You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.09 | নয়াদিল্লীর ইন্ডিয়া গেঁটে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ - সংগ্রামের নোটবুক

নয়াদিল্লীর ইন্ডিয়া গেঁটে অনুষ্ঠিত জনসভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ

ভারতের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় প্রকাশিত দি ইয়ার্স অফ এন্ডিভার

৯ আগস্ট, ১৯৭১

সংসদ ১৯ মার্চ শুরু হয় এবং ২৫ ও ২৬ মার্চ বাংলাদেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যা বিশ্বকে মর্মাহত করেছে। বাংলাদেশের জনগণ একই উদ্দেশ্য নিয়ে লড়ছে যার জন্য আপনি এবং আমি আমাদের দেশে একটা দীর্ঘ সংগ্রামের সময় অতিবাহিত করেছি।

বাংলাদেশের ঘটনা সঙ্কট সৃষ্টি করছে। ৭৩ লাখ মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার কারণে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমরা তাদের আমন্ত্রণ জানাইনি। কীভাবে আমরা তা করতে পারি? আমাদের নিজের দেশে অনেক কিছুর ঘাটতি আছে। সুতরাং, কিভাবে আমরা তাদের আসতে বলি? আমাদের নিজের জনগণের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এতে। এটা আমাদের কোনো দোষ না যে তারা এসেছেন। তারা তাদের দেশ ছেড়ে বিপদ পরে তাদের দুঃখ কষ্ট থেকে অব্যাহতি পাবার আশায় এখানে এসেছেন। এমনকি যাঁরা রাজনীতির সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিলোনা তাদেরকেও হত্যা করা হয়েছে। তাদের ঘর অগ্নিসংযোগ এবং নৃশংসতার সব প্রক্রিয়া তাদের উপর চালানো হয়েছিল।

আপনাদের মধ্যে কেউ যদি শরনার্থিশিবিরে যান তাহলে তাদের দুর্দশার চিত্র দেখতে পাবেন। যে যাবে সে বলবে না যে ভারত সরকার শরনার্থিদের ফেরত পাঠাতে চায়। কোন মানুষই, তার কোলে একটা বাচ্চা নিয়ে সমস্ত দিন ও রাত্রি কাদা ও পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা। কারণ দাঁড়িয়ে থাকবার জন্য কোন শুকনো জায়গা নেই। যদি থাকত তাহলে তারা স্বদেশই থাকতেন যদি সেখানে একটি বিশ্রামের জায়গা খুঁজে পান। কিন্তু, না। তাদের নিজের মাটিতেই তাদের উপর বর্বর শত্রুরা নৃশংসতা চালিয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি এই লক্ষাধিক লোককে ত্রাণ দিতে। আমরা তাদের বলেছি, আমরা তাদের শুধুমাত্র স্বল্প সময়ের জন্য রাখতে পারি। কোন দেশ অন্য কোন দেশ থেকে আসা এত মানুষের ভার বইতে সামর্থ নয়। আমাদের পক্ষেও সম্ভব না। আমরা বিশ্ববাসীকে এটা জানিয়েছি।

আপনারা জানেন যে আমরা যা বলি তা করি। কিন্তু কেউ কেউ মনে করেন যে, স্লোগান দিলেই যথেষ্ট। যারা সবসময় সত্যাগ্রহের বিপক্ষে ছিল তারাই বাংলাদেশ ইস্যুতে সত্যাগ্রহের সাথে যোগ দিয়েছেন। বর্তমানে সত্যাগ্রহের কোণ মানে নেই। সত্যাগ্রহের মূল্য ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়। যখন সত্যাগ্রহ জানত না যে তাদের ৭ বছর বা ১০ বছর কারাগার যাপন করতে হবে। সেটি ছিল সত্যাগ্রহের দিন। কিন্তু এখন উপহাস করা হচ্ছে। সত্যাগ্রহের লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান। আমরা কখনোই বলিনি যে আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবনা। সরকার সাবধানে সব দিক বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। এবং তখন সেটি আমাদের জনগণ দ্বারা সমর্থিত হবে। কিন্তু আমাদের ভাবতে হবে এটা আমাদের ও বাংলাদেশের উপর কোন প্রভাব ফেলবে কিনা।

আপনাদেরকে সত্যি বলছি, সরকার তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করবে। সরকার সব সময় এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করবে যা আমাদের জনগণের এবং বাংলাদেশর জন্য মঙ্গলজনক হবে।

আপত্তি আসতে পারে কেন আমি অন্য দেশের মানুষের কথা উল্লেখ করছি? কিন্তু সচেতন ভাবে খেয়াল করলে দেখবেন কিভাবে সেখানকার ঘটনা আমাদের ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে।

এমনকি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ আজ উদ্বাস্তুদের এই বিশাল অন্তঃপ্রবাহ বরণ করে নিবে না এবং তাদের সাহায্য দিতে প্রস্তুত হতে পারবেনা। আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলির মধ্যে অন্যতম। আমাদের পক্ষে এই বোঝা গ্রহণ করা খুব অস্বস্তিকর। একমাত্র পথ ছিল যে বর্ডারে ঢুকতে চাওয়ার সময় গুলি করার ভয় দেখানো। এছাড়া এত বিপুল সংখ্যক লোকের অন্তঃপ্রবাহ বন্ধ করার কোণ পথ ছিলোনা। এই সমস্যার আরেকটি দিক রয়েছে। আমরা জানি যে এই লোকগুলোকে ঢুকতে দেয়া না হলে তাদের দেশে তাদের হত্যা করে ফেলা হবে- এটা জেনেও কি আমরা না ঢুকতে দিতে পারি? আমরা নিশ্চই তাদের সাথে এমনটা করতে পারিনা। আমাদের ঐতিহ্য হল ভারত সবসময় আর্তপীড়িতদের পাশে থেকেছে তাতে আমাদের যত সমস্যাই হোক। আমরা যতোটুকু সম্ভব তাদের সাহায্য করছি এমনকি আমাদের জনগণও এইসব লোকদের জীবন বাঁচানোর জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমরা তাদের জন্য যথেষ্ট করতে পারছিনা।

আমরা অবশ্যই বাইরে থেকে সাহায্য চাই এবং আমরা কিছু পাচ্ছি। কিন্তু আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বুঝতে হবে যার উপর আমি জোর দিচ্ছি এবং আমাদের জনগণকে বলছি। আমাদের নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে এবং অন্যদের উপর নয়। যত কষ্টই হোক আমরা নিজেরা এই ব্যয় বহন করব এমনকি যদি কেউই আমাদের সাহায্য করতে না আসে। প্রশ্ন হল আমাদের বন্ধু আছে কিনা বা আমাদের সাহায্য করার মত কেউ আছে কিনা। আমাদের সাহায্য করার জন্য যদি কেউ আসে তাহলে আমরা কৃতজ্ঞ হব। কিন্তু আমরা অন্যদের উপর নির্ভর করতে পারি না।

আমি আমাদের বোঝা ঠিক কত বড় হবে সেই ব্যাপারে আমরা সজাগ আছি। আগেই বলেছি, এমনকি সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে ধনী দেশ এই ভারী বোঝায় বিচলিত হবে। আমরা ঠাট্টার স্বীকার হব কিন্তু আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছি কারণ আমরা জানি য়ে আমরা আমাদের ঐতিহ্য, আত্মসম্মান এবং ভাল প্রতিবেশীর প্রতি আদর্শ আচরণ করছি।

সামনের পথ অনেক কঠিন এবং সমস্যাপূর্ন। এটা অনেক বছর ধরেই এমন ভাবে চলছে। এবং এটি আরও বাড়তে পারে। কিন্তু আমি জানি, বড় অসুবিধায় আমাদের সাহস ও শক্তিও বড় হতে হবে। আমরা বিশ্বকে দেখাতে পারবে যে, দারিদ্র্য, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা এবং নিরক্ষরতা থাকা সত্ত্বেও আমাদের শক্তি আছে। অনেকে আমাদেরকে হুমকি দিয়েছে, অনেকে তাদের তরবারি উঁচিয়ে আছে। কিন্তু সেটা আমাদের পথ নয়। আমরা আমাদের করুন অবস্থা দেখিয়ে এইসব লোকদের গৌরবান্বিত বোধ করাতে চাইনা। আমরা জানি, যারা এই ধরনের হুমকি দিতে পারে তাদের বাস্তবে কোণ শক্তি নেই। তারা নিজেদের রক্ষা করার জন্য অজুহাত খুঁজে পেতে চেষ্টা করে। এই অবস্থা ভিন্ন কিছু জাতি ও আমাদের নিজেদের দেশের কিছু মানুষের সাথেও হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের ভয়ানক দুঃখভোগ চলছে। যদিও এই দেশে বাংলাদেশ ইস্যুতে অনেকে রাজনৈতিক ফায়দা করতে চেষ্টা করছেন। বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, আমি যদি আজ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে প্রয়োজন না মনে করি তার মানে এই না যে এই ইস্যুতে মতের ঐক্য ছিল না। আমি বলছিনা যে সেখানে দ্বিমত হতে পারে না। আমি শুধুমাত্র বলতে চাই এই মুহুর্তে সরকারকে কঠোর ও বাস্তব সম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এখন ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিতর্ক করে সরকারকে দুর্বল করে দেয়া ঠিক হবেনা। তাতে বিশ্ব শুধু অবাক হবে। আমাদের মিটিং এর অন্যতম উদ্যেশ্য ছিল এটা দেখানো যে ছোট ছোট রাজনৈতিক ইস্যু এই মুহুর্তে ভারতের কাছে কোন বিষয় না। ভারত ঐক্যবদ্ধ আছে এবং আমরা শক্তিশালী। আমাদের সরকার ও মানুষ কষ্ট করার জন্য প্রস্তুত আছে এবং আমাদের তার জন্য কঠিন ব্যাকিং আছে। তারা জানে যে তারা যদি সাহসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তার প্রভাব শুধুমাত্র আমাদের প্রতিবেশীদের রাষ্ট্রই নয় বরং সমগ্র বিশ্বে ছাপিয়ে যাবে। আমাদের শক্তি প্রয়োগ করে আমরা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাহস ও অনুপ্রাণিত করতে পারব। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল আমরা তাদের বুঝাতে পারি যে আমরা কোন পরিস্থিতিতেই দুর্বল না। এবং কোনো চাপ বা হুমকি আমাদের মনোভাব পরিবর্তন করতে বাধ্য করতে পারবেনা। আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের মানুষকে সাহায্য করা। পাশাপশি আমরা আমাদের নিজেদের জনগণকেও সাহায্য করব। আমাদের সারা দেশকে শক্তিশালী করতে হবে এবং এরপর আমরা আমাদের কার্যপ্রণালী অনুযায়ী এগিয়ে যেতে থাকব।