহিনী। সম্পূর্ণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকিস্তানি বাহিনী টাকা। থেকে হেলিকপটার গানশীপ এনে ধীরাশ্রম এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানের উপর উপর্যুপরি গুলি বর্ষণ করে এবং পর্যদস্ত পাকিস্তানি বাহিনীকে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে জয়দেবপুর থানার দারােগাসহ বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈনিক নিহত হয়। ধীরাশ্রম এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের এ যুদ্ধে অনেক মুক্তিযােদ্ধা গুরুতর আহত হন এবং মুক্তিযােদ্ধা আব্দুল মাজেদ ঘটনাস্থলেই শহিদ হন।
কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের যুদ্ধ
কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিস গাজীপুর জেলার দক্ষিণ-পূর্বে নরসিংদী জেলার সীমান্ত ঘেঁষা কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত কালীগঞ্জ বাজার থেকে প্রায় ১ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এশিয়ার বৃহৎ মসলিন কটন মিলস্ এলাকার পিছনে অবস্থিত। এর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব দিক দিয়ে শীতলক্ষ্যা নদী বয়ে গেছে। টঙ্গী-কালীগঞ্জ পাকা সড়কটি এর উত্তর দিক দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমগ্র কালীগঞ্জ এলাকাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমগ্র এলাকাকে শীতলক্ষ্যার একটি শাখা দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। উত্তর অংশের নাম উত্তর বদাতি ও দক্ষিণ অংশের নাম দক্ষিণ বদাতি। পাকিস্তানি। বাহিনী মূলত উত্তর বদাতি এবং এ এলাকায় অবস্থিত পুরাতন সাবরেজিস্ট্রারের অফিসে অবস্থান নেয় এবং তাদের ট্যাংকের অবস্থান ছিল কটন মিলসের প্রধান সড়কের উপরে অবস্থিত ব্রিজের কাছে। এ এলাকায় পাকিস্তানি। বাহিনীর আনুমানিক ১টি কোম্পানি জনবল ছিল। এদের সাথে ছিল ১ টুপ ট্যাংক এবং মুক্তিযােদ্ধারা সংখ্যায় ছিলেন কম এবং কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন ফেরদৌস। কালীগঞ্জ থানা সদর দপ্তরের আশপাশে অনেকগুলাে খণ্ডযুদ্ধের মধ্যে। কালীগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের যুদ্ধ অন্যতম। টঙ্গী-ঘােড়াশাল রেললাইনকে শত্রুমুক্ত রাখতে পাকিস্তানি বাহিনী আড়িখােলা রেল স্টেশনে অবস্থান নেয় এবং এর পূর্ব ও পশ্চিমে ২টি ব্রিজকে সার্বক্ষণিক পাহারা দেওয়ার জন্য বাংকার নির্মাণ করে।
এদের মূল অবস্থান ছিল কালীগঞ্জ থানা কমপ্লেক্স। তা ছাড়া। পাকিস্তানি বাহিনী মসলিন কটন মিলস্ ও পাওয়ার হাউজও পাহারা দিতে থাকে। ৪-৫ নভেম্বর আড়িখােলা স্টেশনের নিকটবর্তী সম্ভাব্য মুক্তিবাহিনী এলাকায় হেলিকপটারযােগে গুলি বর্ষণ করা হয়। মুক্তিবাহিনী আড়িখােলা রেল স্টেশনের নিকটবর্তী রেলসেতুকে ধ্বংস করতে ব্যর্থ হয়ে কালীগঞ্জ শহরের দিকে নজর দেয়। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি বাহিনী সােমবাজার এলাকায় মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা অনুভব করে। ২০ নভেম্বর মুক্তিবাহিনী শক্তিবৃদ্ধি করে দক্ষিণ বদাতি এলাকা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। প্রথম গ্রুপ দেলােয়ারের নেতৃত্বে নদীপথের দিকে, দ্বিতীয় গ্রুপ। তমিজ উদ্দিন ও ফেরদৌসের নেতৃত্বে সােমবাজার ব্রিজ এলাকায় এবং তৃতীয় গ্রুপটি আলী হােসেনের নেতৃত্বে বােয়াইলি ব্রিজ এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে। ২৫ নভেম্বর সারাদিন পাকিস্তানি বাহিনী থেমে থেমে ট্যাংক ও মর্টার শেলিং করতে থাকে। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনী অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ।করতে থাকে। ঐ দিনই সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে মুক্তিবাহিনী তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে পাকিস্তানি সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। অবস্থা খারাপ অনুধাবন করে পাকিস্তানি বাহিনী সাব-রেজিস্ট্রি অফিস জ্বালিয়ে দেয় এবং ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় সব অবস্থান গুটিয়ে নিয়ে কালীগঞ্জ থানা থেকে আড়িখােলা স্টেশন হয়ে পুবাইলের দিকে পশ্চাদপসরণ করে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ কালীগঞ্জ থানা কমপ্লেক্সে রেখে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা ফজলুল হক শহিদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর হতাহতের কোনাে খবর জানা যায় নি।
গজারিয়া পাড়ার সেতু ধ্বংস
গাজীপুর জেলার কালিয়াকৈর থানাধীন গাজীপুর-টাঙ্গাইল সড়কের উপর গজারিয়া পাড়া নামক স্থানে এ সেতুটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের ১৯ নভেম্বর অধিনায়ক সুলতান ও অধিনায়ক রঞ্জুকে গজারিয়া পাড়া সেতু ও সূত্রাপুর সেতু ধ্বংসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পাকিস্তানি টহল দল গজারিয়া পাড়া সেতু অতিক্রম করে যখন কালিয়াকৈর বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষা করছিল, ঠিক তখনই মাইল দুয়েক পিছনে অধিনায়ক সুলতান ও অধিনায়ক রঞ্জুর দল গজারিয়া পাড়া সেতুতে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ ঘটায়। খুব কাছেই বিস্ফোরণের কারণে শত্রুবাহিনী দ্রুত ঢাকার পথে। পালিয়ে যায়। অধিনায়ক সুলতান ও অধিনায়ক দূর দল ১৯ নভেম্বর গজারি পাড়া সেতুতে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ওখান থেকে টাঙ্গাইলের দিকে আরও আধা মাইল এসে সূত্রাপুর সেতু পাহারারত রাজাকারদের মুখােমুখি হয়। সেখানে রাজাকারদের সাথে সামান্য গুলি বিনিময় হলে তারা আত্মরক্ষার তাগিদে দ্রুত স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করে। ফলে মুক্তিযােদ্ধারা কোনােরকম কঠিন বাধা ছাড়াই ৩০জন রাজাকারকে বন্দি করে সেতুটি দখল করে নেন। ১৯৭১ সালের ২৯ জুন অধিনায়ক আবদুল গফুর ও অধিনায়ক খােরশেদ আলমের নেতৃত্বে অন্য এক দল মুক্তিযােদ্ধা এ সেতুতে সর্বপ্রথম বিস্ফোরণ ঘটান। আগের চেয়ে আরও অধিক সুসংহত ও শক্তিশালী মুক্তিযােদ্ধারা এবার সেতুটির চিহ্ন রাখতে চান নি। তাই মুক্তিবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার কোম্পানি ধীরস্থিরভাবে সেতুতে বিস্ফোরণের ব্যবস্থা করে। বিস্ফোরণের প্রচণ্ড আঘাতে এবার সেতুটি টুকরাে টুকরাে হয়ে ভেঙে নিচে পড়ে যায়।