নাজিরগঞ্জ ঘাটের যুদ্ধ (অ্যামবুশ)
ভূমিকা
পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত নাজিরগঞ্জ ঘাট পাবনা জেলার একটি ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ যােগাযােগ কেন্দ্র। পদ্মা নদীর মাধ্যমে এ ঘাট থেকে পাবনা জেলা ও দেশের অন্যান্য স্থানের যােগাযােগ ছিল। সামরিক দিক থেকে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পটভূমি মুক্তিযুদ্ধের সময় পদ্মা নদী ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর যােগাযােগের অন্যতম প্রধান পথ। এ পথের মাধ্যমে বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি সেনারা বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ ও রসদসামগ্রীর জোগান দিত। পরিকল্পনা মােতাবেক অক্টোবর মাসে মুক্তিযােদ্ধারা নাজিরগঞ্জ ঘাটে অবস্থান গ্রহণ করে পাকিস্তানি বাহিনীর নৌযানের উপর অ্যামবুশ রচনা করেন। ভূমির পরিচিতি নাজিরগঞ্জ ঘাট সুজানগর থেকে আনুমানিক ১৫ কিলােমিটার দক্ষিণ-পূর্বে পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত। নাজিরগঞ্জ ঘাট থেকে একটি রাস্তা উত্তর-পূর্ব দিক হয়ে পাবনা জেলার অন্যতম প্রধান যােগাযােগ কেন্দ্র কাশীনাথপুর গমন করেছে। নাজিরগঞ্জ ঘাট এলাকায় এখনাে ইংরেজদের নীল কুঠির ৪-৫টি বিল্ডিংয়ের ধ্বংসাবশেষ পরিলক্ষিত হয়। এ বিল্ডিংগুলাের মধ্যে মুক্তিযােদ্ধারা অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ: ক, শত্রুবাহিনী: ১৮জন পাকিস্তানি সেনা এবং ১টি কার্গো। খ. মুক্তিবাহিনী: ৪০জন মুক্তিযােদ্ধা।
যুদ্ধের বিবরণ
অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে মুক্তিযােদ্ধারা জানতে পারেন যে, পাকিস্তানি বাহিনী একটি কার্গোযােগে আরিচা থেকে নাজিরগঞ্জ ঘাট হয়ে পাবনা এলাকায় গমন করবে। এ সংবাদের ভিত্তিতে প্রায় ৫০জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল নাজিরগঞ্জ ঘাট এলাকার নীলকুঠিতে অবস্থান গ্রহণ করে। ২৭ অক্টোবর আনুমানিক সকাল ১০টার দিকে মুক্তিযােদ্ধারা মাঝিদের মাধ্যমে সংবাদ পান, পাকিস্তানি সেনাদের একটি কার্গো নাজিরগঞ্জের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। যথাসময়ে মুক্তিযােদ্ধারা যার। যার অবস্থানে চলে যান এবং দুপুর ১২টা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর পাকিস্তানি সেনাদের কার্গোটি দেখতে পেয়ে তা লক্ষ্য করে গুলি ছুড়তে থাকেন। পাকিস্তানি সেনারাও পাল্টা আক্রমণ চালায়। পরিশেষে মুক্তিযােদ্ধাদের অপ্রতিরােধ্য আক্রমণের মুখে আনুমানিক দুপুর ১টায় পাকিস্তানি সেনারা সাদা পতাকা উত্তোলন করে। কতিপয় মুক্তিযােদ্ধা নৌকাযােগে কার্গোটির অভিমুখে রওনা দিলে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নৌকাটি ডুবে যায়, তবে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা হতাহত হন নি। অতঃপর মুক্তিযােদ্ধারা কার্গোটিকে ঘাটে ফেরার জন্য আদেশ করেন। কার্গোটি ফেরার পর পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। এ ঘটনার পর অত্র নদীপথ সম্পূর্ণরূপে মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে, যার পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী সময় পাকিস্তানি সেনারা এ পথ আর ব্যবহার করতে পারে নি।
শিক্ষণীয় বিষয়
ক, তথ্য: পূর্ব তথ্যপ্রাপ্তির কারণে সংঘবদ্ধ আক্রমণ রচনা সম্ভব হয়। খ. সঠিক পরিকল্পনা: মুক্তিযােদ্ধাদের নিখুঁত পরিকল্পনায় পাকিস্তানি | বাহিনীর পরাজয় নিশ্চিত হয়। সঠিক স্থান নির্বাচন: অ্যামবুশের জন্য সঠিক স্থান নির্বাচন এ যুদ্ধে জয়ের কারণ ।
উপসংহার
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা অনেক বিস্তৃত। সীমিত পরিসরে এ মুক্তিযুদ্ধকে বাস্তবসম্মত করে ফুটিয়ে তােলা একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। যে জাতির নিরঙ্কুশ গােষ্ঠীর হৃদস্পন্দনের সাথে স্বাধিকারের চেতনা ফুটে উঠেছিল, ১৯৭১ সালের রক্তাক্ত দিনগুলােয় সঁথিয়া, বেড়া ও সুজানগর সে হৃদস্পন্দনেরই অংশ। এ এলাকার জনগণ তাদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও স্বাধীনতা অর্জনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের বিজয় অর্জনে অগ্রণী ভূমিকা পালনে নগরবাড়ি ও ডাববাগানের যুদ্ধ তথা পাবনার মুক্তিকামী আপামর জনসাধারণের। সামগ্রিক কর্মকাণ্ড আমাদের জাতীয় ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অপ্রশিক্ষিত, অস্ত্রশস্ত্রবিহীন দামাল ছেলেরা সুসংগঠিত একটি সেনাবাহিনীর। বিরুদ্ধে বীরত্বের যে বিজয়গাথা প্রদর্শন করেছে তা আজ স্বর্ণাক্ষরে লিখিত। আমরা শ্রদ্ধাচিত্তে স্মরণ করি সেসব বীর শহিদদের যারা দেশমাতৃকার তরে। আত্মাহুতি দিয়েছেন, যাদের রক্তে আজ রঙিন এ স্বাধীন দেশের পতাকা। অতীতের সব ভুলত্রুটি ভুলে আজ স্বাধীনতার এত বছর পরে হাতে হাত রেখে, কাধে কাধ মিলিয়ে দেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করি আমরা সবাই। আগামী দিনের স্বপ্ন হােক সুখী-সমৃদ্ধ, অহিংসা, হানাহানিবিহীন বাংলাদেশ।
আটঘরিয়া থানার খিদিরপুরের যুদ্ধ
ভূমিকা
আটঘরিয়া থানার খিদিরপুর গ্রামে বংশীপাড়ায় শান্তি কমিটি ও রাজাকারের মাধ্যমে প্রতিদিন হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, রাহাজানি, অগ্নিসংযােগসহ বিভিন্ন অমানবিক অত্যাচার চলছিল নিরীহ জনসাধারণের উপর। ঐ সময় খুব সীমিতসংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা থাকার কারণে শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের প্রতিরােধ বা প্রতিহত করা যাচ্ছিল না, ফলে ৫ নভেম্বর খিদিরপুর গ্রামের আশপাশে ও ঈশ্বরদী থানা থেকে প্রায় ৫০জন মুক্তিযােদ্ধা আটঘরিয়া থানার প্রায় ৩০জন মুক্তিযােদ্ধাসহ বিভিন্ন স্থানের রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করেন। এবং এতে অনেক রাজাকার মারা যায়। যুদ্ধের সংগঠন যুদ্ধের সংগঠন নিমরূপ:
ক, শত্রুবাহিনী: রাজাকারসহ ১৩০জন।
খ. মুক্তিবাহিনী: ৮০জন। যুদ্ধের বর্ণনা। ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর সকালবেলা মুক্তিযােদ্ধাদের রেকিতে যাওয়ার আগে। জানা গেল যে, পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকার দল খিদিরপুর গ্রাম ও পাশ্ববর্তী নদীর পাশ দিয়ে অ্যামবুশ অবস্থানে রয়েছে। তখন মুক্তিযােদ্ধারা গ্রামের মানুষের সহযােগিতায় তাদের উপর প্রতি-আক্রমণ রচনা করেন। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ শুরু হয়। ঐ যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের হাতিয়ার ছিল ২টি এলএমজি, প্রায় ২০টি এসএলআর, .৩০৩ রাইফেল ও গ্রেনেড। পাকিস্তানি সেনাদের হাতিয়ার ছিল ভারি মেশিনগান, এলএমজি, মর্টারসহ চাইনিজ রাইফেল।
এ যুদ্ধে ৯জন মুক্তিযােদ্ধা শহিদ হন এবং ৩জন আহত হন। যুদ্ধে অনেক পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের সামনে টিকতে না পেরে পিছনের দিকে চলে আসতে বাধ্য হলেও তারা পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচুর ক্ষতি করেছিলেন। বিশ্লেষণ ও পর্যালােচনা সংঘর্ষে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযােদ্ধাদের ঘায়েল করার জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে। খিদিরপুর গ্রাম ও পার্শ্ববর্তী নদীর পাশ দিয়ে অ্যামবুশ পেতে অপেক্ষায় ছিল।
মুক্তিযােদ্ধারা এ সুযােগ পেয়ে ত্বরিত প্রতি-আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং পাকিস্তানি সেনাদের উপর প্রতি-আক্রমণ করেন। মুক্তিযােদ্ধাদের স্বল্প প্রস্তুতি, স্বল্প রণকৌশলগত অভিজ্ঞতা এবং অস্ত্রের স্বল্পতা থাকায় একটি সুসংগঠিত প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রতি-আক্রমণ রচনা করে তেমন সুবিধা করতে পারেন নি। মুক্তিযােদ্ধারা যদিও স্থানীয় জনগণের সঠিক সহায়তা ও সহযােগিতা পেয়েছিলেন তথাপিও নিজেদের কিছু দুর্বলতার জন্য তারা এ যুদ্ধে সফলতা লাভ করতে পারেন নি। উপসংহার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি অনন্য দৃষ্টান্ত, কেননা কোনােরকম পূর্ব-প্রশিক্ষণ ও সামরিক প্রস্তুতি ছাড়াই পাবনার দামাল ছেলেরা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং জনসাধারণ মুখােমুখি হয়েছিল। আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটি প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের মধ্যে দিয়ে পাবনা জেলার ৯টি থানায় শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার আন্দোলন ও যুদ্ধের প্রস্তুতি। তারই স্বাক্ষর হিসেবে পাবনার আপামর। জনসাধারণ, ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক কর্মীরা সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই ৩০৩।
রাইফেল, লাঠি, সরকি, রামদা ও গুটিকতক বন্দুক সম্বল করে প্রায় পৌনে ২০০ আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত পাবনা জেলাকে শত্রুমুক্ত রেখেছিলেন। ১০ এপ্রিল সকাল থেকে পাবনা পুরােপুরি পাকিস্তানি সেনাদের দখলে চলে যায়। এর পর শুরু হয় রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম। পাবনার আপামর জনসাধারণ ও শিক্ষকসম্প্রদায় নিজেদের উদ্যোগে দল গঠন করে যারা বিভিন্ন সময় পাকিস্তানি সেনাদের অবস্থান ও চলাচলপথে আক্রমণ রচনা করে। এসব সংঘর্ষে জনতার বিজয় সামান্য হলেও তখন ঠিক সে মুহূর্তে তা ছিল অনন্য সাধারণ। এ ছােটোখাটো বিজয় তখন সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করে। তারা পরবর্তী সময় মুক্তিবাহিনীতে সক্রিয়ভাবে যােগদান করে। মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তারা তাদের অঞ্চলের স্বাধীনতার জন্য, শান্তিকামী মানুষের জন্য যুদ্ধ করে এবং দেশের স্বাধীনতা আনয়ন করে। এরা সবাই আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে সামরিক অভিযান -ষষ্ঠ খন্ড
কুইজ
প্রশ্ন
পাকিস্তানী সেনারা কখন সাদা পতাকা উত্তোলন করে?
ক) দুপর ১ টায়
খ) রাত ১০ টায়
গ) সকাল ১০ টায়
ঘ) রাত ১ টায়।
(কুইজের নিয়মঃ আপনার উত্তর, নাম আর যে মোবাইল নাম্বারে রিচার্জ পাঠানো হবে সেই নাম্বারটি এই পোস্টের কমেন্টে দেবেন। প্রিপেইড বা পোস্ট পেইড হলেও উল্লেখ করবেন। প্রথম ১০ জনকে মোবাইলে ২০ টাকা রিচার্জ পাঠানো হবে। আমাদের আর্থিক সঞ্চয় কম থাকায় এবং ছাত্ররা যাতে বেশী মাত্রায় কুইজের দিকে ঝুঁকে না যায় সেকারণে টাকার পরিমাণ কম রাখা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পড়ার প্রতি আগ্রহী করার উদ্যেশ্যে পোস্টের সাথে কুইজ রাখা হয়েছে। প্রথমে সকল কমেন্ট গোপন রাখা হবে যাতে একজনেরটা দেখে আরেকজন কমেন্ট না করে। কুইজের শেষে কমেন্ট উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।)