You dont have javascript enabled! Please enable it!
ঈশ্বরদী থানা আই কে সড়ক অ্যামবুশ
ভূমিকা
ঈশ্বরদী থানা পাবনা জেলার উত্তরে অবস্থিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকশী থেকে ঈশ্বরদী যাতায়াতের জন্য একমাত্র পাকা রাস্তা ছিল আই কে সড়ক। এ রাস্তার সাইকগাড়ি থেকে চরসাহারপুর পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা অ্যামবুশের জন্য অবস্থান গ্রহণ করেন। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক. শত্রুবাহিনী: ১ কোম্পানি (+)। খ. মুক্তিবাহিনী: মুক্তিযােদ্ধার সংখ্যা ৩০০জন আনুমানিক। যুদ্ধের বর্ণনা ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় লােক মারফত জানতে পারেন। যে পাকিস্তানি সেনারা পাংশা থেকে নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী যাবে। এ তথ্যের উপর ভিত্তি করে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের অ্যামবুশ করার পরিকল্পনা করে এবং ১১ ডিসেম্বর সকাল থেকে মুক্তিযােদ্ধারা আই কে সড়কের উভয় পার্শ্বে অ্যামবুশ পেতে পাকিস্তানি সেনাদের অপেক্ষায় থাকেন। তারা আই কে সড়কের ৩টি স্থানে অ্যামবুশ পাতেন। স্থান ৩টি হলাে চরসাহারপুর, জয়নগর ও সাইকগাড়ি। পাকিস্তানি সেনারা পাংশা থেকে নদী পার হয়ে ঈশ্বরদী অভিমুখে যাত্রা করে। পথিমধ্যে তারা প্রথমে চরসাহারপুর ও জয়নগরে মুক্তিযােদ্ধাদের অ্যামবুশে পড়ে। এতে প্রথমে তাদের ৩জন ও পরে ৫জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধা সেলিম, মােস্তফা এবং পরে ইস্রাফিল ও নূর মােহাম্মদ শহিদ হন। এরপর পাকিস্তানি সেনারা ঈশ্বরদী থেকে ১ মাইল দূরে অবস্থানরত সেনাদের সহায়তায় একযােগে সাইকগাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে প্রতিআক্রমণে লিপ্ত হয় এবং তারা আশপাশের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। 
যুদ্ধে ৭জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধা আব্দুর রহিম ও কফিল উদ্দিন শহিদ হন। এরপর পাকিস্তানি সেনার ঈশ্বরদীতে অবস্থান নেয়। বিশ্লেষণ/বিজয়ের কারণ ও পর্যালচনা। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি হয়। যদিও মুক্তিযােদ্ধারা আপ্রাণ চেষ্টা করেন। পাকিস্তানি সেনাদের ঈশ্বরদী গমনকে প্রতিহত করতে, কিন্তু শেষ পর্যায়ে নিমােক্ত কারণে তা সম্ভব হয় নি। ক. প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযােদ্ধারা তেমন সংঘবদ্ধ ছিলেন না, এমনকি তাদের অস্ত্রবলও তেমন সুসংগঠিত ছিল না। ফলে সুসংগঠিত ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাহিনীকে প্রতিরােধ করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। খ, যেহেতু পাকিস্তানি সেনাদের একটা অংশ আগে থেকেই ঈশ্বরদীর অদূরে অবস্থানরত ছিল, তাই সাইকগাড়িতে পাকিস্তানি সেনারা তাদের সহায়তা পায় এবং দ্বিগুণ উৎসাহে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। গ. প্রাথমিক পর্যায়ে তথা চরসাহারপুর ও জয়নগরে মুক্তিযােদ্ধারা কিছুটা
সফল হলেও পরবর্তী সময় তাদের সফলতা ধরে রাখতে পারে নি। যেহেতু তাদের সহায়তা করার কেউ ছিল না বা গােলাবারুদের স্বল্পতা সফলতাকে স্তিমিত করে। শিক্ষণীয় বিষয় যুদ্ধে যতই মনােবল থাকুক না কেন, শক্তিবৃদ্ধি যুদ্ধের একটি বিরাট দিক, যা যুদ্ধের জয়-পরাজয়কে নির্ধারণ করতে পারে। এ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিবৃদ্ধির জন্য জনবল, অস্ত্রবল ও গােলাবারুদ কিছুই ছিল না। তাই তাদের পক্ষে দীর্ঘসময় যুদ্ধে টিকে থাকা ছিল দুরূহ ব্যাপার।
উপসংহার 
এ যুদ্ধ সাধারণ মানুষের মনে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দেয়। দীর্ঘ ৯ মাস তৎকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর অসহনীয় অত্যাচার এবং বর্বরােচিত হত্যাকাণ্ডে মানুষ যখন অতীষ্ঠ প্রায়, তখন এখানকার দামাল ছেলেরা ঈশ্বরদীর রাজপথের এ যুদ্ধক্ষেত্রে পাকিস্তানি হায়েনাদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। কিন্তু স্বল্প অভিজ্ঞতা এবং সহযােগিতার অভাবে তারা এ যুদ্ধে তেমন কোনাে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি তথাপিও এলাকার মানুষের মনে তারা স্বাধীনতার আলােকছটা। আর বন্দি জীবনের অবসানের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন।
সুজানগরের যুদ্ধ
ভূমিকা
সুজানগর থানা এলাকায় ২টি খণ্ডযুদ্ধ সংঘটিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে ৯ মাস সুজানগর থানা সদর ছাড়া সমগ্র এলাকাই ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে। এ এলাকার বেশিরভাগ অংশ জুড়েই আছে পদ্মা নদীর চর ও গাজনা বিল। যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং মুক্তিযােদ্ধাদের আধিপত্যের কারণে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের অধিকাংশ সময়ই এ এলাকায় তৎপর ছিল না। মূলত থানা সদর এলাকা পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা নিয়ন্ত্রণ করত।
পটভূমি
দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর উপর তেমন কোনাে আক্রমণ রচনা করেন নি। তবে নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযােদ্ধারা যখন যৌথভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর উপর আক্রমণ শুরু করে, তখন সুজানগর থানায় উপস্থিত মিলিশিয়া ও কিছুসংখ্যক রাজাকার সশস্ত্র হয়ে পড়ে। মুক্তিযােদ্ধারা গােপন সূত্রে জানতে পারেন যে, সুজানগরের পাকিস্তানি বাহিনী কিছুদিনের মধ্যেই থানা ছেড়ে পাবনা সদরে চলে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে স্থানীয় ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল অধিনায়ক মােস্তফা কামাল দুলালের নেতৃত্বে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা নেয়। সে মােতাবেক ১৪ ডিসেম্বর তারা থানা অভিযানের পরিকল্পনা করে।
ভূমির পরিচিতি
সুজানগর থানা সদর দপ্তর বিল্ডিং আবাসিক এলাকা ও বাজারসংলগ্ন বিধায় এটা বসতি এলাকার মতােই। থানা বিল্ডিংটি সুজানগর-পাবনা সড়কসংলগ্ন এবং রাস্তার উত্তর দিকে অবস্থিত। থানার উত্তরেই সুজানগর হাই স্কুল বিল্ডিং অবস্থিত এবং থানার দক্ষিণ এলাকায় কোনাে বাড়িঘর নেই। এলাকাটি বাংলাদেশের অন্যান্য এলাকার মতােই খােলামেলা।
যুদ্ধের সংগঠন
যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ:
ক. পাকিস্তানি বাহিনী: ১৬জন মিলিশিয়া, ৩জন অবাঙালি পুলিশ, ১১জন রাজাকার।
খ. মুক্তিবাহিনী: ১৬জন ইপিআর, ৫০জন আনসার, ১০০জনের বেশি সাধারণ মুক্তিযােদ্ধা। যুদ্ধের বিবরণ ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনী আনুষ্ঠানিভাবে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসররা বিচলিত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা নিজেদের গুটিয়ে নিতে সচেষ্ট হয়। সুজানগরের ক্ষেত্রে একই ঘটেছে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা গােপন সূত্রে জানতে পারেন। যে, সুজানগর থানায় অবস্থিত মিলিশিয়া পুলিশ ও রাজাকাররা যে-কোনাে সময় রাতের আঁধারে পলায়ন করে পাবনা সদরে চলে যাবে। তথ্যটি জানার পর থেকে স্থানীয় ১৭জনের ১টি মুক্তিযােদ্ধা দল অধিনায়ক মােস্তফা কামাল দুলালের নেতৃত্বে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ৯ ডিসেম্বর থানা আক্রমণের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা মনিখাট-দাসপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একত্র হন। অতঃপর ৯-১০ ডিসেম্বর রাতে সমবেত মুক্তিযােদ্ধারা খণ্ড খণ্ড দলে মাথুরাপুরে গমন করে। সেখানে থানা আক্রমণের পরিকল্পনা সম্বন্ধে দলনেতা দুলাল মুক্তিযােদ্ধাদের ব্রিফিং প্রদান করেন। তিনি সবাইকে জানিয়ে দেন, তার ফায়ার সিগন্যাল অনুযায়ী সকাল ৬টায় আক্রমণ রচনা করা হবে।
কিন্তু ১০ ডিসেম্বর ৫টা ৪১ মিনিটে অন্য কারাে ভুলের জন্য সিগন্যাল ছাড়া ফায়ার শুরু হয়। ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা যুদ্ধ চলতে থাকে, তখন পরিকল্পনা হয়, ১৩ ডিসেম্বর রাতে থানার এক পাশ খুলে দেওয়া হবে। এ সময় প্রচণ্ড গােলাগুলির সময় অধিনায়ক দুলাল যিনি এ যুদ্ধের সার্বিক পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন, তিনি পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শহিদ হন। ১৩ ডিসেম্বর ভােরে থানার দক্ষিণ পার্শ্বে খুলে দেওয়া হয়, যে পথ ধরে পাকিস্তানি সেনারা পালাতে থাকে। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় জনগণকে নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসরদের হত্যা করে। তবে কিছুসংখ্যক শত্রু পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়নে সুজানগর থানা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে মুক্তিযােদ্ধা দুলালের জীবনের বিনিময়ে। আজও থানার পাশে শহিদ দুলালের কবর সবাইকে স্মরণ করিয়ে দেয় এ বীর মুক্তিযােদ্ধার আত্মত্যাগের কথা। শিক্ষণীয় বিষয়।
ক. সাহসিকতা: সুশিক্ষিত পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহসিকতাই এ যুদ্ধে বিজয়ের মূল কারণ।
খ. সঠিক পরিকল্পনা অধিনায়ক মােস্তফা কামাল দুলালের নিখুঁত পরিকল্পনা এ যুদ্ধে বিজয়ের কারণ।
উপসংহার
সুজানগর থানার মুক্তিযুদ্ধ শুধু জেলা নয়, সমগ্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে একটি স্মরণীয় অধ্যায় রচনা করেছে। স্বাধীনতার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এ এলাকার জনগণ তাদের জীবন বাজি রেখে স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালনের ক্ষেত্রে সুজানগর যুদ্ধ আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
কালিয়া হরিপুরে অ্যামবুশ
ভূমিকা
বর্তমান সিরাজগঞ্জ শহর শত্রুমুক্ত হওয়ার দিন এ যুদ্ধটি সংঘটিত হয়। পাকিস্তানি বাহিনী তাদের পতন নিশ্চিত জেনে ১৯৭১ সালের ১৩ ডিসেম্বর ভােরবেলা সিরাজগঞ্জ শহর ছেড়ে চলে যাওয়ার পথে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পিছু ধাওয়া করে। মুক্তিযােদ্ধারা বুঝতে পেরেছিলেন যে, এটাই তাদের শেষ সুযােগ এবং তারা সে সুযােগের সদ্ব্যবহার করেছিলেন। পলায়নরত পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে না পারলেও তাদের গাড়ি ও গােলাবারুদের যথেষ্ট ক্ষতি করতে সক্ষম হন। এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তিযােদ্ধারা এটা প্রমাণ করেন যে, তাদের যুদ্ধ করার মনােবল তখনাে শেষ হয়ে যায় নি। পটভূমি ১৩ ডিসেম্বর সকালে খােকশাবাড়ি হাসপাতালে মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্পে স্থানীয় লােকজন এসে খবর দেয় যে, পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাচ্ছে। তখন মাে. আলাউদ্দিন (মুক্তিযােদ্ধা নম্বর ০৩১২০১০২১০) তাঁর দল (মােট ১৬জন) নিয়ে শক্রর পিছু ধাওয়া করার পরিকল্পনা করেন। জায়গার বর্ণনা ও ভূমির রূপ। এ গ্রামটি বর্তমান সিরাজগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার কালিয়া হরিপুর ইউনিয়নে অবস্থিত। এটি সিরাজগঞ্জ জেলা শহর থেকে ৪ কিলােমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এ গ্রামটি সিরাজগঞ্জ জেলার অন্যান্য গ্রামের মতােই। গ্রামে ছিল প্রচুর গাছপালা ও চাষাবাদের জমি। গ্রামগুলাে চাষাবাদের জমি থেকে ৪-৫ ফুট উঁচুতে অবস্থিত। সিরাজগঞ্জ জেলার সদর থানা হওয়ায় যােগাযােগ ব্যবস্থা।
অনেক সহজ ও উন্নত ছিল। যুদ্ধের সংগঠন। যুদ্ধের সংগঠন নিম্নরূপ: ক, পাকিস্তানি বাহিনী: ৪৫জন, অস্ত্র (২টি এসএমজি, ৩৩টি জিএফ | রাইফেল, ৪টি এমজি, ৬টি এসএমজি, ২টি ৩ টনি লরি, ১টি জিপ)। খ. মুক্তিবাহিনী: ১৬জন, অস্ত্র (২টি এসএমজি, ১টি এলএমজি, ১০টি ৩০৩ রাইফেল, ৩টি দোনলা বন্দুক)। শত্রুপক্ষের অবস্থান পাকিস্তানি সেনারা সিরাজগঞ্জ শহর থেকে রেলযােগে কামারখন্দ যাওয়ার পথে কালিয়া হরিপুরের রেলওয়ে কালভার্ট ভাঙা থাকার কারণে সেখানে নামতে বাধ্য। হয়। পরে কালিয়া হরিপুর থেকে ২টি ৩ টনি লরি ও ১টি জিপ নিয়ে কামারখন্দ যাওয়ার জন্য রওনা হয়। কামারখন্দে মুক্তিযােদ্ধাদের ধাওয়া খেয়ে পুনরায় রাস্তাযােগে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। এ অবস্থায় পুনরায় তারা যখন কালিয়া হরিপুরে ফিরে আসে, তখন তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালানাে হয়। যুদ্ধের বর্ণনা। বর্তমান সিরাজগঞ্জ শহরের পতনের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী ১৩ ডিসেম্বর ভােরের দিকে সিরাজগঞ্জ শহর থেকে পাবনার দিকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। মুক্তিযােদ্ধারা খুব ভােরেই পাকিস্তানি বাহিনীর পালিয়ে যাওয়ার খবর জানতে পেরে সম্ভাব্য রাস্তার উপর নজর রাখেন। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল জানতে পারে যে, পাকিস্তানি বাহিনী রেলযােগে সিরাজগঞ্জ থেকে ঈশ্বরদীর দিকে রওনা হয়েছে। কামারখন্দ যাওয়ার পথে মুক্তিযােদ্ধাদের ধাওয়া খেয়ে পুনরায় গাড়িযােগে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশ্যে রওনা এ যুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করেন তারা হলেন: ১. মাে, শুকুর আলী ২. গাজী সানাউল্লাহ (নম্বর ৬৬৮০৫০৫ এএসসি সেন্টার, পাকিস্তান) ৩. আজমল। ৪, হারুন অর রশিদ। ৫. শেখ আলাউদ্দিন (অধিনায়ক) ৬, আব্দুল জলিল প্রমুখ।
মুক্তিযােদ্ধারা শহরে প্রবেশ করার পর খবর পান যে, পাকিস্তানি বাহিনী। পুনরায় সিরাজগঞ্জ শহরে প্রবেশ করছে। তাই তাঁরা শহর থেকে কালিয়া হরিপুরের দিকে রওনা হন। মুক্তিযােদ্ধারা কালিয়ার হাটে সমবেত হন এবং পাকিস্তানি বাহিনীকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা করেন। এ সময় মুক্তিযােদ্ধারা ২ ভাগে বিভক্ত হয়ে দুই দিকে রওনা হন। এক দলকে কালিয়া হরিপুর রেল স্টেশনে পাঠানাে হয়, তারা প্রবল যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে। অন্য দলটি কালিয়া হরিপুরের কাছাকাছি পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহরের উপর আক্রমণ করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গাড়িবহরে ছিল ২টি ৩ টনি লরি এবং একটি জিপ। মুক্তিযােদ্ধারা গাড়িবহরের সামনে থাকা জিপের চাকায় গুলি করে জিপটিকে অকেজো করে দেন। এ সময় তাড়াহুড়া করে গাড়ি ঘােরানাের চেষ্টা করতে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর একটি ৩ টনি লরি রাস্তা থেকে পড়ে যায় । কিন্তু পাকিস্তানি বাহিনী বাকি একটি ৩ টনি লরি উল্টাদিকে ঘােরাতে সক্ষম হয় এবং কামারখন্দে পালিয়ে যায়। এ অবস্থায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১টি জিপ এবং একটি ৩ টনি লরি ফেলে যেতে বাধ্য হয়।
এ যুদ্ধে উভয় পক্ষেই কোনাে ক্ষতি হয় নি। তবে ১জন অসামরিক ব্যক্তি শহিদ হন। পাকিস্তানি সেনাদের কাছ থেকে কিছু মূল্যবান হাতিয়ার যেমন: ২টি এমজি, ১০০টি গ্রেনেড, ১টি জিপ এবং ১টি ৩ টনি লরি উদ্ধার করা হয়। এ যুদ্ধের স্থায়িত্ব ছিল ২ ঘণ্টা। রেল স্টেশনে মুক্তিযােদ্ধাদের যে দলটি আক্রমণ চালায়, তারা সেখান থেকে ২টি কামান উদ্ধার করে । ঐ দিনই সিরাজগঞ্জ শহর শত্রুমুক্ত হয় এবং শহিদ মিনারে স্বাধীন বাংলার পতাকা ওড়ানাে হয়।
বিশ্লেষণ/বিজয়ের কারণ ও পর্যালােচনা
ক, এ অ্যামবুশে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয়ের কারণ ছিল মুক্তিবাহিনীর মনােবল, ধৈর্য ও অসীম সাহসিকতা। খ. মুক্তিযােদ্ধারা বিস্ফোরক ব্যবহারে পারদর্শিতা অর্জন করার ফলে কালভার্টসহ বিভিন্ন প্রকার ব্রিজ ধ্বংস করতে সক্ষম হন। গ, সিরাজগঞ্জ জেলার বেশিরভাগ এলাকায় নদী থাকার কারণে পাকিস্তানি সেনাদের যাতায়াতে যথেষ্ট অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এটা সুবিধার কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল। শিক্ষণীয় বিষয়। ক. শত্রুকে সমূলে ধ্বংস করতে হলে দরকার পলায়নরত শত্রুকে পিছু। ধাওয়া করা এবং সময়-সুযােগমতাে কঠিন আঘাত হানা।
খ. দেশকে শত্রুমুক্ত করতে হলে দরকার অপরিসীম ধৈর্য ও কঠিন মনােবল। যে দেশের মানুষ দেশকে মুক্ত করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে পারে, সেখানে বিজয় অনিবার্য। উপসংহার। যে-কোনাে যুদ্ধ জয়ের পিছনে ধৈর্য ও মনােবলের ভূমিকা অপরিহার্য যা আমরা দেখতে পাই কালিয়া হরিপুরের অ্যামবুশে। সেনাবাহিনীর সদস্য গাজী সানাউল্লাহ এ যুদ্ধে অসীম বীরত্বের পরিচয় দিয়ে যুদ্ধকে সহজতর করেছেন। মুক্তিবাহিনীর মনােবল, ধৈর্য, সাহসিকতা, সময়ের উপযুক্ত ব্যবহার, নিজস্ব কার্যে পারদর্শিতা এবং সর্বোপরি দেশের প্রতি অপরিসীম ভালােবাসাই জয়কে অনিবার্য করেছে।
২০ জানুয়ারি।
জানুয়ারি জয়পুরহাট চিনিকলের শ্রমিকেরা সংগঠিত হয়ে বিরাট মিছিল বের করে। এ মিছিলের ফাকে শহরের প্রধান সড়কে অবস্থিত মুসলিম লীগের অফিসে ব্যাপক ভাঙচুর করা হয়। এ ঘটনার পর শহরে আন্দোলনের সূচনা হয়।
ফেব্রুয়ারি। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এর চেতনায় মুক্তিপাগল বাঙালিরা সর্বত্র আন্দোলনের জন্য জেলায় জেলায় পাড়ায় পাড়ায় নিজেরা সুসংগঠিত হচ্ছিল।
মার্চ। | ১ মার্চ : প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করলে সারা দেশের মতাে জয়পুরহাটেও জনমনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এ দিন সঙ্গে সঙ্গে মাহতাব উদ্দিনের নেতৃত্বে ডাক্তার আবুল কাশেম ময়দানে সকাল ১০টার সময় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং পাকিস্তানি সরকারের
বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়। | ৩ মার্চ : রাজশাহী টেলিফোন ভবন ঘেরাও। ১জন শহিদ ও বহু আহত
হয়। এ দিন পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। কারফিউ ভঙ্গ করে
জনতা মিছিল বের করে। ৫ মার্চ : গুলির্ষণের প্রতিবাদে ভুবনমােহন পার্কে আওয়ামী লীগের
প্রতিবাদ সভা। পাঁচবিবি ফুটবল মাঠে স্মরণকালের বৃহত্তম প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের
নেতারা বক্তব্য রাখেন। ৭ মার্চ : যার যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবেলা করতে হবে’ –
বঙ্গবন্ধুর এ ঐতিহাসিক ভাষণের পর স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্রজনতার বিক্ষোভ চলতে থাকে। জয়পুরহাটে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। রাজশাহী শহর থেকে সান্ধ্য আইন তুলে নেয়া হয় ।
১১ মার্চ : এ এইচ এম কামরুজ্জামান ভুবনমােহন পার্কে ভাষণ দেন।
এবং এখানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ টেপ রেকর্ডারে বাজানাে হয়। জনতা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে চারদিক কাপিয়ে
তােলে। | ১২ মার্চ : ওস্তাদ আবদুল আজিজ বাচ্চুসহ অন্যান্য শিল্পী স্বাধীনতার
স্বপক্ষে রাজশাহীর বিভিন্ন রাস্তায় গণসংগীত পরিবেশন
করেন। | ১৩ মার্চ : তঙ্কালীন স্থানীয় প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ।
জরুরি সভা আহ্বান করে দেশকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাত
থেকে রক্ষার জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৭ মার্চ
রাজশাহীতে আবদুল কুদুস ও সারিফ উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে স্বাধীন বাংলা ছাত্র পরিষদ গঠন করা হয়। আহ্বায়ক
হলেন আব্দুল কুদ্ছ ও সারিফ উদ্দিন। ২৩ মার্চ : এত কাল দিনটি পাকিস্তান দিবস হিসেবে উদ্যাপিত হতাে।
ঐ দিবসে সবুজের মধ্যে লাল বৃত্ত এবং মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত পতাকা উত্তোলনের জন্য কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদ থেকে নির্দেশ আসে। এর পর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হলে প্রশাসন ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। সরকারি কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে চাঁদা আদায় ও খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে বণ্টন এবং তাদের স্বাভাবিক। কার্যাদি পরিচালনায় সহায়তা ও সুযােগ প্রদান করা হয়। সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পতাকা উত্তোলন করা হয় । অনুষ্ঠানে স্থানীয় জয় বাংলা বাহিনীর সদস্যরা কুচকাওয়াজ
প্রদর্শন করেন। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি চক্রের সন্ত্রাসী আক্রমণের মুখে পট পরিবর্তনের
ফলে যে স্বাধিকারের আন্দোলন শুরু হয়, তাতে জয়পুরহাটের সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণ ছিল সারা দেশের জনগণের মতােই। ক. রাজধানী ঢাকা পাকিস্তানি হানাদারদের আক্রমণের স্বীকার
হলেও নওগাঁ মুক্ত ছিল প্রায় ১ মাস যাবৎ। খ. পাকিস্তান বিমানবাহিনী বগুড়া শহর ও সন্নিহিত এলাকায়। বিমান হামলা চালায়। এ সময় সম্মিলিত মুক্তিবাহিনী আড়িয়াবাজার পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্যাম্পে হামলা করে।
গ. পাকিস্তানি বাহিনী শহরে প্রবেশ করে এবং ঘাঁটি স্থাপন
করে তৎকালীন আবাসিক শিল্প নগরীতে। ঐ রাতেই টেলিফোন অফিস, হিসাবরক্ষণ অফিস ও ট্রেজারি অফিস দখল করে নেয় এবং সমস্ত শহরে কারফিউ জারি করে। রাজশাহী জেলায় রাস্তায় রাস্তায় মিছিল চলতে থাকে। রাতে ভুবনমােহন পার্কে মঞ্চস্থ হয় নাটক ‘রক্ত কথা বলে’। এ রাতেই ঢাকার মতাে এখানেও রাস্তায় রাস্তায়
নেমে আসে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা। ২৬ মার্চ : ঢাকার সাথে অন্যান্য অঞ্চলের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে
সে সময় নওগাঁর তরুণ সংগ্রামীরা প্রকাশ করে স্বাধীন বাংলার। প্রথম দৈনিক পত্রিকা ‘ইশতেহার’। শাহিনগরে অবাঙালি ও বাঙালিদের সংঘঠিত সহিংস ঘটনায় বহু অবাঙালি প্রাণ হারায়। পাবনায় দেশের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা
নিরূপণের জন্য একটি গােপন সভার ব্যবস্থা করা হয়।  ২৭ মার্চ : পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ ব্যারাকে যায় এবং পুলিশদের
অস্ত্রাগার তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। পুলিশ এতে অসম্মতি জানান এবং স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন যে, ডিসি তাদের অস্ত্রাগার সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দিতে
নিষেধ করেছেন। | ২৮ মার্চ : ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন সকাল ১০টায় নওগাঁ থেকে তাঁর
বাহিনী নিয়ে যাত্রা করে সন্ধ্যার দিকে বগুড়া পৌঁছে যান এবং বগুড়া পুলিশ লাইনের সাথে যােগাযােগ স্থাপন করেন। পাকিস্তানি সেনারা পাবনা জেলা মুক্তিযােদ্ধা সংগ্রাম কমিটির সদস্য অ্যাডভােকেট আমিনউদ্দিন এমপি, বিশিষ্ট ডা. অমলেন্দু দাক্ষী, রাজনীতিক আবু সাঈদ তালুকদারসহ বহু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে হত্যা করে। ২৭জন সৈন্য টেলিফোন
এক্সচেঞ্জ দখল করে পাহারা দিয়ে চলেছিল। ২৯ মার্চ : পাবনা শত্রুমুক্ত হলাে। ৩০ মার্চ : রহমতুল্লাহ সম্পাদিত “দৈনিক জয় বাংলা’ প্রকাশিত হতে
থাকে। এটি নওগাঁর দ্বিতীয় পত্রিকা। এ দিন পাবনা সম্পূর্ণ
স্বাধীন হয়। ৩১ মার্চ : ৩১ মার্চ থেকে বেড়ায় প্রশিক্ষিত-অপ্রশিক্ষিত তরুণ।
মুক্তিযােদ্ধা এবং অনুরূপভাবে পাবনা শহর, সুজানগর,
সাঁথিয়া, শাহজাদপুর প্রভৃতি এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী, পুলিশ, আনসার, এলাকার জনগণ, বগুড়া থেকে আগত ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা সবাই মিলে। নগরবাড়ি ঘাটে দ্বিতীয় দফা পাকিস্তানি সেনা প্রবেশের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়তে শুরু করে।
এপ্রিল ১০ এপ্রিল : পাকিস্তানি সেনাদের এক বিশাল বাহিনী ব্যাপক অস্ত্রশস্ত্রে
সজ্জিত হয়ে পাবনার নগরবাড়ি ঘাটে এসে পৌছায়। নগরবাড়ি ঘাটের প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানি বাহিনী তাদের ঘাটি গুটিয়ে কাশীনাথপুর ও বেড়ার মাঝখানে পাইকারহাটি ও ডাববাগান নামক স্থানের সদর রাস্তার দুই পাশে অবস্থান নিয়ে রাস্তার দুই পাশে বাংকার খোঁড়া শুরু করে। ১১ এপ্রিল নগরবাড়ি ঘাট পার হয়ে আসা বিশাল পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণের মুখে বাকি মুক্তিযােদ্ধারা নগরবাড়ি ঘাট ত্যাগ করে কাশীনাথপুর ও বেড়ার মাঝখানে পাইকারহাটি ও ডাববাগান নামক স্থানে সদর রাস্তা বরাবর প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি
করেন। ১৭ এপ্রিল : ১৭ এপ্রিল পর্যন্ত পুলিশ ও ইপিআররা তাদের প্রতিরােধ
অক্ষুন্ন রাখে। এ সময় ভেড়ামারা ও আশপাশের এলাকা। থেকে পালা করে তাদের জন্য রুটি ও অন্যান্য খাবার সরবরাহ করা হতাে। ১৭ এপ্রিলের পর পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে।
তারা পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হয়। ১৯ এপ্রিল : | ১৯ এপ্রিল দুপুরবেলা পাকিস্তানি বাহিনী ২টি দলে বিভক্ত হয়ে
ডাববাগান ঘাটি আক্রমণ করে। পাকিস্তানি সেনাদের ১টি দল সড়ক ধরে এবং অপর দলটি পিছন দিক থেকে আক্রমণ। চালায়। প্রতিরােধ বাহিনীর কিছুসংখ্যক সদস্য ঐ সময় বাংকারে সতর্ক প্রহরায় নিয়ােজিত ছিলেন। বাকিরা গােসল ও দুপুরের আহারে ব্যস্ত। ঘটনাটি দেখার পর ঘাটিতে যিনি যে অবস্থায় ছিলেন, সে অবস্থাতেই তিনি হাতে তুলে নিলেন। অস্ত্র । পাকিস্তানি সেনারা প্রতিরােধ বাহিনীর অবস্থানের প্রায় কাছাকাছি এলে অতর্কিতে দুই দিক থেকে আক্রমণ চালানাে। হলাে। প্রথম আঘাতেই ১৫-২০জন পাকিস্তানি সৈন্য ধরাশায়ী।
হলেও দক্ষ ও সুশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনারা অসম্ভব ক্ষিপ্রতার সাথে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে নিমেষে পরিস্থিতি নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসে।
২১ এপ্রিল :ক্যাপ্টেন গিয়াসের নেতৃত্বে রাজশাহীর মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতায় নওগাঁর মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানিদের তৎকালীন। শক্ত ঘাঁটি রাজশাহী সেক্টর আক্রমণ করেন এবং বহু পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেন।
 
২২ এপ্রিল :নাটোর থেকে অগ্রসর পাকিস্তানি বাহিনী নওগাঁ অধিকার করার আগে সান্তাহার রেল জংশনের নাম পরিবর্তন করে শাহিনগর নামকরণ করে। নওগাঁ শহরে আকালু নামের পাগল শহরের লর্ড লিটন ব্রিজের পূর্ব পাশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সামনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান উচ্চারণ করতে থাকলে তাকে সেখানে ব্রাশ ফায়ার করে যমুনা নদীতে নিক্ষেপ করা হয়। তাঁর বয়স ছিল ১৯ বছর।
২৩ এপ্রিল: পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নওগাঁয় মােহনপুর গ্রামের সিরাজুল ইসলাম, মখরপুর গ্রামের আব্দুল রাজ্জাক, দশপাইকার গ্রামের বাচ্চু ও মমতাজ উদ্দিন শহিদ হন। এঁদের লাশের কোনাে সন্ধান পাওয়া যায় নি। সিরাজের ভাই শহিদ হন, একই দিনে পাকিস্তানি বাহিনী মাধাইমুরী গ্রামের বিশিষ্ট সমাজসেবী আলিম উদ্দিন খাকে। নির্মমভাবে হত্যা করে। একই সাথে মিলন ও আলীম শাহাকে (পিতা-পুত্র) হত্যা করে।
২৪ এপ্রিল : ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বালুঘাট, বাঙ্গালিপুর, টিয়ারা পাড়া ও মধুপুরের ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের প্রস্তুতি চলতে থাকে। এসব ক্যাম্পে ১ মাস ১৫ দিন করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে। পাকিস্তানি বাহিনী সাঁথিয়ার পাথাইলহাট গ্রামে নিপীড়ননির্যাতন চালায় এবং আগুনে পুড়িয়ে দেয় পুরাে গ্রাম।
২৫ এপ্রিল : পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ করে কুমরিয়া, জাফরাবাজ, নক্ষণপুর, মােহনপুর, হাপানিয়া, একডালা ও মাধাইমুরী গ্রামে। অগ্নিসংযােগ করে, চালায় হত্যাকাণ্ড। নওগাঁ জেলার পিরােজপুর, খিদিরপুর, চণ্ডিপুর, রানীনগর থানার ত্রিমােহনী, বলিরঘাট, শিমুলিয়া, ইলিশাবাড়িসহ সুলতানপুর গ্রাম থেকে পাকিস্তানি বাহিনী লােকজনকে ধরে এনে দোগাছি গ্রামের দক্ষিণপাড়া বধ্যভূমিতে হত্যা করে। নওগাঁ জেলার তিলকপুর
ইউনিয়নের ফতেহপুর গড়ের হাটে ১৩জনকে পাকিস্তানি বাহিনী হত্যা করে।
৩ মে ১২ মে
: এ দিন পাকিস্তানি বাহিনী সর্বপ্রথম সুজানগর প্রবেশ করে। : সুজানগরের বিভীষিকাময় সাতবাড়িয়া গণহত্যা সংঘটিত হয়। ১২ মে। মুক্তিযােদ্ধাদের একটি নিরাপদ ঘাটি ছিল এখানে। আমিন উদ্দিন খান রাজাকারের সহযােগিতায় পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি কনভয় হঠাৎ করে গ্রামে ঢুকে পড়ে যােদ্ধাঅযােদ্ধা পরিচয়ে কয়েক’শ লােককে হত্যা করে। আগুন দিয়ে
জ্বালিয়ে দেয় পুরাে গ্রাম। : ধামুইরহাটে পৃথক পৃথক ২টি অপারেশন চালিয়ে মুক্তিবাহিনী
১জন পাকিস্তানি অফিসারসহ তাদের বেশ কয়েকজন সহযােগীকে হত্যা করে।
১৯ মে
|
৯ জুন
জুন। : নওগাঁর মুক্তিবাহিনী চকের ব্রিজ ও বগুড়া জেলার আদমদিঘির
রেলসেতু ডিনামাইট দিয়ে ধ্বংস করে দেয়। রেলসেতু ধ্বংস হবার সময় মুক্তিযােদ্ধা সুজিত শহিদ হন ।
জুলাই ১০ জুলাই : মধইল নামক স্থানে মকাই চৌধুরীর নেতৃত্বে পাকিস্তানি
বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে তাদের ৬জনকে হত্যা
করা হয়। ১৬ জুলাই : পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে রানীনগর থানার তিলাবুদু গ্রামে
প্রবেশের সংবাদ পেয়ে ওহিদুর রহমান ও আলমগীরের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাদের উপর আক্রমণ চালায়, ফলে শত্রুপক্ষের ২টি নৌকা ডুবে যায় এবং ৪জন পাকিস্তানি সেনা পানিতে ডুবে মারা যায়।
১৪ আগস্ট
আগস্ট : পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস। এ দিন নওগাঁ থানার হাপুনিয়া
মহাসড়কে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা শক্তিশালী ডিনামাইটের আঘাতে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি জিপ ধ্বংস হলে ৫জন। পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।
সেপ্টেম্বর। ৬ : ৬ সেপ্টেম্বর রাতে কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা তল্কালীন গণসংগীত সেপ্টেম্বর শিল্পী পাবনার গােলাম সরােয়ার সাধনসহ সাগরকান্দির এক
বাড়িতে অবস্থান নিলে স্থানীয় রাজাকারদের হাতে ধরা
পড়েন। | ১৯ :
বান্দাইখাড়া গ্রামের উপর পাকিস্তানি বাহিনী নদীপথে ১১টি সেপ্টেম্বর। নৌকাযােগে হামলা চালায়। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে
অগ্নিসংযােগ, লুটপাট ও নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী প্রায় ৫০জন যুবক ও যুবতীকেও আটক করে।
নওগাঁর আশপাশের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় সেপ্টেম্বর আত্রাই, রানীনগর, শাহাগােলা ও ছাতিয়ান গ্রামের প্রায় দেড়
শতাধিক রাজাকার নিহত ও আহত হয়।
সােনাতলা উপজেলা সদরে অবস্থিত প্রাইমারি ট্রেনিং সেপ্টেম্বর
ইনস্টিটিউটে পাকিস্তানি বাহিনীর ২ শতাধিক সৈন্যের ক্যাম্প ছিল। পরিকল্পনা মােতাবেক মােখলেছুর রহমান, আ. হামিদ, মাে. মকবুল হােসেন, খন্দকার মকবুল হােসেন, মাে. শাহজাহান সাজু, আনােয়ার হােসেন ফিরােজ, এ টি এম জুলফিকার প্রমুখের নেতৃত্বে ৫ শতাধিক মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পের পশ্চিম দিকে রেললাইনের পিছনে এবং দক্ষিণে চামড়া গুদামের আশপাশে অবস্থান নেন। আনুমানিক রাত ২টায়।
মুক্তিযােদ্ধারা ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ শুরু করেন। ৩০ : মােখলেছুর রহমান রাজার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী বাগমারা সেপ্টেম্বর। থানার নিকরা ও বাইগাছায় রাজাকারদের ২টি শক্তিশালী
ক্যাম্প ধ্বংস করে দেয়। এতে বহু রাজাকার নিহত ও আহত
|
২৫ অক্টোবর
অক্টোবর : মৈনম উচ্চ বিদ্যালয়ে রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ
করার লক্ষ্যে মৈনমের ৩টি সড়কের পৃথক পৃথক জায়গায় মুক্তিবাহিনী শক্তিশালী মাইন স্থাপন করে।
নভেম্বর। ৭ নভেম্বর : পাকিস্তানি বাহিনী জয়বাংলাহাট ও পারবােয়ালিয়া গ্রাম
আক্রমণ করে বেশ কিছু অসামরিক নিরীহ লােককে হত্যা করে।
গাবতলী সদর থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর ১টি প্লাটুন। নভেম্বর।
সারিয়াকান্দি অভিমুখে রওনা হয়। মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এ বিষয়ে পূর্বেই গােয়েন্দা তথ্য ছিল। তথ্য মােতাবেক অধিনায়ক মাে. মােখলেছুর রহমান এবং অধিনায়ক আবদুস সবুর সওদাগরের নেতৃত্বে ৫০-৬০জনের ১টি দল নেপালতলী।
ব্রিজের পূর্ব পার্শ্বে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৪ : ১৪ নভেম্বর মুক্তিযােদ্ধাদের ১টি দল সাঁথিয়া পাইলট উচ্চ নভেম্বর। বিদ্যালয়ে অবস্থিত রাজাকার কাম্পে হামলা চালায়। রাত
২টা-৪টা পর্যন্ত চলে যুদ্ধ। পরাস্ত হয় রাজাকাররা। এখানে। মুক্তিযােদ্ধারা হত্যা করেন রাজাকার অধিনায়ক আব্দুস সামাদ
ফকিরসহ ৯জনকে এবং ১৪টি অস্ত্র দখল করে নেন। ১৫ : মাে, আব্দুল জলিল এবং ৭ নম্বর সেক্টর অধিনায়ক যৌথভাবে নভেম্বর।
বর্তমান যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে গভীরভাবে বিচারবিবেচনা করে তাদের রণকৌশল পরিবর্তন করে মুক্তিযােদ্ধাদের কিছুটা রদবদল করে সরাসরি থানা আক্রমণ ও দখল করার নির্দেশ দেন।
নওগাঁ সদর থেকে ৩৩ মাইল দূরে নিয়ামত থানার উপর। নভেম্বর। ভােররাতে মুক্তিযােদ্ধারা আক্রমণ চালান। বেশ কয়েক ঘণ্টা
যুদ্ধ চলার পর রাজাকার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর কাছে। আত্মসমর্পণ করে।
০৩ ডিসেম্বর
ডিসেম্বর। : বগুড়া মহাসড়কে মাঝিড়া বাজারের উত্তরে সকাল ১০টায়
বগুড়া থেকে ঢাকাগামী ১টি পাকিস্তানি সেনাবাহী গাড়ির উপর জহুরুল ইসলাম, এ এফ এম আবুল ফজল ও নজীবুর রহমানের ৩টি দল অ্যামবুশ করে। এতে অসংখ্য পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। গাড়ির ভিতর থেকে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিবর্ষণে মুক্তিযােদ্ধা শ্রী ধীরেন কুমার শহিদ হন। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ৭ ডিসেম্বর সাঁথিয়া শত্রুমুক্ত হয়।
| ৭ ডিসেম্বর।
৮ : ৮ ডিসেম্বর সকাল ১০টায় সংঘাত শেষে পাকিস্তানি বাহিনী। ডিসেম্বর ১টি ট্রাক ও জিপ ফেলে পিছু হটে পাবনা চলে যায়।
১০ : ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা ডিসেম্বর। মুক্তিযোেদ্ধা দল কর্তৃক সন্ধ্যায় এক আকস্মিক আক্রমণের
শিকার হয়। সারারাত প্রচণ্ড সংঘর্ষ অব্যাহত থাকে এবং
পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে বহু হতাহত হয়। ১১ : আদমদিঘি উপজেলা সদরে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে ডিসেম্বর
| মুক্তিযােদ্ধাদের এক সংঘর্ষ হয়। ১১ ডিসেম্বর মুক্তিযােদ্ধারা
সুজানগর থানায় অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ। করার পরিকল্পনা করেন।
পূর্বপরিকল্পনা মােতাবেক মাে. আবু বক্কর সিদ্দিকের নেতৃত্বে ডিসেম্বর ৩৫জন মুক্তিযােদ্ধার সমন্বয়ে গঠিত ১টি দল তিন দিক থেকে
পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পটি ঘিরে ফেলে। ২টি এলএমজি, ১২টি এসএমজি, বেশ কিছু রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড ইত্যাদি অস্ত্রে সজ্জিত দলটি পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে গুলিবিনিময় করে। ফলে ভাের ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর পুরাে দলটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও তাদের ১জন সদস্য ধরা। পড়ে এবং ৮০-৮৫জন রাজাকার সদস্য আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
বেতার তরঙ্গ মাধ্যমে খবর এলাে যে, পাকিস্তানি বাহিনী। ডিসেম্বর
আত্মসমর্পণ করেছে অবশেষে বাঙালি জাতি পেলাে তার বহু।
আকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। | ১৮ : সকালবেলা ভারতীয় মেজর চন্দ্রশেখর মিত্রবাহিনী ও ডিসেম্বর
মুক্তিবাহিনীসহ নওগাঁয় প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর তখন আর কিছুই করার ছিল না। ফলে প্রায় ২ হাজার পাকিস্তানি সেনা নওগাঁ কে ডি স্কুল ও সরকারি গার্লস স্কুল থেকে শুরু করে থানা চত্বর, এসডিও অফিস চত্বর থেকে রাস্তার দুই পাশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে অবনত মস্তকে আত্মসমর্পণ করে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!