You dont have javascript enabled! Please enable it! 1973.06.26 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | স্থায়ী বন্যা প্রতিরোধ করতেই হবে | জাতিসংঘের সদস্যপদ হারানো উচিত | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকা: ২৬শে জুন, মঙ্গলবার, ১১আষাঢ়, ১৩৮০

জাতিসংঘের সদস্যপদ হারানো উচিত

বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী গত রোববার লায়ন্স ইন্টারন্যাশনাল উদ্যোগে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণদান করেন। ভাষণে রাষ্ট্রপতি দৃঢ়তার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। তারমধ্যে পূর্বের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম জনসংখ্যা ও ভূমি নিয়ে পাকিস্তান এখন আর জাতিসংঘের সদস্যপদ দাবি করতে পারে না। তিনি জাতিসংঘের প্রতি পাকিস্তানের সদস্যপদ সম্পর্কে নতুন করে বিবেচনার আহ্বান জানান। আটক বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশ্বজনমত ঐকান্তিক সহযোগিতায় তিনি কামনা করেন। জোরপূর্বক বাঙালিদেরকে আটক রাখা জাতিসংঘের সনদ বিরোধী কাজ বলে রাষ্ট্রপতি মনে করেন। এছাড়া ভারত বাংলাদেশ যুদ্ধ ঘোষণা সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন। তার মতে, মানবিক সমস্যার সমাধানের এই ঘোষণার সত্য ও ন্যায়ের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে। উপমহাদেশের শান্তি ও নিরাপত্তা পথ প্রশস্ত করার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে ঘোষণায়। তবু পাকিস্তান এ ব্যাপারে টালবাহানা করছে। এবং উপমহাদেশের উত্তেজনার সৃষ্টি করে চলছে। বস্তুতপক্ষে পাকিস্তান তার পূর্বাঞ্চল হারিয়ে জাতিসংঘের সদস্য হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। যে ভৌগোলিক সীমানা ও জনশক্তির নামে পাকিস্তান জাতিসংঘের সদস্য হয়েছিল আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তা আর নেই। এখন বাংলাদেশে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন তুলতে পারে পাকিস্তান কোন সংজ্ঞার ভিত্তিতে আজও জাতিসংঘের সভা? যে যোগ্যতা বলে সে সভা হয়েছিল আজ তা নেই। তাহলে পাকিস্তান কেমন করে জাতিসংঘের সদস্য হয়? জাতিসংঘের নিকট এটা আজ আমাদের প্রশ্ন। সেইসঙ্গে বিশ্বের বিবেকবান দেশসমূহের কাছেও আমাদের দাবি পাকিস্তানের সদস্য হবার প্রশ্নটি যেন বিবেচনা করে দেখা হয়। পাকিস্তান উপমহাদেশীয় শান্তি ও নিরাপত্তা বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছে। সে নিরীহ নিরপরাধ বাঙালিদেরকে নির্যাতন করছে। তাদের স্ত্রী পুত্র-কন্যা দের উপর নির্যাতন চালাচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের কে বিনা বিচারে ফিরিয়ে নেবার জন্য বিশ্বের দুয়ারে বর্না দিয়ে বেড়াচ্ছে। তাই আমরা বিশ্বের সকল জাতির নিকট পাকিস্তানের আচরণ সম্পর্কে ওয়াকিফহাল হবার আহবান জানাই। আটক বাঙালিদেরকে ফিরিয়ে দেবার জন্য ভুট্টোর উপর চাপ সৃষ্টি করার আবেদন করব। আমাদের বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবেকবান দেশ সমূহ আমাদের যেভাবে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিলেন ঠিক সেভাবে আটক বাঙালিদেরকে ফিরিয়ে দেবার ব্যাপারে তারা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবে।

স্থায়ী বন্যা প্রতিরোধ করতেই হবে

বাংলাদেশের বুকে প্রচণ্ড করার পর আবারও বন্যা এল। আষাঢ় মাসের শুরু থেকেই যমুনা ও ব্রহ্মপুত্রের পানি বাড়তে থাকে। তারপর বিপদসীমার লংঘন করে প্লাবিত করে উভয় তীরে সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলো। রংপুর, বগুড়া, সুনামগঞ্জ, ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জ প্লাবিত হয়। বহু ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয় হাজার হাজার একর জমির ফসল সহ বহু ব্যক্তি আশ্রয়হীন খাদ্যহীন অবস্থায় রেললাইন স্কুলঘর ইত্যাদিতে আশ্রয় নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে। তাদের দৈনন্দিন জীবনের নিত্য দুঃখের সঙ্গে যুক্ত হয় দুর্বিসহ যন্ত্রনা।
সম্প্রতি ভয়াবহ বন্যায় সমগ্র জামালপুরের মহকুমাকে গ্রাস করে ফেলেছে। এই মহাকুমায় সরিষাবাড়ী, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, ইসলামপুর, শেরপুর, মাদারগঞ্জ এলানকুদ ও নকলা থানার বন্যার জল প্রবলবেগে প্রবেশ করে। তার ফলে বন্যা কবলিত এলাকায় বহু ক্ষয়ক্ষতি সহ কয়েক লাখ মানুষ চরম দূর্দশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। হাজার হাজার কাঁচা গৃহ বন্যার জলে ভেসে গেছে লাখো লাখো বাড়ির জলমগ্ন হয়ে রয়েছে এবং কিছু সংখ্যক শিশু সলিল সমাধি লাভ করেছে। এছাড়াও পাঠ ও আউশ ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অঞ্চল বিশ্বাসের শতকরা ৮০ থেকে ৯০ ভাগ ফসল ধ্বংস হয়ে গেছে।
সংবাদ সূত্রটি আরো জানায় যে, এইসব বন্যাকবলিত অঞ্চল থেকে গৃহহারা দুর্দশাগ্রস্ত মানুষদের নিরাপদে সরিয়ে আনার সরকারি প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। জানা গেছে অনুমানিক মাত্র এক হাজার মানুষকে এ পর্যন্ত নিরাপদ অঞ্চলের নিয়ে আসা হয়েছে।
বন্যাকবলিত অঞ্চল গুলোতে চালসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য অতিমাত্রায় বেড়ে গেছে। এদিকে বন্যার পানি ক্রমশ বাড়ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়ানক অবনতি ঘটেছে।
সরকারি মহল থেকে সাহায্যের হস্ত প্রসারিত হয়েছে ইতিমধ্যে। প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু দুঃস্থ মানুষদের মধ্যে পর্যাপ্ত সাহায্যদানের আশ্বাসও দিয়েছেন। কিন্তু সেটি চূড়ান্ত সান্তনা নয়।
ভৌগলিক অবস্থান এবং গঠন প্রকৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নদী বিধৌত পলিমাটিতে যেমন পর্যাপ্ত ফসল জন্মে তেমনি জলের রোষে এক ঝাপটায় তা আবার ডুবে যায়। বাংলার মাটিতে রোদ-বৃষ্টিও প্রখর। তাই খরা আসে, বন্যাও বাসে। এই দুটোই প্রতিবছর বাংলাদেশের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে থাকে। বিশেষ করে তা খাদ্য সমস্যার পরিস্থিতি চূড়ান্ত অবনতি ঘটায়।
বন্যার ফলে তৈরি ফসল এক নিমিষে ধ্বংস হয়ে সমগ্র সরকারী পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যাচ্ছে বারবার। এবার শুষ্ক জমি বা বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচের সুষ্ঠু ব্যবস্থা করতে না পারার দরুন পরিকল্পনামাফিক শস্য উৎপাদন হচ্ছে না। এছাড়াও এবছর তেলের অভাবে পাওয়ার পাম্প গুলো ঠিকমতো চালু রাখতে না পারায় বহু এলাকায় চাষাবাদ ভালো হয়নি এবং উৎপাদন দারুণভাবে হ্রাস পেয়েছে।
কাজেই দেখা যাচ্ছে শুধু প্রাকৃতিক শক্তিগুলোর নয়, পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কর্মদক্ষতার অভাবেও বাংলাদেশের খাদ্য পরিস্থিতিকে পূর্ণতার দিকে এগিয়ে যেতে দিচ্ছে না। দেশে খাদ্য উৎপাদনের জন্য সরকার যে লক্ষ্য স্থির করেছিল তা অর্জন করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে। এতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে হতাশ হলে চলবে না। বরং সরকারকে এখন থেকে অধিকতর সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে এবং যথেষ্ট সাবধান হতে হবে। ঝড়ঝঞ্ঝা ও নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় বহু পুরাতন একথাও সত্য। কিন্তু রকেট বিজ্ঞানের যুগে আজ আর সর্বত্র প্রাকৃতিক শক্তির শিকার নয় মানুষ। মত্ত প্রমত্তা স্রোতস্বিনীর পায়ে শৃংখল দিয়ে শক্তি আদায় করে নিচ্ছে বিজ্ঞান। তার তুলনায় বন্যা প্রতিরোধ করা অনেক সহজ। এর জন্য চাই শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনা। একথা বুঝতে হবে যে, বন্যার্তদের সাহায্যের জন্য প্রতিবছর বহু ক্ষয়ক্ষতি সহ অজস্র অর্থ ব্যয় হয়। অথচ সেই অর্থব্যয় ক্ষণস্থায়ী উপকার পাওয়া যায় না। তাই সংশ্লিষ্ট মহলকে আজ সুদুরপ্রসারী চিন্তার মাধ্যমে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বৃহত্তর জনকল্যাণ ও সামগ্রিক জাতীয় উন্নয়নের দিকে লক্ষ্য রেখে বন্যার রূপ মুহূর্ত অভিশাপের মোকাবেলা করার জন্য তার সঙ্গে কাজে নামতে হবে। স্থায়ীভাবে বন্যাকে প্রতিরোধ করতে হবে। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে হলে এ ছাড়া অন্য কোন বিকল্প ব্যবস্থা নেই।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন