রাজধানীর চিঠি
বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের বাইরে জনমতকে জাগ্রত করার যে চেষ্টা শুরু হয়েছে তা যে খুবই প্রয়ােজনীয় সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছে, তার চেয়েও প্রয়ােজনীয় কাজের দিকে যথেষ্ট মন দেওয়া হচ্ছে না। এটা ভারতের অভ্যন্তরে মুসলিম জনমতকে জাগ্রত করার কাজ। গােড়া থেকে এদিকে নজর দিলে বােধ হয় নিখিল ভারত মুসলিম মজলিস মুশাওয়ারত গত সপ্তাহে দিল্লীতে বসে বাংলাদেশের ওপর যে প্রস্তাব পাশ করেছেন সেটি থেকে তাদের বিরত করা যেত। এই ভুলের জন্য এখন আমরা অসহায়ভাবে দেখতে থাকবাে, ভারত থেকে পাওয়া একটি অস্ত্রের সাহায্যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রচারযন্ত্র ভারতকেই আঘাত করছে।
যে সব মুসলিম রাজনৈতিক বা আধা-রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে মুশাওয়ারত গঠিত, তার মধ্যে আছে মুসলীম লীগ, মুসলিম মজলিস, জামাত ইসলামী, ইত্তেহাদ-ই মুসলিমিন, শিয়া রাজনৈতিক সম্মেলন, আওয়ামী তানজিন, প্লেবিসিট ফ্রন্ট ইত্যাদি। দিল্লীতে মুসলিম মজলিশ মুশাওয়ারত বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রস্তাবটি পাশ করেছেন, শােনা যায়, তার খসড়াটি শেখ আবদুল্লার হাতের। হয় তাদের মধ্যে ছিলেন মুসলিম লীগের মহম্মদ ইসমাইল, কাশ্মীর প্লেবিসিট ফ্রন্টের মীরজা আফজল বেগ, মুসলিম লীগ মজলিসের মহম্মদ মুসলিম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এই সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতাদের সহানুভূতি কোন দিকে মুশাওয়ারতে গৃহীত প্রস্তাবে তা প্রকাশ হয়ে পড়েছে। প্রস্তাবে শেখ মুজিবর রহমান ও আওয়ামী লীগের সমর্থনে একটিও কথা নেই এবং ইয়াহিয়া খাঁ ও তার সৈন্যবাহিনী কর্তৃক গণহত্যার নিন্দাও করা হয় নি। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী যারা তাদের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করা হয় নি। তারপর, কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার মত শরণার্থীদের উপদেশ দেওয়া হয়েছে ইয়াহিয়া সরকার তাদের ফিরিয়ে নেবার উদ্দেশ্যে যে শিবির খুলেছেন সেই শিবিরে ফিরে যেতে।
দেহ এখানে মন পাকিস্তানে
ভারতীয় মুসলিমদের এই নেতারা ইয়াহিয়া খার ইঙ্গিতে পরিচালিত হচ্ছেন একথা বলা হয়তাে ঠিক হবে না। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে তারা যে ভাবে দেখছেন ইয়াহিয়া খাঁর দৃষ্টিভঙ্গী থেকে তার খুব বেশী তফাৎ নেই। এই মুসলিম নেতারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যে পাকিস্তানের ধ্বংস দেখছেন এবং সে সম্ভাবনায় তারা আতঙ্কিত। তারা মুখে বলছেন না, কিন্তু মনে মনে বিশ্বাস করছেন সেই সব কথা ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তান রেডিও যে মিথ্যা অহরহ প্রচার করে চলেছে। ভারত পাকিস্তানের ধ্বংস চায় এবং সে উদ্দেশ্যেই বাঙ্গালী মুসলিমদের তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে প্ররােচিত করেছে ও করছে। শেখ মুজিবরের আওয়ামী লীগ হিন্দুস্থান সরকারের হাতের পুতুল, ইত্যাদি। এই মুসলিম নেতারা সম্ভবতঃ বিশ্বাস করেন যে রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান শক্তিধর হলে ভারতবাসী মুসলিম সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে। এরা ভারতীয় নাগরিক হলেও আচরণে ধারণা হয় এদের প্রাথমিক আনুগত্য অন্যত্র। যেন, এঁদের দেহটা ভারতে কিন্তু মনটা পড়ে আছে পাকিস্তানে।
ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলতে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করতে সততঃ সচেষ্ট যারা তারা একটা ভুল করেছেন যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে গোঁড়া সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের এক ঘরে করতে তারা যে তৎপরতা দেখিয়েছেন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতাদের স্বরূপ উদঘাটন তার সিকি ভাগও দেখান নি। ফলে মুসলিমদের যে সব সাম্প্রদায়িকতাবাদী দল ও নেতাকে এখঘরে করার ও তাদের কর্মতৎপরতা খর্ব করার প্রয়ােজন হল, কোথাও কোথাও সঙ্কীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে তাদের সঙ্গে আঁতত করা হয়েছে, এমন কি তাদের সামাজিক মর্যাদাও দেওয়া হয়েছে। যে জন্য এই সাম্প্রদায়িকতাবাদীদল ও নেতারা মুসলিম জনসাধারণের মধ্যে একটা অংশের উপর তাদের প্রভাব বিস্তার করাতে আজ সক্ষম। খোজ নিলে দেখা যাবে গত পাঁচ সাত বছরে সংখ্যাগুরু সম্পদায়ের ওপর থেকে সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতাদের প্রভাব যে পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে সে তুলনায় সংখ্যালঘু সম্প্রয়ের ওপরে সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতাদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছে বেশী। এর বিপজ্জনক সম্ভাবনার দিকটার কথা গত সাধারণ নির্বাচনের পরেই যথােচিত গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখা উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় তা হয় নি।
তাই, হঠাৎ আজ বাংলাদেশ সমস্যা বিস্ময়ের সঙ্গে এই নির্মম সত্যকে প্রকাশ করে দিয়েছে যে ভারতস্থ বাঙ্গালী মুসলিমদের কিছু অংশের এবং অবাঙ্গালী মুসলিমদের অধিকাংশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন তাে ননই বরঙ মনে মনে তারা শত্রুভাবাপন্ন।
পাকিস্তানের পশ্চিম অংশের সামরিক শাসকচক্রের দ্বারা পূর্বাংশের মুসলিমরা যে দীর্ঘদিন ধরে শােষিত ও অত্যাচারিত একই পাকিস্তানে সংখ্যাগুরু হওয়া সত্ত্বেও বাঙ্গালী মুসলিমরা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে গণ্য হচ্ছে এসব তথ্য মুসলিম নেতাদের মনে কোন দাগ কাটতে পারে নি। বাংলা ভাষার ন্যায্য মর্যাদা দাবীতে পূর্ববঙ্গে আন্দোলন এই মুসলিম নেতাদের সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত রয়েছে। শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগ গত নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে পাকিস্তানে সংসদীয় গণতান্ত্রিক শাসন ক্ষমতার লাগাম হাতে নেওয়ার হকদার এই সত্য এবং টিক্কা খানের ঘাতকরা পূর্ববঙ্গে গণহত্যা শুরু করার পূর্ব মুহূর্তেই ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্রের নবজাত শিশুটিকে হত্যা করে যে কোন অন্যায় কাজ করেছেন সে চেতনা এই মুসলিম নেতাদের কথায়-বার্তায়, লেখায়-বক্তৃতায় আদৌ প্রকাশ পায় নি। বরং শােষিত ও অত্যাচারিতের সমর্থনে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের দাবীর সমর্থনে ভারত জুড়ে যে স্রোত বইতে শুরু করেছে, এই মুসলিম নেতাদের দেখা যাচ্ছে তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে।
যে সত্যই ঘুমায় তাকে জাগানাে যায়, কিন্তু যে জেগে ঘুমায় তাকে জাগানাে শক্ত। কাজেই যুক্তি দিয়ে, তথ্য দিয়ে, মানবিকতা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে এই মুসলিম নেতাদের বাংলাদেশের পক্ষে টানা সম্ভব নয়। কিন্তু এই সংকীর্ণমনা, স্বার্থান্বেষী, সুযােগ সন্ধানী নেতাদের প্রভাবের বাইরে যে বিরাট মুসলিম জনসাধারণ রয়েছে, তাদের সত্য কথা সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলার সময় এখনও রয়েছে। এই মুসলিমদের সতর্ক করে দেওয়া যায় একথা বলে যে ইয়াহিয়া খার সামরিক শাসনাধীনে বাংলাদেশে যে ব্যাপক গণহত্যা অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে সর্বস্ব খুইয়ে ভিটেছাড়া, মাটি ছাড়া হয়ে অন্য একটি রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক মুঠো অন্ন ও একটু মাথা গোঁজার ঠাইয়ের সন্ধানে, ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নর-নারীও সেই দুর্ভাগ্যের সম্মুখীন হতে পারে। ভারতে সংসদীয় গণতন্ত্রের কাঠামাে যদি ভেঙ্গে যায় এবং তার স্থানে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের সহায়তায় সামরিক একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
ভারতীয় মুসলিম সাধারণকে এটা বুঝানাে উচিত যে মুসলিম মুশারাওয়াতের সাম্প্রদায়িকতাবাদী নেতাদের…
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৪ জুন ১৯৭১