বাংলাদেশের নেতাদের কাজে লাগান
শরণার্থী সংখ্যা পঞ্চাশ লক্ষের কোঠা ছাড়িয়ে গেছে। পশ্চিমবাংলার উপর চাপ পড়েছে সবচেয়ে বেশী। গত বুধবার পর্যন্ত এ রাজ্যে এসেছেন প্রায় চুয়াল্লিশ লক্ষ শরণার্থী। বহু গড়িমসির পর কেন্দ্রীয় সরকার কিছু সংখ্যক শরণার্থীকে অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিতে রাজী হয়েছেন। মধ্যপ্রদেশের শিবির তৈরী। ওখানে পাঠাবার কথা ক’হাজার দূর্গত মানুষ। ইতিমধ্যে শরণার্থীদের মধ্যে গড়ে উঠছে অস্বাভাবিক মানসিকতা। ওরা পশ্চিম বাংলা ছাড়তে রাজী নন। তাদেরভ য়, ভিন্ন রাজ্যে নিয়ে তাদের ফেলে দেওয়া হবে জঙ্গলের মধ্যে। মরতে হলে তারা মরবেন বাংলার মাটিতে, অন্য রাজ্যের জঙ্গলে নয়। একদল স্বার্থান্বেষী লােক প্রচার চালাচ্ছে শরণার্থী শিবিরগুলােতে। হতভাগ্য মানুষগুলাে হচ্ছেন তাদের প্রচারের বলি। এদিকে পশ্চিমবাংলা সরকারের অবস্থা কাহিল। অবাঞ্ছিত অবস্থার মােকাবিলা করতে হচ্ছে তাদের। সন্ত্রসের রাজত্ব থেকে আসছেন। শরণার্থীরা। অনাহার, মৃত্যু ব্যাধি এবং ভীতির ভারে তাদের চিন্তাশক্তি হয়ে গেছে বিকল। ওরা ভাবতে পারেন না, যারা তাদের আশ্রয় দিয়েছেন মৃত্যুর মুখে তাদের ঠেলে দিতে পারেন না তারা। অন্য রাজ্যে পাঠানাের আয়ােজন শরণার্থীদের বাঁচানােরই ব্যবস্থা। যেখানেই নেই ইয়াহিয়ার চমু সেখানেই তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়। এই সহজ কথাটি বুঝতে না পারলে শরণার্থীরা নিজেরাও মরবেন এবং পশ্চিমবাংলাকেও মারবেন। শিবিরে এবং শিবিরের বাইরে যে দশায় তারা আছেন তার চেয়ে শােচনীয় অবস্থা কল্পনাও করা যেতে পারে না। চোখের সামনে মৃত্যুর বিভীষিকা দেখে তাদের বােঝা উচিত, অন্য রাজ্যে তাঁদের বাঁচার সম্ভাবনা বেশী।
কেন্দ্রীয় সরকার গােড়াতেই ভুল করেছিলেন। তাঁরাই বলেছিলেন, সীমান্তের কাছাকাছি থাকবেন শরণার্থীরা। অন্য রাজ্য তাে দূরের কথা, পশ্চিমবাংলার অভ্যাল্পরেও তাদের সরান হবে না। কর্তৃপক্ষের অদূরদর্শীতা করেছে অনাবশ্যক সঙ্কট সৃষ্টি। দেশ বিভাগের পর এসেছেন অসংখ্য উদ্বাস্তু। বাস্তব অভিজ্ঞতার দেখা গেছে, আশ্রয় শিবিরে একবার কায়েম হতে পারলে অনেকেই যেতে চান না অন্যত্র। আগে যারা এসেছিলেন তাদের ফিরে যাবার প্রশ্ন ছিল না। পুনর্বাসন নিয়ে সরকার করেছেন তাদের অবস্থান সাময়িক। অন্য রাজ্যে যেতে শরণার্থীদের অনিচ্ছা ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী। আগেভাগে প্রস্তুত না থাকার জন্যই ঘটছে যত বিভ্রাট। ভারতের মাটিতে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গেই যদি শরণার্থীদের অন্যত্র পাঠাবার পরিকল্পনা তৈরী হত তবে দেখা দিত না বর্তমান অনর্থ। এত শরণার্থী যে আসতে পারেন তা ভাবেন নি নয়াদিল্লী। এখানেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তাদের পর্বত প্রমাণ অদূরদর্শিতা এবং প্রশাসনিক অযােগ্যতা। যারা আজ পশ্চিমবাংলা ছাড়তে রাজী নন তারা কোনদিন স্বদেশে ফিরে যেতে চাইবেন কিনা, সন্দেহ। অদূরভবিষ্যতে বাংলাদেশে অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টির আশা করছেন নয়াদিল্লী। কে করবেন এই পরিবেশ সৃষ্টি এবং কারা আনবেন শরণার্থীদের মধ্যে আস্থার মনােভাব তাও জানেন না কর্তৃপক্ষ। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর কথাবার্ত অত্যন্ত অস্পষ্ট এবং হেয়ালীতে ভরা। কোন দাগ কাটতে পারছেন না তিনি শরণার্থী কিম্বা ভারতীয় জনসাধারণের মনে। নৈরাশ্য এবং কেন্দ্রের প্রতি আস্থাহীনতা দানা বেধে উঠছে সর্বত্র।
ইয়হিয়া ফেরৎ নেবেন না অধিকাংশ শরণার্থীকে। তিনি নিতে চাইলেও অনেকে যাবেন না। পাক-সৈন্যদের বর্বরতা ভুলে যাওয়া এত সহজ নয়। ঘাতকের তরবারি কোষবন্ধ হলেও ওতে থাকবে রক্তের ছাপ। একমাত্র ভরসা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। ওরা বলছেন, ইয়াহিয়াকে তার বাংলাদেশ ছাড়া করবেন। প্রত্যেকটি শরণার্থীকে তারা উপযুক্ত মর্যাদা দিয়ে ফিরিয়ে নেবেন। লুণ্ঠিত ধণ-সম্পত্তি আবার মালিকদের হাতে তুলে দেবেন। যদি মুক্তি-সংগ্রামীদের আশা সার্থক হয় তবে শরণার্থীরা অবশ্যই ফিরে পাবেন মনের বল। দখলদারী পাকসৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই চালাবার সঙ্গে সঙ্গে অটুট রাখতে হবে শরণার্থীদের মনের বল। সঙ্কট শেষ না হওয়া পর্যন্ত বিশেষ প্রয়ােজন শরণার্থী এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে আন্তরিক সহযােগিতা। বাংলাদেশের বহু কর্মী এবং নেতা ইতস্ততঃ ছড়িয়ে রয়েছেন। বাছা বাছা লােকদের লাগান উচিত শরণার্থী শিবিরগুলােকে প্রশাসনে। ও’রা হবেন কেন্দ্রীয় এবং সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলাের কর্মীদের সহযােগী। সেবার সঙ্গে চলবে রাজনৈতিক ক্ষেত্র ভবিষ্যৎ রণাঙ্গন। অন্যান্যরা থাকবেন শরণার্থীদের সঙ্গে। শৃঙ্খলা রাখবেন শিবিরগুলােতে। ভেঙ্গে পড়তে দেবেন না তারা দুর্গত মানুষগুলাের মানসিক বল। এ ব্যবস্থা চালু হলে লাভ মানুষগুলাের। কিছুটা হালকা হবে ভারতের দায়িত্ব। সময় যখন আসবে তখন বাংলাদেশের নেতারাই স্বদেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন শরণার্থদের তাদের কথার দাম দেবেন ভাগ্যবিড়ম্বিত মানুষগুলাে। আগামী দিনগুলাে দুর্যোগপূর্ণ। মূল্যবান সময় নষ্ট করছেন কেন্দ্রীয় সরকার। বহির্বিশ্বের দিকে তাকিয়ে থেকে লাভ নেই। মনস্থির করুন নয়াদিল্লী। কোথায় ফিরবেন শরণার্থীরা? ইসলামাবাদের পূর্ব পাকিস্তানে না মুজিবনগরের বাংলাদেশে? প্রথমটি অবাস্তব। দ্বিতীয়টি যদি কার্যকর পথ বলে কর্তৃপক্ষ ধরে নেন, তবে শরণার্থী শিবির পরিচালনায় বাংলাদেশের নেতা এবং কর্মীদের সহযােগিতা খুবই দরকার।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ১১ জুন ১৯৭১