জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সহকারীকে প্রদত্ত ভারতের জবাব
২ আগস্ট, ১৯৭১
১। ভারত সরকার জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দৃষ্টিগোচর করে যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে শরণার্থীদের আগমন তাদের জন্য পরম উদ্বেগের ব্যাপার। পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নৃশংসতা দ্রুত বন্ধ করা জরুরী। দৈনিক ৪০০০০ থেকে ৫০০০০ উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করছে। নৃশংসতা চলতে থাকলে এদের দেশ ছেড়ে ফিরে যাবার সম্ভবনাও কম। ভারত সরকার ইতোমধ্যে উদ্বাস্তু ফেরত পাঠানোর জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে – এর সংখ্যা এখন চার মিলিয়ন হয়ে গেছে। গত ২৫ মে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিবৃতি দিয়েছেন যে তিনি পাকিস্তানি নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেবেন।
২। ভারতে সাত লক্ষেরও বেশি উদ্বাস্তু আছে। দৈনিক দেশত্যাগ এখনও অব্যাহত আছে। এর মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি। বিশৃঙ্খলা ও সামরিক দমন এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ হত্যা অপ্রতিহতভাবে অব্যাহত আছে। আন্তর্জাতিক প্রেসে তা স্পষ্ট। এই বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক রিপোর্ট ও স্বাধীন বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ভারতে তাদের ক্যাম্পে সফর এবং উদ্বাস্তুদের থেকে দুঃখের কাহিনী শুনে নিজেরাই বিবৃতি দিয়েছেন।
৩। উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এখনও প্রতিদিন বাড়ছে। লক্ষ লক্ষ লোকদের দেখাশোনা করা ভারত সরকারের উপর বোঝা। এটা সবাই লক্ষ্য করেছেন। তাছাড়া পাকিস্তান পর পর দুটি বিপর্যয় সামলাতে পারছেনা- একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ অন্যটি মানুষসৃষ্ট। ফলে পাকিস্তানের ক্রমবর্ধমান আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও প্রশাসনিক ব্যার্থতা প্রকট হচ্ছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতির উত্তরণেও এটা বাঁধা হয়ে আছে। পূর্ব পাকিস্তানে একটি উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি হলে ভারত থেকে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে চিন্তা করা সম্ভব। দেশের অখন্ডতা রক্ষা ও স্বনিয়ন্ত্রণের মূলনীতির মধ্যে যে সঙ্ঘর্ষ তা বিশেষ ভাবে প্রতিভাত হচ্ছে পুর্ব পাকিস্তানে, যেখানে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী নিপীড়িত হচ্ছে একটি সংখ্যালঘু সামরিক শাসনের হাতে, যারা গত বছরের ডিসেম্বরে তাদেরই নিজেদের দেয়া নির্বাচনের ফলাফল অস্বীকার করছে, এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের উপর নির্বিকার হত্যাকাণ্ড, গনহত্যা ও সাংস্কৃতিক দমন চালাচ্ছে।
৪। প্রিন্স সদরুদ্দিন ভারতের প্রধান মন্ত্রিকে কিছুদিন আগে বলেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নানা ভাষার, নানা পেশার কর্মীদের আনলে শরনার্থিদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হবে। ইউএনএইচসিআর ১৬ জুলাই জেনেভায় অনুষ্ঠিত ECOSOC সভায় সীমান্তে উদ্বাস্তুদের জন্য কোন পরামর্শ দেয় নাই। বর্ডারের উভয় পাশে হাই কমিশনারদের প্রতিনিধি দেয়া হলে শরনার্থিদের ফিরে যাওয়া তরান্বিত হবে কিনা সে ব্যাপারে তিনি কিছুই বলেন নাই।
৫। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকার সীমান্তের ভারতীয় অংশে কিছু লোককে পোস্টিং দেবার উদ্যেশ্য বুঝতে পারছেনা। আমরা মনে করি এতে করে উদ্বাস্তুরা বাড়ী ফিরে যাবেনা। তাছাড়া তারা পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্বিচারে গণহত্যার মুখোমুখি হবে। পাশবিক বল প্রয়োগের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৫ মিলিয়ন মানুষ এখন নির্যাতিত। এতে সেখানে বিরাজমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক বাস্তবতার প্রকাশ হয়। পাক সরকার উদ্বাস্তুদের ফিরে যাবার পরিবেশ সৃষ্টি করেনি। বরং এটাকে অসম্ভব কঠিন করে দিয়েছে। তারা ইচ্ছা করে ভারতে অনুপ্রবেশ ঘটাচ্ছে।
৬। উদ্বাস্তুদের প্রবেশে বাঁধা দেবার কোন ইচ্ছা ভারতের নেই। আমরা তাদের দ্রুত নিরাপদে ফিরে যাওয়া নিয়ে শঙ্কিত। এই প্রেক্ষাপটে, UNHCR এর সেক্রেটারি জেনারেল ৩০শে জুন বিবৃতি দেন ভারতের অভিযোগ উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবর্তন বাধা গ্রস্ত হচ্ছে। প্রিন্স সদরুদ্দিন বলেন হোস্ট সরকারের বিপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই যে তারা শরণার্থীদের বাধা দিচ্ছেন। আবার প্যারিসে এক প্রশ্নের জবাবে ১০ জুলাই প্রিন্স বলেন, এটা বলা ঠিক হবেনা যে ভারত তাদের প্রবেশে বাঁধা দিচ্ছে। ১৯ জুলাই, কাঠমান্ডুতে ব্রিটিশ সংগঠন “ওয়ার্ণ ওয়ান্ট” পাকিস্তানের বিবৃতিকে “আবর্জনা” বলে আখ্যায়িত করেছে। কারণ পাকিস্তান বলেছে ভারত উদ্বাস্তুদের রেখে দিচ্ছে ইচ্ছা করে এবং তাদের ফিরতে দিচ্ছেনা। কলকাতায় ২২ জুলাই, জনাব ম্যানফ্রেড ক্রস, একজন অস্ট্রেলিয়ান এমপি, পাকিস্তানের কথাকে “অসম্ভব” বলে উড়িয়ে দেন। যুক্তরাষ্ট্রের হাউজের প্রতিনিধি মাননীয় কর্ণেলিয়াস ই গ্যালাঘের ১০ জুলাই বলেন পাকিস্তানের সৃষ্ট সংকট ভারত সরকার অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সামলাচ্ছেন। তারা অবিশ্বাস্য সংযম দেখিয়ে যাচ্ছেন। তারা উদ্বাস্তুদের সাহায্য ও সমবেদনা দেখাচ্ছেন। সত্যি করেই বলা যায় এই সরকার নৈতিক ও মানবিক আচরণ করছেন। যেদিন প্রথম উদ্বাস্তু বর্ডার অতিক্রম করেছে সেদিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সরকার সুনাম অর্জন করে চলেছেন। উদ্বাস্তুদের অনুপ্রবেশের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায় পাকিস্তান সরকার নির্বাচনে জয়ী না হতে পেরে তাদের উপর কি পরিমাণ পেষন ও নৃশংস নীতি অবলম্বন করছেন। আমি উদ্বাস্তুদের সাক্ষাৎকার নিয়ে দেখেছি। আমি এখন বিশ্বাস করি খুব হিসাব করে বুদ্ধিবৃত্তিক মানুষদের – অধ্যাপক, ছাত্র, এবং সেনাবাহিনী কর্তৃক ডিস্টিংশনপ্রাপ্ত দের হত্যা করে নিশ্চিনহ করে দেয়া হচ্ছে। আমার এই মতামত গণহত্যার পক্ষে রায় দেয়। এছাড়া আরও যত রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে যার কোথাও বলা নেই যে এটি ছাড়া শরনার্থিদের অনুগমনের অন্য কোন কারণ আছে।
৭. এই পটভূমিতে ভারত সরকার একটি “উভয় পক্ষের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সীমিত উপস্থাপনা” এর প্রস্তাব আনার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে যেখানে তারা বলবে যে তারা শরনার্থিদের ফিরে যেতে বাঁধা দিচ্ছেনা। তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো গুরুতর প্রভাবিত হলেও শুধুমাত্র মানবিকতার ভিত্তিতে ভারত প্রবেশের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার উদ্বিগ্ন যে তারা সহসা দেশে ফিরে যেতে পারবে কিনা। জাতিসংঘ বা ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধিদের উপস্থিতি এই ব্যাপারে সাহায্য করতে পারবে না। অপরপক্ষে, এটা মূল সমস্যাকে চাপা দিয়ে দেবে – যেটি হচ্ছিল মূলত সামরিক নৃশংসতার ধারাবাহিকতা থেকে। বিশ্বের মনোযোগ অন্যদিকে প্রবাহিত হলে শরণার্থীদের আরও অন্তঃপ্রবাহ বজায় থাকবে। এবং রাজনৈতিক নিষ্পত্তির অভাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্বের শাসন প্রতিস্থাপন বিলম্বিত হবে।
৮. ইউএনএইচসিআর এর দিল্লিতে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের একটি মোটামুটি শক্তিশালী দল রয়েছে এবং তাদের জন্যে শরণার্থী শিবিরে দেখার জন্য সুবিধা দেওয়া হয়েছে। বস্তুত জনাব টমাস জেইমসন, ইউএনএইচসিআর এর পরিচালক, ভারতে ইউএনএইচসিআর কার্যালয়ের প্রধান প্রতিনিধি। তিনি সম্প্রতি শরণার্থী শিবিরে সফর করে এসেছেন। সব শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ অনুমতি প্রদান করা হয় এবং সীমান্ত এলাকায় এইসব ক্যাম্পে যানবাহন সুবিধা দেওয়া হয়। এছাড়াও ১০০০ বিদেশী পর্যবেক্ষক শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং তাদের অধিকাংশ প্রকাশ্যে বলেছেন যে উদ্বাস্তুরা বাংলাদেশের সামরিক অপারেশন এর কারণে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে এবং যদি উপযুক্ত অবস্থার সৃষ্টি করা হয় তাহলে তারা নিরাপদ ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করবে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার নির্বাচিত সহকর্মীরা এই ব্যাপারে একটি রাজনৈতিক বক্তব্য রেখেছেন। সরকারী সাহায্য প্রতিষ্ঠানগুলো পরিশেষে জানায় আন্তর্জাতিক সংস্থাদের এগিয়ে আসা উচিৎ। এসে তার উদ্বাস্তুদের পরিস্থিতি দেখুন। তাদের রিলিফ প্রোগ্রাম, মানবিক সহায়তা এবং কিছু লোকবল নিয়োগ করুন। মানুষের এই হতাশাজনক দুর্ভোগ আর ভোগান্তিতে সবাই এগিয়ে আসুন এই আশা ব্যাক্ত করা হয়।
৯. ভারত সরকারের কোনো প্রস্তাব নেই যা মৌলিক সমস্যা থেকে মনোযোগ অন্যদিকে ধাবিত করে। কারণ এতে শরণার্থীদের পরিণতিও অপরবর্তিত থাকবে। তারা জাতিসংঘের যে কোনো কর্ম বা পদক্ষেপ সমর্থন করবে। পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে শরণার্থীদের ভূমি, ঘরবাড়ী এবং সম্পত্তির নিশ্চয়তা নিশ্চিত করে পূর্ব পাকিস্তানে তাদের ফেরত পাঠানো হবে। এমন অবস্থা সেখানে তৈরি করা হবে যে তা আন্তর্জাতিক সংস্থার অধীনে থাকবে এবং উদ্বাস্তুরা নিরাপদে ফিরে আসতে পারে এবং পুনরায় কোন প্রতিহিংসামূলক হুমকি বা নিপীড়নের স্বীকার না হয় সেই ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে। ভারত সরকার ২৭ জুলাই প্রকাশিত নিউইয়র্ক টাইমস এর রিপোর্ট এবং ফোটোগ্রাফিতে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের দৃষ্টি আকর্ষণ করান। এই অবস্থায় ভারতীয় সীমান্তে কাউকে পোস্টিং দেয়া হলে তাতে পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবেনা। ভারত সরকার এটাকে সমর্থন করতে পারেন না কারণ এটা তাদের তারা মনে করে এটা অবাস্তব ও বিপদজনক হবে। তাই তারা এই প্রস্তাব কোন ভাবেই মেনে নেবেন না।
১০. পূর্ববাংলার মূল সমস্যা সেখানে বহুদূর থেকে আসা একটি সেনা বাহিনী নিষ্ঠুরভাবে তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় পূর্ববঙ্গে উদ্বাস্তুদের ফেরতের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সজাগ হয় তাহলে সেখানে ইতিমধ্যে নির্বাচিত নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক নিষ্পত্তির মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের ভিতরে স্বাভাবিক অবস্থার পুনরুদ্ধার সম্ভব।
Translated by – Dr Razibul Bari