You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমি বাড়ীর সবাইকে নিয়ে পালিয়ে আশ্রয় নিলাম উল্লাপাড়া থেকে ৩ মাইল দূরে ভেংড়ী গ্রামে। আমাদের গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারই প্রায় আশ্রয় নিয়েছিল। হারিয়ে গেল আমাদের বাড়ীঘর আর গড়ে তোলা জনসেবা শিবির।

মা-বোনদের পল্লীতে রেখে পালিয়ে পালিয়ে উল্লাপাড়া এসে দেখলাম দস্যুরা বাঙ্গালী ভাইদের ধরে নিয়ে লুট করাচ্ছে ইচ্ছামত আবার গুলি করে বাঙ্গালী ভাইদের মারছে। বিকাল চারটার দিকে দেখতে পেলাম উল্লাপাড়ায় আগুনের লেলিহান, মনে হচ্ছে আগুনও যেন ওদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সমস্ত পাটের গুদাম, কলেজ, স্কুল, বাড়ীঘর দাউ দাউ করে জ্বলছে। মাঝে মাঝে শোনা যাচ্ছে মানুষের আর্তনাদ।

এই আগুনের লেলিহান ৩/৪ দিন উল্লাপাড়া, ঝিকিড়া, ঘোষগাতী, ঘাটিনা, চরঘটিনা ও অন্যান্য গ্রামকে এক এক করে গ্রাস করেছে, গাছপালাগুলো পুড়ে পুড়ে হা করে দাঁড়িয়ে আছে। এমন হয়েছে যেন উল্লাপাড়াতে একটা পাখি পর্যন্ত দস্যুদের দেখে ভয়ে সবাই পালিয়ে গেছে।
এইভাবে ৭ দিন কাটতে না কাটতেই একদল কুচক্রীর দল দস্যুদের পিছু নিয়েছে। তারাও যেন দস্যু হয়ে গেল। ১ মাসের মধ্যে দেখতে পেলাম দস্যুর দল বেশ ভারী হয়ে দানা বেঁধে উঠেছে। আমার বহু বন্ধুদের ধরে নিয়ে নিয়ে পাক দস্যুদের হাতে দিচ্ছে আর দস্যুদল আমার বন্ধুদের একটু একটু করে তিলে তিলে মেরেছে। বাঙ্গালী দস্যুদল ওদের নাম দিয়েছিল শান্তি কমিটি, শান্তির নাম নিয়ে কত মা-বোনকে যে ওদের হাতে তুলে দিয়েছে তার হিসাব নাই। এই শান্তি কমিটির নায়ক ছিল কয়েকজন স্থানীয় অবাঙ্গালী ও কয়েকজন বাঙ্গালী।

এইভাবে আমাদের স্মরণীয় দিনগুলো কাটতে লাগলো। ১ মাস,২ মাস কেটে গেল। স্বাধীন বাংলার খবর শুনি, বুকে একটু বল পাই। জুনের ২৭ তারিখ ভোর ৫ টার সময় দেখতে পেলাম একদল লোক ছুটে আসছে। ভাইরা মন্তব্য করল পাক মিলিটারী হতে পারে? দেখতে না দেখতে ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে গেল। সবাই ছুটে পালাতে লাগলাম কিন্তু হায় দেখি ভেংড়ী গ্রামের চারদিক দস্যুদল ও বাঙ্গালী দস্যুদল (শান্তি কমিটি) ঘিরে ফেলেছে। ছুটে গেলাম ব্যবসাইত পাড়ার ভিতর, ছোট জঙ্গলের ভিতর শুয়ে পড়লাম, কিন্তু দেখি আমাদের সুপরিচিত উল্লাপাড়ার কয়েকজন গুণ্ডা আমাকে দেখেই চিনে ফেলল। বলল শালা মালাউন পালিয়েছিস, বেরিয়ে আয়। নিরুপায় হয়ে এসে দেখলাম আমার বাবাকে ধরেছে, ভাইকে ধরেছে, বন্ধু অরুণকে ধরেছে, বন্ধু জীবনকে ধরেছে ও আর ৪ জনকে ধরেছে। দারুণ মার শুরু করে দিল। আমার বৃদ্ধ পিতাকে মারছে, বৃদ্ধ পিতা মার সহ্য করতে না পেরে আমার কোলে এসে আশ্রয় নিল। তখন আমাকে যে কতক্ষণ কি দিয়ে মেরেছে বলতে পারব না। ঘন্টাখানেক পরে জ্ঞান ফিরলে দেখলাম আমাদের সমস্ত জিনিসপত্র লুট করে এনে জড়ো করেছে এবং দস্যুদল খাওয়া দাওয়া করেছে। দস্যুদল খাওয়া শেষ করে আমাদের দড়ি দিয়ে বেঁধে টানতে টানতে ১২ মাইল হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে সলঙ্গা নামক স্থানে নিয়ে গেল। ওখানে দেখতে পেলাম ৭০/৮০ জন পাকদস্যু ট্রাক নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমাদের পেয়ে মনে হয় জীবিত মানুষগুলোকে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু দেখলাম আমাদের ট্রাকে তুলে উল্লাপাড়া ষ্টেশন ক্যাম্পে নিয়ে এলো। হাজার হাজার মিলিটারী দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে একজন পাক ক্যাপ্টেন বেরিয়ে এলো, বললো তোমাদের নাম লিখে দাও এবং একটি পেন ও ১ টি কাগজ দিয়ে গেল। লিখে দেওয়ার পর আমাদের চারহাত-বাই চারহাত ঘরে রেখে দিল। এমনকি দরজায় পর্যন্ত তারকাটা এঁটে দিল। মনে হলো আর কোনদিন দরজা খুলবে না। সারারাত্রি বসে বসে কাটাতে লাগলাম আর শুনতে পেলাম নারী কন্ঠের আর্তনাদ, বুকফাটা কান্না, চাবুকের সপাং সপাং শব্দ , মদ্যপানের জড়ান জড়ান কথা, শুনে মন ভয়ে শিউরে উঠল।

শুধু মনে হতে লাগল, এরা বেশী দিন টিকতে পারবে না। নারী ধর্ষনে কোন জাতি টিকতে পারে নাই, পারবেও না। এইভাবে সারা রাত্রি কেটে গেল। সকাল ৮টার সময় দরজা খুলে বের করল আমাকে নিয়ে গেল ক্যাপ্টেনের কাছে। ক্যাপ্টেন বলল জয়দেব কে? আমি বললাম আমার ছোট ভাই। সে কি করে? বি, এ পড়ে। কোন পার্টি করে? আওয়ামী লীগকে ভালোবাসে। সে কোথায়? বলতে পারব না। কেন পারবে না? জানি না। এই প্রশ্নের উত্তরে ক্যাপ্টেনের মুখ দিয়ে আগুন ছুটতে থাকলো। বললো যদি বাঁচতে চাও বল জয়দেব কোথায়। কিন্তু আমার একই উত্তর জানি না। নিজে রাগ সামলাতে না পেরে একজন জোয়ানকে ডাক দিল এবং বলল চাবুকে গায়ের চামড়া তুলে ফেলতে। জোয়ান চাবুক মারতে আরম্ভ করে দিল। ওদিকে আমার বাবা চিৎকার করছে, ওকে আর মের না, আমাকে মার। কখন জ্ঞান হারিয়ে গেছে, জানি না। জ্ঞান ফিরে দেখি উল্লাপাড়ার এক পরিচিত ঘরে বিচার হচ্ছে। আমার রক্তাক্ত দেহ দেখে কারও দয়া হল, কেই বলল ভালো, কেউ বলল কিছু খারাপ, এতে শাস্তি হলো, আবার ১০ বেত। আমার বাবাকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দিল। ছোট ভাইকে চাবুক মারল, জীবনকে চাবকাতে চাবকাতে গায়ের চামড়া ক্ষতবিক্ষত করে ফেলল আর আমার সেই সুপ্রিয় বন্ধু অরুণকে গুলি করে হত্যা করল। এদিকে আবার নতুন রাজাকার তৈরী করছে। বিচারে রায় দিয়েছিল উল্লাপাড়ায় থাকতে হবে নইলে গুলি করে মারবে। নজরবন্দী অবস্থায় থাকতে লাগলাম। এখন মনে হচ্ছে কেনই বা ওদের এত জয়দেবকে দরকার। জয়দেব আমার ভাই, আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী, উল্লাপাড়াতে যত বড় আওয়ামী লীগের নেতাই আসুক না কেন, জয়দেব কে সবাই চিনতো এবং ভালোবাসতো। সে একদিন বলেছিল আমি হয়তো থাকবো না কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। এতে কোন দ্বিমত নেই। কুচক্রীর দল সাবধান হয়েই থাকে। কিন্তু হায় জয়দেব আজ আর আমাদের সামনে নেই।

ক্ষতবিক্ষত দেহে বাড়ী ফিরলাম। নজরবন্দী অবস্থায় উল্লাপাড়ায় থাকতে লাগলাম। উল্লাপাড়ার দুঃখ দুর্দশা দেখে ঘরে বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদতাম।

আমি দেখেছি প্রতিদিন পাক সৈন্যরা কোথা থেকে যুবক ধরে এনে মুক্তিবাহিনীর নাম দিয়ে বহু যুবককে গুলি করে মেরেছে। একদিন দেখতে পেলাম একটি যুবককে ধরে এনে আমার বাড়ীর পিছনে গুলি করে চলে গেল কিন্তু যুবকটির পেটের পার্শ্বে গুলি লেগেছে। সে শুধু বলছে আমার হাত টা ছেড়ে দেও, আমি বাঁচব,আমি কোন অপরাধ করিনি। যদি বাঁচতে না দাও আর একটা গুলি করে মেরে ফেল, যন্ত্রণা সহ্য হচ্ছে না। কিন্তু কোন লোক তাঁর কথায় কান দিল না। অবশেষে সন্ধ্যায় যুবকটি আর্তনাদ করতে শুরু করল- একটু পানি দেও, কেউ একটু পানি দাও। কিন্তু কেউ সাড়া দিল না। কারণ দস্যুদের পা-চাটা গোলাম রাজাকারদের পাহারায় রেখেছিল যেন যুবকের মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তার পাহারায় থাকে। সন্ধ্যার পর রাজাকারদের বেয়নেটে তার প্রাণ হারায়, তার স্মৃতি চিহ্নস্বরূপ সেই অন্তিম স্থানের নাম দেওয়া হয়েছে “মা পানি জনপথ “।

স্বাক্ষর/-
শ্রী রথিকৃষ্ণ সাহা
উল্লাপাড়া
পাবনা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!