You dont have javascript enabled! Please enable it! রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো রোজা আবার কি জিনিস। - সংগ্রামের নোটবুক

রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো রোজা আবার কি জিনিস।

১৯৭১ সালের রমজান মাসের প্রথম দিকে পাবনা শহর থেকে বহু খান সেনারা এসে গ্রাম ঘেরাও করে রাত্রির অন্ধকারে। আমার বাড়িতে আমি ও আমার রুগ্ন স্ত্রী ছাড়া কেউ ছিল না। খান সেনারা গিয়ে আমাকে ডেকে ঘর থেকে বের করে। ধরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুইজনকে বেদম প্রহার করে আর বলে “তুই মুক্তিবাহিনীকে খেতে দিস, বল তারা কোথায়।” সেই সঙ্গে আমাদের গ্রামের আরো লোককে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে আসে এবং সেখানে কয়েকজনকে হত্যাও করে। স্ত্রীর পরিণতি কি তা আর জানতে পারি নাই। ক্যাম্পে নিয়ে এসে আমাকে এবং অন্যান্য জায়গার ৫ জনকে এক ঘরে রাখলো। দৈনিক সকাল, দুপুর ও বিকাল এবং ১১/১২ টার দিকে দুই থেকে তিনজন এসে পরপর ঘর থেকে একজন করে বার করে নিয়ে যেত এবং নানা জিজ্ঞাসাবাদ করার পর তাদের খুশীমত কাউকে মারতে আবার কাউকে না মেরেই ঘরে রেখে যেত।

আমাদের কয়েকজন কড়া পাহারাদার ছিল। রোজা তারা রাখতে দিত না। বলতো রোজা আবার কি জিনিস। দৈনিক দুইবার করে আমাদের ৬ জনকে একই জায়গাই কাপড়ে অথবা মেঝের উপর খাবার দিত। পুরাতন রেশন চাউলের ভাত এবং খেসারী কলাইয়ের ডাল। গন্ধে আমরা কেউ খেতে পারতাম না। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে লোক ধরে আনতো এবং রাত্রি বেলা তাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু দূরে শব্দ শোনা যেত। অনেক চেনামুখ আর দেখতে পেলাম না। ১৪ দিন আমাকে তারা প্রহার করার পর ১৫ দিনের দিন তাদের অফিসারসহ ৫ জন এসে ঘর থেকে আমাকে বার করে নিয়ে যায় এবং আমাকে মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে ও এম, পি, এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কোন সন্ধান না পাওয়ায় মোটা রশি নিয়ে এসে আমার দুই হাত গাছের দুই ডালের সাথে এবং দুই পায়ে রশি লাগিয়ে মাটিতে খুঁটি পুঁতে ভীষণ প্রহার করে। তাদের প্রহারে অজ্ঞান হলে তারা কি করেছে জানি না। তবে যখন আমার জ্ঞান হয় তখন দেখি আমার হাতের ও বাম উরুর চামড়া ছিলিয়ে আছে। ১৭ দিনের দিন রাতে আনুমানিক ২ টার সময় আমার ঘরের ও পাশের ঘর হতে ২৪/২৫ জনকে তাদের ক্যান্টনমেন্ট থেকে কিছু দূর নিয়ে যায়। সবাইকে লাইন করে একসঙ্গে গুলি করে হত্যা করে। আল্লাহর ইচ্ছায় আমার গায়ে গুলি লাগেনা তবু ও মরার মত পড়ে যাই। খান সেনারা চলে গেলে প্রায় ভোরের দিকে কোন রকমে এক লোকের বাড়িতে আশ্রয় নেই এবং সেখান থেকে আমার আত্মীয়কে খবর দিই নিয়ে যাওয়ার জন্য। বাড়ি গিয়ে আমার স্ত্রীর সাথে আর সাক্ষাৎ ঘটে নাই। তখন সে মারা গিয়েছিল।

স্বাক্ষর/-
মোঃ হাসেম আলী তালুকদার
গ্রাম- রামচন্দ্রপুর
থানা ও জেলা- পাবনা