পশ্চিম এশীয় নীতির পুনর্মূল্যায়ন
প্রচণ্ড ধাক্কা খেয়েছে ভারত। দিয়েছে পশ্চিম এশীয় রাষ্ট্রগুলাে। বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার গণহত্যা সম্পর্কে তারা নীরব। ভারত আগত পঞ্চশ লক্ষাধিক শরণার্থীর জন্য তাদের কোন দুঃখ নেই। তা ছাড়া রক্ষণশীল আরব রাষ্ট্রগুলাে এগিয়ে এসেছে ইয়াহিয়ার সমর্থনে। সৌদী আরব, কুয়ায়েত প্রভৃতি রাজতন্ত্রীরা হয়ত দেবে তাকে টাকা। তাতে কিছুটা পূরণ হবে ইসলামাবাদের বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। জাতীয়তাবাদী আরব নেতাদের মতিগতি মােটেই স্বচ্ছ নয়। এমন কি, আরব কমিউনিষ্টরাও ইয়াহিয়ার নিন্দায় এগিয়ে আসতে অসম্মত। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা যদি ইস্রাইলী অধিকৃত আরবভূমিতে ঘটত তবে আরবেরা কি করতেন? সারা দুনিয়া হৈচৈ করে বেড়তেন। তাঁদের সঙ্গে তাল ঠুকতেন নয়াদিল্লী। কেন্দ্রীয় সরকারকে শুধু দোষ দিয়ে লাভ নেই। ভারতীয় জনতাও এতদিন ছিলেন দুর্গত আরবের প্রতি একান্ত সহানুভূতিসম্পন্ন। বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী মুসলমানরাও কম যান নি। আরবের আপদে বিপদে সব সময়ই দাঁড়াতেন তারা পশ্চিম এশিয়ার নির্যাতিত মানুষগুলাের পাশে। ১৯৫৬ সালে ইঙ্গফরাসীর সুয়েজ অভিযানের সময় নাসেরের বড় সুহৃদ ছিলেন নেহরু। বৃটিশ-ফরাসীর বিমান আক্রমণে মিশরীয় হতাহতের আসল সংখ্যা তিনিই প্রথমে জানিয়েছিলেন বিশ্ববাসীকে। রাষ্ট্রসঙ্ঘে মিশরের পক্ষে ভারতের প্রচার ছাপিয়ে উঠেছিল সবাইকে। এ সময় পাক সরকার ছিলেন নির্বিকার। তাদের পরােক্ষ সমর্থন পেয়েছিল বৃটেন এবং ফ্রান্স। ১৯৬৭ সালে আরবইস্রইল লড়াই এর সময় আক্রান্ত আরবের প্রতি ভারতের সমর্থন ছিল অকুণ্ঠ। প্রতিদানে নয়াদিল্লী আজ পাচ্ছেন অকৃতজ্ঞতার কন্টক উপহার। বাংলাদেশের মানুষগুলাের ভাগ্যে জুটছে চরম ঔদাসীন্য।
ভারতের ধারণা ছিল, দুটি আদর্শের ভিত্তিতে বিভক্ত আরব দুনিয়া— একটি সাধারণতন্ত্রী এবং সামন্ততন্ত্রী। প্রথমটির নেতা মিশর এবং দ্বিতীয়টির নেতা সৌদী আরব। সাধারণতন্ত্রীরা জাতীয়তাবাদী, সমাজতন্ত্রী, ধর্মনিরপেক্ষ এবং পশ্চিমী শােষণের বিরােধী। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং পররাষ্ট্রনীতি ভারতেরই অনুরূপ। অপরপক্ষে সামন্ততন্ত্রীরা ধর্মান্ধ এবং কায়েমী স্বার্থের পরিপােষক। এ দু’দলের বিবাদ লেগেই আছে। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধে স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল তার তীব্রতা। মিশর ছিল সাধারণতন্ত্রীদের পক্ষে এবং সৌদী আরব রক্ষা করছিল রাজতন্ত্রীদের। পাকিস্তান দোস্তী পাতিয়েছিল সামন্ততন্ত্রীদের সঙ্গে। বন্ধু হিসাবে নয়াদিল্লী বেছে নিয়েছিলেন সাধারণতন্ত্রীদের। মিশরকে কেন্দ্র করে প্রগতিবাদী আরব রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে গাড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে চেয়েছিল ভারত। ধাপে ধাপে ঘটছিল বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং কারিগরী সহযােগিতার সম্প্রসারণ। ধর্মীয় জিগীর সেখানে করে নি কোন বাধা সৃষ্টি।
পাক-ভারত লড়াইএর সময় বাস্তবের প্রথম মােকাবিল করলেন নয়াদিল্লী। আক্রমণকারী আয়ুব খানের বিরুদ্ধে আরব দুনিয়ার একটি অঙ্গগুলাে উত্তোলিত হল না। রাজতন্ত্রী জর্ডান চলাল ভারত বিদ্বেষী উদ্যোগ। তার সঙ্গে যােগ দিল সৌদী আরব। মুখ বুজে রইলেন সাধারণতন্ত্রীরা। বােঝা গেল, আরবরা যখন নিজেদের মধ্যে লড়াই করেন তখন তারা সাধারণতন্ত্রী এবং সামন্ততন্ত্রী। এই লড়াইটা যদি কোন মুসলিম রাষ্ট্র এবং অমুসলিম রাষ্ট্রের মধ্যে দানা বেধে ওঠে তখন তারা সমবেতভাবে ঐশ্লামিক ঐক্যের ধ্বজাধারী। আর স্পষ্ট হয়ে উঠল এই ঐক্যবােধ বারাত সম্মেলন। জেরুজালেমে আল আকসা মসজিদ হল অপবিত্র। সারা ঐশ্লামিক জাহান উদ্দাম। ভারত তাদের সমব্যথী। বারাত সম্মলনে তার কপালে জুটল গলাধাক্কা। এ ষড়যন্তের উদ্যোক্তা পাকিস্তান। তাকে চটাতে চাইল না কোন সাধারণতন্ত্রী আরব রাষ্ট্র। এবার এসেছে বাংলাদেশের পালা। ওখানে গণহত্যাকারী ইয়াহিয়া খান। তিনি ঐশ্লামিক জোটের শরিক। এই জোটের প্রধান নেতা সৌদী আরব। তার কাছে বাধা আছে মিশর। সুয়েজ খাল বন্ধের ক্ষতি পূরণ করে কুয়ায়েত এবং সৌদী আরব। খার্তুম চুক্তি অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট সাদাৎ পান টাকা। সুতরাং সৌদী আরবের সুহৃদ পাকিস্তানের বর্বরতায় তার নেই কোন মাথা ব্যথা। ইরাক এবং সিরিয়ার মতিগতিও তথৈবচ। ভারত মুসলিম রাষ্ট্র নয়। কিন্তু পাকিস্তান ঐশ্লামিক রাষ্ট্র। পঞ্চাশ লক্ষাধিক শরণার্থীকে “ইসলামের ঐতিহ্যবাহী” ইয়াহিয়া খান ঠেলে পাঠিয়েছেন ভারতে। ইয়াহিয়া মুসলমান না হয়ে যদি ইহুদী কিম্বা খৃষ্টান হতে তবে বাঙালী মুসলমান শরণার্থীদের জন্য এদের দরদ উথলিয়ে উঠত। এই যখন বাস্তব অবস্থা তখন ভারতের পশ্চিম এশীয় নীতি পূর্বাবস্থায় থাকতে পারে না। এখন দরকার তার পুণর্মূল্যায়ন।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১৬ জুন ১৯৭১