এবার সবুর খানের কথা বলি।
সবুর খান ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন তার উল্লেখ এখানে নিষ্প্রয়ােজন। ঢাকার পতন হওয়ার আগেরও দিনও পাকিস্তানী বেতার থেকে সবুর খান মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করে গলাবাজি করেছেন। উন্মুক্ত জনতা তাকে হত্যা করার জন্য খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তিনি থানায় আত্মসমর্পন করে প্রাণভিক্ষা চান এবং জেলে আশ্রয় গ্রহন করেন। ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসে দালাল আইনে বিচারাধীন থাকার সময় সবুর জেলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। হঠাৎ একদিন দৈনিক জনপদের ম্যানেজিং ডাইরেক্টার হাবিবুদ্দিন আহমেদের সংগে সবুর খানের এক ভাগ্নে মিন্টু অথবা মন্টু আমার বাসায় এসে হাজির। হাবিবুদ্দিন দীর্ঘকাল ধরে সবুরের বন্ধু । হাবিবুদ্দিনকে আমি শ্রদ্ধা করতাম। তিনিও আমার প্রতি ছিলেন বিশেষ স্নেহপরায়ণ। দু’জনেই আমাকে অনুরােধ জানালেন, সবুর খানের জন্য আমি যেন বঙ্গবন্ধুকে অনুরােধ জানাই; তার চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে কেবিনের ব্যবস্থা করা হােক এবং তাকে জেল থেকে হাসপাতলে স্থানান্তরিত করা হােক। এই অনুরােধ বঙ্গবন্ধুকে আগেও জানানাে হয়েছিল; কিন্তু তিনি তা রাখতে পারেননি। কারণ, পুলিশের তরফ থেকে বলা হয়েছিল, সবুর খানের অসুস্থতা তেমন গুরুতর নয়। অসুস্থতার বাহানা করে তিনি বাইরে আসতে চান এবং রাজনৈতিক যােগাযােগ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চান। মিন্টু অথবা মন্টু বার বার আসতে লাগলেন আমার কাছে। তার মা আমার হাত ধরে একদিন কেঁদে ফেললেন। আইয়ুব আমলের প্রবল প্রতাপশালী সবুর খান। আজ তিনি সামান্য চিকিৎসার জন্য করুণা ভিক্ষা করছেন আমার মত একজন নগণ্য সাংবাদিকের কাছে। অনুরােধ ফেলতে পারলাম না। একদিন রাত আটটার পর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় গিয়ে হাজির হলাম। বঙ্গবন্ধু রাসেলকে সংগে নিয়ে টেলিভিশন দেখছিলেন। আমাকে দেখে রসিকতা করে বললেন ; কি বারতা চৌধুরী। বললাম : যদি অভয় দেনতাে বলি। বঙ্গবন্ধু মুডে ছিলেন। বললেন : অভয় দিলাম। বললাম : জেলে সবুর খান খুব অসুস্থ। তাকে কি চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা যায় না? বঙ্গবন্ধু আমার কাছ থেকে এই অনুরােধ প্রত্যাশা করেননি। বিস্ময়ে চোখ কপালে তুলে বললেন ; দাঁড়াও দাড়াও, ব্যাপার বুঝেনি। গাফফার চৌধুরী এসেছে সবুর খানের জন্য অনুরােধ জানাতে। আসল কথাটা কি?
বললাম : এর মধ্যে কোন রাজনীতি নেই বঙ্গবন্ধু। শুনেছি, জ্বলােক অসুস্থ। একান্তই মানবিক কারণে এসেছি। * মুজিব চিন্তিতভাবে বললেন : কিন্তু পুলিশের রিপাের্ট, তার অসুস্থতা তেমন গুরুতর নয়। বললাম : হতে পারে। তবে কম অসুস্থ লােকও ভালাে চিকিৎসা পাওয়ার দাবি জানাতে পারেন। মুজিব সহানুভূতির স্বরে বললেন : বিশ্বাস করে এদের আমি ছেড়ে দিতে চাই। আমার বিশ্বাস, ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে এরা দেশের বিরুদ্ধে যা করেছেন, তাতে এরা নিজেরাও অনুতপ্ত। তাছাড়া এদের বয়স হয়েছে। রাজনৈতিক ঝামেলায় নতুনভাবে জড়ানাের ইচ্ছে এদের অনেকেরই নেই। জনসাধারণের ঘৃণা। আর ক্রোধ এদের জীবন অভিশপ্ত করে তুলেছে। কি হবে এদের আরাে জেল খাটিয়ে? . বললাম : এই ব্যাপারে আপনার সংগে আমি একমত নই। মুজিব হেসে উঠলেন। বললেন ; এদিকে আবার সবুরের হয়ে ওকালতি করতে এসেছে। বেশ, অনুরােধ রাখলাম। তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে তখনই ফোনে নির্দেশ দিলেন প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা করার। এই হচ্ছে মানুষ মুজিব। উদার মুজিব। ক্ষমাশীল মুজিব। আজ তাঁর মৃত্যুর পর যখন লণ্ডনে বসে এই স্মৃতিকথা লিখছি, তখন বার বার মনে পড়ছে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর মাসের এই ঘটনাটির কথা। সবুর খানেরা মৃত মুজিবের লাশের উপর দিয়ে আবার রাজনৈতিক মঞ্চে নেমেছেন। জীবনে স্বাভাবিক পথে এরা কোনদিন রাজনীতি করেননি। এদের যাতায়াত সকল সময় চক্রান্তের রাজনীতির পেছনের অন্ধকার গলিপথ দিয়ে। জানি না, আজ শহীদ মুজিবের অমর আহা আমার দিকে চেয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছেন কিনা, আর বলছেন কিনা- কি হে চৌধুরী, তােমার সবুর খানেরা এখন কি করছে? খুব না সেদিন তাদের হয়ে ওকালতি করতে এসেছিলে? হত্যার আগে চরিত্র-হত্যা। এটা হচ্ছে তৃতীয় বিশ্বের যেকোন জাতীয়তাবাদী নেতাকে ধ্বংস করার আগে পাশ্চাত্যের রাজনীতি, প্রচার মাধ্যম ও সংবাদপত্রের বিশেষ কৌশল। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডনে প্রথম এসেই বুঝতে পেরেছিলাম, পাশ্চাত্য সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমগুলােতে মুজিবের চরিত্র-হত্যার ব্যাপক আয়ােজন চলছে। এমন কি গার্ডিয়ান’ ও ‘নিউ স্টেটসম্যানের মত কাগজ নিজেদের জ্ঞাতসারে অথবা অজ্ঞাতসারে এই প্রচার অভিযানে গলা মিলিয়েছে। প্রচারের ধারাটি অতি পুরনাে ও বহু ব্যবহৃত। যেহেতু ইংরেজি সংবাদপত্রের প্রতি আমাদের (তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের মানুষের) একটা হীনমন্যতাবােধ জনিত অতিবিশ্বাস আছে, সেহেতু সেই সরল বিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে আমাদেরই জাতীয় নেতা সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহ ও ঘৃণার বীজ বপন করা। এভাবে প্রচারকার্যের মাধ্যমে জাতীয় নেতার ভাবমূর্তিটি তার দেশের মানুষের মনে ধ্বংস করা গেলে তারপর তার উপর হানা হয় প্রত্যক্ষ আঘাত। সেই আঘাত শুধু সেই জাতীয় নেতাকে ধ্বংস করার জন্য নয়, সে দেশের জাতীয় স্বার্থকেও ধ্বংস করার জন্য।
কিন্তু প্রচারণার ধুম্রজালে অন্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের মানুষ এই সত্যটি প্রথমে বুঝতে পারে না। যখন বুঝতে পারে, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। এই প্রচার কৌশলটি আজকের নয়। দু’শাে আড়াইশাে বছর ধরে এটা বৃটিশ ও মার্কিন রাজনীতির অংগ। বাংলাদেশে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লাকে হত্যা করার পর এই হতভাগ্য যুবককে কেন্দ্র করে পরবর্তী কালে যাতে হিন্দু ও মুসলমান বাঙালির কোন সম্মিলিত জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে না ওঠে তজ্জন্য তাকে গর্ভবতী নারী-হত্যাকারী, লম্পট ও অন্ধকূপ হত্যার নায়ক হিসেবে ইংরেজ ঐতিহাসিকেরা চিত্রিত করেছেন। তৎকালে নবীনচন্দ্র সেনের মত কবিকেও ইংরেজ শাসকেরা এই প্রচারকার্যে ব্যবহার করেছেন। নবীন সেনের ‘পলাশী’ কাব্যে সিরাজ-চরিত্রকে জঘন্যভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। অবশ্য পরে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্র সিরাজ চরিত্রকে এই মিথ্যা কলঙ্ক থেকে মুক্ত করার জন্য অনলস প্রচেষ্টা চালান। ইংরেজ ঐতিহাসিকের হাতে ভারতের যে ইতিহাস-বিকৃত, সে সম্পর্কে একবার পণ্ডিত নেহরু মন্তব্য করেছিলেন : “বৃটিশ শাসকেরা ভারতবর্ষে দুশাে বছর ধরে শাসন করছে, তাতে যতটা ক্ষতি হয়নি, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বৃটিশ ঐতিহাসিকেরা যেভাবে ভারতের ইতিহাস ও জাতীয় চরিত্রের বিকৃতি ঘটিয়েছে, তাতে”। আজকের বাংলাদেশ সম্পর্কেও এই কথাটি সত্য। মুজিবকে হত্যায় বাংলাদেশের যতটা ক্ষতি হয়েছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পাশ্চাত্যের অধিকাংশ পত্রিকায় তার জাতীয় নেতৃত্বের ইমেজ বা ভাবমূর্তি ধ্বংসের প্রচারঅভিযানে। মুজিবের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে বহুধাবিভক্ত বাঙালি জাতি বহুকাল পরে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল, ভেতাে বাঙালি দুর্নাম ঘুচিয়ে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করেছিল। মুজিব ব্যক্তি হিসেবে ভালাে, না মন্দ মানুষ ছিলেন, সফল অথবা ব্যর্থ প্রশাসক ছিলেন, দেশে দুর্নীতির বিস্তার রােধে তিনি কতটা সফল হয়েছিলেন অথবা হননি, এসব বিচার একদিন ইতিহাস করবে। কিন্তু আজকের রূঢ় সত্য এই যে, বাঙালির ঐক্য ও স্বাধীনতার একমাত্র প্রতীকটিকে হত্যা করা হয়েছে। এর উদ্দেশ্য শুধু ব্যক্তি-হত্যা নয়; বাঙালির ঐক্য ও স্বাধীনতা হত্যা করা। আর এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে যারা সাহায্য ও সমর্থন জুগিয়েছে, তাদের পুরনাে ও কলংকিত উপনিবেশবাদি চেহারাও আজ ক্রমশঃই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
Reference:
আব্দুল গাফফার চৌধুরী, ইতিহাসের রক্তপলাশঃ পনেরই আগস্ট পঁচাত্তর