You dont have javascript enabled! Please enable it! ঢাকা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস - প্রাথমিক প্রতিরােধ (২৬ মার্চ-১০ মে, ১৯৭১ সাল) - সাভার অঞ্চল - সংগ্রামের নোটবুক
ঢাকা জেলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
আয়তন: ঢাকার ইতিহাস গৌরবময়। এক হিসেবে জানা যায়, অষ্টাদশ দশকে পৃথিবীর সেরা শহরগুলাের মধ্যে ঢাকা ছিল অন্যতম। জেলার আয়তন ১,৪৬৩.৬০ বর্গকিলােমিটার। উত্তরে গাজীপুর ও টাঙ্গাইল জেলা, দক্ষিণে মুন্সিগঞ্জ ও ফরিদপুর জেলা, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে মানিকগঞ্জ জেলা প্রধান নদনদী: বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, ইছামতি, শীতলক্ষ্যা, পদ্মা, মেঘনা, কালীগঙ্গা, বংশী, তুরাগ, বালু, সিংহ, এলামজানী, আলম, ভিরুজখা, রামকৃষ্ণদী, ইলিশামারী, তুলসীখালী ইত্যাদি নদনদী এ জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। ঢাকা শহর বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। ১৮৬৪ সালে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি গঠিত হয় এবং ১৯৬০ সালে এটিকে টাউন কমিটিতে রূপান্তর করা হয়। ১৯৭২ সালে টাউন কমিটি বিলুপ্ত করে পৌরসভা করা হয় এবং ১৯৮৩ সালে একে মিউনিসিপ্যাল করপােরেশনে উন্নীত করা হয়। ১৯৯১ সালে ঢাকা শহরকে সিটি করপােরেশনে রূপান্তর করা হয়। উল্লেখযােগ্য নিদর্শন ও প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ: লালবাগের কেল্লা ও পরী বিবির সমাধি (১৬৭৮), বড়ো কাটরা (১৬৪১), ছােটো কাটরা ও বিবি চম্পার সমাধি (১৬৬৩), প্রাচীন দুর্গ ও নবাবী প্রাসাদ (বর্তমান জেল হাসপাতাল, ১৬৩৮), আহসান মঞ্জিল (১৮৭২), হুসেনী দালান (১৬৪২, চামেলি হাউজ, চক। মসজিদ (১৬৭৬), লালবাগ মসজিদ, বিবি মেহের মসজিদ (১৮১৪), আরমানিটোলা মসজিদ (১৭১৬), খাজা শাহবাজ মসজিদ (১৬৭৯), ইসলাম খান মসজিদ (১৬৩৫-৩৯), শায়েস্তা খান মসজিদ (১৬৬৪-৭৮), খাজা আম্বার মসজিদ (১৬৭৭-৭৮), খান মুহাম্মদ মৃধা মসজিদ (১৭০৪-০৫), মরিয়ম সালেহ মসজিদ (১৭০৪-০৬), সিতারা বেগম মসজিদ (১৮১৫), আজিমপুর মসজিদ (১৭৪৬), করতলার খান মসজিদ (১৭০০-১৭০৪), ফররুখ শিয়ার মসজিদ (১৭০৩-০৪), তারা মসজিদ, বিনোেদ বিবির মসজিদ (১৪৫৬), সাত গম্বুজ মসজিদ (১৬৭৬), ঢাকেশ্বরী মন্দির, জয়কালী মন্দির, বাহাদুর শাহ পার্ক, কার্জন হল, বাগমারা মঠ (নবাবগঞ্জ), রাজা হরিশ চন্দ্রের ভিটা (আনুমানিক অষ্টম শতাব্দী, সাভার) শ্রী শ্রী শনি আশ্রম ও মঠ (১১৯১), নিমতলী দেউড়ি (বাংলাদেশ এশিয়াটিক সােসাইটি, ১৭৬৫) ইত্যাদি নিদর্শন ও প্রত্নতত্ত্ব সম্পদ রয়েছে ঢাকা জেলায়।
তা ছাড়া ঢাকা জেলা এক সময় বাংলার হিন্দু রাজাদের অধীন ছিল। পাল ও সেন বংশ অনেক বছর ঢাকা জেলা শাসন করে। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলায় মুসলমানদের আগমন ঘটে। ১৬০৬ সালে ঢাকাকে বাংলার রাজধানী করা হয় এবং ইসলাম খাঁ সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকাকে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ করেন। আঠারাে শতকের শুরুতে মুর্শিদকুলী খাঁ বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ নিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা রাজনৈতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। ঢাকা ছিল সে সময়কার ব্যবসাবাণিজ্যের মূল কেন্দ্রস্থল। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর ঢাকাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হিসেবে ঘােষণা করা হয়। ৪৭ পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে ঢাকা শহরের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যেমন: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬-দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি। বাহিনীর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর ইত্যাদি। দোহার উপজেলার জয়পাড়াকে কেন্দ্র করে এ অঞ্চলে এক সময় নীল। চাষের প্রচলন ছিল। বিশ শতকের প্রথম দিকে মহাত্মা গান্ধী পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলন ঢাকা জেলার মানুষকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। গান্ধীর আদর্শে দোহারে গড়ে ওঠে ‘অভয় আশ্রম’ (১৯২২-২৩)। ১৯৪০ সালে এ উপজেলার মালিকান্দা গ্রামে গান্ধী সেবা সংঘের সর্বভারতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
এ সম্মেলন উপলক্ষ্যে মহাত্মা গান্ধীর আগমন ঘটে এবং তিনি এখানে ২ দিন অবস্থান করেন। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব: যে-সকল মনীষীদের স্মরণ করে ঢাকাবাসী ধন্য হন তারা। হলেন: খাজা হাফিজুল্লাহ (জমিদার), খাজা আলীমুল্লাহ (জমিদার, সমাজসেবক), নবাব স্যার সলিমুল্লাহ (রাজনীতিবিদ, জমিদার, সমাজসেবক), নবাব আব্দুল গনি (জমিদার, সমাজসেবক), নবাব আহসানউল্লাহ (জমিদার, সমাজসেবক), জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্র পরিচালক), শহীদুল্লাহ কায়সার (লেখক, সাংবাদিক), শেখ এনায়েত উল্লাহ, দীননাথ সেন (সাহিত্যিক), ওবায়েদ উল্লাহ আল ওবেদী (শিক্ষাবিদ), ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ (শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক, অসহযােগ ও স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং স্বাধীন ভারতে। পশ্চিমবঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী), আতাউর রহমান খান (রাজনীতিবিদ), ড, এ আর। মল্লিক (শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিবিদ), অনামী প্রসাদ রায় চৌধুরী (জমিদার, সমাজসেবক), দক্ষিণা রঞ্জন মিত্র মজুমদার (লেখক – ঠাকুরমার ঝুলি শিশু সাহিত্য)।মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন ও গণকবর: মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের পরিচয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা যে-সব স্মৃতিচিহ্ন বা গণকবরও রয়েছে এ জেলায় সেগুলাে হলাে: কালামপুর বাজারের পাশে (ধামরাই), দক্ষিণ কমলাপুর (ঢাকা), সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, মিরপুর বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, জাতীয় শহিদমিনার, সংশপ্তক’ ও ‘অমর একুশে ভাস্কর্য (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়), অপরাজেয় বাংলা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), স্বােপার্জিত স্বাধীনতা (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়), সােহরাওয়ার্দী উদ্যান (রেসকোর্স ময়দান), শহিদ জাহাঙ্গীর গেট, অগ্রযাত্রা গেট উল্লেখযােগ্য।
ঢাকা শহরকে মসজিদের শহর বলা হয়। তা ছাড়া অন্যান্য ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানও রয়েছে অনেক, যেমন: মসজিদ ৩০৮৮টি, মন্দির ৮০৮টি, বৌদ্ধ কেয়াং ও প্যাগোডা ৪টি, গির্জা ৩৩টি এবং মাজার ৩৭টি। উল্লেখযোগ্য মসজিদগুলাের কথা না বললে একটু অসম্পূর্ণ থেকে যায়; যেমন: বায়তুল মােকাররম মসজিদ, সাত গম্বুজ মসজিদ, চক মসজিদ, লালবাগ মসজিদ, নারিন্দার বিনােদ বিবির মসজিদ, বিবি মেহের মসজিদ, আরমানিটোলা মসজিদ, খাজা শহবাজ মসজিদ, ইসলাম খান মসজিদ, শায়েস্তা খান মসজিদ, খাজা আম্বার মসজিদ, খান মুহাম্মদ মৃধা মসজিদ, মরিয়ম সালেহ মসজিদ, সিতারা বেগম মসজিদ, আজিমপুর মসজিদ, করতলব খান মসজিদ, ফররুখ শিয়ার মসজিদ, তারা মসজিদ, আমীর উদ্দিনের মসজিদ ইত্যাদি। তা ছাড়া পর্যটকদের দেখার মতাে কিছু পুরােনাে মাজার ও মন্দির রয়েছে এ জেলায় । হজরত শাহ আলী বােগদাদী (র.)-এর মাজার, পীর জঙ্গী (র.)-এর মাজার, শাহ আমীর আলী বােগদাদী (র.)-এর মাজার, গােলাপ শাহর মাজার, পীর ইয়ামেনি (র.)-এর মাজার, নিয়ামত উল্লাহর কবর, পরি বিবির সমাধি, বিবি মরিয়মের সমাধি, বিবি চম্পার সমাধি, চিস্তি বিহিস্তির সমাধি, ডরা বেগমের সমাধি, হাজি শাহবাজ সমাধি, নারিন্দার খ্রিষ্টান সমাধি, আজিমপুর কবরস্থান, বনানী কবরস্থান ইত্যাদি। জয়কালী মন্দির, ঢাকেশ্বরী মন্দির, লক্ষ্মীনারায়ণ মন্দির, কালীবাড়ির মন্দির, শিব মন্দির, কদমতলী কালী মন্দির, রামকৃষ্ণ মিশন মন্দির, শিখ মন্দির (গুরু দুয়ারা নানক শাহী), ব্রাহ্মসমাজ মন্দির, বাগমারা মঠ (নবাবগঞ্জ উপজেলা)।
উল্লেখযােগ্য গির্জা: হলি রােসারি (১৬৭৮), আমপুতি (১৮১৫), থমাস অ্যাংলিক্যান, হলিক্রস, আর্মেনিয়ান গির্জা ইত্যাদি। ঢাকা নওয়াব এস্টেট ঔপনিবেশিক যুগে পূর্ব বাংলার সবচেয়ে বৃহৎ জমিদারি। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা হাফিজুল্লাহ এবং তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র খাজা আলীমুল্লাহ। তবে জমিদারিটির বিকাশ, বৃদ্ধি, জমিদারি ব্যবস্থাপনা এবং এস্টেটের সম্পদ ও ক্ষমতা বৃদ্ধিতে যাদের সবচেয়ে বেশি অবদান রয়েছে, তারা হলেন এ পরিবারটির অধস্তন সদস্য খাজা আবদুল গনি এবং তাঁর পুত্র খাজা আহসান উল্লাহ। এ পরিবারের প্রধানকে নওয়াব বলে আখ্যায়িত করা হলেও প্রকৃতপক্ষে এঁদের সঙ্গে প্রাক্তন মােগল শাসকবর্গ বা নওয়াবদের কোনাে সম্পর্ক ছিল না। তাদের এ নওয়াব উপাধি ব্রিটিশ শাসকদের প্রদত্ত একটি উপাধি বা। খেতাব। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই তারা তাদের ভূস্বামীগত অবস্থান থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী অত্যন্ত প্রভাবশালী একটি পরিবার হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। বস্তুত, ১৯৫০-এর দশকের প্রথম দিক পর্যন্ত তাদের পারিবারিক বাসস্থান আহসান মঞ্জিল ছিল সারা পূর্ব বাংলার মুসলমানদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন খ্যাতিসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষকগণ কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে শিক্ষার উচ্চমান বজায় রাখতে সচেষ্ট ছিলেন, যার ফলে এ প্রতিষ্ঠানটি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাতি লাভ করে। ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির ২২ নম্বর আদেশ অনুসারে পৌরসভাগুলােয় পরিবর্তন আনা হলেও এগুলাের কার্যপ্রণালি প্রায় আগের মতােই থাকে। ১৯৭৭ সালে ১টি নতুন পৌরসভা অর্ডিন্যান্স ঘােষণা করা হয়, এতেও পৌরসভাগুলাের কার্যপ্রণালির তেমন কোনাে পরিবর্তন করা হয় নি। এ আইনের আওতায় ঢাকাও ১টি পৌরসভায় পরিণত হয়। কিন্তু প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব, বিশেষ করে মিউনিসিপ্যাল সরকারে জনপ্রতিনিধিত্ব ও করারােপের ব্যাপারে এ শহরের জন্য অধিকতর ব্যাপক প্রশাসনিক কাঠামাের প্রয়ােজন অনুভূত হয়। তাই বিভিন্ন মহল থেকে ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটিকে উন্নত করার দাবি উত্থাপিত হতে থাকে। এভাবে ১৯৮৩ সালে একটি স্বতন্ত্র অর্ডিন্যান্স মােতাবেক ঢাকার জন্য সিটি করপােরেশন নামে নতুন ধরনের পৌর সংস্থা গঠিত হয়। ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপােরেশন অর্ডিন্যান্স নামে পরিচিত ১৯৮৩ সালের অর্ডিন্যান্স ঢাকাকে একটি করপােরেশনে পরিণত করে এবং এর নাম হয় ‘ঢাকা মিউনিসিপ্যাল করপােরেশন।
প্রাথমিক প্রতিরােধ (২৬ মার্চ-১০ মে, ১৯৭১ সাল)
বাঙালিদের উপর পাকিস্তানি বর্বরােচিত, নিষ্ঠুর ও কাপুরুষােচিত সামরিক পরিকল্পনা অপারেশন সার্চ লাইট’ কার্যকরী করা হয় ২৫ মার্চ মধ্যরাতে। এ অপারেশন পরিকল্পনা দুই অংশে বিভক্ত ছিল। প্রথম অংশ ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জন্য প্রযােজ্য, দ্বিতীয় অংশ প্রযােজ্য ছিল ঢাকা ব্যতীত সমগ্র বাংলাদেশের জন্য। প্রথম অংশের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দায়িত্বে ছিলেন। গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী খান। এ অংশ কার্যকরী করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকাস্থ ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন ও ১৪। ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের ৪৩ লাইট অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টকে। ২৭ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২২ বালুচ রেজিমেন্ট এবং ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টকে (এফএফ) ঢাকায় আনা হয়। এ ২টি ইউনিটকেও ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর প্রথম অংশ কার্যকরী করার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অপারেশন পরিকল্পনার দ্বিতীয় অংশের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও দায়িত্বে ছিলেন ১৪ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) মেজর জেনারেল খাদিম হােসেন রাজা। এ অংশ কার্যকরী করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ঢাকার বাইরে অবস্থিত ব্রিগেডসমূহকে। যেমন: যশােরের ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড, রংপুরের ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড এবং কুমিল্লার ৫৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড। চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পাকিস্তানি কোনাে পূর্ণাঙ্গ ইউনিট না থাকায় সেখানে অবস্থিত ২০ বালুচ রেজিমেন্টকে (যার অগ্রগামী দল ইতােমধ্যেই পশ্চিম। পাকিস্তান চলে গিয়েছিল এবং বাকি প্রায় ৫০০জনের মতাে সমুদ্রপথে পূর্ব পাকিস্তান ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল) চট্টগ্রামের অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
‘অপারেশন সার্চ লাইট’ কার্যকরী করার সময় (H-hour) নির্ধারণ করা হয়। ২৫ মার্চ রাত ১টায়। কিন্তু পথে ব্যারিকেড এবং অন্যান্য বাধার কথা বিবেচনা করে পাকিস্তানি বিভিন্ন ইউনিট রাত সাড়ে ১১টার দিকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু বাঙালিদের পক্ষ থেকে কোনাে পরিকল্পিত সশস্ত্র প্রতিরােধের পরিকল্পনা না থাকায় পাকিস্তানিদের কোনােরূপ বাধা দেওয়া সম্ভব হয় নি। ‘অপারেশন সার্চ লাইট’-এর প্রথম অংশ কার্যকরী করার জন্য ৫৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব তার অধীনস্থ। ইউনিটগুলােকে নিমরূপভাবে দায়িত্ব দেন।
নতুন আগত ১৩ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সকে ঢাকা সেনানিবাসে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয় এবং প্রয়ােজন হলে ঢাকা সেনানিবাস রক্ষা করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি ভারত নিজ দেশের উপর দিয়ে সব ধরনের পাকিস্তানি বিমান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরােপ করার পর ৪৩ লাইট অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট রেজিমেন্টকে ঢাকা বিমানবন্দর প্রতিরক্ষায় নিয়ােজিত করা হয়। এ ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিমানবন্দর এলাকা নিরাপদ রাখতে। ২৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান থেকে ঢাকা পৌঁছার পর ২২ বালুচ রেজিমেন্টকে পরিকল্পিতভাবে ইপিআর (বর্তমান বিজিবি) সদর দপ্তর, পিলখানায় আবাসস্থ করা হয়। এ ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়া হয় এখানে অবস্থানরত বাঙালি সদস্যদের হত্যা ও বন্দি করতে। তা ছাড়াও তারা ইপিআর ওয়্যারলেস এক্সচেঞ্জ দখলের দায়িত্ব পান। রাজারবাগে অবস্থিত পুলিশ লাইন আক্রমণ করে বাঙালি পুলিশ। সদস্যদের হত্যা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে। পাকিস্তানিদের আশঙ্কা ছিল যে, পুলিশ বাহিনী প্রতিরােধ তৈরি করবে। বাস্তবেও খণ্ডিত ও বিক্ষিপ্ত প্রতিরােধ আসে রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে। পুরানাে ঢাকায় হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় হত্যাকাণ্ড চালানাের দায়িত্ব। দেওয়া হয় ১৮ পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে।
সেকেন্ড ক্যাপিটাল (বর্তমানে শেরে বাংলা নগর), মিরপুর ও মােহাম্মদপুর এলাকার দায়িত্বে নিয়ােজিত হয় ৩১ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে ছাত্রছাত্রীদের হত্যা করার জন্য ১৮ পাঞ্জাব, ২২ বালুচ ও ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট থেকে ১টি করে কোম্পানি নিয়ে ১টি সম্মিলিত দল গঠন করা হয়, বিশেষ করে জগন্নাথ হল ও ইকবাল হল, যেখানে সশস্ত্র ছাত্র ছিল বলে পাকিস্ত। নিরা আশঙ্কা করছিল। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থিত ৩ কমান্ডাে ব্যাটালিয়নের ১টি প্ল্যাটুন। ইউনিট অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেড এ খানের নেতৃত্বে ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি রেইড এবং বঙ্গবন্ধুকে জীবিত বন্দি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। রংপুর সেনানিবাসে অবস্থিত ২৯ ক্যাভালরি ট্যাংক রেজিমেন্ট থেকে কয়েকটি ট্যাংক ঢাকায় আনা হয় আগেই। এদের দায়িত্ব দেওয়া হয় ২৬ মার্চ সূর্যোদয়ের পূর্বে ঢাকা শহরে প্রবেশ করে জনগণের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করা, পূর্বোক্ত ইউনিটগুলােকে সাহায্য করা এবং প্রয়ােজনে গুলি করারও আদেশ দেওয়া হয়। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল জয়দেবপুর, রাজবাড়িতে। ঢাকাস্থ ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধীন ছিল এ ইউনিট। ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ কার্যকর করার সময় প্রতিরােধ আসতে পারে আশঙ্কায় পাকিস্তানিরা এ ইউনিটকে নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইউনিটের ‘সি’ কোম্পানি মেজর নুরুল ইসলামের (বাঙালি) নেতৃত্বে ময়মনসিংহে এবং ‘এ’ কোম্পানি মেজর কাজেম কামালের (অবাঙালি) নেতৃত্বে টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে অবস্থান করছিল। ‘ডি’ কোম্পানি মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরীর (বাঙালি) নেতৃত্বে ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের সাথে জয়দেবপুর রাজবাড়িতে (১টি প্লাটুন রাজেন্দ্রপুর অ্যামুনিশন ডিপােতে নিয়ােজিত) এবং ‘বি’ কোম্পানি মেজর আসজাদ লতিফের (অবাঙালি) নেতৃত্বে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে নিয়ােজিত ছিল।
১৯ মার্চ ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব বেলা দেড়টার। দিকে জয়দেবপুর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে উপস্থিত হন। পূর্বে বার্তা দেওয়া হয়েছিল যে, তিনি সেখানে দুপুরের খাবার খেতে আসবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, তিনি ৫জন অফিসার (লে. কর্নেল জাহিদ, মেজর জাফর এবং ৩জন ক্যাপটেন) এবং ৭০জন সৈনিক নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। সৈনিকেরা সবাই ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের। সবার হাতে চাইনিজ এলএমজি। সহজেই বােঝা যায় যে, তারা ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করতে এসেছে। কিন্তু দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধিমূলক আচরণে ২ ইস্ট বেঙ্গল। রেজিমেন্টের সৈনিকেরা ইতােমধ্যেই অস্ত্রাগার থেকে যার যার অস্ত্র নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে যা ব্রিগেডিয়ার আরবাব ধারণা করতে পারেন নি।
আর কোনাে ব্যবস্থা নেয়া রক্তক্ষয়ী ও আত্মহত্যার শামিল হবে ভেবে তিনি নিজেকে নিবৃত রাখেন এবং কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সদলবলে ঢাকায় ফেরত আসেন। পথে জনতার সাথে তার দলের সংঘর্ষ হলে গুলিতে ২জন মারা যায়। এই রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান। ২৩ মার্চ তাকে সরিয়ে তৎস্থানে আরেকজন বাঙালি অফিসার কাজী রকিব উদ্দিনকে অধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য পাঠানাে হয়। লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান মুক্তিযুদ্ধের পুরাে নয় মাস ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। (ব্রিগেডভিত্তিক ইতিহাস, পৃ. ৪) ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার কোনাে পরিকল্পনা ছিল না। পাকিস্তানিরা বাঙালি সৈনিকদের প্রস্তুতি সম্বন্ধে অবগত হয়ে এটা সম্ভব নয় বলে ধারণা করে। ২৮ মার্চ ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর কাজী মােহাম্মদ সফিউল্লাহ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ইউনিটকে নিয়ে জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইল যান। সেখান থেকে ‘এ’ কোম্পানি নিয়ে তিনি ময়মনসিংহ পৌছেন। অতঃপর ২ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কিশােরগঞ্জ, ভৈরব, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় ৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে মিলিত হন।
বিক্ষিপ্ত, অপরিকল্পিত ও অপরিণামদর্শী কিছু বিফল প্রতিরােধ ছাড়াই। পাকিস্তানিরা ঢাকায় তাদের অপারেশনে সাফল্য লাভ করে। ১০ মে পর্যন্ত পাকিস্তানিরা ঢাকায় প্রতিরােধবিহীন ছিল। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা পরবর্তী সময়ে এ ঢাকাতেই পাকিস্তানিদের মাঝে অন্ধকার ঘরে সাপ’-এর মতাে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। তাদের জন্য ঢাকাকে এক মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিলেন ইস্পাতকঠিন কিছু অকুতােভয় তরুণ।
সাভার অঞ্চল
ঢাকা (শহরাঞ্চল ব্যতীত) মানিকগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা নদীমাতৃক এবং নিচু। টাঙ্গাইল ও গাজীপুর জেলা উচু এলাকা এবং বনাঞ্চল (প্রধানত শালবন)। এলাকার মাটি আঠালাে, বিশেষ করে শালবন এলাকায়। গাড়ি চলার পথ না থাকলেও পায়ে হেঁটে গােটা এলাকায় বিচরণ করা যায় । বর্ষার মৌসুমে আঠালাে মাটির কাদায় পথ চলা অত্যন্ত কষ্টকর। তবে উঁচু জায়গা হলেও বর্ষার সময় প্রচুর জলাশয়ের সৃষ্টি হয়। টাঙ্গাইল জেলার পশ্চিমে যমুনা নদী উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে গেছে। ধলেশ্বরী নদীও যমুনা নদী থেকে শাখা হিসেবে টাঙ্গাইল জেলার দেলদুয়ার থানার পাশ দিয়ে মানিকগঞ্জে প্রবেশ করে। যমুনা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে বংশী নদী টাঙ্গাইল জেলায় প্রায় মাঝ বরাবর দিয়ে এঁকেবেঁকে উত্তর থেকে দক্ষিণে বয়ে গেছে। তা ছাড়া এ নদীগুলাে থেকে একাধিক খাল উৎপন্ন হয়ে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন জায়গা সংযুক্ত করে। খালগুলাে শুষ্ক মৌসুমে নৌ চলাচলের উপযােগী থাকে না। মানিকগঞ্জের পশ্চিমে ও দক্ষিণে যমুনা নদী। ধলেশ্বরী নদী টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার, নাগরপুর হয়ে মানিকগঞ্জে প্রবেশ করে দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদীতে মিলিত হয়েছে। ধলেশ্বরীর আরেকটি শাখা কালীগঙ্গা নদী ভিন্ন পথে বুড়িগঙ্গায়। যুক্ত হয়েছে। বংশই নদী উপরি-উক্ত ৩টি নদীকেই সংযুক্ত করেছে। তা ছাড়া গােটা মানিকগঞ্জ অসংখ্য খালবিলে ভরপুর। শুষ্ক মৌসুমের ৩-৪ মাস ছাড়া। নৌপথই একমাত্র চলাচলের মাধ্যম। ঢাকা জেলার উত্তরে তুরাগ ও দক্ষিণে বুড়িগঙ্গা নদী। পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী নারায়ণগঞ্জে প্রবেশ করেছে। জেলার দক্ষিণ প্রান্তে ধলেশ্বরী নদী পদ্মায় মিশেছে। ঢাকা শহরের দক্ষিণ, পশ্চিম ও পূর্ব সবই নদীবহুল।
গাজীপুর জেলার পূর্বে শীতলক্ষ্যা নদী উত্তর-দক্ষিণে বয়ে গেছে। শীতলক্ষ্যার পূর্বে নরসিংদী জেলা। তা ছাড়া তুরাগ, বালু ও বানার নদ গাজীপুর জেলাকে বিধৃত করেছে। এলাকার প্রধান সড়ক পথ ঢাকা-আরিচা, ঢাকা-কুমিল্লা ও ঢাকা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ। ঢাকা থেকে একটি রাস্তা নরসিংদীকে সংযুক্ত করেছে। এ রাস্তাটি সরু হয়ে ভৈরব বাজার (কিশােরগঞ্জ) গিয়ে শেষ হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে যাতায়াতের জন্য ঢাকা-আরিচা সড়ক ছিল অপরিহার্য। দক্ষিণবঙ্গে কোনাে রেলপথ ছিল না। উত্তরবঙ্গের রেলপথ ছিল ঘুর পথ এবং যমুনা নদী ফেরি দিয়ে পার হতে হয়। ফলে এ পথ ছিল অনির্ভরশীল। ঢাকা। থেকে টঙ্গী হয়ে ময়মনসিংহ অথবা আখাউড়া যাওয়ার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযােদ্ধারা রেললাইন উপড়ে ফেলার ফলে এবং ব্রিজ ও কালভার্ট ধ্বংস করার ফলে ব্যবহারের অযােগ্য হয়ে যায়। সড়ক পথই হয় পাকিস্তানি সৈন্যদের চলার প্রধান মাধ্যম। ২৭ মার্চ পাবনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে বিশাল বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। রাজশাহীতে অবস্থিত ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের মেজর আসলামসহ ৪জন অফিসার এবং ১৪৪জন সৈনিক ২৫ মার্চ পাবনায় পৌছে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ কার্যকর করার জন্য ২৭ মার্চ মুক্তিবাহিনীর সাথে যুদ্ধে তাদের ৪জন অফিসারসহ ১৩০জন সৈনিক প্রাণ হারায়। ১ এপ্রিল মাত্র ১৮জন সৈনিক রাজশাহীতে ফেরত যেতে সমর্থ হয়। রংপুর বা সৈয়দপুর সেনানিবাস থেকে রাজশাহী ও পাবনাকে সাহায্য করার কোনাে উপায় ছিল না। প্রথমত, ২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড উল্লেখ্য দুই সেনানিবাসে প্রতিরােধের সম্মুখীন ছিল এবং দ্বিতীয়ত, দূরত্ব একটা সমস্যা তৈরি করে। ৬ এপ্রিলের মধ্যে ৯ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন এবং ১৬ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন করাচি থেকে বিমানে করে ঢাকা এসে পৌঁছে।
ঢাকাস্থ ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডকে আদেশ দেওয়া হয় রাজশাহী ও উত্তরবঙ্গকে সাহায্য করার। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব খান তার ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড নিয়ে ৭ এপ্রিল ঢাকা থেকে সাভার, মানিকগঞ্জ হয়ে আরিচা রওনা হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা যাত্রার সময় রাস্তার দুই পাশে যত দূর তাদের দৃষ্টি যায়, নির্বিবাদে মানুষ হত্যা করে এবং সমস্ত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এ। কারণে পাকিস্তানিরাই ৫৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের নাম দেয় ফায়ার ব্রিগেড’। রংপুর ও সৈয়দপুরে অবস্থিত (২৩ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেড) পাকিস্তানি সৈন্যদের এ সড়ক পথেই যাবতীয় পণ্য সরবরাহ করা হতাে। বিভিন্ন সময় শত্রুর এ ধরনের গাড়ির বহর অ্যামবুশ করা হতাে। কিন্তু তারপরও তাদের এ সড়ক পথ ব্যবহার করা ছাড়া কোনাে গত্যন্তর ছিল না। গাজীপুরে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি, রাজেন্দ্রপুরে অ্যামুনিশন ডিপাে এবং জয়দেবপুর রাজবাড়িতে পাকিস্তানি সৈন্যদের অবস্থান ছিল। প্রথমােক্ত ২টি ছিল স্থায়ী স্থাপনা এবং জয়দেবপুর রাজবাড়িতে ছিল তাদের কৌশলগত অবস্থান। ২৬ মার্চ পরবর্তী সময়ে এপ্রিলের প্রথমার্ধ পর্যন্ত পাকিস্তানিরা রাজেন্দ্রপুরে অ্যামুনিশন ডিপাে থেকে অ্যামুনিশন পরিবহণের জন্য হেলিকপটার ব্যবহার করে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৯ এবং ১৬ ইনফ্যান্ট্রি ডিভিশন পৌছার পর অতিরিক্ত সৈন্য বিভিন্নভাবে মােতায়েন করে তারা গােটা জয়দেবপুর এলাকাকে তারা একটা বৃহৎ দুর্গে পরিণত করে। সীমান্ত থেকে জয়দেবপুর এলাকার দূরত্বের কারণে এবং পাকিস্তানিদের শক্ত ঘাঁটি এবং সজাগ উপস্থিতির কারণে অপেক্ষাকৃত কম প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতালব্ধ মুক্তিবাহিনীর গণযােদ্ধারা অন্যান্য এলাকার মতাে এখানে শক্রর উপর যথেষ্ট চাপ প্রয়ােগ করতে পারেন নি।
ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ এলাকায় শত্রুর চলাচল, গােলাবারুদ ও রসদ পরিবহণ করা হতাে সড়ক পথে টাঙ্গাইল হয়ে। পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রচুর মূল্য দিতে হয় এ পথ ব্যবহার করার জন্য। মুক্তিবাহিনী অ্যামবুশ ও রেইড পরিচালনার মাধ্যমে শক্রর ব্যপক ক্ষতিসাধন করে এবং ব্রিজ, কালভার্ট উড়িয়ে। দিয়ে তাদের নাজেহাল করে। মানিকগঞ্জে এক অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ক্যাপটেন আবদুল হালিম চৌধুরী নিজ উদ্যোগে এবং স্থানীয়ভাবে সংগৃহীত অস্ত্র দ্বারা ১টি বাহিনী গড়ে তােলেন। তিনি মানিকগঞ্জ ট্রেজারি থেকে ৬৩৬টি রাইফেল এবং কয়েক হাজার গুলি নিয়ে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও যুদ্ধ শুরু করেন। দুর্গম অঞ্চল হরিরামপুর থানা এলাকায় তিনি তার সদর দপ্তর গড়ে তােলেন। বিভিন্ন যুদ্ধে তিনি পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র দখল করে শক্তিবৃদ্ধি করেন। ২ নম্বর সেক্টরের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যােদ্ধারাও তাঁর বাহিনীতে যােগ দেন । মানিকগঞ্জ ২ নম্বর সেক্টরের আওতাধীন। থাকলেও ক্যাপটেন হালিম নিজেকে প্রায় স্বতন্ত্র রেখেই যুদ্ধ করেন। যদিও তিনি ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ এবং ক্যাপটেন এ টি এম হায়দারের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেছিলেন। নভেম্বর মাসে তিনি ২ নম্বর সেক্টরের সদর দপ্তর মেলাঘরে যান এবং সেখান থেকে তাকে লিখিতভাবে মানিকগঞ্জ, ঢাকা সদর (দক্ষিণ) এবং ঢাকা সদর (পশ্চিম)-এর দায়িত্ব দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপটেন হালিমের নেতৃতাধীন ‘হালিম বাহিনীর অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী সদর দপ্তর কর্তৃক ভৌগােলিক সীমারেখা দ্বারা বিভিক্ত ১১টি সেক্টরের দায়িত্বপূর্ণ এলাকা অনুযায়ী বেশি অংশ টাঙ্গাইল ১১ নম্বর সেক্টরের অধীন; টাঙ্গাইলের পূর্বাঞ্চল, গাজীপুর ৩ নম্বর সেক্টরের অধীন এবং মানিকগঞ্জ ও ঢাকা ২ নম্বর সেক্টরের অধীন থাকার কথা।
টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী ও হালিম বাহিনীর সাংগঠনিক তৎপরতা এবং যুদ্ধের সাফল্যের কারণে ১১ নম্বর সেক্টর ও ৩ নম্বর সেক্টর থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রয়ােগ করা যায় নি এবং ত প্রয়ােজনও পড়ে নি। ক্যাপিটেন আবদুল হালিম চৌধুরী ২ নম্বর সেক্টরের।
অধিনায়ক মেজর খালেদ মােশাররফ এবং ক্যাপটেন এ টি এম হায়দারের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন। উক্ত সেক্টর থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যােদ্ধারা এসে টাঙ্গাইল মুক্তিবাহিনী, হালিম বাহিনী ও বাতেন বাহিনীর সাথে মিশে যুদ্ধ করেন।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান – তৃতীয় খন্ড