তেরশ্রী গ্রামের গণহত্যা
মুক্তিযুদ্ধকালীন মানিকগঞ্জ জেলার বিভিন্ন স্থান পাকিস্তানি সেনা কর্তৃক গণহত্যার মধ্যে ঘিওর থানার তেরশ্রী গ্রামের গণহত্যা অন্যতম। ১৯৭১ সালের ২২ নভেম্বর এ হৃদয়বিদারক ঘটনাটি সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তেরশ্রী গ্রাম আক্রমণ করে এবং এ এলাকার জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায়চৌধুরী ও অধ্যক্ষ আতিয়ার রহমানসহ গ্রামের প্রায় সব লােককে একত্র করে গুলি করে হত্যা করে। আর জমিদার সিদ্ধেশ্বর রায়চৌধুরীকে গায়ে কাপড় ও কম্বল পেঁচিয়ে কেরােসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
নারচি ও কুস্তা গ্রামের যুদ্ধ
মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানাধীন নারচি ও কুস্তা পাশাপাশি অবস্থিত ২টি গ্রাম। আর এ দুই গ্রামের মাঝখানেই ১৯৭১ সালের ২৮ নভেম্বর শত্রুর উপর আক্রমণ করা হয়। পাকিস্তানি সেনাদের হাঁটা টহলের উপর এ আক্রমণ করা হয়। দেশের চারদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় এবং পাকিস্তানি সেনাদের তীব্র খাদ্যঘাটতির ফলে ইতােমধ্যেই তারা যুদ্ধের মনোেবল হারিয়ে ফেলে। ১জন গ্রামবাসী মুক্তিযােদ্ধাদের খবর দেন যে, কয়েকজন পাকিস্তানি সেনাকে নারচি। গ্রামের পাশে চলাচল করতে দেখা গেছে। খবর শুনে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদের টহল দলের উপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। শত্রু পক্ষ যখন নারচি গ্রাম ছেড়ে কুস্তা গ্রামের মাঝখানে আসে, তখন মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিতে তাদের উপর আক্রমণ করেন। আক্রমণের জন্য মুক্তিযােদ্ধা মুনসুর আলম খানের নেতৃত্বে এক দল মুক্তিযােদ্ধা এবং লে. কমান্ডার (বিএন) গিয়াসউদ্দিনের নেতৃত্বে আরেক দল মুক্তিযােদ্ধা অর্থাৎ একত্রে প্রায় ৩০৪০জনের দল এ আক্রমণে অংশ নেয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনারা পালটা। ফায়ার করে পলায়ন করে।
বালপুর-জাজিরা এলাকার যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আনুমানিক ২০০-৩০০জন। সদস্য টাঙ্গাইল থেকে এলাসিন ঘাট হয়ে সাটুরিয়ার দিকে পায়ে হেঁটে কেদারপুর নদীর পাশ ধরে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধারা পাকুটিয়া, কেদারপুর, লাউহাটি, দগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্ত অবস্থানে ছিলেন। শত্রু বাহিনীর সংবাদ পেয়ে পাকুটিয়া, কেদারপুর ও লাউহাটির মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে। তাদের প্রতিহত করতে শুরু করেন। পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য বাতেন বাহিনীর খন্দকার আবু তাহের, মাে. দেলােয়ার হােসেন হারিছ, আলী আকবর খান ডলার, মােঃ শাহজাহান প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন দলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। বিভিন্ন স্থানে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে পাকিস্তানি বাহিনী বিক্ষিপ্ত হয়ে ছােটো ছােটো দলে সৈন্য প্রত্যাহার করতে শুরু করে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ চলতে থাকে এবং রাতের অন্ধকারে তারা বিভিন্ন বাড়িতে আত্মগােপন করে থাকে।
ভাটরা ও জাজিরা এলাকায় যে-সকল শত্রু সৈন্য আশ্রয় নেয়, মুক্তিযােদ্ধারা তাদেরও ঘেরাও করে ফেলেন। বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে আনুমানিক ৫০০ মুক্তিযােদ্ধা এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। জাজিরা এলাকায়। পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে ঘেরাও করতে মাে. নিজাম উদ্দিন বুকে ও পেটে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। জাজিরায় ২জন পাকিস্তানি সৈন্যকে মৃত অবস্থায় এবং ৪জনকে আহত পাওয়া যায়। পরবর্তী সময় পাকুটিয়া ক্যাম্পে স্থানান্তরের পর। আহত পাকিস্তানি সৈন্যরা মারা যায়। অক্ষত অবস্থায় ৭জন পাকিস্তানি সৈন্য মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। স্বাধীনতার পর তাদেরকে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। জাজিরা ও পার্শ্ববর্তী স্থানে পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী পরদিন বনালপুর গ্রামে আত্মগােপন করে থাকে। দরগ্রামে এ সংবাদ পৌঁছার পর দরুগ্রামের। মুক্তিযােদ্ধা মনজুর নেতৃত্বে ১০-১২জন মুক্তিযােদ্ধা তাদের খুঁজে বের করেন। মুক্তিযােদ্ধারা ১জন পাকিস্তানি সৈন্যকে হাতেনাতে ধরে ফেলেন। ধস্তাধস্তির সময় হানাদার বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযােদ্ধা শাহজাহান আহত হন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড