কুসুমহাটির ফাঁদ
১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা গােপন সংবাদে জানতে পারেন যে, মধ্যরাতের দিকে শত্রু সৈন্যদের ৩০-৪০জনের ১টি দল বুড়িগঙ্গা নদীর দক্ষিণে জিঞ্জিরা-নবাবগঞ্জ রাস্তা ধরে কুসুমহাটিতে যাবে। এ সংবাদের ভিত্তিতে ক্যাপটেন হালিম তার মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে দ্রুত ঐ এলাকা রেকি করে সন্ধ্যার আগেই তারা অ্যামবুশের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। সন্ধ্যার পরই তাঁরা। অ্যামবুশের নির্দিষ্ট স্থানে রাস্তার মােড়ে বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান নেন। ঘন্টার পর ঘণ্টা বিরামহীন প্রতীক্ষার পর অবশেষে শক্র মধ্যরাতের শেষে। আসতে শুরু করে। ৩০-৪০জনের পাকিস্তানি সৈন্যের দলটি তাদের ফাঁকা এলাকার মাঝামাঝি এসে পৌছানাের সাথে সাথেই ক্যাপটেন হালিমের নেতৃত্বে একযােগে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের উপর গুলি বর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযােদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে শত্রু সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে এবং তাদের ৭-৮জন গুলিবিদ্ধ হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের ২-৩জনের পায়ে গুলি লাগে। মুক্তিযােদ্ধাদের এ সফল এবং পরিকল্পিত আক্রমণ শত্রু সৈন্যদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করে। এর ফলে তারা কুসুমহাটিতে আর যায় নি।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অ্যামবুশ
স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষের দিকে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর সাভার থানাধীন রাজাসন যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। সে সময় মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত বিজয় আসন্ন। সাভার ঢাকা জেলাধীন একটি উল্লেখযােগ্য উপজেলা। এর বুক চিরে বয়ে গেছে। সাভার-আরিচা মহাসড়ক। এ মহাসড়ক সংলগ্ন রাজাশন গ্রামটি উপশহর ঘেঁষা হলেও বাংলাদেশের আর দশটি গ্রামের মতােই। রাজাশন প্রধানত কৃষিজীবী ও ব্যবসাজীবী সমৃদ্ধ গ্রামটি মহাসড়ক থেকে প্রায় ৩ কিলােমিটার পূর্ব দিকে। গ্রামটির পাশ দিয়ে সমান্তরালভাবে একটি সরু খাল বয়ে গেছে। সাভার বাস স্ট্যান্ড থেকে ঠিক পূর্ব দিকে পায়ে চলার একটি পথ রাজাশন গ্রামের মধ্য দিয়ে চলে গেছে পূর্ব দিকে। অবশ্য রাস্তাটি এখন পাকা হয়েছে এবং বিরুলিয়া রােড। হিসেবে পরিচিত। এ পথের মধ্যে খালের উপরের ছােটো কালভার্টটিতে মুক্তিযােদ্ধারা সমবেত হয়েছিলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে এ মহাসড়ক। সামরিক কৌশলগত দিক দিয়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
কারণ, উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকে ঢাকা শহরে প্রবেশের এটিই একমাত্র পথ ছিল। ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি যান্ত্রিক বহর (আনুমানিক ১ কোম্পানি) আরিচা থেকে ঢাকা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। গােপন সূত্রে সংবাদ পেয়ে সাভারের মুক্তিযােদ্ধা খন্দকার আব্দুল হামিদ রঞ্জু প্রায় ৩০জনের ১টি দলকে কনভয়ের উপর অ্যামবুশ করার জন্য রাজাশন গ্রামে সংগঠিত করেন। আনুমানিক আড়াইটার দিকে কনভয়টি সাভার বাজার অতিক্রমকালে। রঞ্জুর দল কনভয়টির উপর আক্রমণ করেন। সাথে সাথে ভারি অস্ত্রে সুসজ্জিত কনভয় থেকে পালটা হামলা আসে। বৃষ্টির মতাে গুলি আসতে শুরু করলে সীমিত অস্ত্র ও অপর্যাপ্ত সামরিক জ্ঞানসম্পন্ন মুক্তিযােদ্ধারা হতভম্ব হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন। ফলে মুক্তিযােদ্ধা নুরুল ইসলামসহ মােট ৪জন রাজাশন যুদ্ধে শহিদ হন। পাকিস্তানি বাহিনীর দলটি দ্রুত ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাই তাদের ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় নি।
সাভারে যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল থেকে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মিত্র বাহিনীর চাপে পিছু হটে ঢাকার দিকে আসছিল। মুক্তিযােদ্ধা অধিনায়ক নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বে এ রেজিমেন্টকে সাভারের কাছে বাধা দেওয়া হয়, ফলে সেখানে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পুরাে শক্তি কাজে লাগিয়ে ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেন। এখানে শত্রুপক্ষের প্রায় শতাধিক সৈন্য নিহত হয় এবং ১জন পাকিস্তানি সুবেদার মেজর আত্মসমর্পণ না করে আত্মহত্যা করে। বিজয়ের পূর্বমুহূর্তের এ যুদ্ধই ছিল এ এলাকার সবচেয়ে বড়াে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা টিটো শহিদ হন। তারপর মুক্তিযােদ্ধারা ১৬ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনীর সাথে প্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেন। বাচ্চু গ্রুপের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধা মানিক, আফতাব, আমজাদ, নেহাল, টিটো এবং মানিকসহ মােট ৬জন বিভিন্ন যুদ্ধে শহিদ হন।
আমছিপুরের যুদ্ধ
১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা টাঙ্গাইল জেলার মির্জাপুর থানাধীন চৌহাটি থেকে বংশী নদীর চর দিয়ে ঢাকার পথে রওনা হয়। এমতাবস্থায় বালিয়ায় আগরতলা বেতারকেন্দ্র থেকে খবর এলাে, ভারতীয় সৈন্যদল হেলিকপটারযােগে বাংলাদেশের বালিয়া এলাকায় আসছে, আপনারা তাঁদের রিসিভ করুন। এ খবর পেয়ে মুক্তিযােদ্ধার ১টি দল অস্ত্র রেখে তাদের স্বাগতম জানানাের উদ্দেশ্যে বংশী নদীর চরে উপস্থিত হয়। ওখানে উপস্থিত হয়েই তারা দেখেন যে, অনেক পাকিস্তানি সৈন্য লাইন ধরে বংশী নদীর চর দিয়ে ফায়ার করতে করতে সামনের দিক অগ্রসর হচ্ছে। সাথে ঘােড়ায় চড়ে বােরকা পরিহিত পথপ্রদর্শকের দল। স্বাগতম জানানাের পরিবর্তে মুক্তিযােদ্ধারা শত্রুর খপ্পরে পড়লেন। শত্রু বুঝতে পারে নি যে, এঁরা মুক্তিযােদ্ধা। তারা মুক্তিযােদ্ধাদের সাধারণ জনগণ মনে করে তাদের কাউকে বহন করতে দেয় অ্যামুনিশনের বস্তা, কাউকে অস্ত্রশস্ত্র, কাউকে রেশন আবার কারও ঘাড়ে জুতার বস্তা। বালিয়া এলাকা থেকে ১৭জনকে ধরে নিয়ে শত্রুরা তাদের বিভিন্ন জিনিসপত্র বহন করার কাজে ব্যবহার করে।
পাকিস্তানি বাহিনী যখন যাদবপুর ইউনিয়নের ভাগ্যেশ্বরীর নিকটবর্তী আমছিপুর এলাকায় পৌছে, তখন অধিনায়ক কাদের সিদ্দিকী ও অধিনায়ক বেনজিরের দল তাদের আক্রমণ করে। ইতােমধ্যে বালিয়া এলাকা থেকে যেসকল মুক্তিযােদ্ধাকে তারা তাদের জিনিসপত্র বহন করার কাজে ব্যবহার করেছিল, তারা সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং উল্টো শক্রর উপর ঝাপিয়ে পড়েন। আমছিপুর এলাকায় প্রচণ্ড গােলাগুলি হয়। শক্ররা এ যুদ্ধে জয়লাভ করে। শক্রর ১টি ঘােড়াকে মুক্তিযােদ্ধারা আহত করলে আহত ঘােড়া ও আরােহীদের শত্রুরা গুলি করে হত্যা করে। শত্রুর লাশটিকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় এবং ঘােড়াটিকে পুঁতে রাখা হয়। রাজা নামের শত্রুপক্ষের একটি ছেলে পথ হারিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের এলাকায় প্রবেশ করে পরবর্তী সময় ছেলেটিকে বালিয়ার পার্শ্ববর্তী গ্রামে স্থানান্তর করা হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের চরম ক্ষতি হয়। শত্রুরা আমছিপুর এলাকায় অসংখ্য ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয় যেখানে গবাদি পশু ও মানুষ ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের ৩জন এ যুদ্ধে শহিদ হন। শহিদ মুক্তিযােদ্ধাদের লাশ নিজ নিজ এলাকায় প্রেরণ করা হয়। শহিদ মুক্তিযােদ্ধা ৩জন হলেন:
১. মাে. আবুল হােসেন
২. মাে. মেছের আলী
৩. মাে. ওয়াহেদ আলী।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড