You dont have javascript enabled! Please enable it!
কালিয়াকৈরে রাজাকার ক্যাম্প রেইড
কালিয়াকৈর থানার ফুলবাড়িয়া গ্রামে পাকিস্তানিদের দোসর জনৈক তৈজউদ্দিনের বাড়িতে রাজাকারদের মাধ্যমে ১টি বড়াে ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। সাময়িক ক্ষমতার মােহে তারা হয়ে ওঠে উচ্চুঙ্খল ও অত্যাচারী। রাজাকারদের উদ্ধত আচরণে জনগণ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধারা পরিকল্পনা করেন রাজাকারদের দমন করার। ১৯৭১ সালের ৩০ আগস্ট গভীর রাতে সুবেদার আবদুল হাকিম ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে তৈজউদ্দিনের বাড়ির রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করেন। রাজাকাররা ঘুমন্ত অবস্থায় কোনাে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারে নি। সহজেই তাদের পরাভূত ও বন্দি করা হয়। নিজেদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া ৭৩জন রাজাকারকে বন্দি করা হয়। এ ক্যাম্প থেকে ১০৩টি ৩০৩ রাইফেল ও প্রচুর গুলি উদ্ধার করা হয়।
রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপােতে চোরাগােপ্তা হামলা
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্ববৃহৎ অ্যামুনিশন ডিপাে ছিল জয়দেবপুরের অদূরে রাজেন্দ্রপুরে। ডিপােটি গঠনশৈলী এবং প্রহরার দিক থেকে অত্যন্ত সুরক্ষিত ছিল। এ ডিপাের ভিতর বড়াে ধরনের আক্রমণ পরিচালনার মতাে অস্ত্র ও দক্ষতা মুক্তিযােদ্ধাদের ছিল না। তারা আশপাশের প্রহরীদের উপর হামলা করে শত্রুকে নাজেহাল করতেন। মুক্তিযােদ্ধারা রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপাের ডিউটি পােস্টগুলােতে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৭১ সালের ১ সেপটেম্বর সুবেদার আবদুল হাকিম তার দল নিয়ে ডিউটিরত পাকিস্তানি পুলিশের উপর আক্রমণ করেন। অতর্কিত আক্রান্ত হওয়ায় পুলিশ সদস্যরা হতভম্ব হয়ে পড়ে। হাতিয়ার ফেলে দিয়েই তারা দৌড়ে প্রাণে বাঁচে। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি রাইফেল। উদ্ধার করে নিজ অবস্থানে নিয়ে আসেন।
কড়া অ্যামবুশ
বর্তমান গাজীপুর জেলার সদর থানার নাম জয়দেবপুর থানা সদরের অদূরেই কড়া গ্রাম। জয়দেবপুর রাজবাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যন্ত শক্তিশালী। ক্যাম্প ছিল। এখান থেকেই আশপাশের এলাকায় তারা ফাইটিং প্যাট্রল বের করত। পায়ে হেঁটে কিংবা গাড়িতে টহল দিয়ে তাদের আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা চালাত। মুক্তিযােদ্ধারাও জঙ্গলাকীর্ণ গ্রামগুলােয় লুকিয়ে থাকতেন এবং টার্গেটে আঘাত হানতেন। ১৯৭১ সালের ৪ সেপটেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা হঠাৎ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১টি গাড়ি চলন্ত অবস্থায় দেখতে পান। ৫জন আরােহীসহ পিকআপটি কড়া নামক স্থানে আসার পরই মুক্তিযােদ্ধারা কালবিলম্ব না করে আক্রমণ করেন। শক্ররা গাড়ি থেকে তৎক্ষণাৎ নিচে লাফিয়ে পড়ে। বেশ কিছুক্ষণ গুলি বিনিময় হয়। অবশেষে শক্রর শােচনীয় পরাজয় ঘটে। শক্রর ৫জন সৈন্যই নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে ১২টি চাইনিজ রাইফেল পাওয়া যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের কোনাে ক্ষয়ক্ষতি হয় নি।
জয়দেবপুর থানা আক্রমণ
জয়দেবপুর থানায় অন্যান্য এলাকার মতাে পুলিশ মােতায়েন ছিল। তারা। এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখার প্রচেষ্টা চালাত। কিন্তু তারা অপকর্মের সাথে অধিক জড়িত হয়ে পড়ে। স্বাভাবিকভাবে জনগণ তাদের উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। মুক্তিযােদ্ধারা এ অপকর্ম বন্ধ করার জন্য থানায় আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। হাবিলদার সামসুল হকের নেতৃত্বে ১ প্লাটুন মুক্তিযােদ্ধা ৮ সেপটেম্বর রাতে থানা আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে .৩০৩ রাইফেল ছাড়া কিছুই ছিল
স্বাভাবিকভাবে পুলিশ কোনাে প্রতিরােধ করার চেষ্টা চালায় নি। মুক্তিযােদ্ধারা কিছুক্ষণ ফায়ার করে থানায় ঢুকে পড়েন। সব পুলিশকেই হত্যা করা হয় এবং অস্ত্র ও গুলি উদ্ধার করা হয়। নিহত পুলিশের সংখ্যা ছিল ১৫জন। তবে ৪টি রাইফেল উদ্ধার করা সম্ভব হয়।
দরদরিয়া-কাপাসিয়ার যুদ্ধ
গাজীপুর জেলা সদর থেকে উত্তর-পূর্ব কাপাসিয়া থানা অবস্থিত। কাপাসিয়া থানার অন্তর্গত লক্ষ্যা নদীর তীরবর্তী গ্রাম দরদরিয়া। এখানেই স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ি। প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির প্রায় ১ কিলােমিটার দূরে লক্ষ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে গােসিঙ্গা গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ৪০-৫০জন সদস্য ছিল। নদীর পূর্ব পাড়ে তাজউদ্দিন আহমেদের বাড়িতে এবং আশপাশে প্রায় ৩০০-৪০০ মুক্তিযােদ্ধা থাকতেন। ১৯৭১ সালের এপ্রিলের প্রথম দিক থেকেই পাকিস্তানি বাহিনী গােসিঙ্গায় অবস্থান নেয়। নদীর পশ্চিম পাড়ের পাকিস্তানি বাহিনীর এবং পূর্ব পাড়ের মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে প্রায়ই মুখােমুখি অবস্থানে গুলি বিনিময় হতাে এবং মাঝে মাঝে কাপাসিয়া থেকেও শক্র সেনারা নদীপথে গানবােটে করে দরদরিয়া এলাকায় টহলে আসত। পাকিস্তানি সেনারা প্রায়ই দরদরিয়ায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বাড়ি ও সেখানকার মুক্তিযােদ্ধাদের খোঁজখবর নিত। সেপটেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিবাহিনী নদীর পশ্চিম পাড়ের পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ জোরদার করে। ফলে পাকিস্তানি বাহিনী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দরদরিয়া গ্রামের জনসাধারণের উপর নির্বিচারে অত্যাচার চালায় এবং তাজউদ্দিন আহমদের বাড়িসহ বেশ কয়েকটি বাড়িতে রাজাকারদের সহযােগিতায় অগ্নিসংযােগ করে। ঐ এলাকায় তৎকালীন মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক ছিলেন সিরাজ।
বান্নিখােলা-তরগাঁও যুদ্ধ
গাজীপুর জেলার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত কাপাসিয়া থানা থেকে লাখিয়া নদী ফেরিতে পার হয়ে দেড় কিলােমিটারের মতাে উত্তরে গেলেই বান্নিখােলার অবস্থান। রাস্তাটি চলে গেছে মনােহরদীর দিকে। মুক্তিবাহিনী খবর পায় যে, ১৯৭১ সালের ১১ অক্টোবর পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি দল ঐ রাস্তায় বান্নিখােলা হয়ে উত্তর দিকে যাবে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর উপর অ্যামবুশের সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাস্তার পূর্ব পাশে তফি মােক্তারের বাড়ির কাছে মুক্তিবাহিনী অবস্থান গ্রহণ করে। কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি মুক্তিবাহিনীর ধারণা অনুযায়ী সামনের রাস্তায় না এসে আরও পূর্ব দিক তথা অ্যামবুশ দলের পিছন দিয়ে যাচ্ছিল। তখনই হঠাৎ পিছন থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের দেখতে পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা গুলি ছুঁড়লে তৎক্ষণাৎ ১জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং পরে। বাড়ির ভিতর তল্লাশি করে আরও ২জনকে ধরে গুলি করে হত্যা করে। এঁরা হলেন শহিদ সাজ্জাদ, শহিদ গিয়াস এবং শহিদ আউয়াল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!