সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ
মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে ঢাকা জেলার (রাজধানী) সন্নিকটে পশ্চিম দিকে সিঙ্গাইর থানা অবস্থিত। ঢাকা-মানিকগঞ্জ সড়ক ও নদীপথে এ থানার সাথে যােগাযােগের ব্যবস্থা রয়েছে। এ থানার উপর দিয়ে কালীগঙ্গা ও ধলেশ্বরী নদী প্রবহমান। খন্দকার আব্দুল বাতেন ১৯৭১ সালের মে মাসের প্রথম দিকে শত্রু বাহিনীর উপর আক্রমণ পরিচালনা শুরু করেন। ৪ মে তিনি তার বাহিনী নিয়ে মানিকগঞ্জ জেলার সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করেন। এটি ছিল বাতেন বাহিনীর একটি উল্লেখযােগ্য আক্রমণ পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে সিঙ্গাইর থানা আক্রমণের পরিকল্পনা কার্যকরী করার জন্য বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন নৌকা নিয়ে তার বাহিনীসহ সিঙ্গাইরে প্রবেশ করেন। তার সঙ্গে ছিলেন সুবেদার আব্দুল বারী, আব্দুল কালাম আজাদ (শাহজাহান), মাে. দেলােয়ার হােসেন হারিস, মাে. ফজলুল হক মল্লিক, আব্দুর রশীদ, মাে. আলী জিন্নাহ, আফতাব হােসেন আরজু, নায়েক আব্দুস সামাদ, হরমুজ আলী বিএসসি, নায়েক আজাহারুল ইসলাম, নায়েক হুমায়ুন, নায়েক আলাউদ্দিন, নায়েক সিরাজুল হক, ইপিআর বাহিনীর সদস্য বাবুল চৌধুরীসহ আরও অনেকে। ঝড়বৃষ্টির রাতে ১১টার সময় আক্রমণ করা হয়। খন্দকার আব্দুল বাতেন ও সুবেদার আব্দুল বারীর নেতৃত্বে বাতেন বাহিনীর ২টি দল সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে। বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেন তার হাতের চাইনিজ স্টেনগান দিয়ে গুলি ছুড়ে আক্রমণের সূচনা করেন। অধিনায়কের গুলি ছােড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর যােদ্ধাদের অস্ত্র থেকে গুলিবর্ষিত হতে থাকে। দ্বিমুখী আক্রমণের চাপে হানাদার বাহিনীর সৈন্যরা ও তাদের সহযােগী পুলিশের সদস্যরা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এখানে বাতেন বাহিনীর সঙ্গে হানাদার বাহিনীর ২ ঘন্টা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে শক্রর প্রচুর জীবনহানি ঘটে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে শত্রু সৈন্যরা তাদের কয়েকটি মৃতদেহ, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ রেখে পালিয়ে যায়।
শত্রু পালিয়ে যাওয়ায় সিঙ্গাইর থানা বাতেন বাহিনীর দখলে আসে। দখল করার পর সেখান থেকে বাতেন বাহিনী প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করে। এ যুদ্ধে বাতেন বাহিনীর পক্ষে তেমন কোনাে ক্ষতি হয়নি। তবে যুদ্ধে। ভাগ্যের জোরে অল্পের জন্য জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন মাে. ফজলুল হক মল্লিক। কারণ, তিনি যখন গুলি ছুঁড়ে ক্রলিং করে থানার উপকণ্ঠে উপস্থিত হন, তখন পিছন থেকে নিক্ষিপ্ত ১টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হওয়ার মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তিনি দূরে চলে যান। সিঙ্গাইর থানা পতনের পর ভাের ৬টার দিকে ২টি স্যার জেট জঙ্গিবিমান বাতেন বাহিনীর উপর দিয়ে উড়ে যায়। প্রথমে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা মনে করেন, বিমান ২টি আর হয়ত ফিরে আসবে না। কিন্তু দেখা গেল, বিমান ২টি উপর দিয়ে বার বার উড়ে যাচ্ছে। বিমানের ওড়া দেখে সুবেদার আব্দুল বারী বিমান ২টিকে গুলি করার জন্য বাহিনীর প্রধান খন্দকার আব্দুল বাতেনের কাছে অনুমতি চান। অধিনায়কের অনুমতি পেয়ে সুবেদার আব্দুল বারী ও নায়েক আজাহার জি-৩ রাইফেল দিয়ে বিমান ২টিকে গুলি করেন। জি-৩ রাইফেলের গুলির মুখে বিমান ২টি অতি দ্রুত স্থান ত্যাগ করে চলে যায়। সিঙ্গাইর থানা আক্রমণ করে সফলতা অর্জন করায় মুক্তিযােদ্ধাদের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়।
দৌলতপুর থানা আক্রমণ
মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে উত্তর-পশ্চিমে পদ্মা নদীর পাড়ে দৌলতপুর থানা। বাতেন বাহিনীর একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ ছিল মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর থানা আক্রমণ। ১৯৭১ সালের ১৭ মে খন্দকার আব্দুল বাতেনের নেতৃত্বে রাত ২টার সময় দুঃসাহসী যােদ্ধারা দৌলতপুর থানা আক্রমণ করেন। শত্রু বাহিনীর মিলিশিয়া ও পুলিশ বাহিনীর লােকজন দৌলতপুর থানা প্রতিরক্ষার কাজে নিয়ােজিত ছিল। ৩ ঘণ্টাব্যাপী প্রচণ্ড যুদ্ধের পর শত্রু বাহিনীর সদস্যরা প্রচুর লাশ, অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়। দৌলতপুর থানায় ওড়ানাে হয় স্বাধীনতার পতাকা। পতাকা উত্তোলন করেন বাতেন বাহিনীর প্রধান। খন্দকার আব্দুল বাতেন। বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা ১৮ মে বিকাল ৩টার সময় দৌলতপুর থানা ত্যাগ করে চলে আসেন। কারণ, যুদ্ধের কৌশল ছিল শক্রকে। আঘাত করে সরে পড়া।
ঘিওরের জাবরায় গানবােট আক্রমণ
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে মানিকগঞ্জ জেলার জাবরা ব্রিজের কাছে শত্রুর গানবােট ধ্বংস করা ছিল বাতেন বাহিনীর একটি কৃতিত্বপূর্ণ আক্রমণ ।। গােলাবারুদের অভাবে বাহিনীর ৬২টি চাইনিজ রাইফেল এবং ১৫টি এলএমজি প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে। সে সময় বাহিনীর গােয়েন্দা দপ্তরের মাধ্যমে অধিনায়ক সংবাদ পান যে, মানিকগঞ্জের জাবরা ব্রিজের উত্তরে এক গ্রামে ১৭ পেটি চাইনিজ গুলি আছে। সে গুলির সন্ধান এবং উদ্ধার করার লক্ষ্যে অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন ২ কোম্পানি যােদ্ধাসহ ঐ এলাকার দিকে অগ্রসর হন। কোম্পানি অধিনায়ক ছিলেন নায়েক আব্দুস সামাদ ও নায়েক আজাহার। বহু কষ্টে বহু পথঘাট অতিক্রম করে মানিকগঞ্জের সে গ্রামে উপস্থিত হন বাতেন বাহিনীর দুঃসাহসী যােদ্ধারা। সৌভাগ্যবশত সেখানে ১৭ পেটি গুলিই পাওয়া যায়। ফলে জীবন ফিরে পায় ৬২টি চাইনিজ রাইফেল এবং ১৫টি চাইনিজ এলএমজি। ওখানে আরও অতিরিক্ত ১০০টি তাজা গ্রেনেড পাওয়া যায়। এসব অস্ত্রশস্ত্র পাওয়ার পর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা যখন স্থান ত্যাগ করার প্রস্তুতি নেন, তখন চারপাশ থেকে বিভিন্ন গ্রামের লােকজন এসে ভিড় করে। জনতা সংবাদ দেয় যে, পাকিস্তানি সেনারা প্রতি সপ্তাহে ১টি গানবােটে করে অস্ত্রশস্ত্র ও গােলারুদ নিয়ে উত্তর দিকে যায়। যাওয়ার সময় গানবােটটি জাবরা ব্রিজের ৩-৪ মাইল উত্তরে একটি নির্দিষ্ট ঘাটে থামায়। হানাদার সৈন্যরা এসব গ্রামে হত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযােগ ও নারী নির্যাতন করে। ইতােমধ্যে হানাদার সৈন্যরা ঐ এলাকা থেকে ১০-২০জন যুবতীকে গানবােটে তুলে নিয়ে যায়। ফলে ঐ এলাকার অধিবাসীদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে যায়।
স্থানীয় জনসাধারণ বাতেন বাহিনীর কাছে বার বার দাবি করতে থাকে, আপনারা এ অত্যাচার থেকে আমাদের মুক্তি দিন। জনতার আকুল দাবির মুখে বাহিনীর অধিনায়ক খন্দকার আব্দুল বাতেন বিষয়টি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা ও প্রতিরােধের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত নেন। অকুস্থলে যাওয়ার পর দেখা গেল যে, পাল মশাইদের হাঁড়ি-পাতিল তৈরি করার এঁটেল মাটির ঢিবি সারিবদ্ধভাবে সাজানাে আছে। নদীটিও সে স্থানে একটু সংকীর্ণ ছিল। কোম্পানি অধিনায়কদের সঙ্গে পরামর্শ করে আক্রমণের কৌশল ঠিক করেন বাহিনীর অধিনায়ক মাটির ঢিবিগুলাে নদীর ঘাট থেকে ২০০ গজ দূরে ছিল। সেখানেই বাংকার করে অবস্থান নেন বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা প্রথম দিকে যেভাবে অবস্থান গ্রহণ করেন সেভাবে শত্রু সৈন্যদের ঘায়েল করা কঠিন হবে ভেবে কোম্পানি অধিনায়কদ্বয় বাহিনীর অধিনায়কের সঙ্গে পরামর্শ করে ২ কোম্পানিকে নদীর দুই তীরে অবস্থান গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য ঘন। অন্ধকারে নৌকাযােগে নদীর পূর্ব তীরে নায়েক আব্দুস সামাদের নেতৃত্বে ১ কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধা পাঠানাে হয়। সিগন্যাল কর্মপদ্ধতি এবং শত্রু দ্বারা আক্রান্ত হলে অথবা কোম্পানি প্রত্যাহার করার প্রয়ােজন দেখা দিলে নদীর দুই তীরের কোম্পানি কোথায় একত্রিত হবে, তার পয়েন্ট নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। তারপর বাতেন বাহিনীর যােদ্ধারা শত্রু সৈন্যের আগমনের জন্য প্রতীক্ষায় বসে থাকেন। | রাত ২টার সময় যােদ্ধারা গ্রামবাসীদের দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করে ক্ষুধা নিবারণ করেন। রাত কেটে গেল, দিন এল। কিন্তু হানাদারদের গানবােটের খোঁজ পাওয়া গেল না। গানবােটের কোনাে খোঁজ না পেয়ে বাতেন বাহিনীর।
যােদ্ধারা যখন স্থান ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন গ্রামবাসীরা আরও। এক রাত থাকার অনুরােধ করেন। ইতােমধ্যে যােদ্ধারা খাদ্য গ্রহণ করে। আবারও প্রতীক্ষায় থাকেন কোন সময় আসবে হানাদারদের গানবােট, কোন। সময় গর্জে উঠবে হানাদার নিধনে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মারণাস্ত্রগুলাে। রাত ২টার সময় ১জন স্কাউট তিন ব্যাটারি টর্চের আলােয় সংকেত প্রদান করেন। যে, গানবােট আসছে। কিছুক্ষণ পর দেখা যায়, জাবরা ব্রিজের নিচ দিয়ে। গানবােটটি আসছে। স্বভাবত অপর পাড়ে সিগন্যাল চলে যায় প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। রাত ৩টার সময় গানবােটটি বাতেন বাহিনীর অবস্থানের ৪৫ শত গজ দূরে ঘাটের দিকে অগ্রসর হয়। ঘাট থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে থাকতে গর্জে ওঠে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের মারণাস্ত্রগুলাে। ফলে গানবােট থেকে শত্রু সৈন্যরা। প্রচণ্ড গুলি বর্ষণ করতে শুরু করে বাতেন বাহিনীর যােদ্ধাদের উপর। প্রথম দিকে বাতেন বাহিনীর গুলিতে গানবােটের কোনাে ক্ষতি না হওয়ায় বাহিনীর অধিনায়ক বাধ্য হয়ে গুলি ছােড়ার কৌশল পরিবর্তন করেন। গানবােটের ফোকাস হােলে এবং চেইনে গুলি বর্ষণের নির্দেশ দেন। নির্দেশ মতাে যােদ্ধারা গুলি ছুড়তে থাকেন। এবার কাজ হলাে, গুলিতে গানবােটের। হােলের চেইন ছিড়ে যায়।
গানবােটটি নদীর পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়। স্রোতের টানে গানবােটটি একটু ভাটির দিকে চলে যায়। পরক্ষণেই ওপারে অবস্থানরত কোম্পানি গুলি ছুড়তে থাকে। রাত সাড়ে ৪টার সময় স্কাউটের সংকেত পাওয়া। যায় যে, শত্রু বাহিনী উত্তর দিকে অগ্রসর হচ্ছে। বাতেন বাহিনীর গুলির আঘাতে গানবােটটি আর বেশি দূর অগ্রসর হতে পারে নি। কিছু দূর অগ্রসর হওয়ার পর সেটি নদীর এক কিনারায় আটকে যায়। এ আক্রমণে গানবােটের। প্রচুর ক্ষতি হয়। হানাদারদের ১৮জন নিহত এবং ২৫জন মারাত্মক আহত হয়। উল্লেখ্য, ঐ সময় পাকিস্তানি বাহিনী পুরু স্টিলবডি ইঞ্জিনচালিত নৌকাকে উন্নত করে গানবােট হিসেবে ব্যবহার করত। সাধারণের কাছে এগুলােই গানবােট হিসেবে পরিচিতি পায়। ভাের ৫টার দিকে সংকেত পেয়ে বাতেন বাহিনী উত্তর দিকে সরে যায়। তারা নদীর পাড় ধরে ২ কিলােমিটার উত্তর দিকে অগ্রসর হয়ে খেয়ার মাধ্যমে একত্রিত হয়। অপারেশন থাকে অসম্পূর্ণ।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড