You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.16 | ইয়াহিয়ার শয়তানি ফাঁদ | যুগান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

ইয়াহিয়ার শয়তানি ফাঁদ

বেশ পঁাচ কষেছেন ইয়াহিয়া খান। পৃথিবীর যেকোন স্থানে এবং যেকোন সময় প্রধানমন্ত্রী শ্ৰমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তিনি দেখা করতে রাজী। কানাডার পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের কাছে বলেছেন একথা। শ্ৰীমতী গান্ধী যদি এ ফাঁদে পড়েন তবে ইসলামাবাদের পােয়াবারা। ঢাকঢােল পিটিয়ে তারা বলতে পারবেন বাংলাদেশ সমস্যাটা আসলে কিছু নয়। ওটা নিছক পাক-ভারত বিরােধ। গান্ধী-ইয়াহিয়ার সাক্ষাৎকারের প্রস্তাবটি হঠাৎ করে গজায় নি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বরণ সিং যখন বিদেশ সফর করছিলেন তখন কোন কোন রাষ্ট্রনায়ক দিয়েছিলেন এ ধরনের প্রস্তাব। এটা নিঃসন্দেহে পাক-দরদীদের কূটচাল কিম্বা অতি ভালমানুষদের রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা। বাংলাদেশটা ভারতে নয়। সেখানকার সংগ্রাম স্থানীয় জনসাধারণের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম। এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ জনপ্রতিনিধিরা, ভারত নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার এবং গণতন্ত্রের পূর্ণ প্রতিষ্ঠার জন্যই মুক্তিফৌজ চালাচ্ছেন লড়াই। গত তিন মা ধরে ইসলামাবাদের পশুরা মেরেছে মানুষ। এখন মানুষেরা শিকার করছেন পশুদের। পশুরাজ ইয়াহিয়া বেসামাল। তার অর্থিক কাঠামাে ভেঙ্গে পড়ার উপক্রম। বাইরের সাহায্য অনিশ্চিত। বিশ্বব্যাঙ্ক বসেছেন বেঁকে। মার্কিন দরদের ফলগুধারা গােপন পথ ছেড়ে বাইরে আসামাত্রই তার মাথায় পড়ছে জনতার পদাঘাত। এ গােপন স্রোতও হয়ত আপাতত থমকে দাঁড়াবে। দু-চার দিনের মধ্যেই বােঝা যাবে আমেরিকার বড় কর্তাদের মতিগতি। পাকমিথ্যা প্রচারের ধারও ভোঁতা হয়ে আসছে দিন দিন। বিদেশী সংবাদপত্রগুলাে ফাস করে দিচ্ছেন সত্য ঘটনা। এ অবস্থায় নতুন ফাঁদ পাতা ইয়াহিয়ার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আশার কথা, নয়াদিল্লী ধরে ফেলেছেন এই শয়তানি। তাঁরা দেবেন না ফাঁদে পা।
জনমতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে পরছেন না বিদেশী সরকারগুলাে। পাশ কাটাতে চাচ্ছেন তাঁরা। বের করার চেষ্টা করছেন হরেক রকমের ফন্দিফিকির। বৃটেন এবং আমেরিকা নাকি দেখছে পাক-ভরত যুদ্ধের সম্ভাবনা। বাংলাদেশ এবং ভারত সীমান্ত বরাবর রাষ্ট্রসঙ্ঘ বাহিনী মােতায়েনের ইঙ্গিত দিচ্ছে অনেকে। এই অপচেষ্টা সার্থক হলে মুক্তিফৌজ হয়ে পড়বে দুর্বল। সীমান্ত অঞ্চলগুলােতেই তাদের সামরিক ঘাঁটি। এখান থেকে তারা হান দেন বাংলাদেশের ভিতরে। পাক-পশু শিকার করে ফেরেন নিজেদের শিবিরে। সীমান্তে রাষ্ট্রসংঘ বাহিনীর উপস্থিতি বিঘ্ন ঘটাবে তাদের মুক্তি সংগ্রামে। ইয়াহিয়া তখন দিতে পারবেন নরমেধ যজ্ঞের পূর্ণাহুতি। এটাও পাক-দরদীদের ষড়যন্ত্র। সাফ কথা বলেছেন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তাদের নিয়ন্ত্রিত অঞ্চলে জায়গা হবে না রাষ্টসংঘ বাহিনীর। বিশ্বসভা যাদের বগলদাবায় স্বৈরাচারী ইসলামাবাদ তাদের সামরিক ভাই। এই দুর্বিনীত ক্ষুদে ভ্রাতাকে রক্ষার জন্য এদের পাঁয়তারার অন্ত নেই। এতবড় একটা গণহত্যার পরও নিন্দার ভাষা আসছে না তাদের মুখে। দুনিয়ার বিবেক একদিকে এবং বিবেকবর্জিত বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের নয়কেরা অন্যদিকে। ক্ষমতা প্রয়ােগ করেন রাষ্ট্রনায়কেরা। আর ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষগুলাের শুধু সম্বল চেচামেচি। ওদের মুখ বন্ধ করার জন্য চলে উপর মহরের ধোকাবাজী। বাকসংযম এবং কূটনৈতিক সতর্কতা দরকার নয়াদিল্লীর। তাদের একটি বেস কথায় ইসলামাবাদ পাবেন প্রচার সুযােগ। এ সুবিধা কোন মতেই দেওয়া যেতে পারে না পাক-বর্বরদের। বাংলাদেশের ঘটনায় ভারত সঙ্গত কারণেই উদ্বিগ্ন। প্রায় সত্তর লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছেন এখানে। ওখানে নিরবিচ্ছন্নভাবে চলেছে পাক-পশুদের অত্যাচার। তার উপর ঘনিয়ে আসছে আসন্ন দুর্ভিক্ষের কালােছায়া। যতদিন যাবে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। কেন্দ্রীয় সরকার বলছেন—মুজিবুর এবং আওয়ামী লীগের সঙ্গে দরকার ইসলামাবাদের বােঝাপড়া। বাংলাদেশ সরকার নিয়েছেন দৃঢ় সঙ্কল্প। নরঘাতকদের সঙ্গে বসবেন না আলােচনা বৈঠকে। সার্বভৌম বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত চলবে সংগ্রাম। এই অবাস্তব পরিকল্পনা লােকঠকানাে। ভাওতা। সােজা কথায়, মার্কিন পরিকল্পনায় সব সময়ই থাকবে ইসলামাবাদের প্রাধান্য। ইয়াহিয়ার হাত রক্তসিক্ত। আমেরিক তাতে যতই জল ঢালুক না কেন, রক্তের দাগ কিছুতেই মুছবে না। নয়াদিল্লীর বােঝা উচিত, তাঁদের বঙ্গদেশ স্ট্র্যাটেজী প্রায় ব্যর্থ। বাইরের রাষ্ট্রগুলাের ভারী চাপ পড়বে না ইয়াহিয়ার উপর। ওরা জীইয়ে রাখবে ইসলামাবাদের স্বৈরতন্ত্রীদের। পাক-ভারত শক্তিসাম্য তাদের কাম্য। দুনিয়ার জনমত আগের চেয়েএখন বেশী জাগ্রত। আর দেরী করা অদুরদর্শিতা। শুভলগ্ন এসেছিল বাংলাদেশে পাক-গণহত্যার প্রথম পর্যায়ে। এ সময় নয়াদিল্লী যদি বিদ্রোহী জনতার পাশে এসে দাঁড়াতেন তবে অবস্থার মােড় ঘুরত। এ শরণার্থী আসতেন না ভারতে। ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হত ক’মাসের মধ্যেই। ইয়াহিয়া খান এবং তাঁর সুহৃদরা সময় পেতেন না ঘর গােছাবার। কু-যুক্তির খপ্পরে পড়েছিলেন নয়াদিল্লী। হেলায়হারিয়েছেন এ সুযােগ। বিশ্বজনমত ভারতের পক্ষে। বিদেশী সরকারগুলাে দ্বিধাগ্রস্ত। এখনই দিতে হবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সামরিক মদৎ। তা হলেই শয়তানি ফাঁদ পাতার উৎসাহ হারাবেন ইয়াহিয়া খান। তিনি বুঝতে পারবেন—শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার জন্য দুনিয়ার যে কোন প্রান্তে যাবার দরকার নেই তার। হাতের কাছেই আছেন মুজিবুর রহমান। তার সঙ্গে দেখা করাই বুদ্ধিমানের কাজ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ জুলাই ১৯৭১