প্রতিকার চাই, প্রতিশােধ চাই
পাক-সৈন্যদের মতিগতি সুবিধের নয়। ওরা কান্ড-জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মানছে না সীমান্ত আচরণবিধি। পাক-ভারত সীমান্তের পাঁচ কিলােমিটারের মধ্যে কোন পক্ষের সৈন্যদল থাকার কথা নয়। কিন্তু পাক-সৈন্যরা এখন নিষিদ্ধ অঞ্চলে হামেশাই ঢুকছে। তাদের নিক্ষিপ্ত গােলা এসে পড়ছে ভারতীয় এলাকায়। ইতিমধ্যেই দুজন ভারতীয় সীমান্তের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে করছিল বেপরােয়া গুলীবর্ষণ। তাদের গােলাগুলী পড়েছে ভারতীয় গ্রামগুলাের উপর। সন্ত্রস্ত গ্রামবাসীরা বাড়ীঘর ছেড়ে নিয়েছিলেন কড়া নােট। তারা চেয়েছেন, ইসলামাবাদের কাছে সদাচারের প্রতিশ্রুতি। নইলে সম্ভাব্য পরিণামের পুরাে দায়িত্ব বর্তাবে পাকিস্তানের উপর। বেশ কিছুদিন ধরেই ইসলামাবাদ চালাচ্ছেন ভারতের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক এবং প্রচার সংগ্রাম। এখন তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে কামানের আক্রমণ। কূটনৈতিক এবং প্রচার যুদ্ধের মােকাবিলা কূটনৈতিক এবং প্রচার মাধ্যমে সম্ভব। বুলেটের লড়াইএ তা সম্ভব নয়। ভারত এখন আসন্ন দুর্যোগের সম্মুখীন। গত ক’সপ্তাহে অনেক নােটই নয়াদিল্লী পাঠিয়েছেন ইসলামাবাদে। কোন আমল দেননি ইয়াহিয়া খান। তার মুখে এক কথা—পূর্ববাংলা শান্ত। ভারতীয় জওয়ানরা অনুপ্রবেশ করেছেন তার জমিদারীতে। জনা কয় বাঙালী দুষ্কৃতকারী তাদের সহযােগী। তাই ছােটখাট হাঙ্গামা চলছে পূর্ববাংলার বিক্ষিপ্ত অঞ্চলে। সারা দুনিয়া পাক-প্রচার বিশ্বাস করুক বা না করুক, তাতে কিছু যায় আসে না। ইয়াহিয়া তার নিজের কথা বলবেন। তার মিথ্যার জোয়ারে কোনদিন ভাটা পড়বে না। নয়াদিল্লীর কড়া নােটের পিছনে যদি বলপ্রয়ােগের সুনিশ্চিত হুমকী এবং প্রস্তুতি না থাকে তবে ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্তরা অবস্থার গুরুত্ব বুঝবেন না। ক’সপ্তাহ আগে অধহৃত ভারতীয় রক্ষীদের ফেরত পাঠাবার দাবী করেছিলেন নয়াদিল্লী। কি উত্তর তারা পেয়েছেন তা পাক-বেতার ভাষ্যেই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রক্ষীদের ফেরত পাঠানাে তাে দুরের কথা, তাদের ঘিরে পাকিস্তান ফেলছে অপপ্রচারের ব্যাপক জাল। দুটি ভারতীয় কোম্পানী নাকি নিশ্চিহ্ন করেছে পাক-সৈন্যদল। তাদের হাতে বন্দি হয়েছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা। বনগাঁ এবং ত্রিপুরা সীমান্তে পাক-সৈন্যদের গুন্ডামী হয়ত চেপে যাবেন ইয়াহিয়া খান। তাঁর প্রচারযন্ত্র ধরলাে উল্টো সুর। যারা ভাবছেন, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে ভারতের প্রত্যক্ষ যােগাযােগ প্রমাণের জন্য পাকিস্তান দিচ্ছে যুদ্ধের উস্কানী। ওরা চায় নয়াদিল্লীকে ফাঁদে ফেলতে। সুতরাং সন্তর্পণে গা বাঁচিয়ে চলতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। শত প্ররােচনা সত্ত্বেও ভারতকে থাকতে হবে নিরপেক্ষ। বিশ্বের সামনে তাকে সাজতে হবে ভাল মানুষ এবং গােবেচারী। এ ধরনের চিন্তাধারা এবং মানসিক ক্লৈব্য রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পরিপন্থী। ভারতের নিরাপত্তার পক্ষেও বিপদজনক। যত দিন যাব মুক্তিযােদ্ধাদের তাৎপরতা ঘাড়ের উপর। যুদ্ধের ঝুঁকি এড়াতে পারবেন না নয়াদিল্লী।
স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব। ভারতের স্বার্থেই তার দৃঢ় প্রতিষ্ঠা একান্তভাবে কাম্য। বড় বড় রাষ্ট্রের মুখ চেয়ে বসে থেকে লাভ নেই। মুজিবরের চেয়ে ইয়াহিয়া বৃটেনের রক্ষণশীল সরকারের কাছের লােক। বাংলাদেশের বৃটিশ জঙ্গী এবং পারস্য উপসাগরের তৈল-স্বার্থ রক্ষণের জন্য তাদের দরকার স্বৈরাচারী ইয়াহিয়া খানের জাতীয়তাবাদী মুজিবরের নয়। আমেরিকার চোখের সামনে ভাসছে পাক-ভারতের শক্তি-সাম্যের প্রশ্ন। বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে গেলে পাকিস্তান হবে দুর্বল। ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে তখন ভারতের বিরুদ্ধে শক্তিসাম্যের প্রশ্ন। বাংলাদেশ হাতছাড়া হয়ে গেলে পাকিস্তান হবে দুর্বল। ইয়াহিয়া খানকে নিয়ে তখন ভারতের বিরুদ্ধে শক্তিসাম্যের খেলা চলবে না। পশ্চিম এশিয়ায় মিশর-ইস্রাইলের শক্তিসাম্য অক্ষুন্ন রাখার ইঙ্গ-মার্কিন পায়তারা থেকে নয়াদিল্লীর শিক্ষা নেওয়া উচিত। ভৌগলিক কারণে সােভিয়েট রাশিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতি বেশী আগ্রহশীল। বাংলাদেশ অনেক দূরে। এখানে চীনা অনুপ্রবেশ বন্ধের জন্য যতটুকু কূটনৈতিক তৎপরতা দরকার তার বেশী সে হয়ত প্রথম পর্যায়ে করবে না। বৃটেন এবং আমেরিকাও এ সম্পর্কে সচেতন। তারা চাইবে আপাতত স্থিতাবস্থা এবং পরে পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের কনফেডারেশন। বাস্তব অবস্থার সঙ্গে বৃহৎ শক্তিগুলাের রাজনৈতিক পরিকল্পনার মিল নেই। পাক-বাহিনীর গণহত্যা এবং ব্যাপক ধ্বংসলীলার পর স্থিতাবস্থা অসম্ভব। স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত লড়াই থামবে না। লক্ষ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে ভারত পড়বে মহাফ্যাসাদে। সম্ভাব্য বিপদ এড়াবার একমাত্র উপায় বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতিদান এবং তাদের জয়যাত্রার পথ সুগম করে তােলা। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী ছুটির শেষে দিল্লী ফিরে এসেছেন। চার সপ্তাহ চলে গেছে। আর বিলম্ব নয়। অবিলম্বে বাংলাদেশকে দিতে হবে কূটনৈতিক স্বীকৃতি। মনে রাখতে হবে ইসলামাবাদের নােটের উত্তর নয়াদিল্লীর নােট। আর তাদের কামানের গােলার উত্তর পাল্টা গােলা। ভারতীয় মাটিতে পড়ছে পাকিস্তানি গােলা। ভারতীয় নাগরিকদের খুন মিশেছে বাঙালী শহীদদের খুনের সঙ্গে। এর প্রতিকার চাই—প্রতিশােধ চাই।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ এপ্রিল ১৯৭১