লেছড়াগঞ্জে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে রেইড
১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর মুক্তিযােদ্ধারা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মানিকগঞ্জ জেলার হরিরামপুর থানাধীন লেছড়াগঞ্জ পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে হামলা করেন। এ যুদ্ধ অনেক সময় ধরে চলে। যুদ্ধে ৮৫জন শত্রু সৈন্য মারা যায় এবং বাকি ৫০জন আত্মসমর্পণ করে, তারমধ্যে রাজাকার এবং ৩জন পাঠান সৈন্য ছিল। এ অপারেশনে ২টি এলএমজি, ১টি এমজি এবং প্রচুর গােলাবারুদসহ ৩০টি হালকা অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। মুক্তিযােদ্ধারা ওয়্যারলেস অফিস ও পাকিস্তানি ক্যাম্পটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেন। এ সংবাদ তখন ভয়েস অব আমেরিকায় ফলাও করে প্রচার করা হয়েছিল।
গােলাইডাঙার যুদ্ধ
সিঙ্গাইর থানার গােলাইডাঙার যুদ্ধ মুক্তিবাহিনীর সাফল্যের আরেকটি মাইল ফলক। নিজ দলের কোনাে ক্ষতি ছাড়াই মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে। এ যুদ্ধের সাফল্যে মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে, যার ফলে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে পরবর্তী যুদ্ধে অধিকতর সাহসিকতার সাথে মােকাবিলা করেন। গােলাইডাঙায় ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে মানিকগঞ্জের সর্ববৃহৎ ও সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে। দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত সিঙ্গাইর থানাটি ধলেশ্বরী নদীর তীরে অবস্থিত। এ ধলেশ্বরী নদীরই একটি শাখা (খাল) সিঙ্গাইর থেকে গােলাইডাঙা হয়ে কালীগঙ্গা। নদীতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। আব্দুল আলী নামক এক ব্যক্তি এসে। মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ দেন যে, ৩ শতাধিক পাকিস্তানি সেনারা ১০-১২টি নৌকা। নিয়ে গােলাইডাঙা মুক্তিযােদ্ধা শিবির দখল করতে অগ্রসর হচ্ছে। সংবাদ পাওয়ার সাথে সাথে মুক্তিযােদ্ধারা দুই দলে বিভক্ত হয়ে ১টি দল গােলাইডাঙা খালের মােড়ে এবং অন্য দল খালের অপর পাড়ে অবস্থান নেন। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে স্থানীয় স্কুলে যায় এবং কোনাে মুক্তিযােদ্ধার সন্ধান না পেয়ে ফিরে আসার সময় সব নৌকা যখন মুক্তিযােদ্ধাদের আওতার মধ্যে আসে, তখন মুক্তিযােদ্ধারা সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালান। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে পাকিস্তানি সেনাদের সবগুলাে নৌকা ডুবে যায় এবং প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি সেনা ঘটনাস্থলে নিহত হয়। কিছু সৈন্য নৌকা থেকে আত্মরক্ষার জন্য লাফিয়ে পানিতে পড়লে মুক্তিযােদ্ধারা পানিতে নেমেই তাদের হত্যা করেন।
ওয়্যারলেসের মাধ্যমে খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সমর্থনে বিমান দ্বারা উক্ত স্থানে আক্রমণ চালায় এবং ফসফরাস বােমার সাহায্যে ঐ এলাকার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। পাকিস্তানি সেনারা ডুবুরি নামিয়ে পানি থেকে মৃত সৈন্যদের লাশ তুলে নিয়ে যায়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের পক্ষে মুক্তিযােদ্ধা আলী আকবর এবং মুক্তিযােদ্ধা বদির আহত হন। গােলাইডাঙার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মুক্তিযােদ্ধা তােবারক হােসেন লুডু এবং সার্বিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করেন মুক্তিযােদ্ধা লােকমান হােসেন। এ যুদ্ধে আরও যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন; ১. মিরাজ ২. ইয়াকুব ওরফে ওবায়দুল ইসলাম ৩. হেকমত। নুরুল ইসলাম জলিল ৬. আনােয়ার ৭. ফরিদ। ৮. জাহিদুর রহমান ৯. হারুন ১০. মান্নান ১১. চায়নাম্যান ১২. মহাদেব ১৩, ভবেশ ১৪. মােস্তাফিজ ১৫. বিল্লাল ১৬. লাবু বাহার ১৭. বাদশা ১৮. আরমান মালেক মজনু ১৯. ওয়াজেদ ২০. লুৎফর ২১. আলী ২২. আকবর পাটোয়ারী প্রমুখ। গােলাইডাঙা যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা এলএমজি, এসএলআর, ইন্ডিয়ান স্টেনগান, .৩০৩ রাইফেল, মার্ক ৪ রাইফেল ও গ্রেনেড বাবহার করেন। যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধারা দখল করেন। দখলীকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল রকেট বােমা, চাইনিজ এসএমজি, চাইনিজ অটোম্যাটিক রাইফেল, রকেট লঞ্চার প্রভৃতি।
ট্রাক ও জিপে অ্যামবুশ (সিঙ্গাইর)
১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর ঢাকা থেকে মানিকগঞ্জ যাওয়ার পথে সিঙ্গাইর থানার কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি ট্রাক ও ১টি জিপে মুক্তিযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ করেন। এতে ৩০জন পাকিস্তানি সৈন্য ও রাজাকার মারা যায়। মুক্তিযােদ্ধারা ২টি রাইফেল উদ্ধার করেন, যা পরে নিজেরা ব্যবহার করেন।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড