You dont have javascript enabled! Please enable it! ভারতের পুঁজিপতিরা স্বাধীনতা চায়নি। মুজিবনগর সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত। - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের দ্রুত শক্তি বৃদ্ধির আরেকটা কারণ ‘৪৭ সালের দেশ ভাগের পর প্রতিষ্ঠিত হিন্দু ভূস্বামী ও মহাজনের দল বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যায় এবং সেখানে ধীরে ধীরে মুসলমান কৃষিজীবী শ্রেণী থেকে একটি গ্রাম্য পাতি  বুর্জোয়া শ্রেণী তৈরি হয়। পাকিস্তানের তৎকালীন দুই অংশে সমস্বার্থ ভিত্তিক জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণী অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের উদীয়মান পুঁজিপতিদের সংগে গ্রাম্য পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর আপাত মিলন ঘটে এবং পাকিস্তানী ও অবাঙালি মুসলিম বৃহৎ পুঁজির বিরুদ্ধে তারা আওয়ামী লীগের ভিতরে শক্তিশালী ঐক্য গড়ে তােলে। শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠিত শহুরে পুঁজিপতি শ্রেণী ও এলিট ক্লাসের নেতা। কিন্তু তার আপােষবাদী নীতি ব্যর্থ হওয়ায় তাঁর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে যে নতুন শ্রেণী-চরিত্রের বিকাশ ঘটে তাতে গ্রাম্য পাতি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে আগত ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবি মানুষ ও শ্রমিক নেতাদের প্রধান্য বিস্তৃত হয় এবং শেখ মুজিবের অ-শহুরে দৃঢ়তা, সাহস ও সংগ্রামী মনােভাবের মধ্যে তারা তাদের প্রকৃত নেতৃত্বের সন্ধান লাভ করে। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর আওয়ামী লীগ ছিল শহুরে, মার্জিত নিয়মতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। তাতে প্রাধান্য ছিল শহুরে এ্যলিট শ্রেনীর। তারা চাপ প্রদানের এবং মােটামুটি সুবিধা আদায় ও ক্ষমতা ভাগাভাগির রাজনীতিতে আস্থাবান ছিলেন; কোন বড় রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তন ও সামাজিক বিপ্লবে বিশ্বাসী ছিলেন না। বরং শঙ্কিত ছিলেন। আওয়ামী লীগে যতই মিলিট্যান্ট গ্রামীন পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর  প্রাধান্য বাড়তে থাকে, ততই এরা কার্যত আওয়ামী লীগের সংশ্রব এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। শহীদ সােহওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান। খান থেকে শুরু করে বহু প্রতিষ্ঠিত শহুরে নেতা যে পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগে আসতে চাইলেন না, তার মূল কারণও এখানেই। তারা রাজনীতির সহজ, শান্ত, পরিচিত ও পীচঢালা সমতল রাস্তা ছেড়ে অপরিচিত, অনিশ্চিত আন্দোলনের অন্ধকার পথে পা বাড়াতে রাজি ছিলেন না।  আমি বিস্ময়ের সংগে লক্ষ্য করেছি, যাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শেখ মুজিব যখন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে অত্যন্ত অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা, তখনাে শহরে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী সাধারণভাবে শিক্ষিত সমাজে তিনি ছিলেন বহুলভাবে সমালােচিত। শিক্ষিত শ্রেণী কখনােই তার নেতৃত্বকে বিনাদ্বিধায় বিনাশর্তে মেনে নেয়নি – এমনকি তার জনপ্রিয়তার জোয়ারের যুগেও নয়। 

এখানে ১৯৬৭ সালের একটা ঘটনা বলি। ১৯৬৭ সালের গােড়ায় ছয়দফা কর্মসূচি প্রচারের জন্য শেখ মুজিব বাংলাদেশে ঝটিকা-সফরে ব্যস্ত। মােনেম খানের পুলিশ তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ১৭ই এপ্রিল খুলনায় বিরাট জনসভা। আমিও গিয়ে হাজির হলাম ঢাকা থেকে খুলনায়। শেখ মুজিবের সভায় জনসমুদ্রের ঢল দেখে বিস্মিত হলাম। সন্ধ্যায় খুলনা থেকে যশােরে ফিরলেন শেখ মুজিব। সংগে সংগে তাকে গ্রেফতার করা হল। খুলনার শিরিন হােটেলে বসে খবরটা শুনেই শেখ মুজিবের উপর একটা কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা বােধ করলাম। সংগে সংগে লিখে ফেললাম: ’সিংহকে শিকলে বাঁধে শৃগালে দল ’পুরাে কবিতাটি আজ আর মনে নেই। সংগেও নেই। কবিতাটা নিজের কাছে ভালাে লেগেছিল। তাই ভাবলাম, দৈনিক ইত্তেফাকে’ ছাপতে দেব। ইত্তেফাক তখন ছ’দফা আন্দোলন সমর্থন করতে শুরু করেছে। ইত্তেফাকের’ সম্পাদক মানিক মিয়া তখন জীবিত এবং তার বড় ছেলে মঈনুল হােসেন বিলেত থেকে। ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরেছে। শেখ মুজিবকে সে কাকা ডাকে। তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তার চাইতেও বেশি।কিন্তু কবিতাটি ইত্তেফাকে ছাপা হল না। মঈনুল আপত্তি জানাল । আমার সংগে দেখা হতেই সে বললে : শেখ মুজিবকে অত বড় করে দেখিয়ে কবিতা লিখছেন কেন? ব্যক্তি নিয়ে নয়, আন্দোলন নিয়ে কবিতা লিখুন। তখন এই শিক্ষিত, মার্জিত সদ্য বিলাতফেরত তরুণের কথা ভালাে লেগেছিল। কিন্তু অনেক পরে যখন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শ্রেণী-চরিত্র নিয়ে ভাবতে বসেছি, তখন এই ঘটনাটা আরেক তাৎপর্য নিয়ে আমার কাছে ধরা পড়েছে। এই তাৎপর্য হল, মুজিবের এত ঘনিষ্ঠ পরিবারের শিক্ষিত ও শহুরে আলাে হাওয়ায় মানুষ তরুণটিও তার নেতৃত্ব বিনাদ্বিধায় মেনে নিতে রাজি নয়। অথচ এই মঈনুল যখন পরবর্তীকালে ১৯৬৯ সালে ‘ইত্তেফাক অফিসে বসে আমাকে জানালে যে, সে এবং তার মত একদল শিক্ষিত মার্জিত শহুরে আইনজীবি শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তখন প্রশ্ন না করে পারিনি যে, রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব সম্পর্ক তাদের এতদিনের যে পােষিত ধারণা, অর্থাৎ নেতা বিলেত ফেরৎ উচ্চ শিক্ষিত হবেন, শহুরে জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হবেন, পাশ্চাত্য রাজনৈতিক ধ্যান ধারণার অনুরাগী হবেন, তার কোনটাইতাে শেখ মুজিব নন, তিনি একেবারেই গ্রামীন বাংলার প্রতিনিধি; তখন তার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগে যােগ দেওয়ার জন্য শহুরে আইনজীবি সমাজে এত সাজ সাজ রব কেন? মঈনুলের কাছ থেকে সেদিন আমার প্রশ্নের জবাব পাইনি ।

কিন্তু ঢাকার একদল তরুণ আইনজীবী যখন আওয়ামী লীগে যােগ দিলেন, শুধু যােগ দেওয়া নয়, তাদের কেউ কেউ আওয়ামী লীগের অর্ধশিক্ষিত এবং শহুরে আদব-কায়দায় অভ্যস্ত নয় এমন কর্মীদের সংগে গাড়িতে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে রাজনৈতিক প্রচারণায় ছুটাছুটি শুরু করলেন, তখন মনে হয়েছিলাে, শেখ মুজিব শেষ পর্যন্ত বুঝি শহুরে এ্যালিটু ও পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর কাছেও গ্রহণযােগ্য হলেন। কিন্তু আমার এ ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের মত শেখ মুজিবের নেতৃত্বও যে বাংলাদেশের চরিত্রহীন পাতি বুর্জোয়াদের এবং পাতি বুর্জোয়া শ্রেণী থেকে তৈরি চরিত্রহীন বুদ্ধিজীবীদের কাছে নিজেদের প্রয়ােজন পূরণের সাময়িক হাতিয়ার মাত্র এবং প্রয়ােজন পুরণ হওয়ার সংগে সংগে মুজিব নেতৃত্ব ও জাতীয়তাবাদ – এ দুই হাতিয়ারই তারা দূরে নিক্ষেপ করবেন, এই সত্য দেশ স্বাধীন হওয়ার কিছু পরেই আমাদের অনেকের কাছে ধরা পড়ে এবং আগের বিভ্রান্তি কাটতে শুরু করে। তখন বুঝতে দেরি হয়নি, পাকিস্তানের পতন এবং ক্ষমতার হাত বদল অনিবার্য বুঝেই বাংলাদেশের শহুরে পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীর চতুর অংশ সংগে সংগে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানের সাময়িক পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশ রাজত্বের অবসান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা দেখা দিতেই বৃটিশ-ঘেঁষা নাইট নবাব খান বাহাদুরের দল এমন কি স্যার ফিরােজ খান নুনের মত বৃটিশ সেবাদাস যেমন রাতারাতি বৃটিশের দেওয়া খেতাব বর্জন করে মুসলিম লীগে ঢুকেছিলেন, ১৯৭০ সালেও তেমনি বাঙালি শিক্ষিত সুবিধাভােগী শ্রেণীর একটা বড় অংশ রাতারাতি আওয়ামী লীগে নাম লিখিয়ে মডারেট থেকে তথাকথিত র‍্যাডিকাল হয়ে ওঠেন। এদের এই রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে বাইরের গােপন নির্দেশ ও ইংগিত যে ছিল, মুজিব বেঁচে থাকতে তা তিনি নিজেও জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু ড. কামাল হােসেন ৰা ড. নুরুল ইসলাম, রেহমান সােবহান সহ অর্থনীতিবিদের আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন একটি উল্লেখযােগ্য ব্যতিক্রম হিসেবে আমি সবসময় বিবেচনা করেছি। তাদের ভূমিকাকে আমি কখনাে মঈনুলদের ভূমিকার সংগে এক করে দেখিনি। 

চুয়াত্তর সালের ১৩ই জুন তারিখে ঢাকার সচিবালয়ে তাই বিরূপ নয়, সহানুভূতির মনােভাব নিয়েই ড. নুরুল ইসলামের কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম। পরিকল্পনা কমিশনের বিরুদ্ধে তখন আক্রমণ শুরু হয়েছে। মজার ব্যাপার, এই আক্রমণে যুক্তভাবে অংশ নিয়েছে ‘ইত্তেফাক’ এবং ‘হলিডে’ পত্রিকা। আক্রমণ চলছে অথমন্ত্রণালয় এবং অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনের উপর। পাশ্চাত্য পত্রিকায় প্রচার চলছে এটা ব্যুরােক্রাটও টেকক্রাটদের লড়াই। কিন্তু মুজিব-হত্যার সুপরিকল্পিত ব্লুপ্রিন্ট অনুসরণ করেই যে এই আক্রমণের সূচনা, তা বােঝার মত দূরদর্শিতা তখন আওয়ামী লীগের নেতাদের কারাে মধ্যেই দেখা যায়নি। পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ড. নুরুল ইসলাম বিরক্ত এবং বিমর্ষ। সংগে কমিশনের সদস্য রেহমান সােবহান। তিনি ক্ষুব্ধ। পরিকল্পনা কমিশনের বিরুদ্ধে তখন চারদিক থেকে আক্রমণ শুরু হয়েছে। শুধু ‘হলিডে’ আর ইত্তেফাক পত্রিকা নয়, আওয়ামী লীগের ডানপন্থী এবং বামপন্থী যুব অংশের কিছু নেতাও শুরু করেছেন সমালােচনা। ড, ইসলাম বললেন, সরকারি চাকরির বাধ্যবাধকতা মেনে নিয়ে এসব সমালােচনা ও কুৎসার প্রকাশ্য জবাব দিতে আমরা পারি না। এখানেই আমরা ঠেকে গেছি। তাই আপনাদের মত দু’একজন সাংবাদিককে ডেকে আমাদের বক্তব্য জানাতে চাই।  প্রথমেই তিনি বললেন, রক ফসফেট আমদানী করা নিয়ে কেলেঙ্কারি ও পরিকল্পনা কমিশনের ভূমিকার কথা। একটা ফাইল ও দেখালেন। তাতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রকের অফিসার ও মন্ত্রীদের মন্তব্য। ফাইলটি দেখে বুঝতে বাকি রইল না, প্রশাসনিক ব্যাপারে একেবারেই অনভিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের মন্ত্রী হিসেবে পেয়ে কিছু কিছু চতুর আমলা তাদের যা খুশি বুঝিয়ে হাত করেছেন এবং পরিকল্পনা কমিশনের বিরুদ্ধে তাদের মনকে বিষিয়ে তুলছেন। এভাবে ধীরে ধীরে পরিকল্পনা কমিশনের সমস্ত প্লান পরিকল্পনা ভণ্ডুল করা এবং তাদের এফেকটিভনেস্ ধ্বংস করাই ছিল এই আমলাদের লক্ষ্য। তাতে তারা ক্রমশ সফলও হচ্ছিলেন।রক ফসফেটের কথা নজির হিসেবে বলি। আন্তর্জাতিক বাজারে এক ফসফেটের দাম বাড়বে এবং একটিমাত্র দেশ মনােপলি ব্যবসায়ের সুযােগ নিয়ে। চড়াদর হাকবে এ সম্পর্কে পরিকল্পনা কমিশন আগেই সরকারকে সর্তক করে দিয়েছিলেন। কিন্তু মন্ত্রীসভার বৈঠকে যখন প্রসঙ্গটি উঠলাে, তখন আলােচনার জন্য অগ্রাধিকার পেল বেবি ফুড়। কারণ, মন্ত্রীসভার অনেক সদস্যই জানেন না, রক ফসফেট কি এবং দেশের কৃষি উন্নয়ন ও অন্যান্য ব্যাপারে তার প্রয়ােজন কি?

তখন দেশে বেবি ফুডের কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে দুনীতি পরায়ন ব্যবসায়ীরা  অফিসারদের যােগসাজসে দু’হাতে টাকা লুটছে। পঁয়ত্রিশ টাকার বেবি ফুডের কৌটা বিক্রি হচ্ছে দেড়শাে টাকায়। ক্ষমতাসীন দলের কিছু কিছু টাউট এবং ব্রিফকেস-সর্বস্ব ব্যবসায়ীও এই লুটের ভাগিদার। সুতরাং বেবি ফুড আমদানীতেই লাভ বেশি। কিছু অফিসার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বােঝালেন,পরিকল্পনা কমিশনের কর্তারা অর্থনীতির ডাক্তার। বড় ডিগ্রি নিয়ে এসেছেন বটে, রােগ বােঝেন না। এখন বেবি ফুডের ক্রাইসিস না কাটাতে পারলে বঙ্গবন্ধুর সরকার মানুষের কাছে হেয় হয়ে যাবেন। এই সাধারণ কথাটা পরিকল্পনা কমিশনের ডাক্তারেরা বােঝেন। তারা বেশি মাথা ঘামাচ্ছেন রক ফসফেট নিয়ে। মন্ত্রীসভার এক বৈঠকেও এ নিয়ে হাসাহাসি হল । ড. নুরুল ইসলাম ও তার সহকর্মীদের চুপ থাকতে হল। কিন্তু সত্য সত্যই যখন রক ফসফেটের দাম বাড়লাে এবং বােঝা গেল বাংলাদেশের জন্য এই দাম বাড়ার পরিণাম কি, তখন শুরু হল পরিকল্পনা কমিশনের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড়। রেহমান সােবহান নিবিষ্টমনে আমাদের কথা শুনছিলেন। তাকে বললাম আপনি কি বলেন? সােবহান বললেন : আমি কি বলবাে? বললাম : ১৯৭০ সালে আপনাকে বাঙালি পাতি বুর্জোয়াদের সম্পর্কে একটা প্রশ্ন করেছিলাম, আপনার মনে পড়ে? সােবহান আপনাদের পরিকল্পনা কমিশনের ব্যর্থতা যদি কোথাও থাকে, তা পরিকল্পনা প্রণয়নে নয়, বাঙালী পাতি বুর্জোয়ার চরিত্র-বিশ্লেষণে। এই চরিত্র আপনারা আগে ঠিক ভাবে বুঝতে পারেননি; বিশ্লেষণও করতে পারেননি।  

১৯৭০ সালের কথাটাও এখানে বলি। বাংলাদেশ তখন স্বাধীন হয়নি। পাকিস্তান অখণ্ড এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্টের গদীতে। তখন পার্লামেন্ট নেই। সুতরাং অর্থমন্ত্রী নবাব মুজাফফর আলি কিজিলবাস সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বাজেট ঘােষণা করেন। রাওয়ালপিন্ডিতে ওই বাজেট মিটিংয়ে ঢাকা থেকে আমরা একদল সাংবাদিক আমন্ত্রিত হলাম। ফোরাম’ পত্রিকা থেকে হলেন রেহমান সােবহান। জানা গেল, পাকিস্তান পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম, এম, আহমদের একটাই পরিচয় ছিল— তিনি বাঙালি বিদ্বেষী এবং বৈষম্য নীতির হােতা। সুতরাং বাঙালিদের বঞ্চনা এবং বাংলাদেশকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা সম্পর্কে আমরা তাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করবাে ঠিক করলাম। রাওয়ালপিন্ডির হােটেল ইন্টারকন্টিনেনটালে আমাদের আস্তানা। আমি আছি পাঁচতলায়। শেখ ফজলুল হক মণি, রেহমান সােবহান, হলিডের এনায়েতুল্লা এবং খুলনার ওয়েভ’ পত্রিকার মাহমুদ সম্ভবত চিলেন তেতলায়। মণির বাংলার বাণী কাগজ তখন মাত্র সাপ্তাহিক আকারে বের হয়েছে। আমাদের সংগে কিছু প্রবীন সাংবাদিকও আছেন। আছেন আবদুস সালাম, মুজিবুর রহমান খান প্রমুখ। রেহমান সােবহানকে কেন্দ্র করে আমাদের একটা গ্রুপ গড়ে উঠলাে। এই গ্রুপে ছিলেন ‘ওয়েভের মাহমুদ, আমি এবং এনায়েতুল্লা। এনায়েতুল্লা প্রথমে আমাদের সংগে ছিলেন। পরে আমাদের ঘরােয়া ব্রিফিং মিটিংয়ে না এসে স্টান্ডার্ড ব্যাঙ্কের পিণ্ডি ব্যাঞ্চে ছুটাছুটি শুরু করলেন। পরে তার এই ছুটোছুটির আসল রহস্য। আমরা অনেকেই জানতে পেরেছিলাম। সে কথা এখানে থাক।

একদিন বিকেলে চা খেতে নিচে নেমেছি, দেখি রেহমান সােবহান কফির কাপ সামনে রেখে চুপ করে বসে আছেন। তার সংগে এনায়েতুল্লা। সুইমিং পুলে বেশ ভীড়। সংখ্যায় বিদেশীরাই বেশি। রেহমান সােবহানের কাছে বসতেই তিনি বললেন, আগামী কাল নবাব মুজাফফর আলী কিজিলবাসের কাছে আপনারা কে কি প্রশ্ন করবেন, তার একটা খসড়া আমি তৈরি করেছি, আপনার প্রশ্নটা আপনি বেছে নিন। রেহমান সােবহান তখন আমাদের কাছে এমন কি অনেক বিদেশীর কাছেও ছ’দফা প্রস্তাবের ভাষ্যকার হিসেবে পরিচিত। তার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যার কাছে অনেকেই হার মানছেন। লক্ষ্য করলাম, তার প্রশ্নগুলােও ছ’দফার আলােকে তৈরি করা। নিজের প্রশ্নটি বেছে নিয়ে হঠাৎ একসময় বললাম : সােবহান ভাই, আমিও ছ’দফা প্রস্তাবের পূর্ণ সমর্থক। কিন্তু এই প্রস্তাবের মধ্যে একটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে।  সােবহান বললেন : সেটা কি? বললাম : ছ’দফা প্রস্তাবে পাকিস্তানী বৃহৎ পুঁজির শােষণ ও শাসনমুক্তির পূর্ণ নিশ্চয়তা রয়েছে। কিন্তু এই মুক্তি অর্জিত হওয়ার পর বাঙালি পুঁজিপতি তৈরি হওয়ার পথ বন্ধ করার এবং তাদের শাসন ও শােষণ থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার কোন সম্পূরক ব্যবস্থা নেই। সােবহান অবজ্ঞাভরে বললেন : বাংলাদেশে এখন যে পাতি ব্যবসায়ী শ্রেণী রয়েছে, তারা বিড়িঅলা, পানঅলার পর্যায়ে পড়ে। এরা দ্রুত কোন শক্তি হয়ে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। রেহমান সােবহানের এই জবাব সেদিন মেনে নিলেও মনে মনে আমি খুব একটা সন্তুষ্ট হতে পারিনি। রাত্রে হােটেল কক্ষে ফিরে পুরাে আলাপটাই ডায়েরিতে লিখে ফেললাম। তারপরে ঘুমুতে গেলাম। তারপর চার বছর কেটে গেছে। ১৯৭৪ সালের তেরই জুন তারিখে ঢাকার সচিবালয়ে পরিকল্পনা কমিশনের কক্ষে বসে তাই রেহমান সােবহানকে প্রথম সুযােগেই প্রশ্ন করেছিলাম বাঙালি পাতি ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আপনি কি আগের ধারণাই পােষণ করেন? ক্ষুব্ধ সােবহান জবাব দিয়েছিলেন ; তখন কে জানতাে, ওরা এত বড় চোর এবং ডাকাত। সােবহান কেন, আমরা অনেকেই এই প্রশ্নের জবাৰ আগে জানতাম না। ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে তাই সাড়ে সাতকোটি বাঙালিকে আবার নিজ বাসভূমে পরবাসী হতে হয়েছে। রেহমান সােবহানদের আবার করতে হয়েছে দেশত্যাগ। বাংলাদেশের যে চরিত্রহীন পাতি বুর্জোয়া শ্রেণীকে আমরা উপেক্ষা করেছিলাম; সৎ অসৎ যে কোন উপায়ে মূলধন গঠন, পাচার ও বিদেশী পুঁজির সংগে আঁতাত গঠনে তারা কত দক্ষ, রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য তারা কত বড় নৃশংস ও হিংস্রতার প্রমাণ তারা আমাদের অহিংস, রুগ্ন বৈদগ্ধ ও বুদ্ধির কাছে আরেকবার তুলে ধরেছে।

বণিকের মানদণ্ড, দেখা দিল রাজদণ্ড রূপে, পােহালে শর্বরী।

বাণিজ্যের নামে বাংলাদেশে এসেছিল বৃটিশ বণিক। তারপর হঠাৎ একদিন দেখা গেল, বণিকের মানদণ্ড রাজদণ্ডে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ বণিক হয়েছে শাসক। অষ্টাদশ শতকের ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে বিংশ শতকের বাংলাদেশে। এবার বাণিজ্যের নামে নয়, সাহায্যের দানছত্র নিয়ে এসেছিল বিদেশীরা। তারপর  রাত না পােহাতে দেখা গেল, সাহায্য নয়, তা ষড়যন্ত্র। আর সেই ষড়যন্ত্রের প্রথম বলি বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের নায়ক শেখ মুজিব । বিদেশী সাহায্যের এই অনুপ্রবেশ শুরু বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগেই ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে কলকাতায় পেীছেই দেখলাম, অবাক কাণ্ড। মার্কিন সাংবাদিক আর সাহায্য সংস্থার কর্মকর্তাদের ভীড়ে সার্কাস এ্যাভেনিউর বাংলাদেশ। দূতাবাসে (তখন মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র) ঢােকা মুশকিল। মার্কিনীরা একটা সাহায্য সংস্থা খুলে প্রত্যেক বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিককে হাজার ও পাঁচশাে টাকা করে এককালীন সাহায্য দিচ্ছেন। এ ছাড়াও আছে আরাে নানা রকম পাশ্চাত্য দেশীয় সাহায্য সংস্থা। কেউ উদ্বাস্তু শিবিরের জন্য ঔষধ, কেউ দুধ, কেউ। কম্বল প্রভৃতি বিলােচ্ছেন। নগদ টাকারও চলছে ছড়াছড়ি।  তখনই মনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। আমেরিকা এবং তার পাশ্চাত্য দেশীয় কোন কোন বন্ধুদেশ তখন পাকিস্তানের সমর্থক। মার্কিনী অন্ত্রে ইয়াহিয়ার নরমেধ যজ্ঞ চলছে বাংলাদেশে।

ঠিক একই সময়ে সেই আমেরিকার সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলাে কিভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের এবং দেশত্যাগী উদ্বাস্তুদের সাহায্য দিতে পারে? এ কি দুঃস্থ মানবতার প্রতি মমত্ববােধ কোন রাজনৈতিক চাতুরি? এই প্রশ্নের জবাব পেতে দেরি হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেল, মুজিব নগর প্রশাসনের একটা শক্তিশালী অংশ ভারত ও সােভিয়েট-বিরােধী সুক্ষ্ম প্রচারণা এবং গুজব ছড়াতে ব্যস্ত। অন্যদিকে মার্কিনীদের সংগে তাদের চব্বিশ ঘন্টার ওঠাবসা। মুজিব নগর সরকারের তখনকার সবচাইতে নন্দিত ব্যক্তি হােসেন আলীর সংগে একদিন দেখা করতে গেলাম সার্কাস এ্যাভিনিউর দূতাবাসে। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। কারণ, তিনি দু’জন বিদেশীর সংগে আলাপে ব্যস্ত। যখন এই বিদেশীরা বেরিয়ে এলেন, তখন বুঝলাম দু’জনেই আমেরিকান। শুধু হােসেন আলী নন; বিদেশ মন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমদ, বিদেশ সচিব মাহবুব আলম চাষী, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর প্রমুখেরও চব্বিশ ঘন্টার সংগী মার্কিন সাংবাদিক অথবা কোন পাশ্চাত্য এজেন্সির কর্তা বা প্রতিনিধি। কিছুদিনের মধ্যে জানা গেল, মুজিব নগর সরকারের গােপন ফাইলের সবকিছু ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। সকলের আগে তা জানছে আমেরিকানরা, তারপর পাকিস্তানীরা। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন কঠোর হলেন। বিদেশমন্ত্রী মােশতাকের সংগে তার এইভাবে বিবাদের সূচনা। সার্কাস এ্যাভেনিউর ভবনে বিদেশীদের আনাগােনার উপর কঠোর নজর রাখার ব্যবস্থা হল। ফল হল না কিছুই। সম্ভবত ‘৭১ সালের নভেম্বর মাসের গােড়ার কথা। আমি তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মুখপত্র ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক এবং স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগে যুক্ত। গভীর রাতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ডেকে পাঠালেন। তাজউদ্দিন তখন সদ্য অসুখ থেকে উঠেছেন। রাত্রে সামান্য রুটি এবং  তরকারি খান। তবু মাঝরাত পর্যন্ত তার কক্ষে রাজনৈতিক ভীড়। এই ভীড় যখন একেবারে কমলাে, তখন তিনি আমাকে কাছে ডাকলেন। বললেন : আপনাকে একটা কথা বলার জন্য ডেকেছি। শত্রু এখন বন্ধুর ছদ্মবেশে আমাদের ভেতরে ঢুকেছে। এখন আমাদের আরাে বেশি সাবধান হওয়া দরকার। বললাম : কিভাবে সাবধান হব বলুন। তাজউদ্দিন বললেন : রেডিও পাকিস্তান, পাকিস্তান কাগজ এবং তাদের বাঙালি কোলাবরেটরদের অপপ্রচার আপনারা সাফল্যের সংগে কাউন্টার করেছেন।

কিন্তু এখন আমাদের ভেতর থেকে শুরু হয়েছে অপপ্রচার এবং গুজব ছড়ানাে। আমাদের সাহায্যকারী মিত্রদেশগুলাের ভূমিকা ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে গুজব ছড়ানাে হচ্ছে। এমনকি আমাদের নিজেদের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবচাইতে বিপদের কথা, সাহায্য দেওয়ার নাম করে এগিয়ে এসে টাকা ছড়িয়ে। পাশ্চাত্যের কোন কোন দেশ আমাদের সরকারের মধ্যে তাদের শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করেছে এবং মুক্তিবাহিনী ও বুদ্ধিজীবীদের নানাভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে তােলার জন্য চেষ্টা করছে। বলেই তাজউদ্দিন তার সামনে রাখা একটা ফাইল টেনে নিলেন। বললেন ; আপনাদের বন্ধু এবং সহকর্মী দু’জন বুদ্ধিজীবী সম্পর্কে এখানে রিপাের্ট রয়েছে। তারা মুক্তিসংগ্রামী সেজে ঢাকা থেকে চলে এসেছেন। এখন রােজ সন্ধ্যায় তাদের দেখা হয় বিদেশীদের সংগে বারে বসে মদ খেতে। মদ খাওয়ার মত এত টাকা তাদের কোথা থেকে জোটে? এবং বিদেশীদের সংগে তাদের সম্পর্কের ভিত্তিটা কি? বললাম : এ সম্পর্কে আপনারা সাবধান হচ্ছেন না কেন? তাজউদ্দিন বললেন : সত্যি কথা বলতে কি, প্রচলিত অর্থে যাকে স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠিত সরকার বলা হয়, আমরা এখনাে তা নই। আমাদের মুখ্য দায়িত্ব মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা। প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনের মত সময়, সুযােগ সুবিধা ও ব্যবস্থা কোনটাই আমাদের নেই। ফলে বহু ব্যাপারেই আমরা কোন সতর্কতা বা প্রতীকার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না। এই মুহূর্তে আমেরিকা বা আমেরিকার মত কোন দেশের সাহায্য আমরা চাই না- এমন কথা বলার সুযােগ ও ক্ষমতাও আমাদের নেই। বিদেশী সাহায্য সবটাই খারাপ তা আমি বলি না। কিন্তু এর মধ্যে যারা খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, তাদের সম্পর্কে সতর্ক থাকা এবং তাদের বাঙালি সমর্থকদের গুজব প্রচার ব্যর্থ করার জন্য আপনাদের একটু সক্রিয় হতে হবে। বললাম : কি ধরনের গুজব প্রচার করা হচ্ছে, আমাকে একটু বলবেন? তাজউদ্দিন বললেন : আপনাদের কাছে কি কিছুই পৌছায়নি? বললাম ; কিছু কিছু শুনেছি। ভেবেছি, এগুলাে আড্ডাবাজদের বানানাে কথা।তাজউদ্দিন বললেন ; মােটেই তা নয়। এগুলাে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে, উদ্দেশ্য নিয়ে ছড়ানাে হচ্ছে। নানারকম গুজব ছড়ানাে হচ্ছে।

যেমন : ক) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ভারত চায় না, তাই তারা মুজিবনগর সরকারকে এখনাে স্বীকৃতি। দেয়নি। খ) কমিউনিস্ট পার্টি ও মুজাফফর ন্যাপকে ক্ষমতার অংশ এবং সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে না দিলে সােভিয়েট ইউনিয়ন মুজিবনগর সরকারকে সাহায্য ও সমর্থন দেবে না। গ) ইয়াহিয়া এখন শেখ মুজিবকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চান, কিন্তু তাজউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকার লােভে পাকিস্তানের সংগে কোন মিটমাট চান না। চান, পাকিস্তানী জেলে মুজিবের মৃত্যু হােক এবং পাকিস্তান ভেংগে যা। বললাম ; এই ধরনের গুজব আমিও শুনেছি। তাজউদ্দিন বললেন ; শুধু গুজব প্রচার নয়, বেনামা প্রচারপত্রও প্রকাশ করা হয়েছে এবং মুক্তিযোেদ্ধাদের মধ্যে বিলি করা হচ্ছে। আরাে বিপদের কথা কি জানেন, এই বিদেশীরা আমাদের মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের সংগেও গােপন যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের তারা বােঝাচ্ছে, আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতারা অপদার্থ, অযােগ্য এবং ভারতের দালাল। এরা ক্ষমতায় গিয়ে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে মােতায়েন রেখে রাজত্ব চালাবে। সুতরাং বাঙালি অফিসারদের কোন ভবিষ্যৎ নেই। অন্যদিকে পাকিস্তানের সংগে একটা মিটমাট হলে অটোনােমাস বাংলাদেশে বাঙালি অফিসারেরাই হবে মিলিটারি চীফ ও হর্তাকর্তা। পাকিস্তানের মিলিটারি বাজেটের। সিংহভাগ দেয় আমেরিকা। তার সমান ভাগ বাংলাদেশ আর্মিও পাবে। আর পাকিস্তান যদি ভেংগেই যায়, তাহলেও মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের উচিৎ হবে, অযােগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বকে সরিয়ে নিজেদের হাতেই ক্ষমতা নেওয়ার জন্য প্রস্তুত হওয়া। এশিয়া ও আফ্রিকার অধিকাংশ দেশেই সেনাবাহিনী ক্ষমতায়।

বাংলাদেশেও তার অন্যথা হওয়া উচিৎ নয়। এইভাবে ভবিষ্যতের স্বাধীন বাংলাদেশে মিলিটারি ব্যু ঘটানাের বীজ বপন করা হচ্ছে। প্রশ্ন করলাম ; এই বিদেশী ষড়যন্ত্র সফল হবে বলে আপনি মনে করেন? তাজউদ্দিন বললেন : তৃতীয় বিশ্বে ফরেন এইড বা বিদেশী সাহায্য এবং তার রাজনৈতিক ভূমিকা সম্পর্কে মার্কিন লেখকদেরই কয়েকটি লেখা আমি পড়েছি। এই লেখা পড়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমি শংকিত। এদের অপারেশন হবে অনেকটা এই ধরনের। বাংলাদেশ মুক্ত হলে এরা বিপুল সাহায্যের অফার নিয়ে এগিয়ে যাবে এবং নিজেদের তত্ত্বাবধানে সাহায্য বিতরণ করতে চাইবে। সাহায্য যা পাওয়া যাবে, তার বারাে আনা ব্যয় হবে তাদের তদারকিতে, সাহায্য প্রেরণের জাহাজ ভাড়ায় এবং তাদের লােকজনের খরচ মেটাতে। কিন্তু বাইরে প্রচার হবে, বাংলাদেশে সাহায্যের বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়েছে। এই সাহায্য প্রকৃত অভাবী লােকদের হাতে পৌছাবে না। সাহায্যের টাকার দৌলতে সরকারি প্রশাসনে তাদের সমর্থক শক্তিশালী গ্রুপ তৈরি করা হবে। দেশপ্রেমিক অফিসার ও মুক্তিবাহিনীর লােকজনকে দুর্নীতি পরায়ণ করার চেষ্টা হবে। সরকার বিরােধী এবং সংশ্লিষ্ট বিদেশীদের সমর্থক রাজনৈতিক দল ও পত্রিকাকে টাকা দেওয়া হবে। সরকারি দলের মধ্যে নিজেদের গ্রুপ তৈরি করা হবে। সামরিক বাহিনীর আনুগত্য ও দেশাত্মবােধ নষ্ট করা হবে। তারপর বাংলাদেশের নতুন সরকার যদি এই বিদেশীদের কথামত না চলেন, তাহলে সব দুর্নীতি ও খারাপ কাজের দায়-দায়িত্ব সরকারের কাধে চাপানাে হবে। সাধারণ মানুষ – বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণীকে বিক্ষুব্ধ করে তােলা হবে। ব্যবসায়ী শ্রেণীকে হাত করে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় সৃষ্টি করা হবে এবং এইভাবে প্রতিষ্ঠিত সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করার পর। সিভিল অথবা মিলিটারি কু ঘটিয়ে তাদের পছন্দমত তাবেদার সরকার বসানাে। হবে। _ বললাম : বাংলাদেশ একদিন হানাদার মুক্ত হবে এই আশা আমাদের সবসময়ই। কিন্তু হানাদারদের চাইতেও বড় বিপদ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। তা হল বিদেশী সাহায্য। এই বিপদের মােকাবিলা করার কোন পন্থা কি আপনারা ভেবে রেখেছেন?  তাজউদ্দিন হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে ঘরময় পায়চারি শুরু করলেন। বুঝলাম তিনি চিন্তিত। বললেন : শেখ মুজিব দেশে ফিরে কি করতে চাইবেন আমি জানি না।  যদি তিনি আমার কথা শােনেন, তাহলে এই বিপদও মােকাবিলা করা যাবে। কিন্তু এখন দরকার, শত্রুদের গুজব-প্রচার ব্যর্থ করা। আপনারা ‘জয় বাংলা’ কাগজে এবং স্বাধীন বাংলা বেতারে যারা আছেন, তারা এনিয়ে আলােচনা করুন এবং একটা পরিকল্পনা ঠিক করুন। সে রাতে ঠিক হয়েছিল, আমরা আরাে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রীর সংগে আবার মিলিত হব।

এর একদিন কি দু’দিন পরই অবাক কাণ্ড। কলকাতার পার্ক সার্কাসে বালু  হাক্কাক লেনে ছিল ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার কলকাতা অফিস। সকালে বসে পরের সপ্তাহের কপি ঠিক করছি, হঠাৎ সার্কাস এভেনিউ থেকে পত্রবাহক এসে হাজির। তার হাতে খােন্দকার মােশতাক আহমেদের সই-করা বিবৃতি। বিবৃতিটি পাঠ করে বিস্মিত হলাম। তাতে খােন্দকার ভারত সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে লিখেছেন, “যদি অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে এখুনি স্বীকৃতি দেওয়া না হয়, তাহলে ভারতের মাটিতে আমাদের স্বাধীনভাবে মরার সুযােগ দেওয়া হােক।”  গােটা বিবৃতিটির প্রতিপাদ্য, ভারত সরকার ইচ্ছে করে অর্থাৎ উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুজিবনগর সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিচ্ছেন না। মােশতাক অবিলম্বে এই স্বীকৃতি চান। বুঝতে বাকি রইলনা, এই বিবৃতি যদি ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় প্রকাশ হয়,  তাহলে শুধু মুজিব নগর সরকারের মধ্যেই নয়, মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন শাখার মধ্যেও গুরুতর বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। মােশতাক মুজিবনগর সরকারের বিদেশমন্ত্রী। তার বিবৃতি ‘জয় বাংলা পত্রিকায় প্রকাশ না করার কোন ক্ষমতা আমার নেই। মােহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী নামে এক ভদ্রলােক ছিলেন তখন আমাদের সংগে । আমার আগে তিনি ‘জয় বাংলা’ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত-সম্পাদক ছিলেন। তিনিও সাংবাদিক। ঢাকার ইত্তেফাকে’ সাব-এডিটর ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পালিয়ে মুজিব নগরে চলে আসেন। জয় বাংলা’ পত্রিকার দায়িত্বভার তাকেই দেওয়া হয়। মােহাম্মদ উল্লা নিয়মিত কাগজটি বের করতেন না। প্রায়ই অধিকৃত বাংলায় তার স্ত্রী পুত্রের খোজখবর করার নাম করে সীমান্তে চলে যেতেন। আসতেন একমাস দু’মাস পর। মুজিবনগরেও মােহাম্মদ উল্লা ছিলেন বেশ রহস্যময় মানুষ। তিনি জানতেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন ও বিদেশমন্ত্রী খােন্দকার মােশতাক আহমেদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল নয়। মােশতাক মার্কিন-ঘেঁষা, বাঙালি জাতীয়তাবাদের চাইতে মুসলিম জাতীয়তাবাদে বেশি বিশ্বাসী এবং রাজনৈতিক চরিত্রে সুবিধাবাদী। অন্যদিকে  তাজউদ্দিন স্বাধীনচেতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদী। তার রাজনৈতিক চরিত্রে সুবিধাৰাদ নেই। বরং একটু অতিরিক্ত নীতি-নিষ্ঠা ও সততা আছে- যার ফলে।  তিনি ততটা জনপ্রিয় নন। মােশতাকের মত তিনি সকলের মন জুগিয়ে কথা বলতে ভালবাসেন না। এতদসত্ত্বেও মােহাম্মদ উল্লা দু’জনের কাছেই নিয়মিত যেতেন।

দু’জনের কাছ থেকেই ব্যক্তিগত অনুগ্রহ ও সুযােগ সুবিধা আদায় করতেন। কিন্তু তার বেশি যােগাযােগ ছিল মােশতাকের বরকন্দাজ তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সংগে। সেদিন মােশতাকের বিবৃতিটি ‘জয় বাংলা’ অফিসে আসতেই মােহাম্মদ উল্লাহ। বায়না ধরলেন, এই বিবৃতি ছাপাতে হবে। এটা হবে মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের উপর রাজনৈতিক চাপ। মুজিবনগর সরকারকে স্বীকৃতি দান সম্পর্কে ভারত সরকারের মনােভাব তখন মােটামুটি আমাদের সকলের জানা। খােন্দকার মােশতাকের আরাে বেশি জানা। আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না দিলেও মুজিবনগর সরকারকেই বাংলাদেশে একমাত্র বৈধ। সরকার হিসেবে ভারত সরকার তখন মেনে নিয়েছেন এবং সবরকম সাহায্য দিচ্ছেন। টেকনিক্যাল কারণে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিতে তখন দেরি করা হচ্ছিল। এই টেকনিক্যাল অসুবিধাটা কি, তাও বাংলাদেশের নেতাদের বুঝিয়ে বলা। হয়েছিল। সুতরাং ভুল বােঝাবুঝির বা স্বীকৃতি আদায়ের জন্য চাপ প্রয়ােগের কোন দরকারই ছিল না। আমরা সকলেই জানতাম, ভারত সরকারের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি শীঘ্রই আসছে। ঠিক এই সময়ে মুজিবনগর সরকারের একজন হর্তাকর্তা ব্যক্তির এই বিবৃতি? মােহাম্মদ উল্লাকে বললাম ; চলুন, খােন্দকার মােশতাকের সংগে ফোনে কথা বলি। মােহাম্মদ উল্লা বললেন ; কথা বলার দরকার নেই। আমার সংগে তার আগেই। কথা হয়েছে। তিনি চান বিবৃতিটি ছাপা হােক। বললাম ; তাহলে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে ভুলবােঝাবুঝি এবং মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে দারুণ বিভ্রান্তি দেখা দিবে। মােহাম্মদ উল্লা বললেন : কি হবে না হবে তা দেখার বা বিবেচনা করার দায়িত্ব মুজিবনগর সরকারের। আপনার নয়। বললাম : বেশ । তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনকে বিষয়টা জানানাে হােক। মােহাম্মদ উল্লা রেগে গেলেন। বললেন ; আপনি তাজউদ্দিন মােশতাক ভাইয়ের মধ্যে ঝগড়া সৃষ্টি করতে চান। বললাম : কিন্তু আপনি যা চাচ্ছেন, তাতে তাে গােটা মুক্তিবাহিনীর মধ্যে বিভ্রান্তি, বিভেদ ও হতাশা দেখা দিতে পারে। মােহাম্মদ উল্লা বললেন ; তাহলে আপনি এই বিবৃতি ছাপতে দিতে চান না? বললাম না। আমি তথ্য বিভাগের ইনচার্জ এম. এন. আবদুল ইলেষ্ট মান্নান সাহেবের সংগে আগে আলােচনা করবাে। তারপর সিদ্ধান্ত নেব। মােহাম্মদ উল্লা বললেন : তাহলে মােশতাক ভাইকে ব্যাপারটা জানাতে হয়। বললাম : জানাতে পারেন। 

জীবনে বহুবার বহুক্ষেত্রে অপ্রিয় সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাতে অভিযােগ ও অপবাদই শুধু বেড়েছে। কারাে কাছে সান্ত্বনা বা উৎসাহ পাইনি। যাকগে সে ব্যক্তিগত প্রসংগ । শেষ পর্যন্ত ‘জয় বাংলা’ পত্রিকায় বিবৃতিটি ছাপা হল– তবে অনেক কাটছাট করে। মােশতাক নিজেই তার বক্তব্য পাল্টালেন। এবার বলা হল, “বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উচিৎ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া, অন্যথায় সম্মান নিয়ে আমাদের মরতে দেওয়া হােক।” ‘ দু’দিন পরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আমাকে ডেকে পাঠালেন। সংগে টাংগাইলের এম, এন. এ. (মেম্বার অব ন্যাশনাল এসেম্বলি) ইলেক্ট আব্দুল মান্নান। বললেন : আপনি মােশতাক সাহেবের বিবৃতির ব্যাপারে দৃঢ়তা দেখিয়ে ভাল করেছেন। তিনি কেবিনেটের সংগে আলােচনা না করেই বিবৃতিটা ছেড়েছেন। কেবিনেটের সভায় তার কৈফিয়ৎ চাওয়া হয়েছে। বললাম : এটা তাজউদ্দিন সাহেব ও মােশতাক সাহেবের মধ্যে ব্যক্তিগত বিরােধের ব্যাপার হলে আমাদের কিছু বলার ছিল না। কিন্তু বিবৃতিটা যেভাবে পাঠানাে হয়েছিল, সেভাবে ছাপা হলে শুধু মুক্তিবাহিনীর মধ্যে নয়, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মধ্যেও এই ধারণা দৃঢ়মূল হত যে, ভারত সরকার চান না বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে অস্তিত্ব লাভ করুক। তাই অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে চাচ্ছেন না। তাদের অন্য মতলব রয়েছে। এই ধারণা একবার ছড়াতে দিলে বর্তমান মুক্তিসংগ্রামে হতাশা ও বিপর্যয় রােধ করা অসম্ভব হবে।  সৈয়দ নজরুল বললেন : আমাদের মুক্তিসংগ্রামে এখন সবচাইতে বেশি সাহায্য ও সমর্থন দিচ্ছে ভারত এবং সােভিয়েট ইউনিয়ন। লক্ষ্য করলে দেখবেন, এই দুটি রাষ্ট্রের সংগেই আমাদের ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যেই জানা গেল, মােশতাকের বিবৃতিটা ড্রাফট করেছেন মাহবুবুল আলম চাষী। তাকে সাহায্য করেছেন তাহেরুদ্দিন ঠাকুর। এবং জয় বাংলা কাগজ ও স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই বিবৃতি ঠেকানাে গেলেও তার একটা কপি আগেই বিদেশী পত্রিকা ও বেতারের সাংবাদিকদের কাছে বিলি করা হয়েছে। আরাে জানা গেল, মুখে মােশতাক গ্রুপ ভারত-বিরােধিতা দেখালেও ভারতের ইন্দিরা-বিরােধী এবং বাংলাদেশ-বিরােধী কট্টর প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী মহলটির সংগে তাদের যােগাযােগ। ভারতের এই ডানপন্থী মহলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভ পছন্দ করেন না।

তারা আমেরিকার ইংগিতে দিল্লী ও পিণ্ডির মধ্যে বন্ধুত্ব চান। আরাে চান, বাংলাদেশ পাকিস্তানের ভেতরেই থাকুক এবং ভারত যেন বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে সাহায্য না করে। এই প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখপত্র টাইমস অব ইন্ডিয়া, স্টেটসম্যান, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস প্রভৃতি কাগজে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানী গণহত্যা শুরু হওয়ার পর ভারত সরকারকে উপদেশ দিয়ে  যেসব সম্পাদকীয় লেখা হয়েছে, তার মূল কথাই ছিল বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের কিছু করণীয় নেই। ওটা পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার। আসল কথা ছিল, ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল বিগ বিজনেস ও বৃহৎ পুঁজিপতিরা চাননি যে, পাকিস্তানের বিগ বিজনেস ও বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থে কোন আঘাত পড়ুক, বা বাংলাদেশনামক কলােনি তাদের হাত ছাড়া হােক। ধর্মের পার্থক্য, রাজনৈতিক বিরােধ সত্ত্বেও দুই দেশের শ্রেণীস্বার্থের কী গভীর ঐক্যবােধ। আর মােশতাক গােড়া থেকেই যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভারতের এই বৃহৎ পুঁজিপতিদের সংগে। ‘পিপল’ কাগজের মালিক আবিদুর রহমানের মাধ্যমে তার যােগাযােগ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল জয়প্রকাশ নারায়ণের সাথে। কলকাতায় মার্কিন সংবাদ সংস্থা ইউ, পি, আই. এর প্রাক্তন প্রতিনিধি অজিত রায়ের সংগে অন্তরংগ মাখামাখি শুরু হয়ে গিয়েছিল তাহেরুদ্দিন ঠাকুরের। এই অজিত রায় তার নিজস্ব অফিস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভুটানের রাজার দেওয়া এক বাড়িতে – কলকাতার অভিজাত ত্রিভলি কোর্টে। স্বয়ং কিসিংগারের সংগে তার পত্রযােগাযােগ। সার্কাস এভিনিউতে অজিত বাবুর ছিল অবাধ যাতায়াত।

কলকাতার সার্কাস এভিনিউ এবং থিয়েটার রােড। এখন এই থিয়েটার  রােডের নাম সেক্সপিয়ার সরণী। থিয়েটার রােডে ছিল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অস্থায়ী দফতর। অন্যদিকে সার্কাস এভেনিউতে ছিল খােন্দকার মােশতাক, হােসেন আলি, মাহবুবুল আলম চাষী, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর প্রমুখের আড়া। তাদের সংগে আরাে অনেকেই ছিলেন। যেমন আর, আই, চৌধুরী (মুজিব-হস্তা ডালিমের শ্বশুর), আনােয়ার চৌধুরী জয়, আমিনুল হক বাদশা (পরবর্তীকালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘প্রবাসী’র সম্পাদক)। আমিনুল হক বাদশা ছিলেন ঢাকার ‘আজাদ’ পত্রিকার জুনিয়র সাব-এডিটর অথবা রিপাের্টার। ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাকে পছন্দ করতেন; ১৯৭১ সালে কলকাতায় পৌছে শুনলাম, বাদশা মুজিবনগর সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের এক্সটার্নাল পাবলিসিটি ডিভিশনের সঙ্গে যুক্ত। একদিন সার্কাস এভেনিউর দূতাবাসে তার সংগে দেখা। সার্কাস এভিনিউ রাতদিন শুধু বিদেশীদের ভীড়ে গমগম। তাদের মধ্যে আমেরিকানদের সংখ্যাই বেশি। আর এই আমেরিকানদের সংগেই মােশতাক, হােসেন আলি, চাষী, ঠাকুরদের ঘনঘন ওঠাবসা। এই দলের সংগে যুক্ত হয়েছেন কর্ণেল ওসমানীও (তখন তিনি জেনারেল পদে উন্নীত হননি।) সত্যি কথা বলতে কি, এই অবিবাহিত প্রৌঢ় কর্ণেলকে দেখলে আমার হাসি পেতাে। বেটে খাটো মানুষ। কিন্তু ঠোটে একজোড়া জংগী গোফ রেখেছিলেন। সম্ভবত নিজের দেহের হ্রতা ওই গোঁফ দিয়ে ঢাকা দিতে চাইতেন। দিনের মধ্যে ঘন্টা দুই তিনি কাটাতেন তার গোঁফ মােম ঘষে খাড়া রাখার সাধনায়। কথাবার্তায় চলনে বলনে তিনি আইয়ুবকে  অনুকরণ করার চেষ্টা করতেন। তা আমার কাছে আরাে হাস্যকর মনে হত। তার সব রাগ শুধু আইয়ুব এবং অন্যান্য পাকিস্তানী জেনারেলদের উপর। কারণ, তারা তাকে বাঙালি বলে ঈর্ষা করে কর্ণেল থেকে আর প্রমােশন দেয়নি; নইলে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতেই জেনারেল হয়ে তিনি রিটায়ার করতে পারতেন। তার আরাে রাগ, আইয়ুব অনেক পাকিস্তানী সামরিক অফিসারকেই সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে সিভিল সার্ভিসে অথবা ফরেন সার্ভিসে উচ্চ পদ দিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি বলে কর্ণেল ওসমানির মত যােগ্য অফিসারকে তা দেওয়া হয়নি। পাকিস্তানী আমলে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং বেংগল রেজিমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। ওসমানির দাবি, তিনিই এই দুই বাহিনী গঠনের উদ্যোক্তা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তার কৃতিত্বের কাহিনী শুনতে প্রথম দিকে আমাদের অনেকেরই ভাল লাগতাে। পরে অনেকের কাছেই তা অতিশয়ােক্তি বলে মনে হয়েছে।

Reference:

আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশঃ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর