মাচাইন বাজার যুদ্ধ
১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মানিকগঞ্জের হরিরামপুর ও শিবালয় থানার সীমান্তে মাচাইন বাজারে ১৮ জুলাই রাত আনুমানিক ১১টায় মুক্তিযােদ্ধা ও পাকিস্তানি সৈন্যদের মধ্যে যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়, তা ‘মাচাইন বাজার যুদ্ধ’ নামে পরিচিত। এ স্থানটি পদ্মা নদীর একটি উপনদী ইছামতির তীরে শিবালয় থানার অধীন মানিকগঞ্জ শহর থেকে ৩২ কিলােমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। হরিরামপুর থানা আর শিবালয় থানার মিলন স্থলে অবস্থিত মাচাইন গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছােটো নদী ইছামতি। মাচাইন বাজারটি আশপাশের এলাকার মধ্যে সবচেয়ে বড়াে বাজার। পাকিস্তানি বাহিনী এ বাজারের পূর্ব পার্শ্বে স্কুলের ভবনে তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। প্রতিদিন বাজার ঘাট থেকে ইছামতি নদী হয়ে মূল পদ্মায় তারা লঞ্চের মাধ্যমে টহল দিত। ঘটনার তারিখ ১৮ জুলাই। তখন প্রবল বর্ষা রাতের টহল শেষে পাকিস্তানি। সৈন্যরা সবাই মাত্র ক্যাম্পে ফিরে এসেছে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা বহুদিন ধরে ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাদের গতিবিধি লক্ষ্য করে আসছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানি সেনারা খুবই সতর্ক থাকায় কোনােরকম ক্ষতি করা সম্ভব হয় নি। বরং বাজার এলাকা থেকে আশপাশের এলাকা এবং জলপথগুলাে তারা তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়।
এ স্থানের গুরুত্ব উপলব্ধি করে মানিকগঞ্জ জেলার তৎকালীন। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক ক্যাপটেন হালিম চৌধুরী অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানকে এ অপারেশনের দায়িত্ব দেন। ১০ জুলাই মুক্তিযােদ্ধা মাহফুজকে সঙ্গে করে তৎকালীন মুক্তিযােদ্ধা ক্যাপটেন হালিম চৌধুরী পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প রেকি এবং গতিবিধি লক্ষ্য করেন। এ ব্যাপারে ১৫ জুলাই নিজ অবস্থান সইরাকান্দি এলাকায় যুদ্ধের পরিকল্পনা করেন। যেহেতু পাকিস্তানিদের নদীপথ ও সড়ক পথের উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল, সে কারণে ক্যাপটেন হালিম চৌধুরী নদীপথে ১৬ জুলাই পুনরায় রেকি করেন এবং নদীপথের অপারেশনের দায়িত্ব দেন সহ-অধিনায়ক অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানকে। তখন যুদ্ধের চূড়ান্ত সময় নির্ধারণ করা হয় ১৮ জুলাই গভীর রাতে। সারাদিন বৃষ্টি হওয়ার কারণে পরিস্থিতি ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের অনুকূলে। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক ক্যাপটেন হালিম চৌধুরীর নেতৃত্বে শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা স্থলপথে এবং সহ-অধিনায়ক আব্দুর রউফ খানের নেতৃত্বে ২০-২৫জনের ১টি টহল দল ২টি দেশি নৌকাযােগে রাত আনুমানিক ১১টার সময় ক্যাম্প আক্রমণ করে। এ যুদ্ধে অল্প সময়ের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্প দখল করেন এবং প্রচুর। গােলাবারুদ ও রসদ হস্তগত হয়। রাতের অন্ধকারে লঞ্চযােগে পালিয়ে যাওয়ার সময় শত্রু সেনাদের প্রায় ৭জন সৈন্য অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ খানের পাটির গুলির আঘাতে মারা যায়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাদের শােচনীয় পরাজয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয় হয়।
পিটিআই মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ
১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই মুক্তিযােদ্ধারা মানিকগঞ্জ শহরের পিটিআই মিলিশিয়া ক্যাম্প আক্রমণ করেন। এটি একটি সংঘবদ্ধ আক্রমণ ছিল। দেশের চারদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় এবং শত্রুদের তীব্র খাদ্য ঘাটতির ফলে ইতােমধ্যে পাকিস্তানি। সেনারা যুদ্ধের মনােবল হারিয়ে ফেলে। পাকিস্তানি সেনাদের ১ প্ল্যাটুনের চেয়ে বেশি সৈন্য এখানে অবস্থান নিয়েছিল। তাদের মনােবলের পরিস্থিতি জানতে পেরে গােপন সংবাদের ভিত্তিতে অধিনায়ক আব্দুল মতিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ৩৫৪০জন মুক্তিযােদ্ধা রাতের বেলায় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করেন। কিছুক্ষণের মধ্যে পাকিস্তানি সেনারা পালটা ফায়ার করলে প্রায় ৩০ মিনিট সম্মুখযুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ৭জন শত্ৰু নিহত হয় এবং বাকিরা রাতের অন্ধকারে গাড়িযােগে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
মালুচি গ্রামের রেইড
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট আব্দুল হালিম চৌধুরী ২জন অবসরপ্রাপ্ত সামরিকবাহিনীর সদস্য নিয়ে নৌকাযােগে হরিরামপুরের মালুচি গ্রামে পৌঁছান। তিনি সেখানে গিয়েই সংবাদ পান যে, শিবালয় থানার দারােগা মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সন্ধানে দারােগা কয়েকজন পুলিশ নিয়ে মালুচি গ্রামে এসেছে। সংবাদ পেয়ে ক্যাপটেন আব্দুল হালিম চৌধুরী সহকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে ছােটো ১টি নৌকাযােগে সাহাপট্টির বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে অতর্কিত ইউনিয়ন পরিষদ কক্ষে অবস্থানরত দারােগা ও পুলিশের উপর আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের হামলায় ভীত হয়ে পাকিস্তান পন্থি পুলিশ অস্ত্র ফেলে আনুগত্য প্রকাশ করে। কিন্তু দারােগা আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করলে ক্যাপটেন আব্দুল হালিম চৌধুরী। তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করেন। ঐ স্থান থেকে ৪টি রাইফেল, ১টি পিস্ত। ল ও কয়েক’শ রাউন্ড গুলি মুক্তিযােদ্ধাদের হস্তগত হয়। এ সফলতার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের মনে প্রচণ্ড উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।
সাটুরিয়া থানা আক্রমণ-১
বাতেন বাহিনীর মুক্তিযােদ্ধারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হন যে, যে-কোনাে মূল্যেই হােক ১৪ আগস্ট পাকিস্তানিদের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন ব্যাহত করা হবে এবং ঐদিন তাদের উপর আক্রমণ রচনা করা হবে। মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ২০০-২৫০জন এবং বিভিন্ন গ্রামে ও বেইস ক্যাম্পে অস্ত্র বিক্ষিপ্ত ছিল অস্ত্র ছিল। এলএমজি, ৩০৩ রাইফেল, চাইনিজ রাইফেল ও গ্রেনেড সাথে অ্যামুনিশনও ছিল প্রচুর। অপারেশনটির সার্বিক পরিকল্পনায় ছিলেন খন্দকার আব্দুল বাতেন ও দেলােয়ার হােসেন হারিছ। তাদের নির্দেশনায় মুক্তিযােদ্ধাদের দলীয় অধিনায়কগণ নিজস্ব জনবল নিয়ে পাকুটিয়া কলেজ প্রাঙ্গণে সন্নিবেশিত হন। পাকুটিয়া ক্যাম্প থেকে ১৩ আগস্ট সন্ধ্যার পর নৌকাযােগে বিলের মধ্য দিয়ে। মুক্তিযােদ্ধারা সাটুরিয়া থেকে ১ কিলােমিটার উত্তরে কুষ্টিয়া গ্রামে সন্নিবেশিত হন। এবং চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। দেলােয়ার হােসেন হারিছ তাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে দেন। বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে থানার পূর্ব পার্শ্বে এবং উত্তর-পশ্চিম পার্শ্বে (মাজারের কাছে) এবং চন্দ্রখালী খালের পশ্চিম পাড়ে বিভিন্ন দলগুলাে অবস্থান গ্রহণ করে।
আনুমানিক রাত সাড়ে ১০টার দিকে আক্রমণ শুরু হয়ে সাড়ে ১২টা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতায় হানাদার বাহিনী টিকতে না পেরে অস্ত্র ও গােলাবারুদ ফেলে বিভিন্ন। পথে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে সাটুরিয়া থানার ওসি গােলাম মর্তুজা। ধরা পড়ে। তা ছাড়া ইপিআর ও রাজাকার, যারা বিভিন্ন পােস্টে দায়িত্বরত ছিল, তাদের মধ্যেও কয়েকজন ধরা পড়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে। পাকিস্তানিদের ক্যাম্পে কর্মরত মুক্তিযােদ্ধাদের গুপ্তচর কনস্টেবল মােহাম্মদ আলী শাহাদতবরণ করেন। মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিনটি আনন্দঘন পরিবেশে বিশেষ মর্যাদার সাথে উদযাপন করেন। কিন্তু তারা এ অবস্থান বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন নি। পরবর্তী ২-৩ দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আবার ক্যাম্পটি পুনর্দখল করে নেয় ।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড