এই সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব জানালেন, পূর্ববাংলায় স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা সমস্ত বিলাসব্যসন, খানাপিনা পরিত্যাগ করার সংকল্প নিয়েছেন। তারপর শুরু হল কথাবার্তা। অত্যন্ত সরল করে এবং সহজ ভাষায় তাজউদ্দীন সাহেব পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিলেন এবং জানালেন বাঙালির জাতীয় জীবন পর্যদস্ত করতে ইয়াহিয়া, টিক্কা খান ও ভুট্টো চক্র বদ্ধপরিকর। পৃথিবীর রাজনৈতিক মানচিত্রে বাংলার স্থান এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারত মহাসাগরের গুরুত্ব তাঁর ব্যাখায় সুস্পষ্ট হয়ে উঠল। সকালের দিকে তারা বিশ্রাম করতে গেলেন। ইতােমধ্যে রুস্তামজী সাহেব দিল্লীর সঙ্গে কথা বললেন এবং স্থির হল তাদের দিল্লী যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আলােচনা করবেন। পরের দু’দিন দফায় দফায় রুস্তামজী সাহেব তাঁদের সঙ্গে কথা বললেন। মােটামুটি স্থির হল, পূর্ব পাকিস্তানের নাম বদলে রাখা হবে বাংলাদেশ, পতাকা হবে সবুজ জমিতে সােনালি রেখায় চিত্রিত বাংলাদেশের মানচিত্রসহ লাল সূর্য, জাতীয় সঙ্গীত হবে রবীন্দ্রনাথের আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি এবং সরকার হবে ধর্মনিরপেক্ষ গণপ্রজাতন্ত্র। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের মূল বক্তব্যগুলাে তিনি (তাজউদ্দীন আহমদ) ঠিক করে দিলে আমীর-উল ইসলাম এবং কলকাতার প্রখ্যাত ব্যারিস্টার সুব্রত রায় চৌধুরী তাঁর সহকর্মীদের সাহায্যে ঘোষণাপত্র রচনার কাজে হাত দেন। সেদিন ছিল কলকাতা শহরে হরতাল। বিশেষ অনুরােধে দোকান খুলিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব ও আমীর-উল ইসলামের জন্য জামাকাপড়, সুটকেস, জুতামােজা ও সমস্ত নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রী কেনা হয়। ওষুধপত্রের বিকল্প ব্যবস্থা করা হয় যেহেতু তার অভ্যস্ত ওষুধ ভারতে অচল। তাজউদ্দীন সাহেবের ইচ্ছামত তাঁকে পুনরায় টুঙ্গি সীমান্তে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে তিনি সহকর্মীদের কিছু নির্দেশ পাঠান এবং ভারতের মনােভাব সম্বন্ধে তাদের অবহিত করেন। কলকাতায় ফিরে তাঁকে দিল্লী যাবার প্রস্তুতি সেরে নিতে হয়। মধ্যরাতে বিশেষ বিমানে তাঁদের নিয়ে আমরা যাত্রা শুরু করি। শ্রান্তিতে তারা সেই বিশাল বিমানের মেঝেতে শুয়ে পড়েন এবং ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যান। রাত আড়াইটার সময় যখন আমরা দিল্লীর পালাম বিমানবন্দরে পৌছাই তখন নিরাপত্তার স্বার্থে অন্যান্য সমস্ত বিমানের জন্য বিমানবন্দর বন্ধ ছিল। বিশেষ মােটরযােগে বিদেশী গােয়েন্দাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে অনেক ঘােরাপথে তাদের গুপ্ত বাসস্থানে নিয়ে আসা হয়। পরদিন তাজউদ্দীন আহমদের প্রকৃত পরিচয় এবং আওয়ামী লীগে তার প্রতিপত্তি যাচাই করার উদ্দেশ্যে ইতােমধ্যেই পূর্ববাংলা থেকে যারা দিল্লী এসে পৌছেছিলেন এমন কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এবং ব্যক্তিবর্গকে তাজউদ্দীন। সাহেবের সাথে সাক্ষাৎ করতে নিয়ে আসা হয় কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায়। তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে এঁদের প্রথম দর্শন এবং কথাবার্তায় দিল্লীর কর্তারা নিশ্চিত হন যে, তাজউদ্দীন সাহেব শেখ সাহেবের ঘনিষ্ঠতম সহযােগী। তাঁর অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণে সক্ষম এবং সকল দায়িত্ব নেয়ার অধিকারী একমাত্র তাজউদ্দীন আহমদ। তারপর তিনি বিদেশ সচিব, রাজ্য সচিব, দেশরক্ষা সচিব, বহু সংস্থার প্রধান, প্রধানমন্ত্রীর সচিব ও উপদেষ্টা এবং অবশেষে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ-আলােচনা করে তাৎক্ষণিক প্রয়ােজনের কথা বুঝিয়ে বলেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনায় স্থির হয়, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় বৈঠকে সর্বসম্মতিক্রমে একটি সরকার গঠন করতে হবে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী এবং সমরপ্রধান নিয়ােগ করতে হবে। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, পূর্ব পাকিস্তানের নতুন নামকরণ প্রভৃতি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং সুযােগমত ওই দেশেরই কোন স্থানে প্রকাশ্য সভায় স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র গ্রহণ, সরকার গঠন, মন্ত্রীদের শপথ গ্রহণ, জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম ঘােষণা এবং মুক্তিযুদ্ধের জন্য যুবশক্তিকে যােগদান করতে আহ্বান প্রভৃতি অনুষ্ঠান ও প্রচারের আয়ােজন সম্পূর্ণ করতে হবে। প্রথম থেকেই তাজউদ্দীন সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি করতে থাকেন এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাঁকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, যথাসময়ে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঠিকই দেয়া হবে এবং আশ্রয়দানই বস্তুত স্বীকৃতিদান। ইতােমধ্যে আমি কলকাতা ফিরে তাঁদের থাকার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা সেরে ফেলি এবং টেলিফোনে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি জেলার সঙ্গে প্রয়ােজনমত যােগাযােগের গােপন ব্যবস্থা করাই। দিল্লী থেকে ফিরে তাজউদ্দীন সাহেব যুবনেতাদের সহযােগিতায় মুক্তিবাহিনী গঠন করেন এবং ভারতীয় সীমান্তসংলগ্ন অঞ্চলে তাদের জন্য কয়েকটি সামরিক শিক্ষার ও অভিযানের ঘাঁটি স্থাপন করান। সামরিক বাহিনী এবং ইপিআর-এর দলত্যাগী অফিসারবৃন্দ এইসব ঘাঁটির ভার নেন। এরই মধ্যে তিনি বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাঁদের ভারতে আনিয়ে নেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলি, খন্দকার মােশতাক আহমদ, কামরুজ্জামান প্রমুখ। অনেক এমএনএ এবং নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদেরও সমাগম হয়। এদিকে ত্রিপুরার পথে কর্নেল ওসমানী এবং ধুবড়ির পথে মওলানা ভাসানী এসে পড়েন। আব্দুস সামাদ আজাদ, মণি সিংহ, অধ্যাপক ইউসুফ আলি, আইনবিদ নূরুল আলম প্রমুখদের প্রায়ই দেখা যেত।
Reference:
– গোলক মজুমদার, গ্রন্থ – তাজউদ্দীন আহমদ – আলোকের অনন্তধারা